সকল মেনু

আজ সরস্বতী পূজা

 আফিফা জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা: সরস্বতী পূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি অন্যতম ধর্মীয় পর্ব। প্রতিবছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে এই পূজা হয়ে থাকে। তাই এদিনটি ‘শ্রীপঞ্চমী’ নামেও বিশেষভাবে পরিচিত। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বিদ্যা, সঙ্গীত, শিল্পকলা ও জ্ঞানের প্রেরণাদাত্রী শক্তির প্রতিভূ হলেন দেবী সরস্বতী। তাই এই পূজা বিশেষত তাদের কাছেই বেশি মহিমান্বিত যারা জ্ঞানের সাধক, বিদ্যার্থী, শিল্প ও ললিতকলার অনুরাগী, সঙ্গীতের নিয়ত সাধনাকারী। এক কথায় যা কিছু মানুষের মাঝে মননশীলতার উৎকর্ষ সাধন করে, জ্ঞানের বিকাশ ঘটায় অবিদ্যারূপ অন্ধকার দূর করে, মানুষের মাঝে সাত্ত্বিক চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটায় তারই অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন সরস্বতী। তাই দেবীপূজায় সবকিছুই হতে হয় সাত্ত্বিক প্রকৃতির।  শুভ্রবর্ণ হলো শুদ্ধ চেতনা ও জ্ঞানের উৎকর্ষতা স্বরূপ পবিত্রতা ও সাত্ত্বিকতার প্রতীক। তাই পদ্মপুরাণের বর্ণনানুসারে দেবী শাশ্বত ও নিত্যস্বরূপ। তার গায়ের বর্ণ চাঁদের আলোর ন্যায় শুভ্র। তার বসন শুভ্র, তিনি শ্বেত পুষ্পে শোভিতা, শ্বেতচন্দন চর্চিতা, শ্বেত রুদ্ররাক্ষ মালা ও বীণাধারিণী। স্বরস্বতী শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা, শ্বেত পদ্মাসনে উপবিষ্টা, শ্বেত রাজহংস তার বাহন। সাত্ত্বিক এই দেবীর আরাধনায় ভক্তের হৃদয়ও তাই শুভ্রতায়-সাত্ত্বিকতায় পবিত্র ও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিদ্যাদেবী সরস্বতী এক হাতে বীণা ও অপর হাতে পবিত্র গ্রন্থ বেদ ধারণ করে আছেন। সরস্বতী দেবীর দ্বিভূজা ও চতুর্ভূজা উভয় রূপেই পূজা হয়ে থাকে। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে দেবী চতুর্ভূজারূপে পূজিত হন। পূর্বভারত ও বাংলাদেশে চতুর্ভূজা অপেক্ষা দ্বিভূজা রূপে দেবীপূজা বেশী প্রচলিত। সরস্বতী পূজায় দোয়াত-কলম, পুস্তক, আমের মুকুল, মটরশুঁটি, যব, পলাশফুল, বাসন্তী রঙের গাঁদাফুল বিশেষভাবে আবশ্যক।
বাগ্‌দেবী, বিরাজ, সারদা, বাণী, ব্রাহ্মী, শতরূপা, মহাশ্বেতা, পৃথুধর, বাগেশ্বরী-সহ আরো অনেক নামেই সরস্বতী দেবী পরিচিত। মানব জীবনের প্রাথমিক বিদ্যারম্ভের জন্য একটি পবিত্র তিথি শ্রীপঞ্চমী। এই দিনে শিশুদের মাতৃভাষায় হাতেখড়ি দেওয়া হয়। অতীতে মূলত সংস্কৃত বর্ণমালাতেই হাতেখড়ি দেওয়া হতো। পরবর্তীতে মাতৃভাষাতেই হাতেখড়ি প্রচলিত হয়। তবে বিদেশি ভাষাতে হাতেখড়ি হয় না। এই পবিত্র দিনে বিদ্বান ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের বিশেষভাবে আপ্যায়ন করা হয়। এছাড়া পরলোকগত পূর্বপুরুষদের আত্মার সদ্‌গতি কামনায় এদিনে তর্পণ করারও বিধান আছে। হিন্দুধর্ম অনুযায়ী ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তিনি নিরাকার ও সর্বশক্তিমান। যেহেতু সর্বশক্তিমান তাই তিনি ইচ্ছা করলে নিরাকার থেকে সাকার রূপও পরিগ্রহ করতে পারেন। যেহেতু নিরাকার তাই তিনি পুরুষ বা নারী কিছুই নন। