সকল মেনু

পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্র প্রতিভার স্ফুরণ

debojyot-1428129474ডেস্ক রিপোর্ট : চেকোস্লোভিয়ার পণ্ডিত ড. দুসান জাবিতেলের মতামত সমর্থন করে আমরাও বলি, ‘রবীন্দ্রনাথ মানুষ ও কবি হিসেবে যা হয়ে উঠেছিলেন তা তিনি হতে পারতেন না যদি পূর্ববাংলার গ্রামদেশে না আসতেন, আর যদি লাভ না করতেন পদ্মাপাড়ের মরমী বাউলদের অন্তরঙ্গ সাহচর্য।’
প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন, ‘কলকাতার নাগরিক সন্তানকে মহাকবির পদবী দান করলো বাংলাদেশের জনপদ আর পল্লী আর নদনদী শস্যক্ষেত্র নিচয়ের ঋতুভেদে বিচিত্র দৃশ্যাবলী।…এ তার জন্মস্থান নয়, এখানে এসে পৌঁছাতে তার কিছু বিলম্ব হয়েছে- তাই তার প্রতিভা স্ফুরণেও কিছু বিলম্ব ঘটেছে।’
পূর্ববাংলার রবীন্দ্র-ভুবন রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে নতুন উপাদানে সমৃদ্ধ করেছিল যে, এর ফলে তার শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতায় চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটে। এই জীবনভিত্তিক অভিজ্ঞতা তার জন্য ছিল একেবারে নতুন, সম্পূর্ণ অভিনব। নাগরিক-কবি রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে, আত্মীক সম্পর্ক গড়ে ওঠে জমিদারি দেখাশোনা উপলক্ষে শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরে আসা ও বসবাসের মধ্য দিয়ে। পরিচয় ঘটে গ্রামবাংলার অপরূপ নিসর্গ-সৌন্দর্যের সঙ্গে, জীবন ও জনপদের সঙ্গে। পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনের দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষা ও সংস্কারাচ্ছন্নতার মতো অনেক কিছুই নাগরিক কবিকে রূঢ়, নগ্ন বাস্তবতার মুখোমুখি করে দিয়েছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে হতশ্রী গ্রামীণ জীবনের দ্বন্দ্ব হয়তো এ উপলব্ধির উৎসার ঘটিয়ে থাকবে। পদ্মা-ইছামতি-আত্রাই-গড়াই-বড়াল-নাগর নদী এবং বিশাল চলনবিল তীরবর্তী অঞ্চলের রূপবৈচিত্র্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় নতুন, বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত উৎসমুখ খুলে দিয়েছিল, তার সৃষ্টিকে বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল।
তাকে প্রভাবিত করে এই এলাকার মানুষ ও প্রকৃতি। এছাড়াও পূর্ববাংলার জীবন ও জনপদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রভাব রোমান্টিক কবির চেতনায় গভীর দাগ কাটে, দাগ কাটে কবি-মনের সংবেদনশীল পলিস্তরে। কবির উপলব্ধি কর্মী রবীন্দ্রনাথের জন্ম দেয়। পল্লী উন্নয়ন ও স্বদেশী সমাজ গঠন তার জন্যে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। কবি’র স্বপ্ন হয়ে ওঠে আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী গ্রামীণ মানুষের এক স্বনির্ভর সমাজ। গ্রামবাংলার জীবন ও নিসর্গ রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে বাস্তব জীবন রসে সমৃদ্ধ আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের জন্ম দিয়েছে।বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি রচনা করেছেন কবিতা-গান :
