সকল মেনু

হ‌ুমায়ূন আহমেদ ছিলেন পাঠক তৈরির জাদুকর

অাফিফা জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা: তরুণ প্রজন্মকে গল্পে গল্পে বৃষ্টিতে ভেজা, জোৎস্না দেখা, ঘুরে ঘুরে শহর ও মানুষ চেনা শিখিয়েছেন যিনি, তার নাম হ‌ুমায়ূন আহমেদ। তিনি ছিলেন পাঠক তৈরির জাদুকর। কারণ তার গদ্যে ছিল জাদু। শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যে আয়োজন করে জ্যোৎস্না দেখার তৃষ্ণা তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনিই। নাগরিক মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতা তার মতো আর কেউ ধরতে পারেননি। কলকাতার উপন্যাসে বুঁদ হয়ে থাকা পাঠকরা নব্বইয়ের দশকে ফিরে এসেছিল তার সরস ভাষার লেখনীর জাদুতে। তারা রাজনৈতিক পাঠও পেয়েছেন হ‌ুমায়ূনের লেখার মধ্য দিয়ে।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ (জন্ম: ১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮; মৃত্যু: ১৯ জুলাই, ২০১২) লেখক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, হ‌ুমায়ূন একটা প্রজন্মকে পড়তে শিখিয়েছেন। তাদের মতে, ‘হ‌ুমায়ূন আহমেদ নিছক একজন সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন বলেই তার পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। আবার তার পাঠকগোষ্ঠীই তাকে প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে। হ‌ুমায়ূন-পাঠ থেকে পাঠকদের বোধগম্য হয়েছে, নন্দিত এই কথাশিল্পী অরাজনৈতিক লেখক ছিলেন না। বরং বিভিন্ন গ্রন্থে রাজনীতি নিয়ে তার ভাবনার প্রতিফলন উঠে এসেছে।’

হ‌ুমায়ূন আহমেদের লেখনীতে বিরাজ করতো প্রবল শক্তি। কিন্তু রোগব্যাধির কাছে কাবু হতে হয়েছে তাকে। ২০১১ সালে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য গেলে তার শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির মেমোরিয়াল স্লোয়ান-ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসা নেওয়ার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কেমোথেরাপি ও অস্ত্রোপচারের পর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল বটে। কিন্তু শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস সংক্রমণের কারণে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই এক বরষায় সবার মন কাঁদিয়ে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

মৃত্যুর পর হ‌ুমায়ূন আহমেদের গল্পের ‘বোহেমিয়ান’ চরিত্র হিমুর আদর্শ ধরে রাখতে তৈরি হয় হিমু পরিবহন নামে সংগঠন। তার উপন্যাসের চরিত্র রূপার মতো করে নীল শাড়িই ধারণ করে নতুন প্রজন্মের মেয়েরা। এ সময়ের তরুণ সাহিত্যিকরা বলছেন, ‘হ‌ুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পড়লে মনে হবে হালকা চালের অন্তঃসারশূন্য কিছু হয়তো! কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তার রাজনৈতিক মনোভাব বুঝতে পারে তরুণ পাঠকরা।’

হ‌ুমায়ূনের লেখনীর সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস থেকে বাংলার তরুণ পাঠকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে কথা বলেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের শিক্ষক সুমন রহমান। তিনি  বলেন, ‘পাঠকগোষ্ঠী তৈরির প্রক্রিয়া যতটা না সাহিত্যিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। হ‌ুমায়ূন আহমেদ সেই ঐতিহাসিক দায়িত্বটুকু পালন করেছেন।’

হ‌ুমায়ূনের অবদানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে লেখক অনেক কিছুই হারান। পাঠকগোষ্ঠীর কাছে হ‌ুমায়ূন আহমেদ যেমন পূজনীয়, সমালোচকরা হয়তো তাকে সে জায়গায় রাখবেন না। কিন্তু তিনি যে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক উভয় অর্থে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় আইকনদের একজন, তা নিয়ে সম্ভবত কারও দ্বিমত নেই। এটা অস্বীকার করার উপায়ও নেই।’

নব্বইয়ের দশকে পাঠক ধরার জন্য কোনও ফাঁকা একটা সময়কে হ‌ুমায়ূন আহমেদ ব্যবহার করেছিলেন কিনা জানতে চাইলে সাহিত্যিক সাখাওয়াত টিপু  বলেন, ‘ফাঁকা সময় বলাটা ঠিক হবে না। কারণ তার সময়ে অন্য লেখকরাও তো ছিলেন। একটা আলাদা নতুন রাষ্ট্রের বিকাশ দিয়ে সময়টা বুঝলে ভালো হয়। কারণ হ‌ুমায়ূন আহমেদ অরাজনৈতিক লেখক নন। বিভিন্ন বইয়ে তার সেইসব ভাবনার প্রতিফলন আছে।’

এই সাহিত্যিক আরও বলেন, ‘তরুণদের আকৃষ্ট করার প্রধান কারণ হ‌ুমায়ূন আহমেদের সরস ভাষা। নাগরিক মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতা তার মতো আর কেউ ধরতে পারেননি। মানে কল্পনার সঙ্গে অধিবাস্তবতার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তিনি। ফলে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন শহরমুখী তরুণদের।’

হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তাকে নিয়েই কাজ করেছেন লেখক-গবেষক শাকুর মজিদ। হ‌ুমায়ূনই কি এ দেশের তরুণদের পড়তে শেখালেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পড়তে শিখিয়েছেন বলবো না। কিন্তু তার গদ্যে জাদু ছিল যা তরুণদের টেনেছে। এ কারণেই হ‌ুমায়ূনের লেখা পেয়ে দুই বাংলার অন্য হালকা চালের লেখকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এইসব পাঠকরা।’

বর্তমান সময়ের লেখক সাদাত হোসাইন  বলেন, ‘হ‌ুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে তেমন একজন গল্পকথক, যে গল্পগুলো শোনা বা পড়া আমাদের প্রয়োজন ছিল। তার এসব গল্পের চরিত্রগুলোও যেন আমাদের সচেতন বা অবচেতন প্রতিচ্ছবি। ফলে গল্প ও চরিত্রগুলো খুব আপন হয়ে উঠেছিল, আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এই আচ্ছন্নতা তিনি ছড়িয়ে রেখেছিলেন ভিজ্যুয়ালি গল্প বলাতেও। সহজে গল্প বলার সহজাত এবং বিস্ময়কর ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top