মুস্তাক মুহাম্মদ: প্রত্যেক কবি তাঁর সমসাময়িক সময়ের প্রতিনিধি।তাঁর কবিতা তাঁর সমসাময়িক সময়ের আর্থ – সামাজিক ,রাজনীতি -দর্শন,সংগতি – অসংগতি,সংস্কৃতি এক কথায় গোটা সমাজ ব্যবস্থার নিটুট চিত্রর অখ- দলিল।কবি কাজী রকিবুল ইসলাম একুশ শতকের এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।সিমান্তরক্ষী বাহিনীতে থাকাকালীন তিনি বিনিদ্র আঁখিতে দেশকে রক্ষার জন্য যেমন সাহসিকতার দেখিয়েছেন তেমনি অবসারকালীন সময়ে এখনো তিনি একজন সাহসী সৈনিক।হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। লিখছেন অবিশ্রান্তভাবে তার দেশ প্রেমিক হৃদয় -তীক্ষ চোখ অর্ দৃষ্টি দিয়ে দেখছেন সমাজকে। সমাঝের কোথাও অসংগতি দেখলে প্রতিবাদ করেছেন ।এই প্রতিবাদী সমাজ সচেতন কবি কবিতার জগতে নবীন হলেও তাঁর অভিজ্ঞতা সচেতনতা তার কবিতাকে করেছে ঋদ্ধ।প্রাঞ্জল সমসাময়িক শব্দের ব্যবহারে করে সমসাময়িক সমাজ চিত্রনে তিনি বিশেষ পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। তার কবিতা প্রতিবাদের তীব্র হাতিয়ার হয়েছে।তার প্রথম কবিতার বই “যাপিত যন্ত্রণা” এ তিনি অংগতিকে এমনভাবে তুলে এনেছেন যেন আঁতশ কাচে দেখার মত।তার প্রতিবাদী সত্ত্বা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।নজরুলের মত চরমে না যেতে পারলেও শাসক শ্রেণীর মনে ভীতির সঞ্চয় করে। সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর তার কবিতা । মোট ৬৪ টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হলো কাব্যগ্রস্থটি।কবিতাগুলোতে ২০১০ থেকে চলমান সময়ের নানা অংগতির নিখুঁত কাব্যিক বিন্যাস লক্ষ্য করার মত।দল মতের ঊর্ধে কলমকে শানিত করে তুলেছেন।মানবতা যেখানে লংঘিত সেখানেই তিনি সোচ্চার প্রতিবাদী।মুক্ত গদ্য ছন্দে লেখা কবিতাগুলো পড়লে শিহরণ জাগে।মনে হয় তিনি তো আমাদের কথাই লিখেছেন ।আমাদের চারপাশের ঘটে যাওয়া পরিচিত ঘটনা নিয়েই যেনো তার কারবার ।বইয়ের সূচনা কবিতাটি আমাদেরে ভাবিত করে।কী বাস্তবতা না তিনি লিখেছেন ! সরকারী দল জনগণের জন্য কাজের আড়ালে স্বর্থ হাসিল করছে । অন্যদিকে বিরুধী দল গণতন্ত্রর সামান্যতম চর্চা হচ্ছে না দেখে রাজপথে চরম আন্দোলন সংগ্রাম করছে। পেট্রোল ককটেলে দিশেহারা জনগণ।আসলে গণতন্ত্রের নামে সার্থতন্ত্র চলছে। আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় নিরাপত্তাহীনতায় জনগণ । কখনো কখনো প্রাণ দিতে হচ্ছে জনগণের।যে জনগণ নিয়ে এত টানাটানি সেই জনগন কেনো নিরাপত্তাহনিতায় ভুগছে? কেনো জীবন দিতে হচ্ছে জনগণকে ? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? আর জনগণ যাবে কোথায়? এদিকে জনগণের জান মাল রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসন চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। হঠকারী অপরাধীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রশাসন পুরস্কার ঘোষণা দিচ্ছে। জনগণ যদি সন্ত্রাসীদের ধরে দেয় তাহলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশাসন পোষার কি দরকার? গণতরÍ্র রক্ষার নামে শাসক দল Ñ বিরোধী দলের দরদ উতলে পড়ছে অথচ মধ্যদিয়ে যা ভোগার দরকার তা জনগণ ভুগছে। এমনই অসঙ্গতির বিরুদ্ধে শানিত কলম তালিয়েছেন কবি।এ প্রসঙ্গে“পাবলিক তুমি কার”কবিতার কয়েকটি ছত্র উল্লেখ করছি Ñ
“পাবলিক তুমি কার?/সবাই বলে তুমি আমার।।/তাহলে তুমি কেন খাচ্ছো মার!/একদল ক্রসফায়ারের নামে খরচ করে কার?/অন্য দল পেট্রোল বোমা মারে রুহু কবজ করে কার? কার? কার? কার? কার/.