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’
সংগীতটির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি উচ্ছ্বাস অনুসরণ করলে এই একটিই জীবনসত্য আমাদের সামনে প্রতিভাত হয় যে, সংগীতটির রচয়িতার অন্তস্থল থেকে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে তাই-ই শব্দের মাধ্যমে উচ্ছ্বাসে প্রকাশিত হয়েছে। এবং এই অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গদর্শন (বর্তমান বাংলাদেশ)-কালে সঞ্জীবিত।
প্রকৃতি অংশের মূল নায়ক পদ্মা। কত বিচিত্রভাবে কবি এই পদ্মাকে উপলব্ধি করেছেন, তার পরিচয় আছে সমকালীন পত্রাবলী- ছিন্নপত্রে। পদ্মা শুধু ভৌগোলিক নদী নয়, রূপ ছাড়িয়ে কখনো রূপকে পরিণত হয়েছে। উপলব্ধির স্তর ভিন্ন থেকে ভিন্ন হয়েছে। কবি লিখেছেন, ‘বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড় ভালবাসি।…এখন পদ্মার জল অনেক কমে গেছে, বেশ স্বচ্ছ কৃশকায় হয়ে এসেছে, একটি পাণ্ডুবর্ণ ছিপছিপে মেয়ের মত, নরম শাড়িটি গায়ের সঙ্গে বেশ সংলগ্ন। সুন্দর ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে, আর শাড়িটি গায়ের গতির সঙ্গে বেশ বেঁকে যাচ্ছে। আমি যখন শিলাইদহে বোটে থাকি তখন পদ্মা আমার পক্ষে সত্যিকার একটি স্বতন্ত্র মানুষের মতো।’
তিনি আবার লিখেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে উঠে দেখি তটদৃশ্য অল্প অল্প করে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে। এতদিন সামনে ঐ দূর গ্রামের গাছপালার মাথাটা সবুজ পল্লবের মেঘের মতো দেখা যেত, আজ সমস্ত বনটা আগাগোড়া আমার সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়েছে- ডাঙা এবং জল দুই লাজুক প্রণয়ীর মত অল্প অল্প করে পরস্পরের কাছে অগ্রসর হচ্ছে- লজ্জার সীমা উপছে এল বলে, প্রায় গলাগলি হয়ে এসেছে।’
এভাবেই পদ্মা দেখে রবীন্দ্রনাথের কবি মনে ভাব সত্যের উদয় ঘটে। পদ্মাকে এতো বিচিত্রভাবে বাংলার কোন কবি এর আগে অনুভব করেননি। কবি রবীন্দ্রনাথের প্রবাস জীবনের সহচরী পদ্মা উপলব্ধির বৈচিত্র্য ঘটিয়েছে, ভাব সত্যের প্রকাশ দেখিয়েছে, মানবিক সত্যকে প্রকাশ করেছে। পদ্মায় ভেসে যাওয়া মৃত পাখি দেখে কবির মনে হয়েছে, ‘আজকাল প্রায়ই দেখতে পাই ছোটো ছোটো মৃত পাখি স্রোতে ভেসে আসছে-তাদের মৃত্যুর ইতিহাস বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। কোন এক গ্রামের ধারের আমবাগানের আম্রশাখায় তাদের বাসা ছিল। তারা সন্ধ্যের সময় বাসায় ফিরে এসে পরস্পরের নরম ডানাগুলি একত্রিত করে শ্রান্ত দেহে ঘুমিয়ে ছিল; হঠাৎ রাত্রে পদ্মা একটুখানি পাশ ফিরেছেন, অমনি গাছের নিচেকার মাটি ধ্বসে পড়ে গেছে, গাছ তার সমস্ত ব্যাকুল প্রসারিত শিকড়গুলো নিয়ে জলে পড়ে গেছে, নীড়চ্যুত পাখিগুলো হঠাৎ রাত্রে এক মুহূর্তের জন্য জেগে উঠল- তার পর আর জাগতে হলো না। এই ভাসমান মৃত পাখিগুলিকে দেখলে হঠাৎ মনের মধ্যে বড় একটা আঘাত লাগে। বুঝতে পারি আমরা যে প্রাণকে সব চেয়ে ভালোবাসি প্রকৃতির কাছে তার মূল্য যৎসামান্য।’
