সকল মেনু

সমন্বয় নেই শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায়

50c2da765db992e64ccb39c65db6c8b2-582b1a9cb9ae9হটনিউজ২৪বিডি.কম : ফের আলোচনার কেন্দ্রে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকার পরও ৬ নভেম্বর শাহজালালের বহির্গমন লাউঞ্জে এক যুবকের ছুরিকাঘাতে আনসার সদস্য মারা যাওয়ার পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে। এ ঘটনায় শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীগুলোর সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকবলও পর্যাপ্ত নয়।বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন সমন্বয়হীনতা এবং লোকবল সংকটের কথা। এছাড়া, নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠকেও বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মূলত দুই ধরনের। কোর সিকিউরিটি বা ফিজিক্যাল সিকিউরিটি এবং এভিয়েশন সিকিউরিটি বা নন-কোর সিকিউরিটি।ফিজিক্যাল সিকিউরিটির আওতায় বিমানবন্দরের বহিরাঙ্গন, রানওয়ে, অপারেশন টাওয়ার, রাডার স্টেশন, মার্কার, ভিওআর, লোকালাইজার, গ্লাইডপাথসহ সব ধরনের স্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তা ও অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো। অন্যদিকে এভিয়েশন সিকিউরিটির আওতায় বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশের সময় যাত্রীর দেহ তল্লাশি ও লাগেজ চেক,কার্গো চেক,স্ক্রিনিং,ফ্লাইট সেফটি এবং আনুষঙ্গিক কাজ।

সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফিজিক্যাল সিকিউরিটির দায়িত্বে রয়েছে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এএপিবিএন)।অন্যদিকে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির অধীনে এভিয়েশন সিকিউরিটির দায়িত্বে আছে এভিয়েশন সিকিউরিটি গার্ড, অ্যাভসেক এবং আনসার বাহিনী।দেশে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিমান বাহিনী, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয় এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স- অ্যাভসেক। এছাড়া, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন শাহজালালে।

শাহজালাল বিমানবন্দরের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, একজন পুলিশ সুপারের অধীনে আর্মড পুলিশ নিজেদের মতো করে কাজ করছে। এভিয়েশন সিকিউরিটি গার্ড ও আনসার সদস্যরা বিমানবন্দরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার অধীনে কাজ করছেন। বিমান বাহিনী,পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয় এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স- অ্যাভসেক কাজ করছে শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালকের অধীনে। এক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে অন্য সংস্থার সদস্যদের মধ্যে রয়েছে বৈরি মনোভাব। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে অন্যবাহিনীর অনিয়ম ধরতে ব্যস্ততাও চোখে পড়ার মতো। নিয়ম রক্ষার জন্য প্রতি মাসে একবার সমন্বয় মিটিং হয় প্রত্যেক বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সমন্বয়ের জন্য।

সূত্রে জানা গেছে,শাহজালাল বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা সিভিল এভিয়েশনের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা নন ক্যাডার সহকারী পরিচালক পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা। আর্মড পুলিশের নেতৃত্বে রয়েছেন বিসিএস ক্যাডার পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। অন্যদিকে অ্যাভসেকে বিমানবাহিনী,পুলিশ এবং আনসারের বিসিএস ক্যাডার সহকারী পুলিশ সুপার সমপদমর্যদার কর্মকর্তার রয়েছেন। পদ মর্যাদার সমতা না থাকায় সিনিয়র কর্মকর্তারা সিভিল এভিয়েশনের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে এড়িয়ে চলেন।

এছাড়া, অ্যাভসেকের সদস্যরা যাত্রীদের দেহ তল্লাশি, ব্যাগ তল্লাশির মতো দায়িত্বে এসে হীনমন্যতায় ভুগছেন এবং বদলির চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রেড লাইনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিলেও এ্যাভসেক থেকে বদলি হয়েছেন। অন্যদিকে সিভিল এভিয়েশন ও এপিবিএন সদস্যরা আলাদা ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন। ফলে কোথাও ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে সর্তক হওয়ার সুযোগ থাকে না।

