সকল মেনু

চোখের জলের সাথে বন্যার জল একাকার হয়ে গেছে

monirampur-waterlock-3মণিরামপুরের বানভাসি অঞ্চল ঘুরে এসে যশোর প্রতিনিধি, আব্দুল ওয়াহাব মুকুল: গত তিন দিন বৃষ্টি না হলেও মণিরামপুরে জলাবদ্ধতার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং হরিহর নদীর পানি উপচে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির সংকট, নোংরা ও বিশাক্ত পরিবেশের মধ্যে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত আদম সন্তানের চোখের জলের সাথে বন্যার জল একাকার হয়ে গেছে। দুধ নেই উপবাসী মায়ের বুকে, তাইতো ক্ষুধায় ছটপট করছে শিশুরা। শুরু হয়েছে পেটের পীড়া ও পানি বাহিত রোগ।
পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকতে না পেরে সরকারি রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ শতাধিক পরিবার। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া লোকের সংখ্যা বাড়ছে।
গত চার দিন ধরে পানিবন্দি হাজারো মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করলেও সরকারি সাহায্য পৌঁছেছে না বল্লেই চলে। সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতার শুধুই আশ্বাস দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক এক প্রকার চুপ রয়েছেন। ফলে ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষেভ বাড়ছে।
নিম্নচাপের প্রভাবে গত মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে মণিরামপুরের সব এলাকার খালবিল, ডোবা, পুকুর ভেসে একাকার হয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ে উপজেলার মনোহরপুর, ঝাঁপা, দুর্বাডাঙ্গা, মশ্মিমনগর, হরিহরনগর, কুলটিয়া, শ্যামকুড়, হরিদাসকাটি ইউনিয়নসহ আশপাশের অনেক গ্রামের হাজারো পরিবার। বসতঘর ও রান্নাঘরে পানি উঠে যাওয়ায় গত চার দিন ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে রয়েছেন পানিবন্দি মানুষেরা। প্রবল বর্ষণে এলাকাগুলোতে টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকটও দেখা দিয়েছে।
এলাকাবাসী বলছেন, সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের। হরিহর নদীতে পলি জমাসহ অবৈধ পাটার কারণে পানি নামতে পারছে না। ফলে নদী উপচে পানি ঢুকে পড়েছে ইউনিয়নের চিনেটোলা, ফকির রাস্তা, হাসাডাঙ্গা, শ্যামকুড়, নাগোরঘোপ ও জামলা গ্রামের অনেক এলাকায়। এতে প্রায় ছয় হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘরের মধ্যে মানুষের পাশাপাশি আশ্রয় হয়েছে সাপ, পোকা-মাকড়ের। পানিবন্দি হয়ে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ রয়েছে ইউনিয়নের প্রায় বিশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে পানি ঢুকে ধর্মীয় ক্রিয়াদি বন্ধ হয়ে গেছে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও ভেতরে হাঁটুপানি থাকায় চিকিৎসাসেবাও বন্ধ। এলাকার কোনো কোনো পাকা সড়কের ওপর দিয়ে প্রায় এক ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হওয়ায় ছোট যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শনিবার দুপুরের দিকে চিনাটোলা বাজার-সংলগ্ন রাস্তার ওপর জাল ফেলে গ্রামবাসীকে মাছ শিকার করতে দেখা যায়।
এদিকে, পানি না কমে বরং বেড়ে যাওয়ায় উপায় না দেখে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সবকিছু নিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের দুই ধারে চিনাটোলা বাজার থেকে কেশবপুর পর্যন্ত ইতিমধ্যে পাঁচ শতাধিক পরিবার বাঁশ, পাটকাঠি, পলিথিন দিয়ে ঘর বেঁধে আশ্রয় নিয়েছে।
উদ্বাস্তু হয়ে পড়া এসব মানুষ শনিবার দুপুরে জানান, তারা এখনো পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণ বা সহযোগিতা পাননি। তবে গত শনিবার বিকেলে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদের নেতৃত্বে সরকারি কর্মকর্তারা জানান দিতে কিছু ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলেন।
রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া চিনাটোলা গ্রামের রোকেয়া বলেন, বাড়িতে বুক সমান পানি। ৫-৬ দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। বাড়িতে টিকতে না পেরে পরিবারসমেত শুক্রবার এখানে (রাস্তায়) আশ্রয় নিইছি। তবে এই পর্যন্ত কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি।
সড়কে আশ্রয় নেওয়া খাদিজা নামে আরেক বয়োবৃদ্ধা বলেন, ছেলে, বউ, নাতি-পুতিসহ ১৮ জনকে নিয়ে রাস্তায় উঠিছি। সকাল থেকে সবাই না খাওয়া। রাস্তার অস্থায়ী বাসিন্দা বদিউজ্জামান বলেন, শুরু হয়েছে পেটের পীড়া ও পানি বাহিত রোগ। পানিবন্দি থাকায় চিকিৎসা না পেয়ে বাছুর হতে গিয়ে রাতে পাশের জলিলের একটা গাভি মারা গেছে।
তিনি বলেন, সরকারি সহযোগিতা পাবো কি-না জানি না। তবে আশ্রয় নেওয়া লোকগুলোর জন্য অস্থায়ী কয়টি টয়লেট স্থাপনের দাবি আমাদের।
এরআগে কখনো এমন পরিস্থিতি হয়েছে কি-না জানতে চাইলে রাস্তার অস্থায়ী বাসিন্দারা জানান, ১৯৮৮ সাল ও ২০০৪ সালসহ এই নিয়ে তিনবার তাদের বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় আশ্রয় নিতে হয়েছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনি জানান, হরিহর নদীতে পলি জমায় ও পাটা থাকায় পানি নামতে পারছে না। বরং উজান ঢলে ইউনিয়নের প্রায় ছয় হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এই পর্যন্ত প্রায় ৫০০ পরিবার রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে কষ্টে থাকলেও সম্মানের দিকে তাকিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিতে পারছেন না।
কোনো সহযোগিতা দিতে পেরেছেন কি-না জানতে চাইলে শনিবার দুপুরে তিনি বলেন, এমপি স্বপন ভট্টাচার্য্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু পরিস্থিতি দেখে গেছেন। তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০০ পরিবারকে দশ কেজি করে চাল, এক কেজি করে ডাল ও এক কেজি করে আলু বিতরণ করা হবে বলে চেয়ারম্যান শুনেছেন বলে জানান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top