কবির চিঠিতে গ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে এভাবে : ‘গ্রামের চতুর্দিকে ঘন জঙ্গল আচ্ছন্ন এবং অন্ধকার তাতে আবার তারই মধ্যে জলপ্রপাত করে সমস্ত পাতা লতা গুল্ম পচতে থাকে, গোয়ালঘর এবং মানবগৃহের আবর্জনা সমস্ত চারদিকে ভাসতে থাকে, পাট পচা দুর্গন্ধ জলের রঙ নীল হয়ে ওঠে। পেটমোটা, পা সরু রুগ্ন ছেলেমেয়েগুলো যেখানে সেখানে জলে কাদায় মাখামাখি, ঝাঁপাঝাঁপি করতে থাকে, মশার ঝাঁক পচা জলের উপর একটি বাষ্পস্তরের মত ঝাঁক বেধে ভন ভন করতে থাকে। গৃহস্থের মেয়েরা একখানা ভিজে শাড়ি জড়িয়ে বাদলার ঠান্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে জল ঠেলে সহিষ্ণু জন্তুর মতো ঘরকন্নার নিত্যকর্ম করছে, তখন সে দৃশ্য কিছুতেই ভালো লাগে না। ঘরে ঘরে বাতে ধরেচে, পা ফুলছে, সর্দি হচ্ছে, জ্বর হচ্ছে, পিলেওয়ালা ছেলেগুলো অবিশ্রাম ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদছে, কিছুতেই তাদের বাঁচাতে পারছে না।  এত অবহেলা, অস্বাস্থ্য, অসৌন্দর্য, দারিদ্র্য, বর্বরতা মানুষের আবাসস্থলে কিছুতেই শোভা পায় না।’
এসব চিঠি পড়ে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা খুবই কাছ থেকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে অবলোকন করেছিলেন। যা তার গল্প, উপন্যাস, কবিতা এবং নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে।
‘জাভাযাত্রীর পত্র’-তে কবি লিখেছেন, ‘বাঙলা দেশের পল্লীতে সন্ধ্যাবেলায় চাঁদ উঠেছে অথচ গান উঠেনি, এমন কখনো হয় না।’ তিনি এ কথা লিখে প্রমাণ করেছেন তিনি মানুষের অতি ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলেন। জমিদারি পরিদর্শন ও পরিচালনা করতে এসে বাঙলার অন্তরের সঙ্গে তাঁর যোগ হলো- মানুষকে তিনি পূর্ণদৃষ্টিতে দেখলেন। তার কাব্যের মধ্যে হৃদয়াবেগের আতিশয্যে এ যুগে বহুল পরিমাণে মৃদু হয়ে আসলো; পদ্মা তার কাব্যে ও অন্যান্য রচনায় নতুন রস, নতুন সৌন্দর্য দান করলো। তাই তো তিনি লিখতে পেরেছেন :
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।’
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে শ্রীবিনয় ঘোষ লিখেছেন, ‘রুদ্ধশ্বাস শহুরে পরিবেশ থেকে তার মন তাই কাব্যের উৎস সন্ধানে আত্মপ্রকাশের অস্থিরতায় ছুটে যেত পল্লীর মানুষের কাছে এবং একান্ত নিভৃতে তাদের জীবন গঙ্গায় অবগাহন করে তিনি পরিতৃপ্ত হতেন, সৃষ্টির শক্তির সঞ্চয় করতেন।’
পূর্ববঙ্গে জমিদারি পরিদর্শন ও দায়িত্ব পালনের সময় ১৮৯১ থেকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র দশ বছরে রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখেছেন ৫৯ টি। ৬০টিই হতো যদি ‘নষ্টনীড়’ গল্পটি শেষ করতে পারতেন। শুরু হলেও সেটি শেষ হয় কলকাতায়। রবীন্দ্রনাথের গল্পে পদ্মাপর্বের প্রকৃতির চেয়ে মানুষই প্রাধান্য পেয়েছে তার জমিদারি-পর্বের গল্পগুলোতে। তাই বলে প্রকৃতি অনুপস্থিত নয়। রবীন্দ্রনাথ তার গল্পে জনপদের কলরব ও বিশাল  উদার প্রকৃতির নীরবতাকে জাদুকরের মতো আশ্চর্য কৌশলে মিলিয়ে দিয়েছেন। কবির চেতনায় গল্পকারের আবির্ভাবের জন্য যে উপকরণ ও পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিলো, পদ্মা এবং তার জনপদ ও নিসর্গ সেই প্রয়োজনীয় উৎস ও পটভূমি সৃষ্টি করেছিল।
রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গে জমিদারি করতে আসার আগেও গল্প লিখেছেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ জীবনের; পল্লী প্রকৃতির ও রহস্যময়ী পদ্মার বহুবিচিত্র ও সংঘাতময় যে রূপ গল্পে তুলে এনেছেন তা সম্ভব ছিল না। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করে বলেছেন, ‘এই সময় বিষয়কর্মের ভার আমার প্রতি অর্পিত হওয়াতে সর্বদাই আমাকে জলপথে ও স্থলপথে পল্লীগ্রামে ভ্রমণ করিতে হইত-কতকটা সেই অভিজ্ঞতার উৎসাহে আমাকে ছোটগল্প রচনায় প্রবৃত্ত করেছিল।’ পদ্মার রূপ-রহস্য, পদ্মার আশপাশের জনপদ প্রকৃতি রবীন্দ্র চেতনায় গল্পসৃষ্টি প্রেরণা যুগিয়েছে। মানুষ ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে শিল্পসত্তা আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ নানান মাত্রায়। শিলাইদহে তার লেখা প্রথম গল্প ‘দেনা পাওনা’। নারীসত্তার জাগরণ তিনি পদ্মাপাড়ের বা শিলাইদহ অঞ্চলের গ্রাম্য নারীদের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের সহজ-সরল মানুষের কাছাকাছি এসে পল্লীপ্রকৃতির প্রভাবে নতুন নতুন সৃষ্টির সম্ভারে সমৃদ্ধ হন। এর প্রকাশ ঘটে শিলাইদহে বসে লেখা তার কবিতাতেও।
রবীন্দ্রনাথ যখন পূর্ববঙ্গে আসেন তখন শিলাইদহ, শাহজাদপুর এবং পতিসর অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল তা জানা যায় ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের লোকগণনার প্রতিবেদন থেকে। তখন কুষ্টিয়া ছিল নদীয়া জেলাধীন। বর্তমান কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও ভারতের কৃষ্ণনগর জেলা (রানাঘাট মহকুমাসহ) ছিল নদীয়া জেলা। এই জেলার শতকরা ৫৮ জন ছিলেন মুসলমান। পাবনা জেলার (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ) শতকরা ৭৪ জন ছিলেন মুসলমান এবং রাজশাহী জেলায় (রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ)মোট জনসংখ্যার ৭৯ জন ছিলেন মুসলমান। তখন মুসলমানদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২ জন শিক্ষিত ছিলেন এবং হিন্দুরা ছিলেন শতকরা ৭ জন। শিক্ষিতদের মধ্যেও আবার উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা ছিলেন বেশি শিক্ষিত (ব্রাহ্মণ ৩০শতাংশ এবং ২৮ শতাংশ কায়স্থ)।
রবীন্দ্রনাথের জমিদারি এলাকায় স্বল্প সংখ্যক শিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদের মৌলিক বৃত্তির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সামান্য কিছু ব্যাতিক্রম বাদে এই মানুষদের প্রায় সকলেই জমি থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তিদের সম্পর্কেও এ কথা সত্য। তাদের আয় ছিল খুবই নগণ্য।