সকল মেনু

ভয়ঙ্কর অর্ধশত জঙ্গির খোঁজে গোয়েন্দারা

ঢাকা, ১৫ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাইন বোর্ড এলাকায় প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেয়া জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) দুই জঙ্গির হদিস মেলেনি দীর্ঘ ২০ দিনেও।
image_81889_0
তবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর রমনা এলাকা থেকে জেএমবির অর্থদাতা পোশাক ব্যবসায়ী আজমির ওরফে অমিত ও হুন্ডি গোলাম সরোয়ার রাহাতকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

একই রাতে আল-আমীন ও জিয়াউল ইসলাম জিতু নামে জেএমবির আরও দুই সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে তারা। ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে আটকের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় আনা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

তদন্ত সংশ্লিস্টরা বলছেন, জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ পলাতক দুই জঙ্গী জাহিদুল ইসলাম সুমন ওরফে বোমারু মিজান ও সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিনকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।

ত্রিশালের ঘটনার তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা দেশে নতুনভাবে চাঙ্গা হওয়া জঙ্গী নেটওয়ার্কের অনেক তথ্য পেয়েছেন বলেও জানা গেছে।

জেএমবির প্রায় দুই ডজন জঙ্গী নতুন ছকে কার্যক্রম শুরু করেছে। এছাড়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হুজির অন্তত ৩০জন নতুনভাবে সংগঠিত হতে যাচ্ছে বলেও তথ্য মিলেছে। তাদের মধ্যে মুফতি হাকিম, মুফতি সিরাজ ও আবদুস সালাম ওরফে ল্যাংড়া সালাম নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শুক্রবার বলেছেন, ‘পুলিশভ্যান থেকে ছিনতাইয়ের পর পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গি আর বেশি দিন লুকিয়ে থাকতে পারবে না। এ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যেভাবে সীমান্ত এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নজর রাখা হয়েছে, তাতে পলাতক জঙ্গিদের দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।’

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রীদের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে  সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।

আটজন গোয়েন্দা জালে:
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ২৩ ফেব্রয়ারি ত্রিশালে পুলিশ হত্যা করে তিন জঙ্গী ছিনতাইয়ের পর সখীপুর থানার সামনে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র ও মাইক্রোবাসসহ ধরা পড়ে জেএমবি সদস্য জাকারিয়া। একইদিন গ্রেপ্তার হয় রায়হান ওরফে রাসেল।

এরপর টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জাকারিয়ার স্ত্রী স্বপ্না বেগম ও তার ভাই মো. ইউসুফকে। এ আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি জেএমপির অর্থদাতার সূত্রসহ সংগঠিত হওয়ার অনেক তথ্য পেয়েছে। ডিবির তদন্তে বেরিয়ে আসে অর্থদাতা দুই ব্যবসায়ীর নাম। এ অর্থদাতাদের বলা হয় সুধী।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে জাকারিয়া জানান, ‘সুধীদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা পেতেন তিনি।’

এমন তথ্য পাওয়ার পরই জেএমবির সুধীদের শনাক্তে কাজ শুরু করেন গোয়েন্দারা। জাকারিয়ার ব্যাংকিং লেনদেনের হিসাব খতিয়ে দেখা হয়।

সূত্র জানায়, তিন জেএমবি সদস্যকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দুটি মাইক্রোবাসসহ চারটি গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। এই চারটি গাড়ি কেনার টাকা জেএমবিকে সরবরাহ করেন পোশাক ব্যবসায়ী রাহাত ও আজমীর।

রাজধানীর মিরপুরে রাহাতের একটি পোশাক কারখানা আছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জেও তার টাইলস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে। রাহাত ও আজমীরের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে।

এদিকে জেএমবি সদস্য জিতু দু’মাস ধরে ময়মনসিংহে অবস্থান করেন। তিন জেএমবি সদস্যকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় জিতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বলে জানায় গোয়েন্দা সূত্র।

জিতু ও আল-আমীন গ্রেপ্তারের পর কারাগারে ছিলেন। কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়ায় তারা তিন জেএমবি নেতাকে ছিনিয়ে নেয়ার মিশনে অংশ নেন। এ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের পলাতক জঙ্গীদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সূত্র।

অর্ধশত জঙ্গীকে খুঁজছে গোয়েন্দারা:
সূত্রমতে, জেএমবির তিন দূর্ধর্ষ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পর সংগঠনটির আর্থিক উৎস জানতে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিবিড়ভাবে কাজ করছে। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ২০১২ সালের পর থেকে জেএমবির অর্থ শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন জাকারিয়া। নামে-বেনামে একাধিক ব্যাংক হিসাব নম্বরে এই টাকা গচ্ছিত রাখেন জাকারিয়া।

তিন জঙ্গীকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় জেএমবির অর্ধকোটি টাকা খরচের হিসাব পাওয়া গেছে। অভিযান সফল করতে ৫-৬টি অগ্নেয়াস্ত্র কেনে জঙ্গিরা। তা ছাড়া দুটি মাইক্রোবাস, একটি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেটকার কেনা হয়েছিল।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ত্রিশালের হামলায় সরাসরি জড়িত হিসেবে এখন পর্যন্ত ১১ জনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। দুই জঙ্গি নেতাকে সহযোগীদের গ্রেপ্তারে এখন অভিযান চলছে। এ ছাড়া আরও এক ডজন দুর্ধর্ষ জেএমবির সদস্য জামিনে মুক্তি পেয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

