সকল মেনু

ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতিকেজি আলুর দাম ৫৪ পয়সা !

 download (2)হুমায়ুন কবীর, বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) থেকে:  ঠাকুরগাঁওয়ের বাজারগুলোতে ৮ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হলেও আলু চাষীরা প্রতিকেজি আলুর দাম পাচ্ছেন মাত্র ৫৪ পয়সা ! লাভের আশায় গত ৩ বছর ধরে ক্রমাগত লোকসানের পরেও আলু চাষীরা আলু চাষ অব্যাহত রাখেন। গত মৌসুমে আলুর বাম্পার ফলন হওয়ায় ঠাকুরগাঁয়ের আলু চাষীরা জেলার ৯ টি হিমাগার সহ আশপাশের জেলার হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষন করেন। চলতি মৌসুমে জেলায় আলু চাষ শুরু হয়েছে। ৯ টি হিমাগারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আলু চাষের আগাম মৌসুম শেষ হতে চললেও এখন পর্যন্ত হিমাগারে সংরক্ষন করা আলুর ৫ ভাগের এক ভাগ আলু বাজারজাত হয়নি। মৌসুমের শুরুতেই এমন বিপর্যয়ের কারনে প্রতি বস্তা (৮৪ কেজি) আলুর দাম ৬শ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছেনা। কৃষকগন হিমাগারে সংরক্ষন করে রাখা আলু লোকসানের ভয়ে নিয়ে যাচ্ছেন না। কৃষকগন জানান, প্রতিবস্তা আলুর জন্য হিমাগার ভাড়া বাবদ ৩শ ৬০ টাকা, কুলি ও বাতাস দেয়া বাবদ ৭০ টাকা ও পরিবহন বাবদ আরো ৭০ টাকা খরচ করতে হবে। এ হিসেবে সংরক্ষন করে রাখা প্রতিবস্তা আলুর জন্য ৫শ টাকা নগদ পরিশোধ করতে হবে। এতে করে প্রায় ২ মন আলুর দাম মাত্র ১শ টাকা পাবেন আলু চাষীরা। এ হিসেবে আলু চাষীরা প্রতি কেজি আলুর দাম পাচ্ছেন মাত্র ১ টাকা ১৯ পয়সা। বিষয়টির এখানেই শেষ নয়, আলু সংরক্ষন করতে প্রতিটি ৫৫ টাকা দরে বস্তা কিনেছেন আলু চাষীগন। বস্তার দাম বাদ দিলে আলু চাষীরা প্রতিবস্তা (৮৪ কেজি) আলুর মূল্য পাচ্ছেন মাত্র ৪৫ টাকা। অর্থাৎ আলু চাষীরা প্রতি কেজি আলুর দাম পাচেআছন মাত্র ৫৪ পয়সা ! বস্তা প্রতি ৪৫ টাকা পাবার আশায় কোন কোন কৃষক হিমাগার থেকে তাদের সংরক্ষন করা আলুর কিছু অংশ তুলে নিয়ে গেলেও বাজারজাত করতে হিমশিম খেয়েছেন এবং ওই ৪৫ টাকাও তারা পাননি। নিশ্চিত লোকসান এবং সর্বশান্ত হওয়া আলু চাষীগন মাথায় হাত দিয়েছেন। অপরদিকে হিমাগার কর্তৃপক্ষও নিশ্চিতভাবে কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন। একদিকে আলু সংরক্ষনকারী কৃষকগন হয়েছেন সর্বশান্ত এবং ক্রমাগত লোকসানের কারনে বন্ধ হতে চলেছে ঠাকুরগাঁওয়ের ৯ টি হিমাগার সহ পঞ্চগড়, দিনাজপুর সহ আশপাশের জেলাগুলোর হিমাগারগুলো। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার লক্ষ্মী প্রিজার্ভস, রাহবার কোল্ড ষ্টোরেজ, শাহী হিমাগার, হিমাদ্রী লিঃ সহ কয়েকটি হিমাগারে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য বছর আগাম আলু চাষের এ ভরা মৌসুমে আলু চাষীদের ভিড়ে মুখরিত থাকে হিমাগার এলাকা। চলতি বছরে আগাম আলু চাষের মৌসুম প্রায় শেষ হতে চললেও আলু চাষীরা তাদের সংরক্ষন করা আলু নিতে হিমাগারে আসছেন না। দু-একজন আলু চাষী আলু নিতে আসলেও তা খুবই নগন্য। লক্ষ্মী প্রিজার্ভস হিমাগারে আলু নিতে আসা জেলার হরিপুর উপজেলার যাদুরানী গ্রামের আলু চাষী রহমত আলী, একই ঠিকানার আসগর আলী সহ কয়েকজন আলু চাষী জানান, গত ৩ বছর ধরেই আলু চাষ করে লোকসান গুনেছেন তারা। গত মৌসুমেও আলুর বাম্পার ফলন হয়। চলতি মৌসুমে আলু চাষে অধিক লাভের আশায় রহমত আলী ১শ১৫ বস্তা, আসগর আলী ৯০ বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষন করেন। তাদের মতই জেলার হাজার হাজার আলু চাষী হিমাগারে আলু সংরক্ষন করেন। সংরক্ষন করা এসব আলুর মধ্যে গ্যানোলা, কার্ডিনাল ও দেশীয় জাতের আলু রয়েছে। আগাম চাষের জন্য গ্যানোলা জাতের আলু চাষ করা হয়। লাভের আশায় প্রায় প্রত্যেক কৃষক হিমাগারে ওই ৩ ধরনের জাতের আলু সংরক্ষন করেন। ক্রমাগত লোকসানের জন্য অধিকাংশ আলু চাষী চলতি মৌসুমে আলু চাষাবাদের বদলে আলু বীজ বিক্রি করতে আগ্রহী হন। সে অনুযায়ি আলু বীজের আধিক্য