সকল মেনু

চাঁদপুরের প্রাইভেট হাসপাতালগুলো যেন মরণ ফাঁদ ॥ দেখার কেউ নেই

Hospital-1 শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর ,২২সেপ্টেম্বর:  ভুল চিকিৎসায় চাঁদপুরে মানুষ মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। সারা জেলায় ব্যাঙ্গের ছাতার মত গড়ে উঠেছে প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার। এগুলোর না আছে অনুমোদন, না করা হয় মানসম্মত চিকিৎসা। নেই আধুনিক যন্ত্রপাতিও। কোন কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে রিপোর্ট দেখার জন্য নিয়মিত ডাক্তারও নেই। টাকার বিনিময়ে কিছু ডাক্তার দিয়ে আগেই রিপোর্টের ফরমে সই করে আনা রাখা হয়। তারপর অনভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানরা নিজেদের মত করে রিপোর্ট তৈরী করে রোগীদের সরবরাহ করে। আর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা এখন পানি ভাতের মত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে হাজীগঞ্জ শাহমিরান হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টনসিলের অপারেশন করতে গিয়ে বিল্লার হোসেন নামের ১৯ বছরের এক টগবগে যুবককে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হল। যাবার সময় ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার অভিভাবকদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হল এক লাখ টাকা। এর ঠিক দুই সপ্তাহ আগে চাঁদপুরের কর্ণফুলি হাসপাতালে চিকিৎসকদের অবহেলায় প্রাণ হারাল প্রাণ কৃষ্ণ নামের একজন তরুণ আইনজীবী।

নিহত বিল্লালের মা সুফিয়া জানান, তাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামে। ৪ সন্তানের মধ্যে বিল্লাল সবার বড়। বিল্লাল সহসা বিদেশে চলে যাবে, তাই গলার টনসিলের সমস্যা সারিয়ে নিতে গত বৃহস্পাতিবার বিকেলে বিল্লাল তার মা-বাবার সাথে নিজে হাজীগঞ্জ শাহমিরান হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসে। এক আত্মীয়ের দালালির মাধ্যমে আসলেও হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এনএম ইসলাম সুমনের সাথে গলার অপারেশন বাবদ ৮ হাজার টাকায় চুক্তিপত্র হয়। এর পর বিল্লাল পায়ে হেঁটে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে। ঢাকা থেকে আসা অতিথি ডাক্তার ওবায়দুল ইসলাম অপারেশন করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। অগত্যা নিজে ও হাসপাতালকে বাঁচাতে তারাতারি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিলে বিল্লালকে রাতেই কুমিল্লা রেফার করে দেন। আর ডাঃ ওবায়দুল ইসলাম ঢাকা চলে যান। বিল্লালের পরিবার তাৎক্ষণিক বিষয়টি না বুঝলেও কুমিল্লা হাসপাতালে পৌঁছার পর সেখানকার ডাক্তাররা বিল্লালকে রিসিভ করেননি। কারণ, বিল্লাল অনেক আগেই মারা গেছে অর্থাৎ হাজীগঞ্জ শাহমিরান হাসপাতালেই বিল্লাল মারা গেছে। তখনই বিল্লালের মা-বাবার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।

রাত ১১টার কিছু পরে বিল্লালের লাশ নিয়ে তার পরিবার হাসপাতালের সামনে পৌঁছে। এর পরেই ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায়। রাত ১২টার পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিহত বিল্লালের পরিবারের সাথে বিল্লালের জীবনের মূল্যের কষাকষিতে বসে। হাসপাতালের বাইরে বিল্লালের লাশের উপর পড়ে তার মা-বোন ও অন্য সকল আত্মীয়ের গগণবিদারী কান্না ওই এলাকার পরিবেশ ভারী করে তোলে। হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এনএম ইসলাম সুমনের নিজের চেম্বারে আয়োজিত ওই দর কষাকষির সালিসে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ দেওয়ান আবুল হোসেন, এস আই আনোয়ার হোসেন ও বাজার ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সর্বশেষ লক্ষাধিক টাকায় বিল্লালের জীবনের মূল্য নির্ধারণ হয়।

