সকল মেনু

নিরক্ষর ও দারিদ্রমুক্ত দেশ গড়তে যশোরের ইবাদ আলীর অভিনব স্কুল

unnamedআব্দুল ওয়াহাব মুকুল, যশোর প্রতিনিধি: যশোর সদর উপজেলাধীন ১২নং ফতেপুর ইউনিয়নস্থ ফতেপুর গ্রামে ইবাদ আলীর বাড়ি। তাঁর বয়স এখন তিরিশ। সে স্বপ্ন দেখে এদেশকে একদিন নিরক্ষরমুক্ত করবে। সেই স্বপ্নকে বুকে বেঁধে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত এবং দারিদ্র মুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছেন ইবাদ আলী। চালু করেছেন জ্ঞানের মেলা স্কুল।
ইবাদ আলীর স্কুলের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। নির্ধারিত জায়গাও নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো বয়স-সীমাও নেই। সেই সাথে শিক্ষকদের যোগ্যতারও কোন মাপকাঠি নাই। আর এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হলো একটি বই।
ইবাদ অক্ষর পরিচয়ের নতুন একটি মডেল উদ্ভাবন করেছেন, নাম গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেল। নতুন রকমে একটি বইও লিখেছেন, নাম গণশিক্ষার প্রথম পাঠ। যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করেন তিনি। কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের বিরুদ্ধেও প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খাদ্য প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতকোত্তর।
২০১১ সালে লেখাপড়া শেষ করে রাজবাড়ি এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইবাদ কাজ নেন। ইবাদ আলী বলেন, কাজ করার সময় দেখেছি যেসব মহিলা স্বাক্ষর করতে পারেন না, তারাই বেশি গরিব। বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে গবেষণা করি। জানতে পারি, লেখাপড়া বিষয়ে কুসংস্কার আছে মহিলাদের। তাছাড়া তাঁরা গৃহস্থালি কাজে এতো ব্যস্ত থাকে যে কোথাও গিয়ে পড়ার মতো সময় তাদের হাতে থাকে না। আমি ভাবতে থাকি, উপায় খুঁজতে থাকি। গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেলের সূচনা সেসব দিনেই। ২০১৪ সালে ২৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের বড়দাসপাড়া গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে মডেলটি চালু করি। অল্প সময়ের মধ্যে বড়দাসপাড়াসহ কুমারগাতি, কালিয়ানিকান্দা, দক্ষিণ ভাটপাড়া দিপচর গ্রামের ৮০০ মানুষকে এই মডেলে যুক্ত করি এবং তাঁরা নিরক্ষরতা থেকে রেহাই পায়।

