সকল মেনু

৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর মুক্ত দিবস

indexশাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর: ত্যাগ ও তিতিক্ষর মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ ৮ মা পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর শত্রুমুক্ত হয়। এর আগে ৬ ডিসেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর গভির রাত পর্যন্ত হাজীগঞ্জের বলাখাল এলাকায় পাক হানাদার বাহীণির দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। সে যুদ্ধে পাক হানাদার বাহীণি পরাজয় বরণ করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। চাঁদপুরের উপর দিয়ে নদী পথে তারা পালিয়ে যায়। তখন পাক হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল আব্দুর রহিম মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আহত হয়। মাঝ নদী থেকে হেলিকপ্টার যোগে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর সকালে মিত্র বাহিনীর টেঙ্কার  লে: কর্নেল সুট্টির নের্তৃত্বে চাঁদপুরে প্রবেশ করে। মিত্র বাহিনী চাঁদপুরে প্রবেশের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা চাঁদপুরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। ৭ ডিসেম্বর রাতে পাক হানাদার বাহিনী চাঁদপুর থেকে পালিয়ে যায়। প্রথমে চাঁদপুরের ততকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রাঙ্গনে ও পরে চাঁদপুর সদর থানা প্রাঙ্গনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এভাবেই ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর শত্রুমুক্ত করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরে ৫৮ টি স্থানে পাক বাহিণীর সাথে মুক্তিবাহিণীর সাথে যুদ্ধে অবতির্ণ হতে হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোহরাওয়ারর্দী  ময়দানের ভাষনের পর চাঁদপুরের মুক্তিকামী জনতা দেশকে স্বাধীনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলো।  সেজন্য আওয়ামীলীগের হয় নের্তৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। তার নের্তৃত্বে ছিলেন তৎকালীন প্রাদেশীক পরিষদের সদস্য আব্দুর রব, মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারী, মরহুম সিরাজুল ইসলাম, মরহুম অ্যাড.আবু জাফর মাইনুদ্দিন প্রমুখ। অন্য দিকে ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন সমন্ময়ে আরেকটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর নের্তৃত্বে ছিলেন, ন্যাপ নেতা আব্দুর রউফ, মরহুম অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুসছাত্তার, ফজলুর রহমান, মরহুম অ্যাড. আব্দুর রহমান, জীবন কানাই চক্রবর্তী, মরহুম অ্যাড.মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারী, মরহুম আব্দুল কাদের মাষ্টার, শহিদ্রল্লাহ মাষ্টার প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পর চাঁদপুর শহরের রেলওয়ে ১৪ কোয়ার্টার মাঠে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির গঠিত সংগ্রাম কমিটি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন শুরু করে। ৯ মার্চ থেকে তারা প্রশিক্ষন শুরুকরে। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ২ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা চৌদ্দ কোয়াটার মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষন শুরু করে। তাদের প্রশিক্ষন দেন তৎকালীন বিমান  বাহিণীর কর্মকর্তা মরহুম শাহ মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ বাচ্চু ও জীবন কানাই চক্রবর্তী। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাক বাহিণীর হামলা শুরু হলে চাঁদপুরে আওয়ামীলীগের নের্তৃত্বাধীন গঠিত সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষনের প্রস্তুতি গ্রহন করে। বর্তমান চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ ছাত্রী নিবাসে তখন স্থাপন করা হয় প্রশিক্ষন ক্যাম্প। তখন ঐ হোষ্টেলটি বিডি হল নামে পরিচিত ছিলো। বর্তমানে বিজয়মেলা ২৪ বছর যাবত যে  মাঠটিতে উদযাপিত হয়ে আসছে এ হাসানআলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠটিতে ২ এপ্রিল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন শুরু করে। প্রশিক্ষন প্রদান করেন মরহুম ফ্লাইট লে: অব: এবি সিদ্দিকী ও বিমান বাহিণীর তৎকালীন কর্মকর্তা মরহুম অ্যাড. সিরাজুল ইসলাম। প্রশিক্ষনে তাদের সহযোগীতা করেন,সুবেদার আব্দুর রব, সুবেদার জহিরুল হক পাঠান, আবতাব আহমেদ, সুবেদার আলী আকবর, ইপিআর ও আনসারের কয়েকজন কর্মকর্তা। এখান থেকে প্রশিক্ষস নিয়ে ৫ শতাধিত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষনে অংশ গ্রহন করেছিলো। ২৬ মার্চ সকালে প্রথম অস্ত্র সংগ্রহ করা হয় চা৭দপুর সদর থানা থেকে সংগ্রাম কমিটির সদস্য মরহুম অ্যাড. সিরাজুল  ইসলাম। তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ওয়াহিদুর রহমানের নের্তৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয় ব্যাক্তিগতভাবে। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল চাঁদপুর শহরের ট্রাক রোডস্থ পোদ্দার বাড়ীতে পাক হানাদার বাহিণীকে প্রতিহত করতে ছাত্র নেতারা গোলা বারুদ তৈরি করতে গেলে অসাবধানতার কারনে আবুল কালাম, আব্দুল খালেক, সুশিল ও শংকর শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল সকালে ২টি জেড বিমানের মাধ্যমে আকাশ পথে পাক হানাদার বাহিণী চাঁদপুরে আক্রমন চালায়। প্রথমে তারা পুরাণ বাজার এলাকা ষোলঘর ও ফিসারী এলাকায় বিমান থেকে বৃষ্টির মতো গোলা বর্ষন শুরু করে। সকাল ১০ টা থেকে একটানা গুলি বর্ষন শুরু করে। এ গুলি বর্ষনের ফলে পুরাণ বাজারের পাটেরমিল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে আগুন ধরে যায়। তখনই পুরানবাজার লোহার পুলের কাছে একজন পুরুষ ও একজন নারী পথচারি মারা যায়। আহত হয় কয়েক শতাধিক মানুষ। পরদিন ৮ এপ্রিল সকালে পাত হানাদার বাহিণীর কিছু সদস্য গানশিপ যোগে নদী পথে চাঁদপুরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন বড় ষ্টেশন গিয়ে পাক হানাদার বাহিণীর গানশিপ লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তখন তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ঐ দিন তৎকালীন পাক মেজর ইফতেখার হানাদার বাহিণী নিয়ে চাঁদপুরে প্রবেশ করে। তারা ৯৬ টি সামরিক যানে করে চাঁদপুরে প্রবেশের পথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পরে। তখন পাক হানাদার বাহিণী প্রতিরোধের মুখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো। টেকিনিক্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রবেশ করার সময় আশে পাশের বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এমনকি গুলি বর্ষন করে আতংকের সৃষ্টি করে । ৯ এপ্রিল ভোরে পাক সেনারা ধ চাঁদপুর শহরে প্রবেশ করে যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। এর মধ্যে বাসষ্টেশন এলাকায় ১ জন চিত্রলেখা মোড়ে ২ জন কোর্ট ষ্টেশন এলাকায়২ জন এবং পালবাজার এলাকায় ৪ জনকে তারা হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধারা স্থল পথেই নয় পাকা হানাদর বাহিণীকে নদী পথেও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো। নৌ কমান্ডার শাহাজাহান কবির বীর প্রতিক, মমিনউল্ল্যাহ পাটওয়ারী ২৫ জন নৌ কমান্ডো নিয়ে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীতে রসদ ও গোলা বারুদের কয়েকটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। উল্লেখযোগ্য হলো ৩০ অক্টোবর ডাকাতিয়া নদীতে সরকারী খাদ্য গুদামের সামনে এমভি লোরাম, ২৬ অক্টোবর হাইমচরের বৈশের হাটে একটি থাদ্য বোঝাই একটি জাহাজ, ২ নভেম্বর মেঘনা নদীতে এমভি সামি, ৫ নভেম্বর হাইমচরের টেকের হাটে সৈন্যবাহী জাহাজ, ৭ নভেম্বর মোহনপুরে সৈন্যবাহী জাহাজ এমভি লিলি, ১১ নভেম্বর এখলাসপুরে খাদ্যবাহী জাহাজ এমভি গফুর ও এমভি টাগ ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এমনিভাবে চাঁদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী শত্রু সেনাদের সাথে মরণপণ যুদ্ধ করে ৮ এপ্রিল থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ৮ মাস যুদ্ধের পর চাঁদপুরকে শত্রু মুক্ত করে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top