সকল মেনু

এবার মাটির হাঁড়ির টুং টাং শব্দ ইফতারে আলাদা কদর রফতানিও হচ্ছে

হটনিউজ ডেস্ক: এবার ইফতারে মুড়ির কদরই আলাদা। আবার সেই মুড়ি যদি হয় বরিশালের মোটা মুড়ি, তাহলে তো আর কথাই নেই। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বরিশালের মোটা মুড়ি রফতানি হচ্ছে বিদেশে। ফলে স্থানীয় ১০ গ্রামের প্রায় তিন শ’ পরিবারের প্রায় দেড় হাজার সদস্যের রাতের ঘুম মজে গেছে প্রতিক্ষণে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও অবসরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুড়ি ভাজায় অংশগ্রহণ করছে।

রমজান শুরু হওয়ার পরপরই সরগরম হয়ে উঠেছে বরিশাল জেলার বুড়িরহাটের মুড়িপল্লী। প্রতিদিন রাত দুইটা বাজতেই মাটির হাঁড়ি পাতিলের টুং টাং শব্দ, কখনওবা শিশুর কান্নার সঙ্গে হাজারো মানুষের কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে জ্বলে ওঠে তিন শ’ ঘরের ১২শ’ চুলার আগুন। চলে ভেজা চালে লবণ মেশানোর কাজ। চার মুখো চুলায় শুরু হয় চাল ও বালু ভাজার কাজ। সম্পূর্ণ রাসায়নিক সার মুক্তভাবেই ভাজা হয় মোটা মুড়ি। বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম চরামি, জুরকাঠি, সোহাগকাঠি, বীরনারায়ণ, কয়ারচর, বাখরকাঠি, চৌদ্দপুরা, নলছিটির বুড়িরহাট, দক্ষিণ তিমিরকাঠি, ভরতকাঠি, দপদপিয়া, কুমারখালী ও খেজুরতলা গ্রামের মানুষ মুড়ি উৎপাদনের সঙ্গে কমবেশি জড়িত। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে মুড়ির হাট, আড়তদারি প্রতিষ্ঠান, ধান মাড়াই ও চাল ছাঁটাইয়ের কলসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

তিমিরকাঠি গ্রামের মুড়ি উৎপাদনে জড়িত নির্মল চন্দ্র দাস বলেন, রোজার মাসে বেশি চললেও ১২ মাসই মুড়ি ভাজার সঙ্গে তারা জড়িত। হাতে ভাজা হওয়ায় তাদের মুড়ির চাহিদা বেশি। স্বাদে-গন্ধে এই মুড়ি বাজারের অন্যান্য মুড়ির চেয়ে আলাদা। তাই রমজান মাসজুড়ে মুড়ি বেচা-কেনার ধুম পড়ে।

নলছিটির বুড়িরহাটসহ আশপাশের ১০ গ্রামে মোটা মুড়ি ভাজার কাজ চলছে প্রায় একশ’ বছরেরও অধিক সময় ধরে। অন্য সব পরিচয় হারিয়ে এসব গ্রাম বর্তমানে ‘মুড়ির গ্রাম’ নামেই দেশব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। আড়তদারদের দেয়া ৫০ কেজি চালে মুড়ি হয় ৪৪ কেজি। এ মুড়ি বর্তমান পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ৯০ টাকা দরে বিক্রি হলেও খুচরা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে। নারী শ্রমিক রাশিদা বেগম জানান, মহাজনের (আড়তদার) দেয়া চাল ও জ্বালানি পেয়ে শুধু মুড়ি ভেজে দিয়ে গড়ে ৫০ কেজি মুড়ি থেকে তারা পাঁচশ’ টাকা আয় করেন। তবে নিজেরা ধান ক্রয় করে মুড়ি ভেজে শহরে নিয়ে বিক্রি করতে পারলে দ্বিগুণ আয় করা সম্ভব। শ্রমিকদের মতে, মুড়ি ব্যবসার সব লাভ লুটে খাচ্ছেন আড়তদাররা। অর্থাভাবে তারা চাল ও জ্বালানি ক্রয় করতে পারছেন না। তাই মুড়ি শিল্পে জড়িতরা স্বাবলম্বী হতে সরকারের কাছে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া দাবি করেছেন।

নগর সংলগ্ন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতু পাড় হলেই দপদপিয়া ইউনিয়নের তিমিরকাঠি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে সকলেই মুড়ি ভাজা নিয়ে ব্যস্ত। মাটির হাঁড়ি পাতিলের টুং-টাং শব্দ চারদিকে। কেউ মুড়ি ভাজছে, কেউ তা বস্তা ভর্তি করছে। হাজারো মানুষের কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে হাতে ভাজা এ মুড়ি শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয় সারাদেশের রোজাদারদের কাছে ইফতারির প্রধান রসদ। একেকটি পরিবার প্রতিদিন কমপক্ষে এক মণ চালের মুড়ি ভাজতে পারে। তিমিরকাঠি থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরের বাকেরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম চরাদি গ্রামে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র।

বাণিজ্যিকভাবে মুড়ি ভাজার সঙ্গে তিন যুগ ধরে জড়িত তিমিরিকাঠীর ভূঁইয়া বাড়ির ৪০টি ঘরের সবাই। উনুনের জ্বালের কাছে থাকতে হয় বলে দুজন অথবা চারজন শ্রমিক পালা করে বিশ্রাম নিয়ে নির্বিঘেœ চুলায় তাপ দিয়ে অবিরাম মুড়ি ভেজে যাচ্ছেন। শ্রমিকরা বিশ্রাম নিলেও মুড়ির চুলার কোন বিশ্রাম নেই। দৈনিক গড়ে ৫০ কেজি মুড়ি ভাজতে পারলে খরচ বাদ দিয়ে পাঁচ থেকে ছয়শ’ টাকা লাভ হয়।

স্থানীয় আড়তদাররা জানান, এসব গ্রাম থেকে মুড়ি সংগ্রহ করে তা ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, চাঁদপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের হাতে তুলে দেয়া হয়। একেকজন পাইকার এসব গ্রাম থেকে রমজান মাসেই পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার মুড়ি ক্রয় করে থাকেন। পাইকারদের মাধ্যমে এসব গ্রামের মোটা মুড়ি দেশ ছাপিয়ে গত কয়েক বছর থেকে বিদেশেও রফতানি করা হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top