সকল মেনু

এত বিস্ফোরক জঙ্গিরা পায় কিভাবে ?

 মেহেদী হাসান,হটনিউজ২৪বিডি.কম: সারা দেশে একের পর এক জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে নিয়মিত বিস্ফোরক উদ্ধার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আস্তানা থেকে উদ্ধারের পর নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে হাতে তৈরি বোমা ও গ্রেনেড। উদ্ধার করা হচ্ছে বোমা তৈরির নানারকম ইলেকট্রনিক ডিভাইসও। সর্বশেষ সাভারের জঙ্গি আস্তানা থেকেও বিস্ফোরক দ্রব্য, তাজা বোমা ও সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধারের পর তা নিষ্ক্রিয় করা হয়। গত বছর গুলশান হামলার পর দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে গেলেও জঙ্গিদের কাছে বিস্ফোরকের জোগান বন্ধ হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে জঙ্গিরা এত বিস্ফোরক পায় কিভাবে?

ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিদের ব্যবহৃত বিস্ফোরকের বেশিরভাগ চালানই আসতো পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। এর মধ্যে রয়েছে বোমা-গ্রেনেড ব্যবহৃত ডেটোনেটর, বিস্ফোরক জেল। দীর্ঘ দিন ধরে বিশেষ করে নব্য জেএমবির একটি গ্রুপ চাপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জ এলাকার সীমান্ত দিয়ে বিস্ফোরকের এসব চালান আনতো। মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান নামে এক ব্যক্তি বাংলাদেশে ৬-৭ জনের একটি দল তৈরি করে পুরো বিষয়টি দেখভাল করতো। চলতি বছরের ২ তাকে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গত বছরের ৩ নভেম্বর মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, আবু তাহের, সেলিম মিয়া ও ডা. তৌফিক নামে তার চার সহযোগীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের কাছ থেকে হাতে তৈরি গ্রেনেড, ৭৮৭টি ডেটোনেটর ও একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘জঙ্গিদের বিস্ফোরক সংগ্রহের জন্য দেশে-বিদেশে যেসব রুট ও সোর্সের কিছু কিছু বন্ধ করা হয়েছে। দেশের ভেতরে বিস্ফোরক সংগ্রহের জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।’

এদিকে, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, এই গ্রুপটিই ভারত থেকে বিস্ফোরকসহ বোমা ও তৈরির অন্যান্য উপকরণ দেশে আনতো। এই গ্রুপের মূল দায়িত্বে রয়েছে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, যে দীর্ঘ দিন ধরে পুরনো জেএমবির সঙ্গে জড়িত থাকলেও কয়েক বছর ধরে নব্য জেএমবির হয়ে কাজ করছে। ভারতীয় বিস্ফোরক চালানের রুট সম্পর্কে সোহেল মাহফুজের ভালো জানাশোনা রয়েছে। সে-ই বড় মিজানসহ অন্যদের মাধ্যমে বিস্ফোরকের চালান দেশে আনতো। সোহেল মাহফুজ আত্মগোপনে রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিস্ফোরক চোরাচালানের রুটটি বন্ধ হওয়ার কারণে যশোরে তারা নতুন একটি রুট তৈরি করেছে।

জঙ্গিরা নানা ছলে এসব উপাদান সংগ্রহ করে বিস্ফোরক তৈরি করছে জানিয়ে সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলেন, ‘ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের কথা বলেও বিস্ফোরকের উপাদান সংগ্রহ করছে জঙ্গিরা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কেমিক্যাল ব্যবসায়ী বা ল্যাবরেটরিতে কর্মরত কেউ কেউ জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেমিক্যাল সরবরাহ করেছেন।’

এ রকম একটি অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৯ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ল্যাব সহকারী গাজী মোহাম্মদ বাবুলসহ চার জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। বাকি তিন জন টিকাটুলির রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রির তিন প্রতিষ্ঠান এশিয়া সায়েন্টিফিকের মালিক রিপন মোল্লা, ওয়েস্টার্ন সায়েন্টিফিক কোম্পানির মহিউদ্দিন ও এফএম কেমিক্যাল অ্যান্ড সন্সের মালিক নাসির উদ্দিন।

