সকল মেনু

একেই বলে ভাগ্য!

  নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি, ৭ মে : নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন এক সময়ে ট্রাক চালকের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু বড় হবার অদম্য বাসনা তাকে জীবনের নানা অলিগলিতে ঘুরিয়ে আজকের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী করে তুলেছে। আজকে তিনি নারায়ণগঞ্জের সম্মানিত সিটি করপোরেশন কাউন্সিলরদের একজন।

নানা সময়ে বিভিন্ন গড ফাদারের সংস্পর্শে এসে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন ভয়ংকর প্রভাবশালী। নাসিম ওসমানের ক্যাডার হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ তার। তবে কখনো গিয়াসউদ্দিন আবার কখনো শামীম ওসমানেরও আশির্বাদ পেয়েছেন। হয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান, সিটি কাউন্সিলর।

সিদ্ধিরগঞ্জের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন পেশাজীবী তার সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। বলেছেন তার জীবনের উত্থান পতনের নানা গল্প। এদের মধ্যে স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী এবং ট্রাক স্ট্যান্ডের শ্রমিকও রয়েছেন।

তারা জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল টেকপাড়া এলাকার মৃত হাজী বদরউদ্দিনের ছেলে নূর হোসেন। ১৯৮৬ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় ইকবাল গ্রুপের ট্রাকের হেলপার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন নূর হোসেন।

১৯৮৮ সালের দিকে শিমরাইলে আন্তঃজেলা ট্রাক চালক শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যক্রম চালু করেন দাইমুদ্দিন নামক এক ট্রাক চালক। হেলপারি চাকরির পাশাপাশি নূর হোসেন ইকবাল গ্রুপের ক্যাডার হিসেবে কাজ করতে থাকেন।

পরে নাসিম ওসমানের হাত ধরে যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। নাসিম ওসমানের প্রভাবে তিনি ১৯৮৯ সালে দাইমুদ্দিনকে বের করে দিয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের দখল নেন। এরই মধ্যে তিনি গিয়াস উদ্দিনের হয়েও কাজ করেন।

১৯৯১ সালে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনী জোয়ার দেখে নূর হোসেন সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলামের পক্ষে কাজ করেন। নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হওয়ায় তিনি হয়ে যান বিএনপি নেতা।

একদিকে বিএনপি নেতা, অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষকলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি গিয়াস উদ্দিনের লোক হিসেবে তিনি ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।

১৯৯২ সালের সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেনসহ ১৩ জন। শক্তিশালী প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলামকে পরাজিত করতে মাঠে নামেন সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন। দলবল নিয়ে পক্ষ নেন নূর হোসেনের। আড়াইশ ভোটের ব্যবধানে নূর হোসেন জয়ী হন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও বিএনপি নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে থাকেন নূর হোসেন। কিন্তু সে সময়ে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের সঙ্গে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

বিএনপি প্রার্থী হিসেবে পরবর্তী ইউপি নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ থেকে শামীম ওসমান প্রার্থী দেয় নজরুল ইসলামকে (পরে সিটি করপোরেশনের ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং গত ২৭ এপ্রিল অপহৃত হয়ে নিহত হন)। ওই সময়ে খোদ শামীম ওসমানের প্রতিপক্ষ গিয়াসউদ্দিন জোরে সোরে মাঠে নামেন নূর হোসেনের পক্ষে। নূর হোসেন জয়ী হলেও এলাকায় প্রভাব অক্ষুন্ন রাখতে হাত মেলায় শামীম ওসমানের সঙ্গে। হয়ে যায় আওয়ামী লীগার। শুরু হয় নূর হোসেন চেয়ারম্যানের ডন হিসেবে আবির্ভাব।

১৯৯৭ সালের শেষের দিকে নূর হোসেন তার বাহিনী নিয়ে শিমরাইলের সওজ অফিসে হামলা করে নির্বাহী প্রকৌশলী সাহাবুদ্দিনের রুম দখল করে নেন। এর কিছুদিন পর সানারপাড় এলাকার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নূর হোসেনের সঙ্গে ডাকাত লাইমুদ্দিন বাহিনীর বন্দুক যুদ্ধ হয়। এ ঘটনার ১০ দিনের মাথায় লাইমুদ্দিন খুন হন।

ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার নিয়ে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা নজরুল (অপহৃত) ও গিয়াসউদ্দিনের (সাবেক সাংসদ) সঙ্গে বিরোধ বাঁধে নূর হোসেনের। তখন নূর হোসেনের ক্যাডার বাহিনী একাধিকবার নজরুলকে হত্যার চেষ্টা করে।
১৯৯৮ সালে বন্যার সময়ে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক পানিতে তলিয়ে গেলে কাচঁপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের লঞ্চ থেকে প্রতিদিন মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে তার বাহিনী।

বিগত আওয়ামী লীগের শেষ সময়ে কাসসাফ শপিং সেন্টারের পূর্বপাশে গিয়াসউদ্দিন একটি মার্কেটের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে যান। সেখানে নূর হোসেনের লোকজন গিয়াসউদ্দিন ও তার লোকজনদের পিটিয়ে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে গিয়াসউদ্দিনকে আর সিদ্ধিরগঞ্জে আসতে দেয়নি নূর হোসেন।

১৯৯৮ সালের ৯ জুন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রামমুখী লংমার্চ ছিল। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে সাইনবোর্ড ও কাঁচপুর এলাকায় সেই লংমার্চ প্রতিহত করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এর দায়িত্ব ছিল নূর হোসেনের ওপর।

