সকল মেনু

এবার গৃহকর্মী পাঠানোর নামে ‘বৈধপথে’ নারী পাচার !

আরমান হোসেন, হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা: তিন মাস শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ইয়াসমিন (ছদ্মনাম)। তিনি জানতেন না কিভাবে দেশে ফিরবেন বা আদৌ বেঁচে ফিরতে পারবেন কিনা। যেদিন বিদেশের মাটিতে পা দেন, তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বুঝে যান তিনি বিক্রি হয়ে গেছেন। এখানে তার অন্য কোনও কাজ নেই। গার্মেন্টে চাকরি ও মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতনের স্বপ্ন দেখিয়ে পাচার করে দেওয়া হয়েছে তাকে। বিদেশে যে পরিবারটি তাকে কিনে নিয়েছিল সে পরিবারের তিনজন পুরুষই তাকে নির্যাতন করেছে। একসময় সেই আখড়া থেকে পালিয়ে যাওয়া ইয়াসমিন প্রথমে জেল খেটে এবং পরে দেশ থেকে আরও টাকা আনিয়ে তবেই দেশে ফেরার অনুমতি পান। কিন্তু ততদিনে স্বামী হারিয়েছেন। এখন দেনার দায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দ্বারে দ্বারে।

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন যারা তারা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী হিসেবে পাঠাতে গিয়ে ‘বৈধভাবে’ ঘটছে নারী পাচার। অভিবাসী নারী শ্রমিকরা কাজের স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পরিবর্তে পাচার হয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করে তারা বলছেন, এই শ্রমিকরা যে দেশে যান, সে দেশে নারীর কাজের পরিবেশ নেই জেনেও তাদের আটকানো হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে নারী শ্রমিকদের একটা বড় অংশ ‘বৈধপথেই’ পাচার হয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে দূতাবাসগুলো যাতে কার্যকর নজরদারির ব্যবস্থা নেয় সেজন্য কাজ করা জরুরি বলেও মনে করছেন তারা।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে নারীকর্মী পাঠানোর চুক্তি হয়। ওই বছর ২০ হাজার ৯৫২ জন নারী দেশটিতে যান। আর এ বছরের প্রথম তিন মাসেই গেছেন ২০ হাজার ৩৬ জন। এছাড়া, গত তিন বছরে ৬০ হাজার নারীকর্মী জর্ডানে, ৫০ হাজার নারী সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ৪০ হাজার নারী লেবানন, ৩০ হাজার নারী ওমান ও ১৭ হাজার নারী কাতারে গেছেন।
এই নারীদের অনেকেই সেখানে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ পাননি। বরং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা নারীরা বলছেন, তাদের কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। দেশে ফিরতে চাইলে মারধর করা হয়েছে। মাঝেমধ্যেই বাসাবাড়িতে জোর করে রাতের বেলা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
‘শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সুশাসন: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ থেকে বাইরের দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বেশি শ্রমিক দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। পুরো শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়াকে ‘দালাল নির্ভর’ আখ্যায়িত করে প্রতিষ্ঠানটি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গন্তব্য দেশের ভিসা গ্রহণ থেকে শুরু করে বাংলাদেশে বিএমইটি থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে দালাল আর দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা। প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে, মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে পেশাগত ভিসায় স্বল্প দক্ষ বা আধা দক্ষ কর্মীর জন্য বহির্গমন ছাড়পত্র দেওয়া হয়।’
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘আমরা যেখানে আমাদের নিজেদের মেয়ে পাঠাব না, সেখানে আমরা কেন দেশের মেয়েদের পাঠানোর সাহস করি। এই নারীরা নির্যাতনের শিকার, ফিরে এসে অভিযোগ করেছেন; শোনা হয়নি। বারবার প্রতিবেদন হয়েছে, কেউ আমলে নেয়নি। সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের পাঠানোর কোনও সুযোগ নেই। কেননা, গৃহকর্মীর নামে সেখানে কী করানো হবে, সেটি সবার জানা।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক বলেন, ‘সম্প্রতি ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের নিয়ে নিজেরা করি নামের একটি সংগঠনের গণশুনানির বিষয়টি শুনে আমার মনে হয়েছে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা উচিত। আমরা যখনই বাইরের দেশগুলোতে যাই, সেখানে দূতাবাসে কথা বলি সেখানকার অভিবাসীদের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কিন্তু নারী শ্রমিকদের নিয়ে তেমন কোনও কথা কখনও বলা হয়নি। এমনকি তাদের সমস্যাগুলো যে মাত্রা ও ধরণগত দিক থেকেও ভিন্ন, সেটাও আমরা বিবেচনায় রাখি না। ভুলে গেলে চলবে কেন, মেয়েদের প্রতি নিপীড়নটা অন্য ধরনের। কিন্তু যেসব দেশে এগুলো ঘটছে, সেখানে অনেক জায়গায় মানবাধিকারের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। সৌদি আরবে নিপীড়নের অনেক খবর আসে, সেখানে মানবাধিকার কমিশন বলে কিছু নেই। সেখানে আপনি কিভাবে কাজ করবেন? তবে আমরা সরকারগুলোর সঙ্গে কথা বলে, তাদের কাছে গণশুনানির প্রতিবেদন পাঠানোর কাজগুলো করতে পারি।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top