সকল মেনু

তাহলে তুমি বলো, আবার কবে আসবা?

 মেহেদি হাসান,ঢাকা, ২৪ এপ্রিল :  ‘মা, আমি তোমার সঙ্গে যাব। তুমি আমাকে নিয়ে চলো, মা। বারবার এভাবে আবদার জানানোয় মা একটু রেগে গিয়েছিল। বলেছিল, এরকম করলে আর কিন্তু ঢাকা থেকে ফিরব না। মায়ের রাগ দেখে বলি, ঠিক আছে আমি যাব না। তাহলে তুমি বলো, আবার কবে আসবা?’

ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসার সময় বাসস্ট্যান্ডে এভাবেই মায়ের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল আরিফার। মা বলেছিল, ঈদে আসব, ভালো করে লেখাপড়া কোরো মা। মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আর্শীবাদ আর আদর করে মা রীনা বেগম ফিরে এসেছিলেন সাভারের ইনান্দিপুরে। তারপর…সব শেষ।

মা আর ফিরে আসেননি। মিঠাপুকুরের বৈরাশিহাট গ্রামে এখনো মাকে খুঁজে বেড়ায় নয় বছরের আরিফা। মায়ের মতো কাউকে দেখলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সে। তার কচি তুলতুলে পা দুটি এ-বাড়ি সে-বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। একবার যদি মাকে পাওয়া যায়।

বিছানায় শুয়ে কান পেতে থাকে কখন মা আসবে, খুকুমণি বলে ডাক দেবে। স্কুলে যেতে বলবে। আদর করে খাইয়ে দেবে। হাতড়ে বেড়ায় মায়ের এলোমেলো স্মৃতিগুলো। আজ তার এই ছোট্ট পৃথিবীতে সবই আছে, শুধু নেই মা।

মা তুমি কবে আসবে। এই যে আকুতি, এক বছর পরে আজ বিজিএমইএর অডিটোরিয়ামে বুকফাঁটা আর্তচিৎকারে জানিয়ে দিল আরিফা। মাকে নিয়ে একটি কবিতা পড়ে পুরো অডিটোরিয়ামকে অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে দেয় সে। নেমে আসে কয়েক মিনিটের নীরবতা।

কবিতাটি ছিল : যেখানেতে দেখি যাহা, মায়ের মতো আহা/ একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই/ মায়ের মতন এত আদর সোহাগ সে তো/ আর কোন খানে কেহ পাইবে না ভাই/ হেরিলে মায়ের মুখ/ দূরে যায় সব দুখ ।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শোকাবহ দিবসে বিজিএমইএ বৃহস্পতিবার যে স্মরণসভার আয়োজন করেছিল, সেখানে এই কবিতাটি পাঠ করে আরিফা।

মায়ের সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে লেখা কবিতা পাঠ করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠছিল আরিফা। মা, মা বলে যখন আরিফা কাঁদতে থাকে, তখন অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি উপস্থিত কেউই।

মঞ্চে থাকা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সামছুল হক টুকু, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রোকেয়া আফজাল রহমানও শিশুর মতো কেঁদেছেন। মা-বাবা দুজনকেই হারানো আরেক এতিম শিশু মিনাকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছেন শ্রমিকনেত্রী নাজমা আক্তার। কেঁদেছেন বিজিএমইএ নেতারাও। আবার নীরবে অশ্রু ফেলেছেন সবাই।

ওই এতিম শিশুগুলোর কান্না থামানোর ভাষা কারো ছিল না। চোখের জল মুছে দেওয়ার আঁচলগুলো যে হারিয়ে গেছে ওদের। বুকে টেনে নেওয়ার হাতগুলো যে পিসে গেছে ইট সুরকির কংক্রিটে। আদর করে সোনামণি বলে ডেকে দুঃখ ভোলানোর কণ্ঠগুলো যে থেমে গেছে চিরতরে।

আরিফার বাবা লুৎফর রহমান বলেন, ‘ঠিকমতো যাতে স্কুলে যেতে পারে সেই জন্য ওকে গ্রামের বাড়িতে রেখেছিলাম। শেষ ফেব্রুয়ারিতে যখন ওর মা বাড়িতে এসেছিল, তখন ও মায়ের সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার জন্য অনেক কেঁদেছিল। সেই কান্না ওর আর থামল না।’ বলতে বলতে থেমে যান লুৎফর রহমান।

কারো বাবা, কারো মা, আবার কারো মা-বাবা দু’জনকেই কেড়ে নিয়েছে রানা প্লাজা। এ রকম মা-বাবা হারানো ১৬ জন মেয়ে শিশু থাকে নবীনগরের পাথাইলে । জাতীয় স্মৃতি সৌধের কাছাকাছি এই পাথাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম পরিচালিত এতিমখানায় বড় হচ্ছে এরা। লেখাপড়া করছে নবীন গ্রিন ভিউ মডেল হাই স্কুলে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের অরকা হোমসে থাকে আরো ১৬ ছেলে শিশু। তারাও এসেছিল এই স্মরণসভায়। তার পরও কষ্ট, ব্যথা আর রিক্ততা জয় করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় ওরা।

তোফায়েল আহমেদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মা হারানোর কী যে কষ্ট তা আমাদের মধ্যে যাদের মা মারা গেছেন তারা বুঝি। আজ আবার সেই স্মৃতি ফিরে এল। আর কোনো শিশুকে যেন এভাবে মা-বাবাকে না হারাতে হয় । আর যেন আর্তনাদ শুনতে না হয়। সেই অবকাঠামো শিল্পে গড়ে তুলতে হবে।’

মন্ত্রী আরো বলেন, যে ক্ষতি হয়েছে, তা কোনোভাবেই পূরণ সম্ভব নয়। এ রকম ট্র্যাজেডি যাতে কোনোভাবে আর না ঘটে তার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী অসহায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বিশ্বে শিল্প দুর্ঘটনায় এটা তৃতীয় বৃহত্তম ঘটনা। এই ঘটনা পুরো পোশাকশিল্পকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। যে কারণে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আশা করে না দেশবাসী। এজন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

রোকেয়া আফজাল বলেছেন, ‘পৃথিবীর অনেক কিছু দিয়ে অনেক কিছু পুরণ করা যায়। কিন্তু মা-বাবার শূন্যস্থান পূরণ করা যায় না। আর কাঁদতে চাই না । এই করুণ মুখচ্ছবি দেখতে চাই না। কান্নায় রোকেয়া আফজালের কণ্ঠ রোধ হয়ে যায়। তিনি আর কিছু বলতে পারেননি।’

নাজমা আক্তার বলেন, রাজনীতি আর দুর্নীতির কারণে আজ এই অবস্থা হয়েছে। রাজনীতির বিষবাষ্পে শ্রমিকরা যাতে আর পুড়ে না মরেন, ইট-পাথরের চাপায় না মরেন, তার জন্য তিনি রাজনীতিকে দুর্নীতি মুক্ত করার আহ্বান জানান।

পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন- বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ দুর্ঘটনা আমাদের জন্য বড় আঘাত। যারা আহত হয়েছেন, তারা বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাবেন না। এ ছাড়া মা-বাবা হারানো ৩০০ শিশুর দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজিএমইএ।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top