সকল মেনু

উৎসবে মুখরিত ছিটমহল

1438364408

নিজস্ব প্রতিবেদক-কুড়িগ্রাম, হটনিউজ২৪বিডি.কম ০১ আগষ্ট : ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসানে দিনভর নানা আয়োজন, বাঁধভাঙ্গা আনন্দ-উচ্ছ্বাস চলেছে সিটমহলে।
মসজিদে-মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনার মধ্য দিয়ে ছিটমহলে ‘মুক্তি’র উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ছিটমহল বিনিময় উপলক্ষে গত শুক্রবার দুপুরে কুড়িগ্রামের দাসিয়ার ছড়াসহ ১১১টি ছিটমহলে উত্সবের অভিন্ন কর্মসূচি শুরু হয়। দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসান হওয়ায় ছিটবাসীর মাঝে এখন বইছে আনন্দের জোয়ার।
ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহলের মানুষের জাতীয়তা বদলে গেলো, অবসান ঘটলো দীর্ঘ ৬৮ বছরের অপেক্ষার। চুক্তি অনুযায়ী, সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাসিয়ার ছড়াসহ ভারতের ১১১টি ছিটমহল আজ শনিবার প্রথম প্রহর থেকে হয়ে যাবে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের অংশ। অন্যদিকে ভারতের মধ্যে থাকা ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত হওয়ায় ৪১ হাজার ৪৪৯ জন মানুষ এখন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। রক্তপাতহীন শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্রের ভূখণ্ড বিনিময় ও এত বিপুল সংখ্যক মানুষের নাগরিকত্ব বদল বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
জানা যায়, জেলার বিভিন্ন ছিটমহলের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভোরে ঢোল করতাল, কাসর বাজিয়ে, শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিয়ে বিশেষ প্রার্থনা, দুপুরে মুসল্লিরা জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদে মসজিদে মিলাদ, দোয়া মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাত করে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে আয়োজন করা হয় বিশেষ খাবারের। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিকেল থেকে বিভিন্ন ছিটমহলের বাসিন্দারা জাতীয় পতাকা হাতে ঢোলক বাজিয়ে সঙ সেজে নেচে গেয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মেঠোপথ পেরিয়ে দাসিয়ার ছড়ার কালিরহাটে জমায়েত হয়। এ সময় একে অন্যকে মিষ্টি খাইয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে। অন্যদিকে ছিটমহলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নীলকুমর নদের শাখায় চলে নৌকা বাইচ। একই সঙ্গে বিভিন্ন পয়েন্টে চলে হাডুডু, লাঠিখেলা ও ঘোড় দৌড়। সন্ধ্যায় ছিটমহলগুলোর প্রতি বাড়িতে ৬৮টি করে মোমবাতি প্রজ্বলন, আলোকসজ্জা, মশাল মিছিল শেষে আলোচনা সভা ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এছাড়া রাত ১২ টা ০১ মিনিটে ৬৮ বার তোপধ্বনি দেয়া হয়। উৎসবের এ মাহেন্দ্রক্ষণের সংবাদ সংগ্রহে উপস্থিত ছিলেন দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা। ঘটনার সাক্ষী হতে বাইরে থেকে আসেন অসংখ্য পর্যটকও।
ছিটমহল সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সভাপতি মইনুল হকের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, দাসিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাফ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মোজাফ্ফর হোসেন প্রমুখ।
সভায় তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে ছিটমহলের মানুষ লাঞ্ছনা-বঞ্চনার মধ্যে ছিলেন। আজ থেকে বাংলাদেশের নাগরিক হবেন। আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ছিটবাসীর উন্নয়নে কাজ করবো। যারা ছিটবাসীর মুক্তির জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।
মঈনুল হক জানান, আমরা ছিটমহলবাসী অন্ধকার জীবন নিয়ে দীর্ঘ সময় পার করেছি। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে সদয় হয়ে ছিটমহল বিনিময় করেছেন। এজন্য আমি ছিটবাসীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানাই।
দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের বাসিন্দা মোজাফর জানান, আজ আমাদের খুশির দিন। আমরা গর্বের সাথে বলতে পারবো আমরা বাংলাদেশি। দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের সভাপতি আলতাফ হোসেন জানান, আমরা এখন থেকে স্বাধীন দেশের নাগরিক। আর কেউ বলতে পারবে না আমরা ছিটের মানুষ।
আনন্দে উদ্বেলিত দাসিয়ারছড়ার নজরুল ইসলাম, মোজাফ্ফর হোসেন, মিজানুর রহমান, আজিজার রহমান, আলাউদ্দিন, সুরত আলী, আব্দুল হামিদ, মজিবর রহমান, হাবিবুল, সফিকুল ও আব্দুল খালেক আনন্দাশ্রু মুছতে মুছতে বলেন, ৬৮ বছর অবরুদ্ধ জীবন শেষে আজ আমরা মুক্তির আনন্দে ভাসছি। পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির এ আনন্দের চেয়ে আমাদের কাছে অধিক আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। আজ আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূূর্তের সাক্ষী।
