সকল মেনু

কায়দার কায়দা ,ওরে কায়দা……

 unnamed কোটালীপাড়া থেকে গৌরাঙ্গ লাল দাস: “ভাইরে ভাই,জীবনে যা দেখ নাই, ভাল কইরা দেখ তাই,বাংলাদেশের পতাকা আইল,দেখতে কত সুন্দর লাগল”। একই ছন্দে নেচে গেয়ে গত ৪০ বছর ধরে গ্রাম বাংলার হাজার হাজার মেলা প্রাঙ্গনে সব বয়সি মানুষকে স্থির চিত্র দেখিয়ে আনন্দ দিয়ে আসছে বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা গ্রামের সর্বানন্দ মধু(৬৫)। ৪০ বছর আগের কেনা একটি কাঠের বাক্সই তার বেচে থাকার সম্বল। এই বাক্স দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়েই তার সংসার চলে। এক হাতে প্রেমজুড়ি বাজিয়ে অন্য হাতে বাক্সের চাবি ঘুরিয়ে স্থির চিত্র প্রদর্শন করেন সর্বানন্দ। বাক্সের আতশ  কাঁচে চোক রেখে স্থির চিত্র দেখে উৎফুল্ল হয় শিশু,কিশোর,যুবা কিম্বা বৃদ্ধ।
গত বৈশাখী মেলায় গোপালগঞ্জের  কোটালীপাড়া উপজেলার  ঐতিহ্যবাহী সিদ্ধান্ত বাড়ী বুড়া ঠাকুরের আশ্রমের সামনে দেখা যায় সর্বানন্দ মধু তার কায়দার কায়দা বাক্স নিয়ে নিজস্ব ঢঙ্গে সবাইকে আহবান জানাতে। তার আহবানে সারা দিয়ে কাঠের বাক্সে চোখ রেখে দেখা গেল কিছু স্থির চিত্র। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা,বর্তমান ও সাবেক কয়েক জন সরকার প্রধান,ক্ষুদিরামের ফাসিঁ,রাম লক্ষনের যুদ্ধ,স্বর্গ ও নরকের কাল্পনিক চিত্র,চিড়িয়াখানা,গোপাল ভার,মক্কা ও মদীনা সহ আরও কয়েকটি স্থির চিত্র।
এখানে বসেই কথা হয় সর্বানন্দের সঙ্গে। তিনি জানান-মাত্র ২০ বছর বয়সে সর্বানন্দ অভাবের তাড়নায় কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতে যশোহর গিয়েছিলেন। সেখানে পরিচয় হয় ভারতীয় এক নাগরিকের সঙ্গে। বয়সের ভারে সে নামটি আজ মনে পরছে না বৃদ্ধ সর্বানন্দের। তার কাছ থেকে মাত্র ১৮ টাকায় ক্রয় করেন এই কাঠের বাক্সটি। ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। গ্রামে ফিরে পরিবারের লোক জন সহ আশপাশের লোকজনের তিরস্কার করতে থাকে। সকলের বক্তব্য ছিল এতো গুলো টাকা নস্ট করার কোন মানে হয় না। কিন্তু সর্বানন্দের মনে ছিল অন্য উদ্দেশ্য। এই ১৮ টাকার বাক্সটি হবে তার সারা জীবনের অবলম্বন। জীবিকার এক মাত্র মাধ্যম। নিজ  গ্রামের চৈত্র সংক্রান্তীর মেলায় জন প্রতি ৫ পয়সা করে নিয়ে স্থির চিত্র দেখিয়ে প্রথম দিনে ৩০ টাকা আয় করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন সর্বানন্দ। দুর হয় তার আর্থিক সংকট। শুরু হয় স্বচ্ছল ও সুখি সর্বানন্দের নতুন জীবন। সর্বানন্দ তার জীবন জীবিকা নিয়ে সন্তুষ্ট। সদা  হাস্যজ্জল মানুষটির কর্মোদ্দ্যমের কাছে বার্ধক্যও হার মেনেছে।
৩ ফুট দৈর্ঘ,২ ফুট প্রস্থ,২ ফুট উচ্চতার বাক্সটিতে এক সঙ্গে ৪ জন দর্শক প্রদর্শনি দেখতে পারেন। প্রায় ১০ মিনিটের প্রতিটি প্রদর্শনী গানের সুরে সুরে বিবৃত কাহিনীতে হয়ে ওঠে প্রানবন্ত।
মেলায় আগত গৃহিনী সবিতা হালদার কায়দার কায়দায় স্থির চিত্রের প্রদর্শনী দেখে বলেন-এক সময় মেলায় আগত শিশু-কিশোর,যুবাদের আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দু ছিল এ কায়দার কায়দা বাক্স। কিন্তÍু কালের পরিক্রমায় গ্রাম গুলো থেকে যেমন অসংখ্য মেলা হারিয়ে গেছে তেমনি হারিয়ে যেতে বসেছে এই কায়দার কায়দা যন্ত্রটি। আমাদের আবহমান বাংলার ঐতিহ্য মেলা ও এই কায়দার কায়দা বাক্সটি ধরে রাখা উচিত।
কর্মজীবি মহিলা সন্ধ্যা রানী বাড়ৈ বলেন-প্রযুক্তির ভেল্কি নয়। চিরায়ত গ্রাম বাংলার শাশ্বত ঐতিহ্যের ধারক এই কায়দার কায়দা বাক্স। প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারনে বিনোদনের এ সব মাধ্যমের প্রতি মানুষের আগ্রহ এখন কমে গেছে। আমাদের উচিত এ ধরনের মাধ্যমকে ধরে রাখা।
কলেজ ছাত্র চয়ন হাওলাদার বলেন-এত প্রতিকুলতা সত্যেও যে সামান্য কজন মানুষ এ দেশের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সর্বানন্দ তাদের মধ্যে অন্যতম। আমি মনে করি সর্বানন্দ গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতির অবিচ্ছদ্য অঙ্গ।
সর্বানন্দ বলেন-আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার এই কায়দার কায়দা বাক্সটি নিয়ে এ দেশের মানুষকে আনন্দ দিতে চাই। আমার চিত্র কর্মের মতো বাংলাদেশ যেন সম্প্রতি ও সমৃদ্ধপূর্ন হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top