সকল মেনু

দীপংকর গৌতম এবং গণসঙ্গীত সংগ্রহ

songgid

আবুল কালাম আজাদ : ছোট একটি গল্প বলি, আর সেটি হলো ২০০৯ সালের ১০ মার্চ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের (ডিএসইসি) ফ্যামিলি ডে অনুষ্ঠিত হয়। সেবার আমি ডিএসইসির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ডিএসইসির ফ্যামিলি ডে মানেই সংবাদপত্রের নেপথ্যের মানুষগুলোর কমন হলিডেতে জমকালো অনুষ্ঠান; এক মহামিলন। ওই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করে খুদে গানরাজ জুয়েল রানাসহ অনেকেই। যাদের সঙ্গীত অঙ্গনে রয়েছে অবাধ বিচরণ। আর এ অনুষ্ঠানে হঠাৎ মাউথপিচ হাতে নিলেন খোঁচা খোঁচা দাঁড়িঅলা একজন। তিনি হলেন আমাদের ডিএসইসির সদস্য প্রথিতযশা সাংবাদিক দীপংকর গৌতম।

গাইলেনÑ আমরা এই বিশ্বের বুকে গড়বো রঙমহল/ সৃষ্টির নবমন্ত্রে মোরা করবো দিনবদল/ এসো আজ শিল্পী এসো ¯্রষ্টা/ এই মঞ্চে হাত মেলাই।।/ এসেছি নতুন নতুন প্রাণ/ শোনাতে নতুন নতুন গান/ এসেছি নতুন নতুন প্রাণ/ শোনাতে নতুন নতুন নতুন গান।।/ রঙ্গলোকের অন্ধকার লক্ষ তারার এই জোয়ার/ ঘুচিয়ে দেবে আজ/ মাঠে ঘাটে প্রান্তরে লক্ষ জনার অন্তরে আজ/ ছড়িয়ে দিতে চাই/ এসেছি নতুন…/ শ্রমের ভারে ক্লান্তকে, ব্যথায় শোকে আর্তকে/ আজ জানাই নিমন্ত্রণ/ নাট্যগীতর উৎসবে আনন্দেরই গৌরবে/ সব ভুলিয়ে দিতে চাই/ এসেছি নতুন…। তিনি ওই অনুষ্ঠানে পর পর দুটি গান গাইলেন। সে গান দুটি গণসঙ্গীত। তাঁর গান শুনে আমিসহ সবাই বিমোহিত।

উপরের গল্পটি বলার উদ্দেশ্যÑদীপংকর গৌতম যে একজন সাংবাদিক বা সংবাদকর্মী সেটি ফুটে তোলার জন্য নয়; বরং দীপংকর গৌতম একজন সঙ্গীত পাগল মানুষ সেটিই বলার চেষ্টা করছি। কারণ দীপংকর গৌতমের সংগ্রহ ও সম্পাদনায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে গণসঙ্গীত সংগ্রহ। এটি শুধু গণসঙ্গীত সংকলন নয় এটি একটি দলিল। যে দলিল এ দেশের স্বাধীকার আন্দোলনের, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংগ্রামেরও। যা এদেশের মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাবে। শেখাবে কিভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়। দীপংকর গৌতমের শিরা-উপশিরায় রয়েছে গণগঙ্গীতের বীজ। তাই এ বইটিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
শুধু দীপংকর গৌতমই সঙ্গীত পাগল মানুষ নন; তাঁর বাবা প্রয়াত কানাই লাল গৌতমও ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ। যার কাছ থেকেই দীপংকর গৌতম ছেলেবেলা থেকে পাঠ নিয়েছিলেন গণসঙ্গীত চর্চার। তাই তার পক্ষেই সম্ভব এই অসাধারণ দলিল জাতির কাছে উপস্থাপন করা। কতটা সঙ্গীত পাগল হলে এ অসাধ্য সাধন করা সম্ভব তা পাঠক মাত্রই অনুমেয়। বইটি পড়ে আমি অভিভূত। চেতনার সূক্ষè তারে এ-অনুরণন তোলে। তা সঞ্চারিত হয় তার সকল পরিবাহিকায়। হৃদয়ে জাগায় আকুতি, পাওয়া এবং হারানো, দুটোকেই যা তুমুল বৈভবে ও অন্তহীন আক্ষেপে একই বিন্দুতে মেলায়।
গণসঙ্গীত হচ্ছে মানবমুক্তির চিরন্তন আহ্বান। মেহনতী মানুষের ঘাম নিসৃত দেহের শ্রম শোষণ থেকে অধিকার আদায় অবধি যে বৃহত্তর সংগ্রাম তার সুরই গণসঙ্গীত হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। এক কথায় বলা যায়, সঙ্গীতের সঙ্গে ‘গণ’ শব্দটি যুক্ত হয়ে যে সঙ্গীতভাষার জন্ম দিয়েছে তারই নাম গণসঙ্গীত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা দেয় এই গান।