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ভৌগোলিক, সমাজতাত্ত্বিক অথবা অর্থনীতিকের দৃষ্টিকোণ থেকে শিলাইদহ, শাহজাদপুর এবং পতিসর অঞ্চলের নিসর্গ ও মানুষকে দেখেননি। তিনি দেখেছেন কবির কৌতূহল এবং সহমর্মিতা নিয়ে। কলকাতা থেকে খুব স্বতন্ত্র পল্লীর কোলে এসে তার মনে কৌতূহল জেগে উঠেছিল। তাই যতোদিন পল্লীতে ছিলেন, ততোদিন তাকে জানবার চেষ্টা করেছেন। কার্যোপলক্ষে তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গেছেন কখনো পালকিতে করে, কখনো নদী-নালা বিলের মধ্য দিয়ে নৌকায়। এ সময়ে গ্রামের নিসর্গ ও জনজীবনের বিচিত্র দৃশ্য তার চোখে পড়েছে। এ সব বিচিত্র চিত্র কবির অন্তরকে স্বভাবতই ঔৎসুক্যে ভরিয়ে তুলতো। তাছাড়া, পল্লীর মানুষদের সুখদুঃখ সম্পর্কেও তিনি ধীরে ধীরে একটা সম্যক ধারণা তৈরির সুযোগ লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ দূর থেকে পল্লীকে দেখেছেন, অতএব পল্লীর বাইরের দৃশ্যই তাঁর চোখে পড়েছে, অন্তরের দৈন্য তার কাছে ধরা পড়েনি- এই অভিযোগের উত্তরে কবি নিজেই বলেছেন, ‘কুড়ির মধ্যে যে কীট জন্মেছে সে জানে না ফুলকে। জানে, বাইরে থেকে যে পেয়েছে আনন্দ। আমার যে নিরন্তর ভালবাসার দৃষ্টি দিয়ে আমি পল্লীগ্রাম দেখেছি তাতেই তার হৃদয়ের দ্বার খুলে গিয়েছে। আজ বললে অহঙ্কারের মতো শোনাবে তবু বলবো আমার রচনাতে পল্লী পরিচয়ের যে আন্তরিকতা আছে, কোন বাঁধা বুলি দিয়ে তার সত্যতা উপেক্ষা করা যাবে না।’
রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত উক্তিতে অহংকার সম্ভবত নেই। কেননা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার রচনাতে পল্লী পরিচয়ের অন্তরঙ্গতা আছে। তিনি তার পথের, প্রধানত জলপথের দু-ধারে এবং কাছারিতে গ্রামের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যাস ও দৈন্যের যে ঘনিষ্ঠ চিত্র দর্শন করেছিলেন তা তার লেখা চিঠিপত্রসমূহ থেকে আরও স্পষ্ট জানা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ভরা নদীর উদ্দামতা উপভোগ করেছেন শৈল্পিক প্রয়োজনে। পদ্মার বুকে চলতে কবির মনে যে তীব্র আবেগ জন্ম নিয়েছে তার প্রকাশ ঘটেছে ‘মানসসুন্দরী’ কবিতায়। দীর্ঘ এই কবিতা নারীরূপের সৌন্দর্যের স্তব-তা যেমন প্রাকৃতিক তেমনি মানবীয় তথা রমণীয়। এখানে প্রেয়সী কবিতা ও প্রিয়সখা পদ্মা সম্ভবত একাত্ম হয়ে উদ্দীপক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কবিতা যেমন তার প্রেয়সী ছিল পদ্মার সঙ্গেও ছিল তার আত্মার সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ  কথাটি বলেছেন বারবার। ১৮৯৩-এর ২ মে তিনি একটি চিঠিতে লেখেন, ‘এখন আমি বোটে। এই যেন আমার নিজের বাড়ি। … পদ্মাকে আমি বড় ভালবাসি।’
শাহজাদপুর-শিলাইদহ পর্বের গল্প প্রসঙ্গে কবি জীবনীকার প্রভাতকুমার লিখেছেন, ‘এইসব গল্পের নায়ক-নায়িকা কবির চোখে দেখা মানুষ, কানে শোনা তাহাদের কাহিনী। জমিদারীতে বাসকালে ও নদীপথে ঘোরার সময় বিভিন্ন লোকের সংস্পর্শে আসিতে হয়; যেমন সমস্যা লইয়া গল্পের সৃষ্টি, তাহার অনেক খানিই সেই সব মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রাম-কাহিনী, দুঃখের ইতিহাস।’
লেখক : হাবিবুর রহমান স্বপন
সাংবাদিক, কলামিস্ট

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top