সকল মেনু

রানা প্লাজা দু’বছরে প্রাপ্তি: না বিচার না ক্ষতিপূরণ

siadboss_1366784804_2-rana-plaza-bg20130423230052জ্যোতির্ময় বড়ুয়া  : দু’বছর ঘুরে এল সেই ভয়াবহ বিভীষিকার দিন, হাজার প্রাণের হারিয়ে যাওয়ার দিন। একসাথে মৃত্যুর ইতিহাসে সর্বাধিক মৃত্যুর রেকর্ড সৃষ্টির দিন। রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ার দিন। যারা প্রাণ হারিয়েছেন, যারা গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন কিংবা যারা এখনও তাদের নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজে ফিরছেন- তাদের প্রতি সমবেদনা জানাই।

এই দুই বছরে মৃতদের আত্মীয়-স্বজন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টি এখনও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। মালিক, বিদেশী ক্রেতা, সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে খুবই অসংগঠিতভাবে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও মৃত শ্রমিকের আত্মীয়দের অনুদান দেয়া হলেও কখন কাকে কোন বিবেচনায় কত টাকা দেয়া হয়েছে তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আই,এল,ও,) তত্ত্বাবধানে কিছু কিছু শ্রমিকদের অনুদান দেয়ার কথা শোনা গেলেও সেখানে কাউকে তিপ্পান্ন লক্ষ টাকা আবার কাউকে চার লক্ষ টাকা দেয়ার কথাও শোনা গেছে। কোন বিবেচনায় কেন একজনকে তিপ্পান্ন লক্ষ আর অন্যজনকে চার লক্ষ টাকা দেয়া হলো তা এখনও জানা যায়নি। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা যায়- এই অনুদান দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুতর অব্যবস্থাপনা রয়েছে। কেউ কেউ আবার ভুলবশত একে ক্ষতিপূরণ হিসেবেও ব্যাখ্যা করার প্রয়াশ পাচ্ছেন। কিন্তু, কোন মানদণ্ডে এটি ক্ষতিপূরণ তার কোনো ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত কেউ হাজির করেননি।

বাংলাদেশের বিদ্যমান শ্রম আইনের ১৯, ১৫১ ধারা ও পঞ্চম তফশিলে বর্ণীত বিধান মোতাবেক, কর্মস্থলে কোনো শ্রমিক যদি জখমের কারণে মারা যান তাহলে সেই মৃত শ্রমিকের জন্য এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ, আর যদি কোনো শ্রমিকের জখমের ফলে স্থায়ী সম্পূর্ণ অক্ষমতা ঘটে তাহলে তিনি এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এই ক্ষতিপূরণ কোন বিচারেই বর্তমান সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং শ্রমিক কিংবা সচেতন নাগরিক কেউই ক্ষতিপূরণের এই পরিমাণ নিয়ে সন্তুষ্ট নন। কেবলমাত্র পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ ছাড়া আর কেউ ক্ষতিপূরণের এই পরিমাণ নিয়ে খুশি ছিলেন না। রানা প্লাজা ঘটনার পর এটির সংশ্লিষ্টতায় মহামান্য হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের পক্ষ থেকে একটি এবং অপর আইনজীবীদের পক্ষ থেকে একটি- মোট তিনটি রিট মামলা রুজু হয়। (রিট মামলা নং- ৪৩৫৩/২০১৩, ৪৪২৮/২০১৩ ও স্যুয়ো মোটো নং- ৯/২০১৩)। উক্ত মামলায় আদেশ হওয়ার পরই আমরা রানা প্লাজার মালিক ও অন্যান্য পাঁচজন পোশাক শিল্প মালিকদের গ্রেপ্তার হতে দেখি। বর্তমানে, উল্লেখিত তিনটি রিট মামলা মহামান্য হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে। ইতিমধ্যে মহামান্য আদালতের নির্দেশে সরকার সাভার ক্যান্টনমেন্টের জিওসি-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পদ্ধতি নির্ধারণ করে সুপারিশ করার জন্যে এবং সেই কমিটি আদালতে ইতিমধ্যে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেছেন যেখানে কমিটি চৌদ্দ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ সুপারিশ করেছে। উক্ত তিনটি রিট মামলা চালু থাকা অবস্থায় কোনো কর্তৃপক্ষ যদি দাবি করেন যে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে তাহলে সেটি হবে বিচারাধীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সামিল। অনেকেই ক্ষতিপূরণ এবং অনুদান এই দুটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলছেন। বিজিএমইএ এরকমটাই দাবি করে আসছে ঘটনার প্রথম দিক থেকে যখন তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে অনুদান দিতে শুরু করলেন সেই সময় থেকে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল সংক্রান্ত বিষয়ে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আলাদা কোনো তহবিল নেই, অতিতেও ছিল না। এখন প্রশ্ন জাগে- তাহলে এ বিষয়ে বিগত দুই বছরে কিছুই জানানো হলো না কেন? এই তহবিলের তথ্য চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক কয়েকটি আবেদন করেছিলেন বলে শুনেছি। তিনি সেসবের উত্তর পেয়েছেন কিনা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি টিআইবি কর্তৃক দাবি করা হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে মোট ১২৭ কোটি টাকা অব্যবহৃত পড়ে আছে যা মূলত ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাপ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর টিআইবি’র দাবি প্রত্যাখান করলেও ঠিক সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ও যারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্যে বিগত দুই বছর যাবত কাজ করছেন তারা হতাশ হবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের উচিত হবে স্বচ্ছতার খাতিরে হলেও এই তহবিলের খরচের একটি পূর্ণাঙ্গ হিসাব জনগণের সামনে তুলে ধরা।