songgid1

গণসঙ্গীতের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে বহু কথা চালু থাকলেও গণসঙ্গীত বলে যে গানকে আমরা বুঝি সেটা যে শুধুই গান তা কিন্তু নয়। এ গানের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। অনেক কবিতাও সময়ের প্রয়োজনে গান হয়ে যায়। সেদিক থেকে বাংলা ভাষার প্রাচীন গ্রন্থ চর্যাপদের অজ¯্র চর্যারই সুর দিলে তা গণসঙ্গীত হিসেবেই বিবেচিত হবে। সুতরাং ধরে নেয়া যায় চর্যাপদ যুগ থেকেই গণসঙ্গীতের শুরু।
আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা স্বাধীনতা সংগ্রামে গণসঙ্গীত একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে। জনসভায়, মিছিলে, সংগ্রামী দিনগুলোতে গণসঙ্গীত দেশের আপামর সাধারণ মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বেদনাকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে তুলে ধরতে পেরেছিল এ সময়ের শিল্পীরা, যাদের গান মুক্তিসংগ্রামে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত গণসঙ্গীত মুক্তিযোদ্ধা তথা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর রক্তে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার উন্মাদনা জাগিয়ে তুলেছিল। একই সঙ্গে অধিকারবঞ্চিত এই জনপদের ঘুমন্ত মানুষকে ঝাঁকুনি দিয়ে যেন জাগিয়ে তুলেছিল গণসঙ্গীতশিল্পীরা। স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রেও ঢেউ লেগেছিল সেই রক্ত তোলপাড় করা গানেরই সুরে। এছাড়া ভাষা আন্দোলন থেকে ‘৫৪, ‘৬২, ৬৪, ‘৬৬, ও ৬৯-এর গণআন্দোলনের সময়েও গণসঙ্গীত আন্দোলনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।
লালন শাহ যখন বলেন, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’ বা রাজেশ্বর রাজ যিনি/ চোরের শিরোমনি/ নালিশ করবো আমি/ কোন স্থানে কার নিকটে’, তখন তাঁদের গণচৈতন্যের প্রখরতাই গানে একটি বিশেষ ব্যঞ্জনাধর্মী রূপ নেয়। দুদ্দু শাহর গানে এ ধারা আরো তীক্ষè হয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তা, ভেদবৈষম্য, ধর্মের নামে অনাচার, ব্রিটিশ শাসনের জঘন্য রূপ তাঁর গানে ভাষা পেয়েছে। পরবর্তীকালের বহু বাউল গায়কসহ ময়মনসিংহের জালাল খাঁর গান পর্যন্ত এই ধারারই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। শোষণবিরোধীতা, সামাজিক অনাচার ও ভ-ামির বিরুদ্ধে ক্ষোভ, আর ধর্মনিরপেক্ষ সুস্থ জীবনচেতনার প্রভাব তাতে অত্যন্ত তীক্ষè। অতএব এই তীব্র গণচেতনাসমৃদ্ধ লোকের ধারা যে দেশে প্রবলভাবে বহমান সে দেশের সংস্কৃতিতে গণসঙ্গীত যে একটি প্রধান বিষয় সেটি দীপংকর গৌতম তিলে তিলে অনুধাবন করেছেন। তাই তিনি সারা দেশে চষে বেড়িয়ে তুলে এনেছেন গণসঙ্গীতের নির্যাস।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অত্যন্ত নিগূঢভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন গণসঙ্গীত সংগ্রহ বইটিতে। দীপংকর গৌতম সত্যি এক অসাধ্যের সাধন করেছেন। যা এ দেশের সঙ্গীত পিয়সীদের অনুপ্রেরণা হয়ে টনিক হিসেবে কাজ করবে। দীপংকর গৌতম নিধুবাবু (রামনিধি গুপ্ত), রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, বিদ্যাভূনী, মনোমোহন বসু, গিরিশচন্দ্র সেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অভিজিৎ বসু, মহম্মদ ইকবাল, সুধীন দাশগুপ্ত থেকে রবীন আহসান পর্যন্ত সবার কথাই তুলে এনেছেন। যা এক একটি গণসঙ্গীতের অমীয় বাণী।
