সকল মেনু

আইলার ৬ বছর পূর্তি; শত শত পরিবার এখনো ঘরে ফিরতে পারেনি

unnamed  ওয়াহাব মুকুল,যশোর: ২৫মে ভয়ংকর বিধ্বংসী মহাপ্রলংকারী ঘূর্নিঝড় আইলার ৬ বছর পুর্তি। ২০০৯ সালের এই দিনে পৃথিবীর সর্ববৃহত ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকা দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন জনপদে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। নিমিষেই লন্ডভন্ড করে দেয় উপজেলার ৩টি পোল্ডার। ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয় কামারখোলা ও সুতারখালী দুটি ইউনিয়ন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ ভেঙ্গে কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। গৃহহীন হয় হাজার হাজার পরিবার।
আইলার পর সরকারী ও বেসরকারী বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা জনপ্রতিনিধিদের গাফিলতিতে পানিতে ভেসে যাওয়ার পর সরকারের অধিক অর্থ ব্যয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভেড়িবাঁধ নির্মান ও ক্লোজার আটকিয়ে দূর্গত এলাকাকে ২০১০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী পানি মুক্ত ঘোষনা করা হয়। বর্তমানে ওই এলাকা  আশংঙ্কা মুক্ত হলেও এখন ভেড়িবাঁধের উপর ঝুপড়ি ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছে দুটি ইউনিয়নের ২১৫৬ পরিবারের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার দূর্গত মানুষ।
উপজেলা প্রসাশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২৫ মে দেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের উপর দিয়ে আঘাত হানা ভয়ংকর আইলার মহা তান্ডবে উপকূলীয় জনপদ দাকোপ উপজেলার দুটি ইউনিয়ন কামারখোলা ও সুতারখালী ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়। প্রান হারায় ১৬ জন, নিখোঁজ হয় ৭ জন, আহত হয় ১১ জন। নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বৃদ্ধি পায় ৮/১০ ফুটেরও বেশি। পানির তোড়ে ৩টি পোল্ডারের ৭৫.৫ কিঃমিঃ ভেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিদ্ধস্থ হয়। আংশিক ক্ষতি হয় ৪৮৭ কিঃমিঃ। ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২৯৮৩২ টি পরিবারের ১৪৭৭০০ জন মানুষ। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ ফসলের জমির পরিমান ছিল ১৬৮০ একর, আংশিক ক্ষতি হয় ১৬০০ একর। সম্পূর্ণ ঘরবাড়ি বিধ্বস্থ হয় ২৫০৬৭ টি, আংশিক ক্ষতি হয় ৮৩৪৯ টি। মৃত: গবাদী পশু ও হাঁস, মুরগীর সংখ্যা ছিল ১৩৪০০ টি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বিধ্বস্থ হয় ১৩ টি, আংশিক ক্ষতি হয় ২৮০ টি। ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২টি ব্রীজ। এছাড়া ২৬৯৭ টি পুকুর ও ১৭৫২টি চিংড়ি ঘের ডুবে ভেঁসে যায় কোটি কোটি টাকার মাছ।
