সকল মেনু

দুর্ভোগের নাম ডিএনডি বাঁধ

1436816025

নিজস্ব প্রতিবেদক-নারায়ণগঞ্জ, হটনিউজ২৪বিডি.কম ১৪ জুলাই : ১ ঘণ্টা বৃষ্টিতেই রাস্তা ডুবে যায়। কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলে পানি বারান্দায় ঢুকে পড়ে, এরপরে ঘরে। বাড়ি বানানোর পরে গত ১৫ বছর ধরে এমনটাই দেখছি, খুব সহজ ভঙ্গিতে বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার সি. আই খোলা এলাকার বাসিন্দা মহসিন আলী মধু। যেন এই পানি ওঠা কোন ঘটনাই না, যেন এমনটাই হবে, এটাই নিয়তি। ডিএনডি বাঁধ (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা) এলাকার প্রায় ১৭ লাখ বাসিন্দা প্রতি বছর পানিতে বারবার ভাসে। নোংরা পানি বয়ে আনা অসুখে ভোগে। সব আশা ছেড়ে নিরুপায়, অসহায় মানুষগুলো এ পরিস্থিতি বদলানোর আশাও করেন না। যেন, তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সত্যিই তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। এই জলাবদ্ধতা কাটানোর জন্য, স্যুয়ারেজ লাইন ও পানি সরবরাহের লাইন আধুনিক করার জন্য সরকারের কোন উদ্যোগ নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন কেউই এই এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কোন উদ্যোগ নেয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের একে অপরের প্রতি দোষারোপ আর দায়িত্ব গ্রহণের গড়িমসির শিকার হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। মানুষের কী হলো না হলো সেসব নিয়ে কারোরই খুব একটা আগ্রহ নেই।
কয়েক যুগ ধরে বর্ষা মওসুমে জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধ এলাকার অধিবাসীরা। সরকার এখনও পর্যন্ত এই সমস্যার কোনও স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ডিএনডি বাঁধ ওয়াপদার হাতে থাকলে এই জলাবদ্ধতার সমাধান হবে না। কেননা, আবাসিক এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ওয়াপদার কাজ নয়। এটা নগর প্রশাসন ভালো করবে। তিনি জানান, সরকার প্রথমে ডিএনডির দায়িত্ব বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে ঢাকা ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করতে চেয়েছিল। পরে মন্ত্রী পর্যায়ের এক কমিটিতে ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনকে যৌথভাবে এই দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেই দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে টালবাহানা চলছে। এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওতার মধ্যে ডিএনডি বাঁধের বড় অংশ রয়েছে। কিন্তু পুরো এলাকার ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশন কাঠামো করা সম্ভব হয়নি। নতুন সিটি কর্পোরেশন এলাকা বেড়েছে। আমরা পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছি। তিনি ডিএনডি বাঁধের সমস্যা সমাধানে একটি ভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে বলেন, পাম্প চালানোর মত বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সিটি কর্পোরেশনের নেই। এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডকেই তদারক করতে হবে। আমরা এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারি।
জনপ্রতিনিধিরা তাদের সমস্যা নিয়ে নানা কথা বললেও মানুষের দুর্ভোগ মিটছে না। বরং বর্ষা এলেই সীমাহীন আতংকের মাঝে দিন কাটান ডিএনডি  বাঁধ এলাকায় বসবাসকারী প্রায় ১৭ লাখ বাসিন্দা। প্রতিবছরই আষাঢ়ের শুরু থেকেই অনবরত বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নেয়। বছরের যে কোন সময়ে ১ ঘণ্টার বৃষ্টিতেই ডিএনডি বাঁধ এলাকার অধিকাংশ রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যায়। নেই পয়ঃনিষ্কাশনের ভাল ব্যবস্থা। বদ্ধ ও নোংরা পানিতে সবসময় চুলকানি, ডায়ারিয়া ও আমাশয়ে ভুগতে হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জকে বন্যা থেকে রক্ষা করার জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প ১৯৬২-৬৮ সময়কালে ৮ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমি নিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) ইরিগেশন প্রজেক্টে নির্মিত হয় ডিএনডি বাঁধটি। ৩২ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাঁধের (ডিএনডির) ভেতরে শুষ্ক মৌসুমে সেচ প্রদান এবং বর্ষা  মৌসুমে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের জন্য সেচ খাল ৯টি, ডিটিও খাল ৯টি, আউট লেক খাল এবং ১০টি নিষ্কাশন খাল রয়েছে। এছাড়াও এক কিলোমিটার দীর্ঘ ইনটেক খাল, ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ টার্ন আউট খাল রয়েছে। এসব খাল দিয়ে জমিতে সেচ দেয়া ও পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রতিটি ১২৮ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি পাম্প রয়েছে। কিন্তু এই পাম্প দিয়ে পঞ্চাশ বছর আগের চাহিদা মিটলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা অত্যন্ত অপ্রতুল। সে সময় চাষাবাদের সুবিধা ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এই বাঁধের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু বাঁধ এলাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ন এ অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে। বিশেষত ১৯৮৮ সালের বন্যার পর এই এলাকায় বসবাসের হার আরও বেড়ে গেছে। এর ফলে বেশিরভাগ কৃষিজমি এখন অপরিকল্পিতভাবে আবাসিক এলাকায় রূপান্তরিত হয়েছে। একইসঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে এই এলাকায়। গত সপ্তাহের প্রবল বর্ষণে ডিএনডির অভ্যন্তরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি, ধনকুন্ডা, পাঠানটুলি, দক্ষিণ কদমতলী নয়াপাড়া, পশ্চিম কদমতলী, মিজমিজি, সাহেবপাড়া, পাইনাদি, কালাহাতিয়ারপাড়, সিআইখোলা, পাইনাদী নতুন মহল্লা, মজিববাগ, কুতুববাগ, রসুলবাগ, নিমাই কাসারী, বাগমারা, পশ্চিম সানারপাড়, ডেমরার মাতুয়াইল, মৃধাবাড়ি, কোনাপাড়া, আমবাগান, ভাঙ্গা প্রেস, কাজলা, যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া, রায়েরবাগ, টেংরা, বকসনগরসহ বিভিন্ন এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। হাঁটুপানির নিচে রয়েছে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব এলাকার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, স্যুয়ারেজের পানি মিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রয়োজনের তাগিদে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি দিয়েই যাতায়াত করায় পানিবাহী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। ভুক্তভোগীরা জানায়, অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর, কল-কারখানা, ব্যাংক-বীমা, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মিত হওয়ায় ডিএনডির পানি নিষ্কাশনের বেশির ভাগ খাল বেদখল হয়ে গেছে। খালগুলো দিয়ে ডিএনডির অভ্যন্তরের বসত-বাড়ি, রাস্তা-ঘাটে বর্ষায় জমে থাকা পানি প্রধান নিষ্কাশন খালে যেতে না পারায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এলাকাবাসী জানায়, গোদনাইল থেকে মৃধাবাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটিও ভরাট ও কোথাও কোথাও আগের তুলনায় আরও বেশি জায়গা দখল হয়ে গেছে। শ্যামপুর, তিতাস খালসহ কয়েকটি খালের বর্জ্য ছড়িয়ে পড়েছে জলাবদ্ধ  লোকালয়ে।
নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলে ডিএনডি পাম্প স্টেশনের উপসহকারী প্রকৌশলী রামপ্রসাদ বাছার জানান, এই সমস্যার পেছনে জনসাধারণেরও দায় আছে। অনেকেই ড্রেনে ও খোলা জায়গায় আবর্জনা ফেলে। এর ফলে পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক পথ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, এমনিতে ১২৮ কিউসেকের চারটি পাম্পই পানি নিষ্কাশনের প্রধান ভরসা। এগুলোর মেয়াদও শেষ কয়েক বছর আগে। এসব পাম্পে মাত্রাতিরিক্ত অপচনশীল আবর্জনা ঢুকে যেকোন সময় পুরো ডিএনডিবাসীর জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।
হটনিউজ২৪বিডি.কম/এআর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top