দীপংকর গৌতমের জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়। ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন। ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশুনা করলেও তার রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের উপর পা-িত্ব। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বাম ধারার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। শিল্পকলার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তার রয়েছে অবাধ বিচরণ। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। তার রয়েছে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে বহুমাত্রিক গবেষণা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইনে তিনি নিয়মিত লেখেন। ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুবৎসল ও আড্ডাবাজ দীপংকর গৌতম সংবাদ, সমকাল, মানবকণ্ঠ ও আজকের পত্রিকায় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। সাহিত্য পত্রিকা ‘টংকার’ ও গল্প পত্রিকা ‘বয়ান’ এর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। বর্তমানে বইনিউজটুয়েন্টিফোরডটকম-এর যুগ্ম সম্পাদক। তার প্রকাশিত বই- কাব্যগ্রন্থ: মেঘ বিচ্ছেদ (২০০২), মেঘ বালিকাকে (২০০৩), প্রবন্ধ: নি¤œবর্গের মানুষের আত্মরক্ষার প্রতিবেদন (২০০৬); গবেষণা: আদিবাসী গণসংগ্রাম (২০০৭) এবং জীবনী: কমরেড মোজাফফ্র আহমেদ (২০০৮)।
দীপংকর গৌতম তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এ প্রকাশনীতে প্রয়োগ করেছেন বলে আমার বিশ্বাস। দীপংকর গৌতম বলেছেন, বাজার অর্থনীতির ভূত যেদিন আমাদের ঘাড়ে চেপে বসলো সেদিন আমরা কি বুঝেছিলাম যে এই অনৈতিক ঢেউয়ের তোড়ে আমাদের খোয়াতে হবে অনেক কিছু? বাজার অর্থনীতির নামে আজ আমাদের ধান নেই,পান নেই, মাছ নেই, গান নেই। নেই গণসংগ্রামও। তাহলে গণসঙ্গীত কীভাবে হবে?
হারিয়ে যাচ্ছে রাজনীতির সংস্কৃতি। হারিয়ে যাচ্ছে সঙ্গীতের সুস্থ পরিবেশ। রাজনীতিতে অস্ত্র, সংস্কৃতিতে নেশা আর সঙ্গীতে চিৎকারÑ এখন এই আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবন প্রণালী। তবু হতাশায় শেষ কথা নয়। ‘মানুষ জাগবে ফের’Ñ এ প্রত্যাশা বুকে রেখেই এ কাজে হাত দেয়া।’
গণসঙ্গীত সংগ্রহ বইটির নজরকাড়া প্রচ্ছদ করেছেন রবীন আহসান। প্রকাশ করেছে শ্রাবণ প্রকাশণী। দাম- ৭০০ টাকা। আর পৃষ্ঠা বিন্যাস করেছেন বিবেকান্দ জয়ধর। বইটি সংগীত প্রেমীদের কাজে লাগবে। ৮০০ গানের অধিক গানের সমাবেশ ঘটেছে বইটিতে। সত্যিই এটি সংগ্রহে রাখার মতো।
আবুল কালাম আজাদ : সাংবাদিক, শিল্পসমালোচক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top