সকল মেনু

চাঁদপুরে রেল বিভাগের প্রদীপ নিভে যাচ্ছে

 

শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর:– প্রায় দেড়শ’ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত চাঁদপুর রেলওয়ে (বড়) স্টেশন মেঘনা-ডাকাতিয়ার ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার পর ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও পুনরায় স্থায়ী স্টেশন নির্মাণ করা হয়নি। ওই স্টেশনের সকল কার্যক্রম করা হচ্ছে সাবেক টিএসআর কার্যালয়ের টিনশেড ঘরের ভেতর। নানা সমস্যায় আলোর মুখ দেখতে পারছে না চাঁদপুর রেল বিভাগ। যতই দিন যাচ্ছে, রেল যাত্রীর সেবার মান এখানে কমে যাচ্ছে। যেন দেখার কেউ নেই। চাঁদপুর-লাকসাম ৫২ কিলোমিটার রেলপথ এতটাই নাজুক যে ট্রেনের গতি অর্ধেক কমিয়ে চলাচল করতে হয়। এতে গন্তব্যে পৌঁছতে ট্রেনগুলোর বিলম্ব হবার ঘটনা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত ৬টি ট্রেনের মধ্যে বন্ধ রয়েছে ২টি। ভারতীয় কালন্দি কোম্পানী রেল লাইন সংস্কারে কাজ পেয়েছে। এ কাজের অংশ হিসেবে মেহের পর্যন্ত রেল লাইন, পাথর, স্লিপার স্তূপ করে রাখা হলেও নতুন রেল লাইন বসানোর কাজ এখনো শুরু করা হয়নি। ইঞ্জিন সমস্যা ও ইঞ্জিন স্বল্পতাতো রয়েছেই। চলাচলরত ট্রেনগুলোর মধ্যে মেঘনা আন্তঃনগর ছাড়া অন্যান্য ট্রেনের বগিগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। আধুনিক উন্নয়নের ছোঁয়া বলতে কিছুই নেই এখানে। প্লাটফর্ম না থাকায় যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যাত্রী ছাউনি না থাকায় ভিজতে হচ্ছে বৃষ্টিতে। রেল স্টেশন সংযোগ রক্ষাকারী কোনো পাকা রাস্তা নেই। যাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে উঠানামা করছে। তাদের পথ চলতে হয় রেল লাইনের উপর দিয়ে।

সরজমিনে চাঁদপুর রেলওয়ে বড় স্টেশন (অস্থায়ী) এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্টেশন এলাকাটি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। রেল স্টেশন আছে, প্লাটফর্ম নেই। নেই স্টেশন মাস্টারের কার্যালয়। ছোট পরিসরে একটি টিনশেডের ছাউনি আছে। সেটি যাত্রী ছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যাত্রী শ্রেণী বিন্যাসে নেই কোন ওয়েটিং রুম। বিশুদ্ধ পানির অভাব, স্যানিটেশেন ব্যবস্থা খুবই নাজুক, যাত্রী সাধারণের জন্য কোনো বিশ্রামাগার নেই। নেই ট্রেন অফিস, বুকিংয়ের জন্য আলাদা কোনো অফিস। রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারী সূত্রে জানা যায়, ৩-৪ বছর আগে স্টিমার ঘাটের বিপরীতে একটি রেলওয়ে গুদাম ঘরে অস্থায়ী বিশ্রামাগার প্রায় ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটি এখন ভবঘুরেদের দখলে এবং গাঁজার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যাত্রীদের বসার পরিবেশ নেই। টিএনটি তৌহিদুর রহমান জানান, স্টেশন এক জায়গায়, যাত্রী ছাউনি আরেক জায়গায়। এদিকে এলাকার সচেতন মানুষ জানায়, পুরানো সিক লাইন জরাজীর্ণ অবস্থায় দীর্ঘদিন থেকে পড়ে রয়েছে। সেখানে কোনো লোক না থাকায় জুয়া, নেশা ও অসামাজিক কার্যকলাপ অব্যাহত আছে।

