সকল মেনু

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি যুদ্ধকালের প্রধানমন্ত্রীকে

tajuddin_ahmed1437594463 মেহেদি হাসান নিয়াজ,হটনিউজ২৪বিডি.কম : তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বরের টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ কাহিনী রচিত হয়েছিল। সেখানে তাকে বর্ণনা করা হয়েছিল The Premier of Battle day বা যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন তিনি। সবার কাছেই সৎ ও মেধাবী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় ছিল তার।

যুদ্ধদিনের এই প্রধানমন্ত্রীর ৯০তম জন্মদিন আজ। ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের গজারি বনের ছায়া ঢাকা কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্ম এই বরেণ্য রাজনীতিকের। বাবার নাম মৌলভি ইয়াসিন খান আর মায়ের নাম মেহেরুন্নেসা খানম। তাজউদ্দীন আহমদকে জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

চার ভাই, ছয় বোনের মাঝে চতুর্থ তাজউদ্দীন আহমদের পড়াশোনা শুরু বাবার কাছে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত বাংলায় দ্বাদশ স্থান লাভ করেন তিনি। এ সময়ই জড়িয়ে পড়েন মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে। নির্বাচনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। একই বছর কোলকাতায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ভালো পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বজায় ছিলো উচ্চ মাধ্যমিকেও, ঢাকা বোর্ডে অর্জন করেন চতুর্থ স্থান এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিবেশে ছিলো এ দেশীয় রাজনীতির প্রতিফলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিবেশ তাজউদ্দীন আহমদকে দেশ ও রাজনীতি নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। জড়িয়ে যান সক্রিয় রাজনীতিতে। পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোক্তাদের একজন।

ভাষা আন্দোলনেও তাজউদ্দীন ছিলেন সোচ্চার। ১৯৪৮-এর ১১ এবং ১৩ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ধর্মঘট-কর্মসূচি ও বৈঠক করেন। ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ বৈঠকও করেন।

১৯৫৩ সাল। ‘আওয়ামী মুসলীম লীগ’ দলের কাউন্সিলে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মুসলিম’ শব্দটি দলের নাম থেকে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময়ই আওয়ামী লীগে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন তাজউদ্দীন আহমদ। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার মাঝে সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশীয় রাজনীতিতে বাড়তে থাকে আওয়ামী লীগের প্রভাব। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ঢাকা উত্তর-পূর্ব আসনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হন তাজউদ্দীন। প্রতিপক্ষ মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ নেতা ফকির আব্দুল মান্নানকে ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন। তখন তার বয়স মাত্র ২৯ বছর।

ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে সে অনুযায়ী কর্মকা- এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বায়ত্ত্বশাসন আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। এ আন্দোলনে রাজনৈতিক বলিষ্ঠ পদক্ষেপের জন্য তাজউদ্দীন আহমদ ক্রমে হয়ে উঠতে থাকেন ভবিষ্যতের দৃপ্ত সারথি। চলতে থাকে রাজনীতি, গ্রেফতার হন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৪ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক হন আওয়ামী লীগের।

ছয় দফার ঐতিহাসিক ১৯৬৬ সালে হন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৬ সালের ৮ মে পুনরায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন তাজউদ্দীন। মুক্ত হন ১৯৬৯-এর ১২ ফেব্রুয়ারি। আন্দোলন যখন অনিবার্যভাবে একটি সংঘাতময় যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, তার আগেই শেখ মুজিব দলীয় হাইকমান্ড গঠন করেন। পাঁচজনের হাইকমান্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন তাজউদ্দীন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত। বাঙালি জাতির উপর নেমে আসে পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয়, বীভৎস, খড়গহস্ত। এ বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাজউদ্দীন তার সহযাত্রী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। শত্রুসেনার চোখ এড়িয়ে তিনি অবশেষে হাজির হন ভারতীয় সীমান্তে।

স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ভারত সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। জরুরি হয়ে পড়ে একটি সরকার গঠন। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আর নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ এপ্রিল সরকার গঠন করেন ও ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৌদ্যনাথ তলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করেন।

শত বাধা-বিপত্তির মাঝে তিনি প্রবাসী সরকার চালিয়ে যেতে থাকেন। গঠন করেন প্রশাসনিক কাঠামো, এমনকি আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তাই যুদ্ধের সাংগঠনিক পরিকল্পনাও করতে হচ্ছিল তাকে। দেশ থেকে চলে আসার সময় পরিবার পরিজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পেরে শুধু একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলেন স্ত্রীকে- ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও।…’