এদিকে আইলা বিধ্বস্ত কামারখোলা, জয়নগর, ভিটেভাঙ্গা, শিবনগর, শ্রীনগর, গুনারী, সুতারখালী, কালিবাড়ি, গোলবুনিয়া, কালাবগী, নলিয়ান গ্রাম সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে আইলা দূর্গত ২৭৬৭৬ পরিবারের ১৪০২০০ মানুষ ঘরে ফিরেছেন। বাকি ২১৫৬ পরিবারের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার দূর্গত মানুষের ভিটেবাড়ি আইলায় সম্পর্ণ গ্রাস করায় তারা ভেড়িবাঁধের উপর ঝুপড়ি ঘরে এখনো পর্যন্ত অত্যান্ত মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছে। সরকার নতুন করে পূনর্বাসন না দিলে আর কোনদিন এদের বাপদাদার ভিটেমাটিতে ফেরা হবেনা বলে দাবী করেছেন তারা। দূর্গতদের কর্ম সংস্থান নেই, ঘরে চাল নেই, খাবার পানির তীব্র সংকট, নেই স্যানিটেশন ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। দূর্গত মানুষের ভাগ্যে কি আছে এখনও তারা জানেনা। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে পূনর্বাসনের জন্য সরকারের দেওয়া ১ লাখ ২০ হাজার টাকার তৈরী অধিকাংশ পাকা ঘরে  মানুষের পরিবর্তে গরু, ছাগল, হাঁস মুরগী বাস করছে বলে জানা গেছে। দূর্গত এলাকার শতভাগ মানুষ শ্রমিক হলেও কোথাও শ্রম দেওয়ার জায়গা না থাকায় অনেক পরিবার জীবন জীবিকার সন্ধানে ভারত সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজ জন্মস্থান ছেড়ে চলে গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সামান্য সংখ্যক শ্রমিক কাবিখা ও ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচীর সাথে জড়িত রয়েছে। এছাড়া দূর্গত এলাকায় ওএম এসের চাল বিক্রী ও ভিজিএফ এর চাল দেওয়া বন্ধ রয়েছে। গৃহ নির্মানের ২০ হাজার টাকা পরিবার প্রতি বিতরণ করলেও সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন না করায় গৃহনির্মান কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সুতারখালী ইউনিয়নের গুনারী গ্রামের কৃষক বাসুদেব মন্ডল জানান আইলায় তার ঘরবাড়ি ফসলি জমি সবকিছুই শিবসা নদীতে বিলিন হয়েছে। এখন পাশ্ববর্তী ভেড়িবাঁধের উপর পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। দীর্ঘ ২/৩ বছর আমার ফসলি জমিতে আমন ধান উৎপাদন করতে না পারায় সংসারে অভাব অনটন দেখা দিয়েছে। এখন এলাকায় সরকারী-বেসরকারী ভাবে ত্রান তৎপরতা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। ৫নং সুতারখালী ইউপি চেয়ারম্যান জি এম আশরাফ হোসেন জানান দেখতে দেখতে আইলার ৬টি বছর কেটে গেল। নলিয়ান নদীতে ও কালাবগী জুলন্ত পাড়া এলাকায় বাঁধ না হওয়ায় এখনও পর্যন্ত ১৯শ পরিবারের দূগর্ত মানুষ তাদের পূর্বের জীবন যাত্রায় ফিরতে পারেনি। তারা অনেক নিরব কষ্ট ও অভাবের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি সরকারের নিকট নদী ভাঙ্গন ও দূর্যোগ মোকাবেলায় টেশসই ভেড়িবাঁধ নির্মানের দাবি জানান।
উপজেলার ৬নং কামারখোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উমাশংকর রায় জানান, ইউনিয়নের মাত্র ৪৭ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহার করছে। সুপেয় পানির ব্যবস্থা এ অঞ্চলে নেই বললে চলে, কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়নে  হাতে গোনা কয়টি পুকুরের পানি পান করার উপযুক্ত। ৮/১০ কিঃমিঃ  দূর থেকে দৈনিকের খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। অনেকেই নৌকা অথবা ট্রলার যোগে নদীপথে ১৫/১৬ কিঃমিঃ পাড়ি দিয়ে দাকোপ ও কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়ন থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। আবার কেউ কেউ শিবসা নদী পাড়ি দিয়ে হড্ডা ইউনিয়ন থেকে পুকুরের পানি সংগ্রহ করে। এছাড়া চাষীদের চাষাবাদের সরঞ্জামাদি না থাকায় আগামী আমন মৌসুমে কি দিয়ে তারা চাষাবাদ করে ফসল ফলাবে এ নিয়ে এলাকার কৃষকরা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। তিনি সরকারের নিকট কামারখোলা ইউনিয়নে ভেড়িবাঁধের উপর বসবাসরত ২৫৬ পরিবারের পূনরবাসনের ব্যাবস্থা করার দাবি জানান।