কিছুদিন আগে হাজীগঞ্জ বাজারে সদ্য চালু হওয়া সেবা হাসপাতালে ঘটে আরেক ঘটনা। ওই হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে চাকুরি নেন আল-আমিন নামের একজন গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক। এক সময় জানা যায় ওই চিকিৎসকের ডিগ্রিটি ভুয়া। পুলিশি কিংবা অন্য কোনো হয়রানি থেকে বাঁচতে ওই চিকিৎসক হাসপাতাল থেকে ছুটি না নিয়ে একেবারে পালিয়ে যান। পরে আর এ ডাক্তারকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খুঁজে পায়নি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আল-আমিন নামের ওই ভুয়া চিকিৎসক বর্তমানে সিলেটে নিয়মিত একই পদে চাকুরি করছেন।

শুকরান হাসপাতাল। হাজীগঞ্জ বাজারের পুরাতন হাসপাতালগুলোর একটি। কয়েক মাস আগে ওই হাসপাতালে কালচোঁ ইউনিয়নের সিদলা এলাকার এক রোগী হাসপাতালের এক দালালের মাধ্যমে ডেলিভারীর জন্য ভর্তি হন। বিকেলে অপারেশনের পরে রাতে ওই রোগী মারা যান। আর তিনি রেখে যান ফুটফুটে একটি সন্তান। পরে অবশ্য এ ঘটনাটি কর্তৃপক্ষ মৃত ওই রোগীর স্বামীর সাথে আপোষ করে ফেলেন।

পপুলার হাসপাতালে সায়নোসাইটিস ও টনসিল সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয় দুই রোগী। ওই দিনই ডাক্তার নাকের রোগীর গলা আর গলার সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর নাকের অপারেশন করে ফেলেন। এ ঘটনাটি হাজীগঞ্জসহ সমগ্র চাঁদপুরে তীব্র সমালোচনার ঝড় তোলে।

পপুলার হাসপাতালে কানের চিকিৎসা নিতে এসে বড় ধরনের হয়রানির শিকার হন উপজেলার তারালিয়া গ্রামের অলিউল্লা (৫৫)। তিনি জানান, কিছুদিন আগে পপুলার হাসপাতালে কানের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাই। হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে সরাসরি বলে দেন এটা অপারেশন করতে হবে। এছাড়া এ রোগের সমস্যার সমাধান নেই এবং এ হাসপাতালেই অপারেশন করতে হবে। সচেতন ওই রোগী পরে কুমিল্লা গেলে কুমিল্লার ডাক্তাররা সরাসরি বলে এ ধরনের অপারেশন ঢাকা করালে ভালো হবে। পরে তিনি ঢাকায় গিয়ে ডাঃ প্রাণ গোপালের শরণাপন্ন হন এবং সাধারণ ধরনের কয়েকটি ঔষধে ও বিনা অপারেশনে এখন পর্যন্ত ভালো আছেন।

চাঁদপুর শহরের কর্ণফুলি হাসপাতালে প্রাণ কৃষ্ণ নামের একজন আইনজীবী বুকের ব্যখা নিয়ে চিকিৎসার জন্য যান। নানা টালবাহানা করতে করতে রোগি মারা যায়। চাঁদপুর শহরের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে আকছার এমন ঘটনা ঘটে চলছে। প্রায়ই হাসপাতালে হামরা চালায় রোগীর স্বজনরা। পুলিশ আসে, অভিযোগও নেয় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। চাঁদপুর সেন্ট্রাল হাসপাতাল, রয়েল হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতালে ইতিপূর্বে ভুল চিকিৎসায় অনেক লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোনটারই কোন প্রতিকার হয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top