ছলে বলে কৌশলে, ক্ষমতা চায় সকলে/পাবলিক ভোগে নিত্যনতুন ধকলে।/
পাবলিকের দুই দিকেই বাজে মৃত্যুর বেল/আপন-পর চিনতে করো না ফেল/পেট্রোল বোমা মারে-মারে ককটেল/পাবলিক ছোটে পাগলের মত,/শেষে করে হার্টফেল
সন্ত্রাসিরে ধরে দিলে দেবে পুরষ্কার,/অকর্মারা কথা বলে, তারে করে না কেউ তিরষ্কার!”
মুখে মধু অন্তরে বিষ রেখে প্রতিবেশি রাষ্ট্র আমাদেরকে বঞ্চিচ করছে ।দুই দেশের আন্ত নদী মুখে বাঁধ দিয়ে আমাদের নদীগুলো পানি ক্ষরায় ধুকছে।খর¯্রােতা সেই নদী গতি হারিয়ে আজ ঐতিয্য হারা।টিপায় মুখে বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধের ফলে আমরা তীব্র ক্ষরায় ভুগছি সে বিষয়ে গা এড়িয়ে চলছে কর্তৃস্থানীয়রা আর দেশের ভেতর উদ্ভট আইন জারি করছে। সেই সব হঠকারী সিদ্ধান্তের ক্ষতিকার প্রভাব পড়ছে জনগণর উপরে।এক টাকা দুই টাকা হঠাৎ অচল করে পাঁচ টাকার মুদ্রা ঘোষণা করলো জনগণের উপরে।কিন্তু এর পেছনে যত ক্ষতি হবে তা পুরণ করবে কে? এই সব হঠকারী সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ দেখি এভাবে
“
গচ্ছিত গণতন্ত্র কবে মজবুত হবে?/গচ্ছিত গণতন্ত্র কবে মজবুত হবে?/এক সময়ের খর¯্রােতা গোমতী নদী শুকিয়ে হয়েছে খাল/এখন আর দেখা যায় না সারি সারি নৌকার পাল/চোখে পড়ে না দল বেঁধে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধরা মাছ ধরতে ফেলছে জাল জা/হারিয়ে গেছে কুনি, পাছন, বের, উতার জাল/নেই আর উজান ভাটির মুখে দুই বাঁশে বাঁধা তিন কোনার ভেল জাল।/নে নদীর মুখে ছোট বড় অসংখ্য ফারাক্কার বাঁধ/পানি বিহীন উন্নয়নে বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে মিলাতে পারি না কাঁধে কাঁধ।/নেতা নেত্রীর কথার ঝুলিতে আটকে থাকে সাধ/বাস্তব জ্ঞানহীন নেতা-নেত্রী দেশটা করল বরবাদ।/বোকা-পাঠা-মিনসে, হিসাব করছে পাঁচ থেকে/এক দুই তিন চার সংখ্যার হিসাব কে দেবে?/পাবলিক শুধু গচ্চা দেবে/এই দেশ কবে সোনার বাংলা হবে/গচ্ছিত গণতন্ত্র কবে মজবুত হবে?”