শেখ মুজিবের ছিল নেতৃত্বের কারিশমা আর তাজউদ্দীন আহমদের ছিলো সাংগঠনিক দক্ষতা। মূলত তার সুনিপুণ দক্ষতার গুণেই যুদ্ধ সঠিক পথে এগোতে থাকে। যুদ্ধের সময় দলের অভ্যন্তর থেকে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু তিনি দক্ষতার সঙ্গে সেসব মোকাবিলাও করেছেন। যুদ্ধের সময়ে কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনো শরণার্থী শিবিরে, কখনো ভারতীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করে আবার কখনো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগ্রামী শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের প্রতিটি দিন কাটতে থাকে তার।

সঠিকভাবেই এগোতে থাকে সবকিছু। ভারত স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। দিনটি ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ডিসেম্বরের শুরুতে ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে বাঙালি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়। প্রচণ্ড আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের বিজয় পাখির।

১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি তাজউদ্দীন এক টিভি ভাষণে বলেন-‘৩০ লক্ষাধিক মানুষের আত্মাহুতির মাঝ দিয়ে আমরা হানাদার পশুশক্তির হাত থেকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত বাঙলাদেশকে স্বাধীন করে ঢাকার বুকে সোনালি রক্তিম বলয় খচিত পতাকা উত্তোলন করেছি’। তিনি মুক্তি দাবি করেন জাতির জনকের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এলে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হন নয়া সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী। ১৯৭৩-এ ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এতদিন যিনি সংগ্রাম করেছেন দেশ স্বাধীনের জন্য এখন তিনি সংগ্রামে নামেন দেশ গঠনের।

১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনের বক্তৃতায় দল, সরকার এবং নেতা-কর্মীদের মাঝে দূরত্ব দূর করে, সংগঠন এবং সরকারের মাঝে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান তাজউদ্দীন।

এ সময় কিছু সুবিধাভোগী, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিকদের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। তাদের সুন্দর সম্পর্কে ফাটল ধরে। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগও করেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়৷ এ ভয়াবহ রূঢ়, নৃশংস ঘটনায় সবাই স্তম্ভিত। ঘটনার বীভৎসতায় তাজউদ্দীন আক্ষেপ করে বলেন,‘বঙ্গবন্ধু জেনেও গেলেন না তার শত্রুকে আর বন্ধু কে? তিনি বন্ধুকে চিনতে পারলেন না।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সবাই তাজউদ্দীন আহমদকে আত্মগোপনে যাবার জন্য বলতে থাকেন। কেননা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পরবর্তী লক্ষ্য হবেন তার কাছের মানুষেরা। কিন্তু তিনি আত্মগোপন করতে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে সবার আশঙ্কাই সত্য হয়। ১৫ আগস্ট প্রথম গৃহবন্দী ও পরে ২২ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় তাকে। ৩ কন্যা, ১ পুত্রসহ স্ত্রীকে ছেড়ে কারাগারে যেতে হয় তাকে।

কারা অন্তরীণ হন তিনিসহ আরো তিন জাতীয় নেতা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম. মনসুর আলী, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান। জেলে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী দৃশ্যকল্পের। কারাগারে সেনা সদস্যদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। তার কাছে আর কারাগারকে নিরাপদ মনে হয় না। শঙ্কা সত্য হয়।

কারাগারের নিউ জেল বিল্ডিং ভবনে বন্দি। প্রতিরাতের মতোই কারাগারের কক্ষে তিনি। বাইরে নিথর অন্ধকার। হঠাৎ খুলে যায় কারাগারের মূল ফটক। চত্বরে প্রবেশ করে কালো পোশাকধারীর নেতৃত্বে অস্ত্রধারী ৪ জন সৈন্য। একই ঘরে সমবেত করা হয় তিন সহযাত্রীসহ তাজউদ্দীনকে। গর্জে ওঠে ঘাতকের হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। ৬০ রাউন্ড গুলির পর সব কিছু স্তব্ধ। তিন সহযাত্রী নেতাসহ খুন হন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এভাবেই ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর অস্ত্রের দমকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয় চারনেতার জীবন ও শরীর। নিহত হন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার কাণ্ডারীরা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top