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকার স্রষ্টার ধারণা করা ও তার উপাসনা করা অতীব দুরূহ ব্যাপার। তাই ভক্ত যখন ঈশ্বরের আরাধনা করেন তখন ঈশ্বরচিন্তা ও উপাসনার সুবিধার্থে তাকে যেকোনো প্রতীকী রূপে উপাসনা করতে পারেন। এটা কোনো পুরুষ বা নারীরূপ হতে পারে বা কোনো প্রাকৃতিক বস্তুও হতে পারে। ঠিক এভাবেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বিদ্যা, সঙ্গীত, শিল্পকলা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী প্রজ্ঞাশক্তিরূপকে মাতৃজ্ঞানে সরস্বতীদেবী রূপে উপাসনা করা হয়। দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে শোভিতা, কমলনয়না ও বীণাপুস্তকধারিণী এক দিব্য নারীমূর্তি রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এই মূর্তিকল্প থেকেই দেবী সরস্বতীর প্রচলিত মূর্তিরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উল্লেখ্য, মূর্তিকেই ঈশ্বরজ্ঞানে কখনো পূজা করা হয় না। মূর্তির কাছে কোনো প্রার্থনাও করা হয় না। মূর্তি ঈশ্বরোপাসনার অবলম্বন মাত্র। নির্দিষ্ট তিথিতে এই জড় মূর্তিতে ঈশ্বরের শক্তিরূপ দেবতাকে স্মরণ, মনন, ধ্যানপূর্বক আহ্বান করা হয়। তাকে অর্ঘ্য নিবেদন করে পূজা করা হয়, তার কাছে প্রার্থনা করা হয়। পুষ্পাঞ্জলি শেষে নিরঞ্জনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দেবতাকে বিদায় জানানো হয়। অতঃপর মূর্তিটি প্রাণহীন মৃতদেহের মতো শুধু মূর্তিই থাকে। তাই মূর্তিটিকে শ্রদ্ধাপূর্বক জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। মূর্তিকে ভগবান মনে করলে নিশ্চয়ই মূর্তিকে বিসর্জন দেওয়া হতো না। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা যেমন কাবাঘরকে সামনে রেখে সেজদা প্রদান ও প্রার্থনা করেন। কিন্তু সেই সেজদা ও প্রার্থনা প্রকৃতপক্ষে কাবাঘরকে নয় বরং এর মাধ্যমে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশেই করা হয় এবং স্রষ্টা সেটাই গ্রহণ করেন।
একইভাবে হিন্দুরা দেবতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে পবিত্র তিথিতে মূর্তিতে ঈশ্বরকে আহ্বানপূর্বক প্রণাম ও প্রার্থনা করেন। কিন্তু এই প্রণাম ও প্রার্থনা মূর্তির উদ্দেশে নয় বরং মূর্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের উদ্দেশেই করা হয় এবং ঈশ্বর সেটাই গ্রহণ করেন। সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে জ্ঞানদাত্রী হিসেবে সরস্বতী দেবী অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত। সরস্বতী বৈদিক দেবতা। ঋগ্‌বেদে (১/৩/১১) বলা হয়েছে, “সত্য ও প্রিয়বাণীর প্রেরণাদাত্রী এবং সৎ বুদ্ধির চেতনাদাত্রী মাতা সরস্বতী শুভ কর্মকে ধারণ করিয়া আছেন।” তবে পৌরাণিকযুগে দেবীর মাহাত্ম্য আরো ব্যাপকভাবে পণ্ডিত ও বিদ্বান সমাজে শ্রেষ্ঠ মর্যাদা প্রাপ্ত হয়। প্রাচীনকালে বাগেশ্বরীদেবীর উপাসনা করতেন তান্ত্রিক সাধকেরা। বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান সূত্র গ্রন্থেও সরস্বতী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারত থেকে শুরু করে প্রায় সকল মহাকাব্য, পুরাণ, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদির শুরুতেই সরস্বতী দেবীর বন্দনা করা হয়েছে। পণ্ডিত কালীদাসের মতো অনেক সাধকের সামনেই সরস্বতী দেবী আবির্ভূত হয়ে বরদান করেছেন-এরূপ অনেক কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন গ্রন্থে।

গীতায় বলা হয়েছে “ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে” অর্থাৎ নিঃসন্দেহে এই জগতে জ্ঞানের মতো পবিত্রকারী আর কিছুই নেই। তাই জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেওয়া দিতে হবে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের প্রয়োজন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত চর্চা এবং শিল্পকলা ও সংস্কৃতির উজ্জীবন। এর মাধ্যমেই আলোকিত হোক বাংলাদেশ। আর এটাই আমরা প্রার্থনা করবো দেবী সরস্বতীর কাছে, আমাদের সকলের মাঝে যেন শুভচেতনা ও শুদ্ধজ্ঞান সঞ্চারিত হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top