ঘটে। অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে আলুর চাহিদা থাকলেও নতুন নতুন সব্জি’র আগাম আগমন ঘটায় আলুর চাহিদা তেমন বাড়েনি। চাহিদার তুলনায় আলু সরবরাহ ব্যাপক হওয়ায় বাজারে আলুর দাম বাড়েনি। হিমাগার থেকে ভাড়া ও অন্যান্য খরচ পরিশোধ করে মাত্র ৪৫ টাকা টিকে থাকে। হিমাগারে আলু নিতে আসা কৃষকগন আরো বলেন, চলতি মৌসুমে হিমাগার থেকে আলু নিয়ে যাবার মত অবস্থা কোন কৃষকেরই নেই। তাই অনেক কৃষকই হিমাগারে আলু সংরক্ষন করলেও সেসব আলু ছেড়েই দিয়েছেন। ক্রমাগত লোকসানের কারনে অন্যান্যবারের আলু চাষের ৪ ভাগের এক ভাগ আলু চাষ হচ্ছে চলতি মৌসুমে। একটি হিমাগারের ব্যবস্থাপক জুয়েল রানা বলেন, গত ১ বছর আগে কৃষকগন হিমাগারে তাদের সংরক্ষনকৃত আলু নিয়ে না যাওয়ার কারনে শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার বস্তা আলু হিমাগারেই পচে যায়। সেসব আলু পশু খাদ্যেরও উপযুক্ত ছিল না। হাজার হাজার বস্তা আলু নিজ খরচেই হিমাগার থেকে সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হন হিমাগার কর্তৃপক্ষ। লক্ষ্মী প্রিজার্ভস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আঃ কাদের এবং হিমাগার মালিক সমিতির নেতা মোঃ আঃ সালাম জানান, ক্রমাগত ৪ বছর ধরে ঠাকুরগাঁও সহ আশপাশের জেলাগুলোর হিমাগারগুলো লোকসান গুনে আসছে। কৃষকগন আলু সংরক্ষন করলেও শেষ পর্যন্ত তা আর নিয়ে যান না। এতে করে হিমাগারের সমস্থ খরচ গচ্ছা দিতে হচ্ছে তাদের। চলতি বছর হিমাগারগুলোতে গ্যানোলা, কার্ডিনাল ও দেশীয় বিভিন্ন জাতের আলু জেলার সবকটি হিমাগারে কয়েক লক্ষ্য বস্তা আলু এখনো মজুদ রয়েছে। কার্ডিনাল ও দেশীয় জাতের আলু বপনের মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। আগাম চাষাবাদের জন্য গ্যানোলা প্রজাতির আলু বপনের মৌসুম প্রায় শেষ পর্যায়ে হলেও এখন পর্যন্ত জেলার হিমাগারগুলো থেকে ৫০ হাজার বস্তাও আলু চাষীগন নিয়ে যাননি। তাছাড়াও দেশীয় ও কার্ডিনাল জাতের আলু আবাদের সময় এলেও ৫০ হাজার বস্তা আলু হিমাগার থেকে হয়তো সরবে না। মাত্র ১ মাসের মধ্যে বাজারে নতুন আলু উঠতে শুরু করবে। এতে করে হিমাগারগুলো আলু শুন্য হবার সম্ভাবনা নাই। তারা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এর পরে হয়তো হিমাগার চালু রাখাই কঠিন হবে। জেলা কৃষি দপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত আলু চাষীরা কত হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করছেন তার নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়নি। রানীশংকৈল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাজেদুল ইসলাম জানান, আবহাওয়া আলু চাষের অনুকুলে রয়েছে। তবে কৃষকগন আলু বাজারজাতকরনে নানান সমস্যায় পড়ায় আলু চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বিগত বছরগুলোতে এমন মৌসুমে আলু চাষাবাদের হিড়িক থাকলেও চলতি বছর তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

ঠাকুরগাঁও চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রীজ এর নেতা মাহামুদ হাসান রাজু, ওসমান গনি জানান, আলু চাষীদের সাথে সাথে হিমাগার ব্যবসায়িরাও পথে বসেছেন। সারাদেশেই আলু আবাদ হচ্ছে। যে পরিমানে আলু আবাদ হয়, দেশের চাহিদা মেটাতে সে পরিমান আলুর একটি ছোট অংশের প্রয়োজন হয়। আলু খাতের জন্য ঠাকুরগাঁও জেলা সহ বাংলাদেশ একটি বিপুল সম্ভামনাময় এলাকা। আলু রপ্তানী সহ আলুর নানাবিধ ব্যবহার না করা হলে হয়তো আগামীতে আলু চাষাবাদ বন্ধই হয়ে যাবে। আলু পচনশীল হওয়ায় তা দ্রুত বাজারজাত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার আলু রপ্তানীর ব্যবস্থা করলে হয়তো আলু বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানী দ্রব্যে পরিনত হতে পারে। সরকারের আন্তরিকতায় আলুচাষী সহ হিমাগার কর্তৃপক্ষ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে পারবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top