সকল মেনু

পিছিয়ে ভাষার রাজনীতিতে বাংলা?

হটনিউজ ডেস্ক: ভাষা আন্দোলনকে সাধারণ বিচারে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে ধরা হলেও কালে-কালে এর গতিধারা পরিবর্তিত হয়েছে নানান অবয়বে। শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকটি প্রধান হয়ে ওঠে। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বাইরে অন্য ভাষাকে ভাবতেই নারাজ ছিল তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী।

তবে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগে-পরে এদেশের ছাত্র-জনতা ও রাজনীতিকদের ধারাবাহিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে বাংলা। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলা ভাষার বিস্তার আশানুরূপ ঘটেনি। উল্টো অর্থনৈতিকভাবে, শিক্ষাব্যবস্থায় এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে ভাষা হিসেবে বাংলার অবনমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা বিস্তারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও অর্থনৈতিক কারণে নানাভাবে বাংলার প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় দলিল দস্তাবেজ, আদালতে এখনও ভাষা হিসেবে বাংলা উপেক্ষিত। যদিও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বাংলা ভাষায় রায় না লেখার কারণে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

ভাষার রাজনীতি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার তার ‘ভাষার রাজনীতি, রাজনীতির ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, “প্রায় সব দেশেই জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো যে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করে, সেখানে ভাষা বা শব্দ প্রয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক সময় নির্বাচনের ফলাফলকে এটি প্রভাবিত করে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দটি সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে মনস্তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানের বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু হতে পারে।’’

ভাষাসৈনিক, গবেষক আহমদ রফিক মনে করেন, ভাষা আন্দোলনের দাবিই ছিল রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক। ‘একুশের আন্দোলনে ভাষিক জাতীয়তা ও রাজনীতির সম্পর্ক শীর্ষক’ প্রবন্ধে তার মন্তব্য, “রাজনীতি সচেতন ভাষাপ্রেমী ছাত্র সমাজ, তরুণ ও যুব সমাজের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি উঠেছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’। স্লোগান তিনটির তাৎপর্য অনুধাবন করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এসব উচ্চারণের পেছনে রয়েছে একটি জাতিসত্তার নানাবিধ অধিকার নিশ্চিত করা, সমাজের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করা, সর্বোপরি জনগণের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।”

ভাষা বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক দাবি ও উপাদান এখনও প্রাণবন্ত। আজও গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদের অনুপ্রেরণার জন্য ফিরে তাকাতে হয় একুশে ফেব্রুয়ারির দিকে। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার ‘একুশে ফেব্রুয়ারির উত্তাপ ও গতি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলা ভাষা আদায়ের দাবি জানাবার দিন নয়, মানুষের প্রতিবাদকে প্রকাশ করার, প্রতিরোধকে ভাষা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি।’

স্বাধীনতার পর গত চার দশকে একটি শ্রেণি বাংলাকে প্রায় নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করে চলেছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘যে মধ্যবিত্ত আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছে, মাতৃভাষার জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত থেকেছে, আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয়ে সে মধ্যবিত্তের দৃষ্টি ঘরের মধ্যে নয়, দেশের বাইরে। হিল্লি-দিল্লি করতে করতে কিংবা তার স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে ভাবছে, তার সন্তান-সন্ততিকে বিদেশ পাঠাতে হবে-তারা যদি সেখানে থেকে যায়, তাহলে ভালো, নইলে অন্তত সেখানে তাদের উচ্চশিক্ষা নিতে হবে। সুতরাং গোড়া থেকেই তাদের ইংরেজি শিক্ষার ভিতটা পাকা করা দরকার।’ আনিসুজ্জামানের আশঙ্কা, খুব দ্রুত বাংলা মাধ্যমকে ছাড়িয়ে ইংরেজি মাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

প্রাবন্ধিক ফিরোজ আহমেদের অভিমত, ‘প্রায়ই কেউ কেউ ভুল বোঝেন, বলেন, আপনারা ইংরেজি ভাষাকে তুলে দিতে চান! আমরা কিন্তু চাই উল্টোটা। পুরো জাতির ওপর থেকে বিদেশি ভাষার বোঝাটাই কেবল আমরা তুলে দিতে চাই, যাতে নিজের ভাষায় শিশুরা জ্ঞান চর্চা করতে পারে, মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। সারা দুনিয়ার জানালাটা আমরা বাংলায় খুলে দিতে চাই।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top