ওইদিন নূর হোসেনের বিশাল ক্যাডার বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ট্রাকের টায়ারে গুলি করে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। সন্ত্রাসীরা বাসযাত্রীদের ওপর ধর্ষণ ও লুটপাট চালায়। এ ঘটনার পর থেকে আলোচনায় আসে নূর হোসেন।

২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে বসবাস শুরু করেন নূর হোসেন। সেখানে বসেই তিনি সিদ্ধিরগঞ্জে তার অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

২০০৭ সালের ১২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল নূর হোসেনের বিরুদ্ধে রেড ওয়ারেন্ট জারি করে। তাদের নিজস্ব ওয়েব সাইটে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, বিস্ফোরক ও প্রাণনাশের হুমকিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলে। তবে ২০১১ সালের মার্চে ইন্টারপোল সে ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করে নেয়।

২০১২ সালের ১৬ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনেরে ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা ৩ মামলার চার্জশীটের পর অভিযোগ গঠনের শুনানী অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে আদালত শুনানী শেষে কোনো আদেশ দেয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবি নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট নবী হোসেন জানান, ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল ও ৯৭ হতে ২০০২ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন নূর হোসেন। ওই সময়ে বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেন তিনি।

তিনি আরো জানান, কাজ না করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০২ সালের ২৮ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় নূর হোসেনের বিরুদ্ধে পৃথক ৩টি মামলা হয়েছিল। বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর (এখন দুর্নীতি দমন কমিশন) সে সময়ের একজন কর্মকর্তা বাদী হয়ে পৃথক ভাবে মামলাগুলো দায়ের করেন।

পৃথক ৩ মামলায় ৪ লাখ ৫০ হাজার, ৫ লাখ ও ১৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। মামলাটি দীর্ঘদিন চলার পর সম্প্রতি এ ব্যাপারে আদালতে চার্জশীট দেয় দুদক। ৩টি মামলাতেই তদন্তকারী কর্মকর্তা নূর হোসেনকে অভিযুক্ত করেন।

সূত্র মতে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৬ এপ্রিল ও ৮ মে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে তার শো ডাউন ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।  তবে শেষ মুহূর্তে প্রশাসনের অনুমতি না মেলায় অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।

অবশেষে ২০০৯ সালের ৫ জুন সকাল ১১টার দিকে তিনি কয়েকশ’ লোক সঙ্গে করে নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় আসন গাড়েন। শামীম ওসমান এবার দেশে ফেরার পর থেকেই নূর হোসেন তার আশির্বাদপুষ্ট হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জেই বহাল ছিলেন।

২০১০ সালের ২১ জুলাই কাচঁপুরে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল করে অবৈধ বালু ও পাথর ব্যবসার স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গিয়ে নূর হোসেন বাহিনীর শিকার হয় ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বাধীন উচ্ছেকারী দল। হামলাকারীরা বিপুল সংখ্যক লোকজন নিয়ে উচ্ছেদ অভিযানকারী দলকে বাঁধা প্রদান করে উল্টো শাসিয়ে দেয়। এবং নিলামে অংশ নেওয়া লোকজনের হুমিক দেয়।

পরে সরকারি কাজে বাধা প্রদানের ঘটনায় নূর হোসেন ও তার ছোট ভাই জজ মিয়ার বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের হলেও পুলিশ তার টিকিটিও ছুঁতে পারেনি।

সর্বশেষ চলতি মাসেই নূর হোসেন ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ইজিবাইকের চালকদের কাছ থেকে ইজিবাইক আটকে ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠে।

এ অভিযোগে ইজিবাইক চালকরা শহরে বিক্ষোভ করেন।
সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ের একটু সামনে কাঁচপুর সেতুর দিকে যাওয়ার সময়ে উত্তর দিকে বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ মালিক শ্রমিক এর কার্যালয়। ওই স্থানটি এখন হয়ে উঠেছে মাদকের সবচেয়ে বড় স্পট। এটা সিদ্ধিরগঞ্জের প্রায় সবাই জানে। কিন্তু প্রশাসন যেন দেখেও না দেখার ভান করে। তবে নূর হোসেনের বৈধ কিছু ব্যবসাও রয়েছে। অন্যসব কিছুকে জায়েজ করতে তিনি পরিবহন এবং মৎস খামারের ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত।

শিমরাইল এলাকার অনেকে জানান, ট্রাক স্ট্যান্ডের সামনে কাউন্টার বসিয়ে রীতিমত প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ফেনসিডিল, ইয়াবা আর বিয়ার। কাউন্টারে টাকা দিলেই হাতে দেওয়া হয় এসব মাদক। রাতের বেলায় মদও বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। বকশিশ দিলে ওইসব মাদক পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কাঁচপুর সেতুর নিচে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত বিআইডব্লিউটিএর ল্যান্ডিং স্টেশনের আশপাশ এলাকাতে যেটা এখন নূর হোসেনের নিয়ন্ত্রণে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই নূর হোসেন বাহিনী এসব কাজ করে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আবদুল মতিন জানান, বিষয়গুলো তার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।

আছে পরিবহন থেকে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজির ঘটনাও। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৮টি জেলার প্রায় ৬৫টি রুটের যানবাহনকে পুঁজি করে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী পরিবহন চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সড়কপথের এই পয়েন্টে টাকা না দিলে গাড়ির চাকা ঘোরে না, টাকা দিলেই কেবল চাকা ঘোরে। পেশাদার চাঁদাবাজদের নিয়ে নূর হোসেনের ভাতিজা বাদল গঠন করেছে একটি সিন্ডিকেট।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top