সূত্র জানায়, এ বছর ১৮ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন রাশেদা সুলতানা। এর আগে তিনি সিভিল এভিয়েশন অথরিটির সহকারী পরিচালকের (নিরাপত্তার) দায়িত্বে ছিলেন। তার দায়িত্ব গ্রহণের পর সমন্বয়হীনতা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এএপিবিএন)জানিয়েছে, প্রায় ১১শ’ এএপিবিএন সদস্য শাহজালালে দায়িত্ব পালন করছেন। ৫০ জন অস্ত্রধারীসহ ৭০৩ জন সদস্য বিমানবন্দরে কাজ করছে বলে জানিয়েছে আনসার। তবে সিভিল এভিয়েশনের অধীনে এভিয়েশন সিকিউরিটি গার্ড ও । অ্যাভসেক-এ কত জন কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন এ তথ্য জানায়নি কর্তৃপক্ষ। সিভিল এভিয়েশনের সদস্য (অপারশেন)মুস্তাফিজুর রহমানের বরাত দিয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তার বিষয়টি গোপনীয়, এটি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, অ্যাভসেকে প্রায় ২৩৭জন এবং এভিয়েশন সিকিউরিটি গার্ডে ৫৭০ জন সদস্য রয়েছে।

নিরাপত্তায় সমন্বয়হীনতা প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আর্মড পুলিশের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিরাপত্তার ধরণ অনুসারে দায়িত্বও ভিন্ন। আমাদের লোকবল সংকট থাকা সত্ত্বেও পুলিশের সদস্যরা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে সিভিল এভিয়েশন আমাদের নিজেদের লোক মনে করে না, প্রতিপক্ষ ভাবে। ফলে তাদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এছাড়া, সিভিল এভিয়েশনের কিছু কর্মী অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এপিবিএন তাদের আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দিয়েছে। তারা চোখের সামনে অপরাধ করলে ছেড়ে দেওয়ার কোনও কারণ নেই। এসব কারণেও সিভিল এভিয়েশনের কর্মীরা এপিবিএনকে প্রতিপক্ষ ভাবে। শুরুর দিকে সিভিল এভিয়েশন এপিবিএনের কিছু সদস্যের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেও এখন সেটি করা হয় না।

অন্যদিকে সিভিল এভিয়েশনের এক কর্মকর্তা বলেন, নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশনের।সিভিল এভিয়েশনে লোকবলের সংকট বলেই অ্যাভসেক ও আনসার সদস্যদের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। একমাত্র সিভিল এভিয়েশন সিকিউরিটি গার্ড সদস্যরা চাকরিকালীন পুরো সময় দেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন।

বিমানবাহিনী,পুলিশ এবং আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত অ্যাভসেক সদস্যরা নির্ষ্ট সময় শেষে নিজ বাহিনীতে ফিরে যাবেন। সিভিল এভিয়েশনের কর্মীরা বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত হলেও তাদের সুযোগ সুবিধা কম। অন্য বাহিনীর সদস্যরা কাজ যা-ই করুক, বেশি সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন।

সূত্র জানায়,বিমানবন্দরে এক যুবক ছুরি নিয়ে হামলার পর গত ৮ নভেম্বর নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থাসমূহের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। বৈঠকে বাহিনীগুলোর সমন্বয়হীনতার বিষয়টি তুলে ধরেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা।

এপিবিএন-এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) রাশেদুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি বলবো না সমন্বয় নেই। সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুসারে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।বিমানবন্দরের নিরাপত্তার পাশাপাশি জননিরাপত্তার জন্য প্রত্যেক এপিবিএন সদস্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কেউ যদি বলে সমন্বয় নেই, তবে সেটা তার ব্যক্তিগত সমস্যা।’