চাঁদপুর রেলওয়ে বড় স্টেশন মাস্টার সফিকুর রহমান ভূঁইয়া, সহকারী স্টেশন মাস্টার মারুফ হোসেন জানান, রেলওয়ের টিএসআর ঘরের এক কক্ষে টিকেট কক্ষ, পাশের কক্ষে বুকিং অফিস, অপর কক্ষে স্টেশন মাস্টারের অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। রেলওয়ের বিরাট এলাকা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ‘এ’ গ্রেডের একটি রেলওয়ে স্টেশনের এমন বেহাল দশা দেখে যে কেউ বলবে এটি কি রেল স্টেশন নাকি গরুর ঘর। রেলমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন চাঁদপুর রেল স্টেশন পরিদর্শনে এসে খোদ তৎকালীন রেলমন্ত্রী বর্তমানে যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ স্টেশনকে গরুর আস্তাবলের সাথে তুলনা করেছিলেন। টিটিই ও রেল শ্রমিক নেতা মাহবুবুর রহমান জানান, নদী আছে, ভাঙ্গবে। এভাবে একটি প্রাচীন রেলওয়ে স্টেশন বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকতে পারে না। উত্তর পূর্ব দিকে রেল স্টেশন সরিয়ে নিয়ে সেখানে স্থায়ী স্টেশন করার মতো জায়গা রয়েছে। এছাড়া ঘোড়ামারা গুচ্ছগ্রামের পাশে রেলওয়ের ৩০ শতাংশ জায়গা রয়েছে। রেল বিভাগ সেখানেও স্থায়ী স্টেশন করতে পারে।

এতো গেল স্টেশনের করুণ পরিণতির চিত্র। এবার দেখা যাক যাত্রী পরিবহনে ট্রেনগুলোর কী অবস্থা। যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ রেল বিভাগকে পুরানো চেহারায় ফিরাতে উন্নয়নমূলক কাজ করছে বর্তমান সরকার। ইতিমধ্যে বৃহৎ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে চাঁদপুর রেল বিভাগ ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামের পর রাজস্ব আয়ের দিক থেকে চাঁদপুরের অবস্থান দ্বিতীয়। একটি মাত্র আন্তঃনগর ট্রেন মেঘনা ও মৎস্য পরিবহনে ট্রেন প্রতি বছর বিপুল অংকের রাজস্ব চাঁদপুর রেল বিভাগ পাচ্ছে। তা সত্ত্বেও যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে চাঁদপুর রেল স্টেশনের যাত্রীরা ন্যূনতম সেবাটুকু পাচ্ছে না। লাকসাম হয়ে চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রুটে আন্তঃনগর মেঘনা এক্সপ্রেস ও সাগরিকা মেইল ট্রেন নামে দুটি ট্রেন নিয়মিত চলাচল করে। ৬টি লোকাল ট্রেনের মধ্যে ৪টি চলাচল করছে। তাও অনিয়মিত। চট্টগ্রাম থেকে মেইল ট্রেন সাগরিকা কখন ছাড়ে, চাঁদপুরে কখন পৌঁছবে, কখনই বা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে স্টেশন মাস্টার ও যাত্রী সাধারণ নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারে না। দুর্বল রেল লাইন ও ইঞ্জিন সমস্যার দরুণ সাগরিকার সময়সূচি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে এ ট্রেনের এল.এম আব্দুল খালেক ভূঁইয়া জানান।

স্টেশন মাস্টার সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুর-ভৈরব ও চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রুটে লাকসাম হয়ে দুটি ট্রেন অনেক দিন যাবৎ চলাচল বন্ধ রয়েছে। সিলেট রুটে যাতায়াতের জন্য চাঁদপুর থেকে দুটি বগি যাত্রী নিয়ে লাকসাম যেত। সেখানে জালালাবাদ এক্সপ্রেসের সাথে ওই দুটি বগি যুক্ত হয়ে চাঁদপুরের রেল যাত্রীরা সিলেট যেতে পারতো। সেটিও কয়েক বছর বন্ধ। রেল লাইন ও ইঞ্জিন সমস্যা, ইঞ্জিনের স্বল্পতার কারণে যেগুলো চলছে তাও আবার বন্ধ হবার উপক্রম। আন্তঃনগর মেঘনা সার্ভিস দিয়েই চাঁদপুর রেল বিভাগ টিকে রয়েছে। এ ট্রেনটির লাইন খারাপ ও ইঞ্জিন ত্রুটির জন্য অনেক সময় বিলম্বে পৌঁছছে। স্টেশন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানান, রেল যাত্রী বাড়ছে, সুব্যবস্থা না থাকায় ট্রেনের যাত্রীরা সেবা পাচ্ছে না। যাত্রীদের চাহিদা মোতাবেক সেবা দিতে না পারায় ট্রেনের যাত্রীরা বিকল্প পথে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে। এ স্টেশনে জনবল সঙ্কটও রয়েছে অনেক। স্টেশন মাস্টারসহ দুই তৃতীয়াংশ পদ শূন্য রয়েছে। নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। নিরাপত্তা কর্মী রেল থানা পুলিশের তৎপরতা কম চোখে পড়ছে।

