সকল মেনু

ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করেছে ওরা

Nari1440231322নিজস্ব প্রতিবেদক, হটনিউজ২৪বিডি.কম ২২ আগস্ট : ‘খাইয়া না খাইয়া দিন কাডতো, ভাবি নাই কোন দিন নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারমু, এ বাড়ি ও বাড়ি কাম কইরা জীবন কাইটা যাইবো।’ এই ছিল যাদের জীবনের হিসাব, এখন অনেকখানি পাল্টে গেছেন তারা। সেই আঁধার ঘরে এখন জ্বলছে সোনালী আলো। স্বামী সন্তান নিয়ে যেখানে দু-বেলা দু-মুঠো খাবার, নতুন পোশাক আর শক্ত খুঁটির মাথাগোঁজার ঠাঁই ছিল তাদের কাছে অলিক স্বপ্ন। সেটাই এখন বাস্তব বরগুনার বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ি গ্রামের দরিদ্র গৃহবধু হোসনে আরা বেগমের কাছে। অপুষ্টির শিকার হয়ে শরীরে তার দিন দিন জেঁকে বসেছে জটিলসব ব্যাধি। ওদিকে কোমড়ে আঘাত পেয়ে শয্যাশায়ী দিনমজুর স্বামী আব্দুল মালেক। ছোট ছোট পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে এক বেলার অন্ন যোগাতেই তার টালমাটাল অবস্থা। সীমাহীন অভাব অনটন আর দারিদ্রের কষাঘাতে একসময় দিশেহারা হয়ে পড়েন হোসনে আরা বেগম। ডুবন্ত মানুষ হাতের কাছে খড় কুটো পেলেও ধরতে চায়, হোসনে আরা বেগমও তাই চাইলেন। কখনও গ্রামীণ সড়ক মেরামতের কাজ, কখনওবা পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে ঝিয়ের কাজ। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। চির দারিদ্রের সংসারে একটু সচ্ছলতার স্বপ্ন। কোনদিনই কি তা সম্ভব? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে একসময় হোসনে আরা ভাবেন ক্ষুদ্র ব্যবসার কথা। হোক সে ক্ষুদ্র ব্যবসা, কিছু পুঁজি তো লাগবেই। কে দেবে সেই পুঁজি? নিকটতম এক স্বজনের মাধ্যমে একদিন হোসনেয়ারা জানতে পারেন, বাংলাদেশ সরকারের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ইকোনোমিক এমপাওয়ারমেন্ট অফ দ্যা পুওরেস্ট পিপল‘স’ (ই.ই.পি) প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় একটি উন্নয়ন সংগঠন থেকে হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যদের জন্য এককালীন অফেরতযোগ্য ১০ হাজার টাকার সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। যারা তার মতো আত্ম কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁজছেন তারা এই সহায়তা গ্রহণ করতে পারবেন। এরপর স্থানীয় ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির সদস্য হন তিনি। এভাবেই একসময় হাতে আসে তার এককালীন ১০ হাজার টাকা। বাড়ির পাশেই বিষখালী নদী। বিষখালীর গহীন জলে দিনরাত মাছ ধরে সংসার চালায় শত শত জেলে। ছোট্ট একটি ডিঙ্গি নৌকা আর সামান্য একটু জাল হলে মাছ ধরে প্রতিদিন কিছু না কিছু রোজগার হবেই। অনেক ভেবে চিন্তে হাজার চারেক টাকার মধ্যে একটি নৌকা বানিয়ে ফেললেন হোসনে আরা। বাকী টাকার কিনলেন জাল। এরপর সকাল-বিকাল নাও-জাল নিয়ে পড়ে থাকলেন নদীতেই। মাছ বেঁচে এখন গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে তিন’শ টাকা রোজগার হয় হোসনে আরার। কোন কোন দিন এ হিসেব হাজারের ঘরও ছুঁয়ে যায়। একই সঙ্গে বাড়িতে যেটুকু সামান্য জমি রয়েছে সেখানে হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি বসতঘরের আঙিনায় সবজির আবাদ করলেন। পাশের বাড়ির কবুতর দেখে নিজেও বাঁশ আর খুঁটি দিয়ে উঁচু করে বানালেন কবুতরের ঘর। আর এসব কাজে তার সাথে খাঁটুনি দিতে লাগল তার পাঁচ ছেলে-মেয়ে, এমনকি অসুস্থ স্বামীও। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি হোসনে আরা বেগমকে। ক্ষুধা আর দারিদ্রকে পেছনে ফেলে একটু একটু করে এগিয়ে যান হোসনে আরা। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে বর্ষা মৌসুমে গুটিসুটি হয়ে নির্ঘুম অনেক রাত কাটিয়েছেন হোসনে আরা, কিন্তু আর নয়। ছোট খাট সব দেনা পাওনাও শোধ হয়ে গেছে তার। এবার হোসনে আরা হাত দেন ঘর তোলার কাজে। যেখানে যে সঞ্চিত দু’পয়সা ছিল তা ভেঙ্গে আর নিকট স্বজনদের কাছ থেকে হাজার দশেক টাকা ধার নিয়ে বানিয়ে ফেললেন ঘরও। আত্মবিশ্বাসী হোসনে আরা বলেন, ‘কোনোকালে ভাবি নাই নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারমু। অহন নিজের কাম কইরা নিজেই নিজেগো খাওন যোগাড় করতে পারতে আছি। মাছ বেইচ্চা দুই পয়সা পাই। আবার হাঁস-মুরগির ডিম বেইচ্চাও কিছু পাই। কইতরেও ছাও (বাচ্চা) দেয়। এক জোড়া কইতরের ছাও বেঁচি দেড়’শ টাহা। মাঝে মাঝে নিজেরাও খাই।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র হোসনে আরা বেগমই নন, ক্ষুদ্র ব্যবসায় আত্ম নিয়োগ করে হোসনে আরা বেগমের মত বরগুনা সদর ও বেতাগী উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের সাড়ে তিন হাজার অতি দরিদ্র পরিবার এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ সরকারের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধিনে ই.ই.পি. প্রকল্পের আওতায় দাতা সংস্থা অক্সফামের সহযোগিতায় নারী অধিকার নিয়ে কর্মরত স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন ‘জাগো নারী’ সিডর পরবর্তী সময় থেকে বরগুনা ও বেতাগী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে রি-কল প্রকল্প নামে জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন বিষয়ক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। ২০০৯ সালে স্থানীয় অধিবাসীদের সংগঠিত করে তাদের দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রশমনের পাশাপাশি সকল প্রকার অধিকার সচেতন করে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে এ প্রকল্পটি শুরু হয়। এ প্রকল্পের অধীনেই বরগুনা ও বেতাগী উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে মোট ১০৫টি স্থানীয় সংগঠন বা সিবিও গঠন করা হয়েছে। এসব সিবিওর অধীনে সাড়ে তিন হাজার হতদরিদ্র পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে বিভিন্ন ট্রেন্ডের ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু পালনের জন্য অফেরতযোগ্য এককালীন ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হয়েছে। রি-কল প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এ প্রকল্পের অধীনে নির্বাচিত উপকারভোগীদের আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু পালনসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ওইসব পরিবারের ব্যবসায়িক আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণসহ তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, যাতে দারিদ্রসীমার উপরে উঠে আসতে কেউ ব্যর্থ না হয়।’ বরগুনার বেতাগী উপজেলার সরিষামুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ইউসুফ শরীফ বলেন, ‘অক্সফামের সহযোগিতায় উন্নয়ন সংগঠন ‘জাগো নারী’ যে প্রকল্পটি এখানে বাস্তবায়ন করছে তা যথেষ্ট সময়োপযোগী। এ প্রকল্পের অধীনে এককালীন অফেরতযোগ্য ১০ হাজার টাকার আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে তার ইউনিয়নে হোসনে আরার মতো হতদরিদ্র অনেকেই এখন নিজেদের কর্মসংস্থান নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছেন।’ এ প্রকল্পের মেয়াদ এবং প্রকল্প এলাকা বৃদ্ধির জন্য তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং দাতা সংস্থার প্রতি আহবান জানান।
বরগুনা সদর উপজেলার গৌরীচন্না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘দারিদ্র বিমোচনে বর্তমান সরকার নানামুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। তার মধ্যে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে ই.ই.পি. একটি অন্যতম প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় অক্সফামের সহযোগিতায় উন্নয়ন সংগঠন ‘জাগো নারী’ বরগুনার দুটি উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে।’
হটনিউজ২৪বিডি.কম/এআর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top