এ প্রসঙ্গে শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক কেএম জাকির হাসান বলেন, ‘সারা বিশ্বে বিমানবন্দরের বহিরাঙ্গনের প্রটেকশন দেয় পুলিশ। বহিরাঙ্গনের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব এপিবিএনের হলেও তারা হামলাকারীকে থামাতে পারেনি। আমাদের এভিয়েশন গার্ডরা নিরস্ত্র। তারাতো ছুরি হাতে একটা লোককে থামাতে পারবেন না। এপিবিএনের হাবার্ড বোর্ড আছে, ইন্টিলিজেন্স আছে, ক্রাইসিস রেসপন্স টিম আছে, এগুলো থাকা সত্ত্বেও তারা ঠেকাতে পারেনি।’

বাহিনীগুলোর সমন্বয় প্রসঙ্গে জাকির হাসান বলেন,‘বিমানবন্দরের গেটগুলোতে আগে দেখতাম দুজন এপিবিএন সদস্য থাকতেন। এখন একজন করে আছেন। তারা যদি লোক কমিয়ে ফেলে আমার কী করতে পারি।এপিবিএনকে বারবার চিঠি দিয়ে বলেছি, তাদের কোথায় কত লোক আছে জানাতে,মাঝে মাঝে জানালেও সব সময় তারা জানায় না। ফলে বোঝার উপায় থাকে না, কোথায় কত লোক আছে। এপিবিএন তো আমাদের অধিনস্ত না। চাইলেই অ্যাকশ্যান নিতে পারি না। শাহজালালের নিরাপত্তার সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব একজন ব্যক্তিকে দিতে হবে।তা না হলে এমন ঘটনা ঘটবে।’

অ্যাভসেক প্রসঙ্গে জাকির হাসান বলেন, ‘আমাদের তো লোকবলের সংকট, তাই বিশেষ প্রয়োজনে তিন বাহিনী থেকে আসছে অ্যাভসেক সদস্যরা। রেডলাইন এর মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’

বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীগুলোর সমন্বয়হীনতার বিষয়ে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এহসানুল গণি চৌধুরী ও সদস্য (অপারশেন)মুস্তাফিজুর রহমানের কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিমান ও সিএ উইং) আবুল হাসনাত মো. জিয়াউল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বাংলাদেশ (সিএএবি) এর চেয়ারম্যানকে বলেছি তিনি যেন এ বিষয়ে উদ্যোগ নেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেউ যেন কমপ্লেক্সে না ভোগে, সে ব্যাপারে শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালককেও বলা হয়েছে।’

পদ মর্যাদার সমতা প্রসঙ্গে জিয়াউল হক হটনিউজ২৪বিডিকে বলেন, ‘সিভিল এভিয়েশনে নতুন জনবল কাঠামোতে (অর্গানোগ্রাম)শাহজালালের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার পদ মর্যাদা পরিচালক এবং শাহজালালের পরিচালকের পদ মর্যাদা নির্বাহী পরিচালকে উন্নীত করা হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে এটি বাস্তাবয়ন হলে সব কিছু বদলে যাবে।’

লোকবল সংকট প্রসঙ্গে জিয়াউল হক বলেন,‘প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কর্মীর জন্য সিভিল এভিয়েশনের নতুন জনবল কাঠামোতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।নিয়োগ বিধি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এটি হলে লোকবল সংকট কেটে যাবে।’

অ্যাভসেক প্রসঙ্গে জিয়াউল হক বলেন, ‘নতুন জনবল কাঠামো কার্যকর হলে তখন বিবেচনা করা হবে, অ্যাভসেকের আর প্রয়োজন আছে কি নেই। তবে আমরা বারবার বলেছি, অ্যাভসেকে যাদের পদায়ন করা হয়েছে, তাদের যেন অন্তত দুই বছর রাখা হয়। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে অনুরোধ করেছি। এর বেশি কিছুতো আমাদের করার থাকে না।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top