২০০১ সালের শেষ দিকে মেঘনা-ডাকাতিয়ার আকস্মিক ভাঙ্গনে চাঁদপুর রেলওয়ে বড় স্টেশনের প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরানো স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। উত্তর পূর্ব দিকে সরে এসে সাবেক টিএসআর ঘরটিতে ঠিকানা খুঁজে পায় চাঁদপুর রেলওয়ের অস্থায়ী স্টেশন। ২০০১-২০১৩ এক যুগেও ফিরে পায়নি বাংলাদেশের গ্রেড ওয়ান চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন তার পূর্ব অবয়ব। চলমান রি-মডেলিং প্রকল্পেও বড় স্টেশন স্থান পায়নি। রি-মডেলিংয়ের আওতায় না নিয়ে সংস্কার কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চাঁদপুর লাইনের ৯টি স্টেশনের মধ্যে স্টেশন মাস্টার না থাকায় ওয়ারুক, বলাখাল ও শাহতলী স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। চিতোষী ও মেহের এ দুটি স্টেশন দিনের বেলা খোলা, রাতে বন্ধ থাকে। চাঁদপুর কোর্ট ও চাঁদপুর বড়স্টেশন ছাড়া ৬টি নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ কাজ এখন চলমান। রি-মডেলিং প্রকল্পের আওতায় এর কাজ চলছে বলে জানা যায়।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম জানান, নদী ভাঙ্গনের কারণে চাঁদপুর স্টেশনের জন্য স্থায়ী কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা যাচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেলে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি আরো জানান, যেখানে রেল স্টেশনের সাথে ঘাট রয়েছে, সেখানে রেল বিভাগের কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। এর পরিপন্থী কিছু করার থাকে না। তিনি জানান, এ স্টেশনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থায়ী স্টেশন ভবন ছাড়া আর যে সব করা দরকার এ বছরের প্রোগ্রামে রাখবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী কার্য লাকসাম (এআইডব্লিউ) রাম নারায়ণ ধর জানান, রি-মডেলিং প্রকল্পের আওতায় চাঁদপুরের ৬টি স্টেশন নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। চাঁদপুর কোর্ট ও বড় স্টেশন নতুন ভবন পাচ্ছে না। এ দুটি স্টেশনে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ দ্রুত শুরু করা হবে। এ কাজের মধ্যে বড় স্টেশন চাঁদপুর রেলওয়ে অস্থায়ী স্টেশনের জন্য দুটি প্লাটফর্ম, প্লাটফর্ম সেট, ওয়েটিং রুম, পাবলিক টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। মালামাল উঠা নামার জন্য আলাদা প্ল্টাফর্ম করা হবে।

চাঁদপুর গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন হওয়া সত্ত্বেও নদী ভাঙ্গনের দোহাই দেখিয়ে স্থায়ী স্টেশন ভবন নির্মাণে কেনো রি-মডেলিং প্রকল্পের আওতায় নেয়া হয়নি এ বিষয়টি সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাঁদপুরের। রেলমন্ত্রী মজিবুল হক বৃহত্তর কুমিল্লার। সরকারের প্রভাবশালী এ তিন মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতা থাকাকালীন চাঁদপুর রেল স্টেশন (আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের গেটওয়ে) ও চাঁদপুর-লাকসাম রেল রুটের এমন করুণ পরিণতি চাঁদপুরের মানুষ কখনই আশা করে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top