এ আয়োজনে বড়দের পাশাপাশি ছোটদের অংশগ্রহণও ছিল লক্ষণীয়। স্থানীয় গংগারহাট বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী আয়শা সিদ্দিকার নেতৃত্বে শিশুরা জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করে। তাদের উচ্ছ্বাস ছিল বাঁধভাঙা। আয়শা জানান, আজকের পর থেকে তাকে আর মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে পড়ালেখা করতে হবে না। এখন থেকে এখানকার সকল শিশু নিজ এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে পড়ালেখা শিখে দেশমাতৃকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।
আরো জানা যায়, ছিটমহল বিনিময়ের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করে জেলা অভ্যন্তরের ৩৬টি ছিটমহলের বাসিন্দারা। সকাল ১১টায় জেলা সদরের পুটিমারী ছিটমহলের ফোরকানিয়া মাদ্রাসা মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, ওই ছিটমহলের হাজারো নারী-পুরুষ ও শিশু সেখানে জড়ো হয়েছে। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের পর বিকেলে সেখানেই ছিটমহল নিয়ে নাটক ‘চুক্তির মুক্তি’ মঞ্চস্থ হয়। সন্ধ্যার পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ। এরপর রাতভর চলে আলোর খেলা আর গান-বাজনা। রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটমহলের প্রতিটি মুসলিম বাড়িতে ৬৮টি করে মোমবাতি ও হিন্দু বাড়িতে ৬৮টি প্রদীপ জ্বালানোর কর্মসূচি থাকলেও এর আগেই এসব বাড়িতে মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালানো হয়। ছিটমহলের অন্ধকার রাস্তায় জ্বালানো হয় মশাল। গোটা ছিটমহল এলাকায় শুরু হয় আলোর বন্যা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিটি ছিটমহলে একজন এসআইয়ের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা রাতভর দায়িত্ব পালন করেন। জেলার সকল ছিটমহলে একই কর্মসূচি পালন করা হয় বলে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতারা জানিয়েছেন।
বোদা উপজেলার পুটিমারী ছিটমহল নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান তছলিম উদ্দীন বলেন, আমরা এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। এর চেয়ে আমাদের জীবনে সুখের আর কোনো ইতিহাস নেই।
জানা যায়, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর গোতামারি-১ ও ২ নং ছিটমহলবাসী শুক্রবার জুমার নামাজের পর মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠান শেষে বিকাল ৪টা থেকে দেশীয় খেলাধুলা ও গানবাজনা করে আনন্দ উল্লাস করে। উপজেলা  নির্বাহী অফিসার মাহবুবুর রহমান এ সময় উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।  রাতে গোটা ছিটমহল মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করা হয়।
‘আটষট্টি বছর পর প্রকৃত স্বাধীনতা পেতে চলেছি’
‘দু দুবার আমরা স্বাধীনতা দেখলাম কিন্তু প্রকৃত অর্থে ছিটমহলে যারা থাকি, স্বাধীনতা পাইনি। এতগুলো বছর পর আজ আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পেতে চলেছি।’ বলছিলেন বিবিসি বাংলার প্রতিনিধিকে ছিটমহলের বাসিন্দা মনসুর আলী। তার জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে। এর পর কয়েকবার নাগরিকত্ব বদলেছে তার। ৭৫ বছরের এক জীবনেই পোয়াতুরকুঠি ছিটমহলের বৃদ্ধ মনসুর আলী মিঞা ভারতীয় থেকে হয়েছেন পাকিস্তানি, তার পর বাংলাদেশি। তারপর এখন আবার ৬৮ বছর পর তিনি ফেরত পাচ্ছেন তার আদি নাগরিকত্ব, বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। ভারতের মধ্যে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহল পোয়াতুরকুঠির বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী মনসুর আলী মিঞা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ৬৮ বছর ধরে কীভাবে কেটেছে ছিটমহলবাসীর জীবন। ‘আমার জন্ম ১৯৪১ সালে। এখন বয়স ৭৫। আমরা বাপ-দাদা ১৪ পুরুষ এই গ্রামেরই বাসিন্দা। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার দু বছর পর।’ মনসুর আলী বলছিলেন, ৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হলো– হিন্দুস্তান-পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেল। আর ১৯৪৯ সালে কোচবিহারের রাজা ভারতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন— আর তারা হয়ে গেলেন ছিটমহলের বাসিন্দা। ‘১৯৭১ সালে আবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে জন্ম নিল বাংলাদেশ। দু দুবার আমরা স্বাধীনতা দেখলাম কিন্তু ছিটমহলে যারা থাকি, তারা এখনও প্রকৃত স্বাধীনতা পাইনি।’ ‘৬৮ বছর ধরে  আমরা অন্ধকারের বাসিন্দা। নাগরিকত্ব নেই, প্রশাসন নেই– মিথ্যার আশ্রয় করে বাস করতে হয় আমাদের। এমনও হয়েছে যে স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য ভারতের হাসপাতালে নিয়ে গেলে স্বামীর নাম ভাঁড়াতে হয়। এভাবেই মামাকে বাবা বানিয়ে ভারতের স্কুল-কলেজের লেখাপড়া করে আমাদের ছেলেপুলেরা। আমাদের গ্রাম যেন জেলখানা। এরকমও হয়েছে, ১৯৬৬ সাল থেকে প্রায় সাত বছর আমরা গ্রাম থেকে বের হতে পারিনি। গ্রামে ফেরিওয়ালারা আসত। আমরা গ্রাম থেকে বের হলেই ভারতের পুলিশ তাড়া করতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কড়াকড়িটা কমে যায়। এতগুলো বছর পর আজ আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পেলাম।’
হটনিউজ২৪বিডি.কম/এআর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top