সকল মেনু

হারিয়ে যাচ্ছে মিঠা পানির দেশি মাছ

৪০.নিজস্ব প্রতিবেদক, হটনিউজ২৪বিডি.কম ১২ মার্চ : হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির অনেক স্বাদু বা মিঠা পানির মাছ। কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, শিল্প-কারখানার বর্জ্য-দুষণ, অতিরিক্ত মত্স্য আহরণ, নিষিদ্ধ কারেন্ট ও বাদাই জালের ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, ৫৪ প্রজাতির মাছ চরম বিপন্ন।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যে হারে দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে হচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের নদ-নদীতে মাছের আকাল পড়বে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর জমিতে যে বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তার সিংহভাগ মুক্ত জলাশয়ে চলে আসে। এতে মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়া কারেন্ট জাল ও বাদাই জাল দিয়ে এক শ্রেণীর জেলে (চলনবিল এলাকায় যাদের ‘সাবার বাহিনী’ বলা হয়) নদী-নালা খাল-বিল-হাওর থেকে দলবেঁধে হানা দিয়ে ছেঁকে তুলে নিচ্ছে পোনামাছ, মা মাছ আর মাছের প্রজননকালীন উপাদেয় খাদ্য ক্ষুদে জলজ উপজীব ও প্রাণি। মাছের বংশবিস্তারে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।

সমপ্রতি সরেজমিনে সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর জেলার বিশাল অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত চলনবিল এলাকায় গিয়ে ‘সাবাড় বাহিনীর’ মাছ ধরার চিত্র দেখা যায়। তারা রাতের অন্ধকারে মাছ ধরছে। চলনবিলের মধ্যবর্তী সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি বাজারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মত্স্য ব্যবসায়ী জানান, চলনবিল এলাকার ১৭টি নদী ২২টি প্রাকৃতিক খাল ও ৩৯টি বিলে ৩/৪’শ পয়েন্টে ২/৩ হাজার বাদাই জাল দিয়ে সাবাড় বাহিনী মধ্যরাত থেকে ফজরের আযানের পূর্ব পর্যন্ত রেণু পোনা, পোনামাছ ও ডিমওয়ালা মা মাছ শিকার করে। এভাবে প্রতিদিন শত শত মণ পোনামাছ নিধন করা হচ্ছে। এছাড়াও নষ্ট হচ্ছে জাল ঝেড়ে ফেলে দেয়া অসংখ্য জলজ ক্ষুদ্র প্রাণি। তিনি বলেন, একটি ছোট বাদাই জাল তৈরি করতেও ৬০ হাজার টাকা থেকে প্রায় একলাখ টাকা লাগে। অধিকাংশ মাছ শিকারী গরিব। এদেরকে এলাকার বিভিন্ন আড়ত থেকে বাদাই জাল তৈরির জন্য নগদ টাকা দাদন দেয়া হয়। দাদনের টাকা মাছ শিকারীদের মাছ থেকে কেটে নেয়া হয়। মহিষলুটি মত্স্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সদস্য আব্দুল মান্নান এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আগে এসব পোনামাছ আমাদের আড়তের মাধ্যমে পাইকারি বিক্রি হতো। এখন আমরা আর আড়তে ওসব মাছ উঠতে দেই না। তারা আশেপাশে বসে মাছ বিক্রি করে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, তাড়াশ উপজেলার মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের হামকুড়িয়া, শ্যামপুর, ঘরগ্রাম, আমবাড়িয়া, গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড়, চাটমোহরের বাগলবাড়ি, হান্ডিয়াল, বেলঘরিয়া, নবীন এলাকায় সাবাড় বাহিনীর তাণ্ডব বেশি। এরা বাদাইজাল দিয়ে বেড় দিয়ে পানি ছেঁকে মাছ শিকার করছে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি সড়কসেতুর ভাটিতে বানা দিয়ে বেড়িবাঁধ তৈরি করে। এতে বেড়িবাঁধের এপার-ওপার পানির উচ্চতা ২/৩ ফুট কম-বেশি হওয়ায় স্রোতের বেগ ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ফলে ঐ অঞ্চলের বিশাল জলাভূমির সমস্ত মাছ স্রোতের টানে গিয়ে পড়ে সোঁতির শেষ প্রান্তে পেতে রাখা মাছধরার জাল ও বিভিন্ন ফাঁদে। শামুক, কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ প্রাণীও এখানে নিধন হচ্ছে ব্যাপক হারে।

রায়গঞ্জের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুজ্জামান রাজু বলেন, বিভিন্ন হাট-বাজারে মাঝে-মধ্যেই দেখা যায় বোয়াল মাছের পোনা। এগুলো এত ছোট যে এক কেজিতে ১৫/২০টি পর্যন্ত ধরে। যা খাওয়ারও উপযুক্ত নয়। ৫/৬ মাস এসব মাছ সংরক্ষণ করা গেলে এর এক একটির ওজন হবে ২/৩ কেজি। যে পরিমাণ মাছ এখন এক কেজি হিসাবে বিক্রি হচ্ছে ৬ মাস পরে তার ওজন হতো কমপক্ষে এক মণ।

দেশের অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির মাছ আছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা ২০০০ সালে এর ৫৪ প্রজাতিকে বিপন্ন ঘোষণা করেছে।  ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রজাতির মাছগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেছে। সংকটাপন্ন, বিপন্ন, চরম বিপন্ন ও বিলুপ্ত। সংকটাপন্ন মাছের মধ্যে আছে ফলি, বামোশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, আইড়, গোলশা, কাজলি, গাং মাগুর, কুচিয়া, নামাচান্দা, মেনি, চ্যাং ও তারাবাইন। বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে আছে চিতল, টিলা, খোকশা, অ্যালং, কাশ খাইরা, কালাবাটা, ভাঙন, বাটা, কালীবাউশ, গনিয়া, ঢেলা, ভোল, দারকিনা, রানি, পুতুল, গুজা আইড়, টেংরা, কানিপাবদা, মধুপাবদা, পাবদা, শিলং, চেকা, একঠোঁট্টা, কুমিরের খিল, বিশতারা, নেফতানি, নাপিত কই, গজাল ও শালবাইন। চরম বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে আছে ভাঙন, বাটা, নান্দিনা, ঘোড়া মুইখ্যা, সরপুঁটি, মহাশোল, রিঠা, ঘাউড়া, বাছা, পাঙ্গাশ, বাঘাইড়, চেনুয়া ও টিলাশোল। আইইউসিএনের মতে, বাংলাদেশে বিলুপ্ত  প্রজাতির কোনো মাছ নেই।

তবে আইইউসিএন ২০০০ সালে বিভিন্ন মাছের তালিকা করার পর ২০০১ সালে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) পক্ষ থেকে দেশব্যাপী জরিপ করা হয়। তাতে দেখা যায়, অনেক মাছ আছে যেগুলো হরহামেশা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, আইইউসিএন সেগুলোকেও বিপন্ন হিসেবে দেখিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর মহাপরিচালক  ইয়াহিয়া মাহমুদ গতকাল ‘ইত্তেফাককে’ বলেন, তাদের গবেষণার দেখা গেছে, ৫৪ প্রজাতির মাছ চরম বিপন্ন। এই ৫৪ প্রজাতির সঙ্গে আইইউসিএনের অনেকগুলোর মিল নেই। তিনি বলেন, আরও ১২০ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে।
হটনিউজ২৪বিডি.কম/এআর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top