(কবে হবে)
এভাবে দেশের ভেতওে ঘটে যাওয়া অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন কবি। যেমন তিনি লিখেছেন পহেলা বৈশাখে ঘটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন কেলেঙ্কারী,বৈশাখে মেকি বাঙালিপনা,সরকারী ঘোষণা আছে কিন্তু বিদ্যুতের আকাল –অবৈধ সংযোগ,মানব পাচার সমস্যা,নারী নির্যাতন,করিডোর -বাণিজ্য,অজ্ঞান পার্টি সমস্যা ,যৌতুক প্রথার কুফল,নেতাদের দুমুখো – স্বার্থপর নীতি মোবাইলের মাধ্যমে ঘটিত বিভিন্ন অপকর্ম,ভ- নারীবাধীদেও অপকর্ম,আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব,চাঁদাবাজী , অফিসে অফিসে ঘুষ,অনৈতিক সম্পর্ক -প্রেমের নামে প্রতারণা ,কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে,ডাক্তার -ক্লিনিকের ব্যবসা ,মুক্তিযোদ্ধা -বীরঙ্গনাদের যথার্থ সম্মানের অভাব,মাদকের কুফল,বিরোধী নেতার ¤্রয়িমাণ ভাব,প্রযুক্তি অপব্যবহার,যুদ্ধাপরাধীধের বিচার ও তাদেও দোসরদের অপতৎপরতা,নদী দখল,চাপাবাজি – দুর্নীতি, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাস,দ্রব্যমূল্যের ঊধ্বগতি,ক্রস ফায়ার,কর্মসংস্থানের অভাব –ভুয়া সনদে চাকুরী,নেতা নেত্রীদের কাদা ছোড়াছুরি,মৃত্যু চেতনা,ঋতু পরিবর্তন,ভালোবাসা।এই সব ঘটনা আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা।আর আমাদের কথায় কবিতায় জোড়ালোভাবে কবি তুলে এনে মু¯িœয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত।তিনি “মজুদ আমার শির ” কবিতায় লিখেছেন –
ওহে বীর, তোমার জন্য মজুদ আমার শির
বিজয়ের মাসে তোমাকে শত-সহস্র কোটি সালাম
তোমার গৌরব চিরদিন রবে অম্লান
তুমি মুক্তিযোদ্ধা, তুমি বীর, তোমার জন্য মজুদ আমার শির।”
সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি ঈশ্বরে কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন।দেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা করার জন্য তার এই আকুতি ।কবি আত্মসচেতনতায় প্রবল ।কথা ও কাজে তিনি এক ।কর্মের মাধ্যমে তিনি দেশকে সেবা করে যেতে চান ।তাই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে দেশ থেকে জঞ্জাল সরাতে সদা প্রস্তুত।এজন্য ।ঈশ্বরের সাহায্যও নিজের শক্তি বিনিয়োগ করে বসবাসযোগ্য ডিজিটাল সোনার বাঙলা গড়ার জন্য আতংকিত কবি ‘রক্ষা কর সৃষ্টিকর্তা’শিরোনামে লিখেছেন -“
চতুপার্শ্বের কীট পতঙ্গ
কাটছে সকাল-দুপুর-বিকেল সঙ্গ
আমার কলিজার টুকরা এই পৃথিবীতে এসে
এত পোকার বিষ নিয়ে
টিকে থাকতে পারবে কি শেষে?
রক্ষা কর সৃষ্টিকর্তা
আমার অবুঝ শিশুটিকে।”
কাব্যগ্রন্থের প্রত্যেকটি কবিতায় কবির অর্ন্তাত্মার প্রবল শক্তির প্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মত।সুস্থ সমৃদ্ধ সুখি সমাজ প্রত্যেক দেশ প্রেমিক নাগরিকের কাম্য। সেই দায়িত্ববোধ থেকে সমাজের তলানি থেকে উচ্চস্তরে গোয়েন্দাপ্রবর চোখ নিয়ে এগিয়ে তিনি অংগতিগুলো কাব্যিকভাবে তুলে ধরেছেন। তার কবিতা পাঠ করা মানে চলমান সমাজকে পাঠ করা।সমাজের অকাঠ্য দলিল – দর্পন তার কবিতা।বিষয় বস্তু নির্বাচনে তার অন্তদৃষ্টি,প্রকাশ ভঙ্গির সাবলিলতা,বক্তব্যর স্পষ্টতা,সমমাময়িক প্রচলিত শব্দের ব্যবহার,স্বতন্ত্র বাচনিক ভঙ্গিতে প্রতিবাদী কবিতাগুলো পাঠকের মর্মে স্পর্শ করবে।
যাপিত যন্ত্রণা
কাজী রকিবুল ইসলাম
প্রচ্ছদ:ডা: মধুসূদন অধিকারী
প্রকাশকাল:বইমেলা ২০১৬
প্রকাশক:কাজী হাবিবা খাতুন
মূল্য:১৫০টাকা মাত্র
…………………………
যোগাযোগ
মুস্তাক মুহাম্মদ
কারুকাজ, কেশব লাল রোড, যশোর – ৭৪০০
মোবাইল নং ০১৯১৬৮৮৩৪৩৮
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।