unnamed
তার উদ্ভাবিত গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেলে কাজ করার জন্য প্রথমে একটি গ্রাম বেছে নেওয়া হয়। এরপর একটি পরিবার থেকে একজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যসহ পাঁচজনকে ‘গণশিক্ষার প্রথম পাঠ’ বইটি পড়ান তিনি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যখনই সময় হয় তখনই ক্লাস হয়। পুরো গ্রামে দুইজন পর্যবেক্ষক থাকেন। তাঁরা সপ্তাহে সপ্তাহে ইবাদের কাছে রিপোর্ট করেন। প্রতিদিন দুইটি অক্ষর পড়া ও লেখা শেখানো হয়। পরীক্ষা হয় প্রতি মাসে। পাঁচ মাস পর সনদ দেওয়া হয়। গ্রামে একটি সেন্টার থাকে। সেখানে শিক্ষকদের ১৫ দিন পর পর একটি সমাবেশ হয়। তাঁদের সঙ্গে বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা ইত্যাদি বিষয়ের কুফল সম্পর্কেও আলোচনা করা হয় এবং শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদেরকে সেসকল বিষয়ে জ্ঞান দান করে।
তার ছাপা গণশিক্ষার প্রথম পাঠ বইটি যেকোন নিরক্ষর লোকও পড়তে পারে। বইয়ের বাম পাশের ছবির প্রথম উচ্চারিত ধ্বনিই হচ্ছে ডান পাশের বর্ণ। যেমন বইটির বাম পাশে যখন কলস ও কলমের ছবি তখন ডানপাশে থাকে ‘ক’ বর্ণটি। নিরক্ষর লোকের তাই শিখতে বেশি কষ্ট হয় না। কলম, কলসের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সাথে সাথে ক দিয়ে কাক, কদবেল, কালি ও কোকিলের মতো শব্দও বানাতে পারেন। এভাবে খরগোশ আর খবরের ছবি দেখে ‘খ’ পড়া, ঘড়ি ও ঘরের ছবি দেখে ‘ঘ’ পড়া হয়ে যায়। ২০ পৃষ্ঠার রঙিন এই বইটি ৯০০ কপি ছেপেছেন ইবাদ। বইটির দাম নির্ধারণ হয়েছে ২০ টাকা। বইয়ের সঙ্গে বিনামূল্যে একটি খাতাও দেওয়া হয়।
যশোর সদর উপজেলার একটি গ্রাম সিতারামপুর। সেখানকার ঋষি পাড়ার ১০০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে ১৫ জুলাই থেকে ইবাদের গণশিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ৬০ জন নারী, ৪০ জন পুরুষ। শিক্ষার্থীদের বয়স ১৮ থেকে ৭০। তাঁদের কেউ দিনমজুর, কেউবা রিকশা চালক আবার গৃহবধূ আর শ্রমিকও আছেন। ওই গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে ঘরের বারান্দায়, বাঁশ বাগানের ছায়ায়, উঠানে, রাস্তার পাশে, স্কুল মাঠে সকাল, দুপুুর, বিকেল বা সন্ধ্যায় ক্লাস চলছে। আকাশ নামের গ্রামের এক কিশোর পড়েছে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। এখন সে তার রিকশাচালক বাবা রাফায়েল, মা লক্ষ্মীরানী, মামা পলাশ ও দিদি ফুলমালাকে পড়াচ্ছে। আকাশ বলল, বাবাকে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে। বাবা রাফায়েল বললেন, লেখাপড়া না শিখে ভুল করেছি। এখন ছেলের কাছে লেখাপড়া শিখছি। একটু লজ্জা লাগলেও ভালই লাগছে। এই গ্রামের বিশ্বাস বাড়ির বউ পুষ্প বিশ্বাস এখন শ্বশুর, শাশুড়ি আর স্বামীকে পড়াচ্ছে। এখন বাড়িতে আমার বেশ সম্মান।
সীতারামপুর গ্রামের মহিলা জনপ্রতিনিধি মোছাঃ আনোয়ারা রহমান আনুর কাছে ইবাদ আলীর এ গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেল সম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এই সীতারামপুর গ্রামটি খুবই অবহেলিত ছিল। এলাকার লোকজন নিরক্ষর তারা তাদের নাম লিখতে পারতনা বা দেখেও পড়তে পারত না। ইবাদের এই গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেল এর মাধ্যমে অনেক বয়স্ক লোকও তাদের নাম লিখতে পারছে সাথে সাথে পড়তেও পারছে। তাছাড়া তার এ পদ্ধতিতে বাড়িতে পড়াশোনা হচ্ছে কোন সময় বাধা নেই বলে যে যখন ইচ্ছা তার পড়া সেরে নিতে পারছে। আর শিক্ষক দেখা যাচ্ছে সেই বাড়ির ছেলে মেয়ে কিংবা তাদেরই বৌমারা। যার ফলে অভিভাবকরা তাদের সর্বস্ব মেধা খাটিয়ে পড়া প্রস্তুত করতে চেষ্টা করছে। আমরা এতদিন দেখেছি বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের পড়িয়েছে কিন্তু এখন সন্তানেরা তাদের বাবা মাকে পড়াচ্ছে। এ পদ্ধতিতে গ্রামের অনেক লোক আজ নিরক্ষর মুক্ত হতে চলেছে। ইবাদ আলীর এই কর্মকান্ড আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি প্রায়ই গ্রামের ঐসকল বাড়িতে গিয়ে গিয়ে তাদের পড়াশোনার খোজ খবর নিই। আমি আশা করি ইবাদ তার এই কর্মে নিশ্চই একদিন সফল হবে।
ইবাদের বাবা ছিলেন দিনমজুর। সংসারে খুব টানাটানি ছিল। নিজেও বাবার সঙ্গে দিনমজুরি করতেন। কিন্তু লেখাপড়ার আগ্রহ ছিল বলে ১২ বছর বয়সকালে ব্র্যাক স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন। তারপর পড়াশোনার পাশাপাশি কাজও চালিয়ে গেছেন। এখন যশোরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তাঁর গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেল এগিয়ে নিতে বন্ধুরা ৪৪ হাজার টাকা দিয়েছে কয়েক দফায়।
ইবাদ বলছিলেন, ‘আমার মডেলে প্রতি ১০০জন ছাত্রের নিরক্ষরতা দূর করার জন্য ৩০ হাজার টাকার প্রয়োজন’। তাছাড়া এই মডেলের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে পুরো দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত করা যাবে সাথে বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান এবং অসহায় দরিদ্রদের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
তার নিজ গ্রাম ফতেপুরে কোন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন কিনা এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ফতেপুরে ৬০০ এর অধিক নিরক্ষর লোক আছে। তার গ্রামে এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রায় দুই লক্ষাধিক টাকার প্রয়োজন। এ বৃহৎ অংকের টাকা তার কাছে না থাকায় সে এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। তবে তিনি হাল ছাড়ছেন না। তিনি তার স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ চালিয়ে যাবেন বলে তিনি আশা করেন। তিনি তার কার্যক্রম অব্যহত রাখার জন্য বন্ধুদের পাশাপাশি সরকারি সহযোগিতা কামনা করেন।
তাছাড়া বাংলাদেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে ইবাদ আলীর এই গণশিক্ষার নতুন পদ্ধতির কার্যক্রমকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেবে সরকার, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সকলে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top