ক্ষতিপূরণ ছাড়াও অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন। এই দিকটিতে যেসব ব্যক্তিগত উদ্যোগ দেখা গেছে তাতে কোনো প্রকার সমন্বয় নেই। কোন ব্যক্তি বা সংগঠন কার জন্যে কাজ করছেন তার কোথাও কোনো তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ নেই। দেখা যাচ্ছে একের অধিক দল একই ব্যক্তিকে সহায়তা দিচ্ছে অথচ অপরদিকে কেউ একজন কোনো সহায়তাই পাননি। তাছাড়া, এই দুই বছরে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো উদ্যোগও দেখিনি যেখানে এমন একটি ‘তথ্য কেন্দ্র’ সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন যেখান থেকে রানা প্লাজা সংক্রান্ত সব রকমের তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পূর্ণাঙ্গ কোনো সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়নি যেখানে যেসব ক্ষতিগ্রস্তদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা সেবা লাগবে তাদের সেটি দেয়া সম্ভব হবে। এসব দাবি নতুন কিছু নয়, কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবে এসব অত্যাবশ্যকীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

আমাদের দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রায়োগিক শিথিলতার কারণে অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত যদি হন গরিব শ্রমিক আর প্রতিপক্ষ হন ধনী মালিক তাহলে তো কথাই নেই। রানা প্লাজা ধসের পূর্বে তাজরিন গার্মেন্টস কিংবা স্পেকট্রাম গার্মেন্টসে কাঠামোগত যে হত্যাকাণ্ড তাতে মালিকদের যথাযথভাবে আইনের মুখোমুখি করা যায়নি। এযাবতকালে এসব ঘটনায় অবহেলার কারণে মৃত্যু ঘটানোর দায়ে মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। সেসব মামলায় কেউ শাস্তি পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। ফলে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু আছে তার কারণে কল-কারখানায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেকে দিলেও কোনোভাবেই মালিকের শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। রাজা প্লাজা ধ্বসের ঘটনার পূর্বাপর যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে মালিক পক্ষ রানা প্লাজা ভবন ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও শ্রমিকদেরকে কারখানায় যেতে এবং কাজ করতে বাধ্য করেছেন। তাহলে এক্ষেত্রে অবহেলার পরিবর্তে ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিচার করতে বাধা কোথায়? রানা প্লাজা ঘটনার সংশ্লিষ্টতায় ঢাকাস্থ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মালিকের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন এক মৃত শ্রমিকের ভাই। সেটি আদালত পুলিশকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। এই মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে আর জানা যায়নি। মালিকের অবহেলা হোক আর ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডই হোক- শাস্তি নিশ্চিত করা হবে দেশে আইনের শাসন আছে সেটি সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করানোর একটি অন্যতম উপায়। বিচার, শাস্তি- এসব প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা যতটা না প্রতিশোধ তার চেয়েও বরং সামাজিক সমতা বিধান করা।

নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা ও হেফাজত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সে দায়িত্ব কেবল মালিকের ঘাড়ের ওপর দিয়ে পার করে দিতে পারে না। এই দায়িত্ববোধ থেকে রাষ্ট্রের বিচারিক সমতা বিধান করা অন্যতম কর্তব্য। যে কারখানা পরিদর্শকের দায়িত্ব ছিল আইনি বিধি বিধান প্রতিপালন হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত পরিদর্শন করা সেখানে পরিদর্শক কোনো দায়িত্বই পালন করেননি। ফলে কারখানা পরিদর্শকের সুস্পষ্ট দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ আছে। অথচ তাকে কোনো ধরনের জবাবদিহিতা বা বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। এই হত্যার দায় তাই মালিকের একার নয় রাষ্ট্রেরও। রাষ্ট্র অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে নজির সৃষ্টি করতে না পারলে মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে।

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top