সিটিটিসি কর্মকর্তা ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘জঙ্গিদের কাছে বিস্ফোরকের জোগান বন্ধ করতে আমরা বিস্ফোরক অধিদফতরসহ বৈধ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছি। এমন একটি সিস্টেম তৈরি করছি, যেন খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যারা কেমিক্যাল বা রাসায়নিকদ্রব্য কিনছে, তাদের বিস্তারিত তথ্য যাচাই-বাছাই করে সংরক্ষণ করা হয়। তাহলে কারা কী উদ্দেশ্যে রাসায়নিকদ্রব্য কিনছে, তা মনিটরিং করা যাবে। এতে জঙ্গিরা মিথ্যে পরিচয় দিয়ে কেমিক্যাল সংগ্রহ করতে পারবে না।’

বৈধ কেমিক্যাল ব্যবসায়ী ছাড়াও এ সম্পর্কিত ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ গোপনে, কেউ ঘোষণা ছাড়াই কেমিক্যাল আমদানির সঙ্গে জড়িত বলে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘কেমিক্যাল প্রয়োজন হয় এমন কারখানার ছদ্মবেশেও জঙ্গিরা বিস্ফোরক উপাদান সংগ্রহ করে।’ সর্বশেষ সাভারের নামা গেন্ডার জঙ্গি আস্তানায়ও কসমেটিক্স তৈরির কারখানার নামে জঙ্গিরা বিস্ফোরক উপাদান সংগ্রহ করে বোমা-গ্রেনেড তৈরি করছিল বলে জানা গেছে। জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সোনারবাংলা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে সাবানের একটি কারখানার আড়ালে বিস্ফোরক দিয়ে বোমা-গ্রেনেড তৈরি করতো।’ সাভারের জঙ্গি গ্রুপটির মতো আরও একাধিক দল এ রকম কেমিক্যাল কারখানার ছদ্মবেশে বিস্ফোরক সংগ্রহ করছে বলেও তিনি ধারণা করছেন।

বোমা-গ্রেনেড তৈরিতে নতুন ডাইমেনশন

২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে নতুন ধারার জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি তাদের জঙ্গি কার্যক্রমে যে ধরনের বিস্ফোরক তৈরি করে আসছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তাতে প্রায় একই রকম উপাদান ছিল। কিন্তু চলতি বছরের ৭ মার্চ কুমিল্লার চান্দিনায় আহমেদ আজওয়াদ ইমতিয়াজ তালুকদার ও মাহমুদ হাসান নামে দুই তরুণকে হাতে তৈরি গ্রেনেডসহ গ্রেফতারের পর দেখা যায়, বোমা-গ্রেনেড তৈরিতে নতুন ডাইমেনশন রয়েছে।

বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার একটি জঙ্গি আস্তানায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় সারিক ওরফে তাহিরা আত্মঘাতী বিস্ফোরণে মারা যায়। পরে ওই আস্তানা থেকে আরো আত্মঘাতী বিস্ফোরক ভেস্ট উদ্ধারের পর নিষ্ক্রিয় করে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, যাতে ৬টি করে হাতে তৈরি গ্রেনেড ছিল। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, সিলেটের আতিয়া মহল, মৌলভিবাজারের নাসিরনগর ও বড়হাট, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে উদ্ধারের পর নিষ্ক্রিয় করা আত্মঘাতী বিস্ফোরক ভেস্ট এমন উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যার ধ্বংসক্ষমতা অনেক বেশি। নিরাপত্তাজনিত কারণে এসব বিস্ফোরক ভেস্ট তৈরির উপাদানের নাম প্রকাশ করতে অনুরোধ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা, যা প্রকাশিত হলে কৌতূহলী, সেল্ফ মোটিভেটেড জঙ্গিরা কাজে লাগাতে পারে।

কারা তৈরি করছে বোমা-গ্রেনেড ?

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, নব্য জেএমবির সক্রিয় সদস্যদের সবাই যে বোমা-গ্রেনেড তৈরি করতে সক্ষম, তা নয়। সংগঠনটির মধ্যম সারির কিছু নেতাকর্মী রয়েছে, যারা বোমা-গ্রেনেড তৈরিতে দক্ষ। তাদের মধ্যে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ ও হাদীসুর রহমান সাগর সন্দেহের তালিকার প্রথমে রয়েছে। তারা বলছেন, সম্প্রতি মৌলভীবাজারে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময়ও বোমা তৈরিতে দক্ষ আফগান ফেরত এক যুবকের কথা শোনা যায়, যদিও তার বিষয়ে নিশ্চিত কোনও তথ্য জানা যায়নি।

সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় কিছু মুখোশ উদ্ধার করা হয়েছে। জুনিয়র বা সাধারণ সদস্যদের সামনে এই যুবকরা মুখোশ পরে আলোচনায় অংশ নিতো। তাদের মধ্যেই কেউ কেউ বোমা-গ্রেনেড তৈরিতে দক্ষ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top