সকল মেনু

গাছ কাটতে বাঁধা দিলে খবর আছে’

Jessore Tree - 04.08.13রিপন হোসেন, যশোর থেকে :যশোরে জেলা পরিষদের গাছ নিয়ে চলছে হরিলুট। মালিকানা জেলা পরিষদের অথচ গাছ বিক্রি করে দিচ্ছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। এ দিকে সড়ক বিভাগের বিক্রি করা গাছ দু’বার করে কেটে নিচ্ছেন ক্রেতারা। প্রথমবার কেনা গাছ কাটতে গিয়ে ক্রেতারা জেলা পরিষদ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তারা হাইকোর্টে রিট করে সেই গাছ কেটে নিয়েছেন। এখন আবার ক্রেতারা নতুন করে বলছেন তারা গাছ কাটেননি। আগের রিট বলে আরো ১৩টি গাছ কেটে নেয়ার পায়তারা করছেন ক্ষমতাসীন ওই চক্রটি। সড়ক পার্শস্থ গাছ লোপাট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ ভাবে দুই কোটি টাকা মুল্যের ২০৯টি গাছ মাত্র ১১ লাখ টাকায় বিক্রি দেখিয়ে বাকি টাকা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউল হায়দার আত্মসাৎ করেছেন বলে খোদ বিভাগীয় কর্মকর্তারাই প্রধান প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ করেছেন।

যশোর জেলা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভার সিদ্ধান্তে সড়কের মালিকানা জেলা বোর্ডের স্বীকৃত হলেও হাই কোর্টর আদেশের বলে আটটি নিলাম বিজ্ঞপ্তির প্রায় সব গাছ কেটে নেয় ক্রেতারা। কিন্তু যশোর জেলা বোর্ডের গাছ কাটতে ব্যর্থ হয়। বিষয়টি নিয়ে ডেপুটি কমিশনারের উদ্যোগে এক সমঝোতা বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্রেতারা গাছগুলো কেটে নেন। এই ক্রেতাদের মধ্যে ঝিকরগাছার লাউজানীর ওসমান গনি চারটি, যশোর শহরের পুরাতন কসবার আবদুল হাই, বুনোপাড়ার আতিকুল ইসলাম বাবলু ও কারবালার নূর হোসেন একটি করে গাছ কেটে নেন।

গাছ ক্রেতা আবদুল হাই জানান, তিনি যে গাছ কেটে নিয়েছেন সে বিষয়ে লিখিত স্বীকৃতিপত্র জমা দিয়েছেন। ওসমান গনিও জানান, তিনি নির্ধারিত গাছ বুঝে পেয়েছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও গাছ লুটের পায়তারা বন্ধ হয়নি। এরই মধ্যে হঠাৎ করে একদিন বৃক্ষ খাদক সিন্ডিকেট সদস্য এনামূল কবির সরকারদলীয় এক নেতা শাহারুলের নেতৃত্বে জেলা বোর্ডে সশরীরে হাজির হয়ে দাবি করছেন তারা কেনা গাছ কাটেননি। হাই কোর্টের ওই আদেশ বলে তারা এখন ১৩টি গাছ কেটে নেবেন। তারা শাসিয়ে এসেছেন ‘সামনে ঈদ। টাকার দরকার। তাই গাছ কাটায় বাঁধ সাধলে স্থনাীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বাধাদানকারীদের হাতজোড় করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।’ তাদের শকুনি দৃষ্টিতে পড়া গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে যশোর-বেনাপোল সড়কে নয়টি রেন্ট্রি, যশোর-খুলনা ও যশোর-ঝিনাইদহ সড়কে দুইটি করে মেহগিনি। যশোর-বেনাপোল সড়কের রেন্ট্রি গাছগুলো ১৮৪২ সালে রোপিত, যার বয়স এখন প্রায় পৌণে দুইশ বছর। এলাকার ঐতিহ্যের স্মারক এই গাছ যাতে কাটা না হয় সে ব্যাপারে সড়কের পাশে বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

অভিযোগ আছে গাছ লুটকারীরা ক্ষমতাসীন দলের যশোর জেলার এক শীর্ষ নেতার নাম ব্যবহার করে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছেন। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন তারা সে দলের নাম ভাঙিয়ে নেতাদের ব্যবহার করে নির্বিঘেœ এ কাজ করেন। কর্মকর্তারা আপত্তি জানালে তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

এই সিন্ডিকেটের তৎপরতা দেশব্যাপী। গাছ খাদক ও পরিবেশ বিনাশকারি চক্রটি উচ্চ আদালতে ভুল তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিভ্রান্ত করে নিজেদের পক্ষে রায় নেবার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। কখনো সফলও হয়। আর এ কাজে বরাবরই বিশেষ রফার মাধ্যমে সর্বাতœক সহায়তা করে থাকেন সওজের নির্বাহী বৃক্ষপালনবিদ অপারেশনডিভিশন(পশ্চিমাঞ্চল)।