দূর্গত এলাকায় উন্নয়ন সম্পর্কে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, আইলার পর থেকে এযাবৎ কাল পর্যন্ত সরকারী অনুদান হিসেবে কামারখোলা ও সুতারখালী ২টি ইউনিয়নের দূর্গতদের গৃহ নির্মানের জন্য দেওয়া হয়েছে ২১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয় ২টি সাইক্লোন শেল্টার যার নির্মান কাজ চলমান। ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি ২২ লক্ষ টাকা। ২১ লক্ষ টাকা ব্যয় ১টি ব্রীজ করা হয়েছে। এবার ৫৪ লাখ টাকা ব্যয় আরো ২টি ব্রীজের কাজ চলছে। জলবায়ু ট্যাষ্ট ফান্ড থেকে ১১-১২ অর্থ বছরে ৩শ‘টি পাকা ঘর ও ২৫টি টিনের ঘর দেওয়া হয়েছে যার ব্যয় সোয়া ৫ কোটি টাকা। ইতি পূর্বে ওই ঘরগুলি সুবিধাভোগীদের হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া ১০৮১ মেঃ টন টিআর ও কাবিখার চাউল দিয়ে এলাকার উন্নয়ন করা হয়েছে। তাছাড়া সরকারের রুটিন ওয়ার্কে খাল খনন, পুকুর খননসহ এলাকার উন্নয়ন কাজ চলছে এবং ওই এলাকায় বিভিন্ন এনজিও পৃথক পৃথক ভাবে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দূর্গতদের সাহায্য ও এলাকার উন্নয়ন করেছে।
অপরদিকে ৬০ এর দশকের পানি উন্নয়ন বোর্ডের আখ্যায়িত ৩২ নাম্বার পোল্ডার কামারখোলা ও সুতারখালী পাউবোর তত্ত্বাবধানে যে সমস্ত স্থানে ভেড়িবাধ মেরামত করা হয়েছে তাতেও ব্যাপক ত্রুটি রয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। বাঁধের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আগের চেয়ে কমানো হয়েছে। জোয়ারের পানি থেকে সুরক্ষার জন্য বাঁধের উচ্চতা ও বাঁধের দুপাশে পর্যাপ্ত পরিমানে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়নি। ফলে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমায় জোয়ারের পানি বেড়ে গিয়ে বাঁধে ফাঁটল ও ভাঙ্গন দেখা দিচ্ছে। সরকারী কোন নির্দিষ্ট নিতিমালা ও তদারকির অভাবে বেঁড়িবাধ গুলো আবারও হুমকির মুখে পড়েছে বলে এলাকাবাসী জানায়।

ছবির ক্যাপশন
০১– সব যায়গায় পানি তাই গবাদি পশুকে ‘ঢিবা’ তার উপর রাখা হয়েছে।(কয়রা)
০২– বেড়ী বাঁধের উপর এখনও খুপড়ি ঘরে মানবেতর জীবন যাপন।(দাকোপ)
০৩– ভাবেই বেড়ী বাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। (কয়রা)
০৪– এখনও চারীদিকে পানি আর পানি। মেরামোত করার সংগতি নাই, তাই ঘরে ফেরা হয়নি। (কয়রা)
০৫– ঐ (কয়রা)
০৬– কে কখন রিলিফ নিয়ে আসবে তাই খাওয়া জুটবে, এ জন্য পথপানে চেয়ে থাকা।(দাকোপ)
০৭– বিশুদ্ধ ও সুপেয় খাবার পানির জন্য হায়াকার। (কয়রা)
১১– নিজেদের উদ্যোগে ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ মেরামতের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। (কয়রা)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top