সকল মেনু

প্রাচীর ভাঙ্গায় লালবাগ কেল্লার মূল নকশায় ক্ষতি

1435516454

নিজস্ব প্রতিবেদক, হটনিউজ২৪বিডি.কম ২৯ জুন : ৪শ বছরেরও বেশি সময় আগে নির্মিত ঢাকার মোগল স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন লালবাগ কেল্লার সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে এই পুরাকীর্তির মূল নকশার ক্ষতি করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সম্প্রতি গাড়ি রাখার স্থান তৈরির জন্য কেল্লার সীমানা প্রাচীরের একাংশ ভেঙ্গে ফেলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। অবশ্য হাইকোর্ট  রোববার এক আদেশে ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীর ভাঙ্গা ও কার পার্কিং নির্মাণ কাজ ২৪ ঘন্টার মধ্যে বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে। গত কয়েক দিন ধরেই চলছিলো এই প্রাচীর ভাঙ্গার কাজ। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনের মাধ্যমে এই কাজ বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিলো। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, দেয়াল ভাঙ্গার মাধ্যমে লালবাগ কেল্লার মূল নকশার ক্ষতি করা হয়েছে। এটা ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইনেরও পরিপন্থী। তিনি অবিলম্বে এই প্রাচীর পুনঃনির্মাণের দাবি জানান। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসাইন বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশে প্রাচীর ভাঙ্গার কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এই দেয়াল ভাঙ্গার কারণে কেল্লার মূল নকশার খুব একটা ক্ষতি হবে না। তারপরও আমি বিষয়টি দেখবো। কোন ত্রুটি পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেবো।’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে কেল্লার তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়ের কাছে ওই গাড়ি রাখার স্থান নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। গত ৭ মে মইনুল হক হাসান নামের একজন ঠিকাদার এ কাজের দায়িত্ব পান। গত সপ্তাহের শুরুর দিকে ওই ঠিকাদারের লোকজন কেল্লার উত্তর-পশ্চিম দিকের দেয়াল ভেঙে ভেতরে গাড়ি রাখার স্থান তৈরির কাজ শুরু করে।
প্রখ্যাত নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, কর্তৃপক্ষ লালবাগ কেল্লার দেয়াল না ভেঙ্গেও যদি কারপার্কিং তৈরি করতো, তখনও এই স্থাপনার মূল নকশা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কারণ এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এতে যে কোনও ধরনের পরিবর্তন আনতে গেলেই তা মূল কাঠামোর ক্ষতি করবে। তিনি আরও বলেন, আমরা যখনই ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের দাবি জানাই, তখন কর্তৃপক্ষ তহবিল সংকটের কথা বলেন। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে কারপার্কিং নির্মাণ করা হচ্ছে।
হাইকোর্টের রুল: ঐতিহাসিক নিদর্শন লালবাগ কেল্লার সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে কার পার্কিংয়ের কাজ ২৪ ঘন্টার মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক, লালবাগ কেল্লার কিউরেটর এবং লালবাগ থানার ওসিকে অবিলম্বে এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি আদেশ বাস্তবায়ন বিষয়ক একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন ৫ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চ  রোববার এই আদেশ দেন। এছাড়া প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ আইনের ১২ (৩) ধারা অনুসারে লালবাগ কেল্লা ও এর স্থাপনা সংরক্ষণ এবং ভেঙ্গে ফেলা সীমানা প্রাচীর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়ার কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। সংস্কৃতি সচিব, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ৫ জনকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত লালবাগ কেল্লার সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলা নিয়ে গত সপ্তাহে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশে’র পক্ষে এ ব্যাপারে একটি রিট আবেদন দায়ের করা হয়। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন রিট দায়েরকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, কেল্লার দেয়াল ভেঙে গাড়ি পার্কিং এর জায়গা করা হচ্ছে। আইন অনুসারে এর কোনো সুযোগ নেই, এটি অবৈধ। তাই কেল্লার বৈশিষ্ট্য যাতে পরিবর্তন করা না হয় এবং আইন অনুসারে যাতে সংরক্ষণ করা হয়, তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা চেয়ে এই রিট আবেদন করা হয়েছে। স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া: স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুব আলী  বলেন, আমরা প্রাচীর ভাঙ্গার সময় বাধা দিয়েছিলাম, কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের বাধা উপেক্ষা করেই এই প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে। তিনি অবিলম্বে প্রাচীরটি পুনঃনির্মাণের দাবি জানান। একই সাথে তিনি লালবাগ কেল্লার ভেতর অবৈধভাবে গড়ে তোলা সকল স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। ইতিহাস-ঐতিহ্যে লালবাগ দুর্গ: পুরান ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে দুর্গটির অবস্থান। এটি  আওরঙ্গাবাদ দুর্গ নামেও পরিচিত। নদীটি বর্তমানে আরও দক্ষিণে সরে গিয়ে দুর্গ থেকে বেশ খানিকটা দূর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রখ্যাত চিত্রকর ডয়েলী অঙ্কিত চিত্র থেকে (১৮০৯-১১) দেখা যায়, পূর্ব-পশ্চিমে আয়তাকারে বিস্তৃত দুর্গের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের অর্ধেকেরও বেশি নদী সংলগ্ন ছিল। যুবরাজ মুহম্মদ আজম বাংলার সুবেদার থাকাকালীন ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তার উত্তরসূরি শায়েস্তা খান ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করলেও দুর্গের কাজ সমাপ্ত করেননি। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খানের কন্যা বিবি পরী এখানে মারা গেলে দুর্গটিকে তিনি অপয়া হিসেবে বিবেচনা করে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। দীর্ঘদিন যাবত্ দুর্গটিকে এর প্রধান তিনটি ভবন (মসজিদ, বিবি পরীর সমাধিসৌধ এবং দীউয়ান-ই-আম), দুটি প্রবেশপথ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত একটি দুর্গ প্রাচীরের অংশের সমন্বয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সাম্প্রতিককালে খননের মাধ্যমে এখানে আরো কিছু ভবন কাঠামোর অস্তিত্ব উন্মোচন করে, যা বর্তমানে দুর্গের একটি মোটামুটি সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। বর্তমানে ১৮ একর বিস্তৃত দুর্গ এলাকায় খনন কাজের ফলে ২৬ থেকে ২৭টি কাঠামোর অস্তিত্বসহ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ছাদ-বাগান ও ঝর্নার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। সংস্কারের পর লালবাগ দুর্গ এখন বেশ খানিকটা উন্নত রূপ ধারণ করেছে এবং ভ্রমণকারী ও দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
হটনিউজ২৪বিডি.কম/এআর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top