সওজের গাছ বিক্রিতেও যথেষ্ঠ শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। নথিমূলে দেখা গেছে, বিজ্ঞপ্তির সাথে কার্যাদেশের মিল নেই। আবার বিজ্ঞপ্তিতে নেই অথচ কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত গ্র“প সংখ্যার চেয়ে বেশি সংখ্যক গ্র“প দেখিয়ে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। যে সব গাছ আগে কেটে নেয়া হয়েছে সেগুলো হাইকোর্টের রিটের আর্জিতে অন্তর্ভূক্ত করে পুনরায় কাটা হচ্ছে। ২০০৩-০৪ সালে যশোর-বেনাপোল সড়কের সাতটি রেন্ট্রিগাছ বিক্রি করা হয়েছিল। জেলা পরিষদ বাধা দেবার আগেই চারটি গাছ ক্রেতারা কেটে নিয়ে যায়। পরে জেলা প্রশাসনের মধ্যস্থতায় বাকি তিনটি গাছ কাটা হয়। গাছ কেটে নেয়ার পর নিয়মানুযায়ী দরপত্রের সাথে জামানত হিসেবে দেয়া বিডি ফেরৎ দেয়া হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় গাছ কেটে নেয়া হয়েছে। মরা এবং মাথাহীন গাছ কাটার কথা থাকলেও কোন গাছটি কাটা হবে তা নাম্বারিং বা মার্কিং করা নেই। এমন কার্যাদেশের ফলে ক্রেতারা নিজের ইচ্ছামত মরা গাছ বাদে তরতাজা জ্যান্ত গাছ কেটে নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের জেলা পরিষদ শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০০২-০৩ ও ২০০৩-০৪ সালে জেলা পরিষদের মালিকানাধীন যশোর-বেনাপোল, যশোর-ঝিনাইদহ, যশোর-খুলনা, ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সড়কের পাশের ২০৯ টি বিভিন্ন জাতের গাছ সওজ অপারেশন ডিভিশনের (পশ্চিমাঞ্চল) নির্বাহী বৃক্ষপালনবিদ উন্মুক্ত টেন্ডারের পরিবর্তে কোটেশনের মাধ্যমে বিক্রি করে দেন। ক্রেতারা গাছ কাটতে গেলে জেলা পরিষদ বাধা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেতা এনামুল কবির ২০০৮ সালে হাই কোর্টে রিট করেন। আদালত ক্রেতাদের পক্ষে রায় দেন। আদালতের রায় বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৯ জুন আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সড়ক ও রেলপথ বিভাগের সচিব এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। ওই সভায় আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সলিসিটরকে আহবায়ক করে একই মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (মতামত), অ্যাটর্নি জেনারেলের একজন প্রতিনিধি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের একজন প্রতিনিধি,সড়ক ও রেলপথ বিভাগের উপসচিব (উন্নয়ন) এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, সওজ এবং জেলা পরিষদের একজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে আট সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।

এই কমিটি সওজ ও জেলা পরিষদের মধ্যে সড়কের মালিকানা বিষয়ে আইন, বিধিবিধান, পরিপত্র, গেজেট, আনুসঙ্গিক দলিলপত্র পর্যালোচনা করে সড়ক ও রেল বিভাগের সচিবের কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য ২০১১ সালের ২ মার্চ আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান। সভায় অভিযোগ ওঠে জেলা পরিষদের ২০৯ টি গাছ আটটি কোটেশনের মাধ্যমে সড়ক বিভাগ বিক্রি করে দেয়। গাছগুলোর প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১১ লাখ ২৪ হাজার ১৭৭ টাকা ৮৩ পয়সা। অথচ গাছগুলোর প্রকৃত দাম দুই কোটি টাকারও বেশি। সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি-একনেক ও সমন্বয় অনুবিভাগের প্রজ্ঞাপনে রাস্তার মালিকানা জেলা পরিষদের কাছ থেকে প্রত্যাহার করে অন্য কোনো সংস্থাকে দেয়া হয়নি। এ কারণে কোন সংস্থা জেলা পরিষদের রাস্তার মালিকানা দাবি করতে পারবে না। রাস্তার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য গাছ কাটার প্রয়োজন হলে সওজ জেলা পরিষদকে জানাবে। জেলা পরিষদ গাছ কাটার ব্যবস্থা নেবে। সড়ক বিভাগকে বিক্রিত গাছের হিসাবসহ আগে যে গাছ কাটা হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব জেলা পরিষদকে প্রদান করতে হবে এবং ২০৯ টি গাছ নামমাত্র মূল্যে বিক্রির বিষয়ে জেলা পরিষদ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। এদিকে ঐতিহাসিক যশোর রোডের দুই শত বছরের পুরোনো এসব রেন্ট্রি গাছ রক্ষায় পথে নেমেছেন এলাকার সচেতন মানুষ । তারা গাছ ও পরিবেশ রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন করছেন। করছেন গণসংযোগ। ধর্ণা দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারে দ্বারে। তার পরও শেষ রক্ষা হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে আন্দোলনকারীদের মনে। তারা গাছ খেকোদের হাত থেকে যশোর রোডের রেন্ট্রি গাছ গুলেঅ রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

 

রিপন হোসেন

যশোর

০১৯২০০৯৯৪৪৯

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top