পলাতক জঙ্গী বোমারু মিজান জেএমবির প্রধান বোমা বিশেষজ্ঞ। সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ১৭ আগস্ট বোমা হামলাসহ কয়েকটি হামলায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাদের মাধ্যমেই হ্যান্ড গ্রেনেড, বেল্ট বোমা, টিফিন ক্যারিয়ার বোমা, বই বোমা, জ্যামিতিক বোমাসহ বিভিন্ন নতুন ধরনের বোমার উদ্ভাবন এবং ব্যবহার করেছেন তারা। তাই এ দুর্ধর্ষ দুই জঙ্গীর পালিয়ে থাকার ঘটনায় নতুন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) মুফতি হাকিম ও সিরাজের সঙ্গে অন্তত ১৫ জনের একটি দল নতুন করে জঙ্গি কার্যক্রমের ছক তৈরি করছে। তারা এক সময় ভিন্ন ভিন্ন ব্যানারে নাশকতা চালালেও এখন এক নেটওয়ার্কে এসেছে।

নতুন কৌশলে সক্রিয় হয়ে ওঠা রাহমানীর অনুসারী ও ঘনিষ্ঠদের ছবিসহ একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে দেশের তিনটি বিমানবন্দর ও সব সীমান্তে। রাহমানীর অনুসারীরা গোপনে বিভিন্ন ফোরামে যুক্ত হয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত রয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, মিরপুরের মুফতি দেলোয়ার, পাকিস্তান ফেরত মুফতি ইমতিয়াজ, মুফতি ইফতিখার, মুফতি মনসুরুল, মাওলানা তাসমিয়া, মাওলানা নুরুল, মাওলানা মাহবুব, কারামুক্ত ফারুক আহমেদ চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী ও বগুড়া এলাকায় ভাগ হয়ে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন।

একইসঙ্গে ফেনী এলাকার সাইদুর রহমান সাঈদ, টঙ্গীর মুফতি সিরাজুল ইসলাম সিরাজ, কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মো. সানাউল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুস সালাম ওরফে ল্যাংড়া সালাম, ময়মনসিংহের মুফতি আবদুল হাকিম, ইয়েমেন ফেরত মাইনুদ্দীন শরীফ, তেহজীব করিম, রেজওয়ান শরীফ, ব্লগার রাজীবের খুনের নির্দেশদাতা রানা উল্লেখযোগ্য।

গত বছর ১৫ ফেব্রয়ারি ব্লগার রাজীব হত্যার পর গোয়েন্দারা রানাকে  গ্রেপ্তারে বিভিন্নোবে ফাঁদ তৈরি করেন। কিন্তু তারপরও তার সম্ভাব্য অবস্থানে তাকে পাওয়া যায় না। রানা দেশের বাইরে গিয়েছেন বলেও ধারণা গোয়েন্দাদের।

ডিবি সূত্র জানায়, মুফতি রাহমানীর অনুসারী বিদেশ ফেরত জঙ্গিদের মধ্যে তেহজীব করিমের ভাই রাজীব করিমকে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারের বিমান উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজীব করিম জেএমবির শুরুর দিকে যুক্ত ছিলেন। তারা এখন নতুন কৌশলে জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমুল আলম বলেন, ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন হত্যার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিম উদ্দিন রাহমানীর জঙ্গি কানেকশনের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের বিষয়ে কাজ শুরু করে গোয়েন্দারা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘উগ্রপন্থিরা নানাভাবে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। তারা কৌশল হিসেবে আত্মগোপন করেছেন। তাদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দারাও কৌশলী হয়েছে।’

সূত্র জানায়, আনসারুল্লাহর প্রধান ধরা পড়লেও সংগঠনটির স্লিপার সেলের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে।
জেএমবির জঙ্গীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। ডিবির সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মুফতি হাকিম, সিরাজ, ল্যাংড়া সালাম ও ইয়েমেন ফেরত যুবকরা রাহমানীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মুফতি রাহমানী তাদের বিভিন্ন সময়ে অর্থায়নও করে। তদন্তে দেখা গেছে, রাহমানী কারাবন্দি হওয়ার পর এবিটির সঙ্গে অন্য জঙ্গিদের যোগাযোগ চলছে।’

প্রসঙ্গত- গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহের আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে জেএমবির সাজাপ্রাপ্ত তিন নেতা সালাউদ্দিন ওরফে সালেহিন, হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় হয়। এ হামলায় পুলিশের এক সদস্য নিহত এবং আরও দু’জন গুরুতর আহত হন।

কয়েক ঘণ্টা পর রাকিবকে টাঙ্গাইল পুলিশ আটক করে। পরদিন ভোরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হন।

রহস্য উদঘাটনের আগেই জেএমবি জঙ্গির এমন মৃত্যু নিয়ে অনেক মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top