সকল মেনু

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ নীলাভূমি রুপালী দ্বীপ মনপুরা

  এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা: লাদেশের বৃহওম দ্বীপ ভোলা জেলার মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন রূপালী দ্বীপ মনপুরা। রাক্ষুসে মেঘনার কোলে লালিত চতুর্দিকে মেঘনা নদী বেষ্টিত সবুজ-শ্যামল ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি মনপুরা। সু-বিশাল নদী-নালা, চতুর্দিকে বেড়ীবাঁধ, বিভিন্ন ধরনের ধানের ক্ষেত, বিশাল ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের বাগনে সমৃদ্ধ।মনপুরা উপজেলা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে যেমন আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় জায়গা তেমনি বিদেশীদের কাছেও। যেসব জেলার বা বিভাগের লোকজন মনপুরা ভ্রমনে বা কাজের জন্য এসেছেন বা অবস্থান করেছেন এখানকার মানুষকে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন এবং ভালবেসেছেন। এখানে না আসলে বোঝাই যাবেনা সবুজের দ্বীপ মনপুরায় কি সৌন্দর্য লুকায়িত আছে। পর্যটনের কি অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে পুরানো এ দ্বীপে। পর্যটক আর ভ্রমন পিপাসু মানুষকে মুগ্ধতার বন্ধনে আটকে দেয়ার বহু উপকরণ রয়েছে এ দ্বীপে। এখানে সকাল বেলার সুর্য যেমন হাঁসতে হাঁসতে পুর্বদিকে ডিমের লাল কুসুমের মত উদিত হতে দেখা যায়, তেমনি বিকেল বেলাতেও আকাশের সিঁড়ি বেয়ে লাল আভা ছড়াতে ছড়াতে পশ্চিম আকাশে মুখ লুকায়। মনপুরাতে এসেই কেবল সুর্যোদয় ও সুর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করা যায়। ভোলা জেলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ পুর্ব দিকে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে মেঘনার মোহনায় ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মনপুরা উপজেলা প্রায় দেড় লক্ষাধিক লোকের বসবাস। মিয়া জমিরশাহ’র স্মৃতি বিজড়িত মনপুরা দ্বীপ অতি প্রাচীন। একসময় এ দ্বীপে পর্তুগীজদের আস্তানা ছিল। তারই নিদর্শন হিসেবে দেখতে পাওয়া যায় কেশওয়ালা কুকুর। মনপুরার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচেছ ম্যনগ্রোভ প্রজাতির সারিসারি বাগান। মনপুরায় ছোট বড় ৮ থেকে ১০ টি চর ও বন বিভাগের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে সবুজ বিপ্লব। মাইলের পর মাইল সবুজ বৃক্ষরাজির বিশাল ক্যাম্পাস মনপুরাকে সাজিয়েছে সবুজের সমারোহে। শীত মৌসুমে হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে এসব চরাঞ্চল। এই চরগুলো হলো চরতাজাম্মুল, চর পাতালিয়া, চর পিয়াল, চরনিজাম, চর সামসুউদ্দিন, ঢালচর, চর বদনা, চর জামশেদ, কলাতলীর চর ইত্যাদি। মনপুরা সদর থেকে ২ কিলোমিটার উত্তর পুর্ব পাশে গড়ে উঠেছে মনপুরা ফিশারিজ লিমিটেড। প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২শ’ ১০ একর জমিতে গড়ে উঠা খামার বাড়ীটি গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। খামার বাড়িতে সারি সারি নারিকেল গাছ ও বিশাল ৪ থেকে ৫টি পুকুর রয়েছে। দৃষ্টিনন্দন খামার বাড়িটি হতে পারে পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ। খামার বাড়িটির পূর্ব পাশেই বিশাল ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বাগান। মাঝে মধ্যে এখানে হরিণ দেখা যায়। এখানে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই দেখা যায়না, এখানে খাবারের রীতিমত আইটেম ছাড়াও বিশেষ বিশেষ কিছু খাবার লক্ষ করা যায়। শীতের হাঁস, মহিষের কাচা দধি, টাটকা ইলিশ, বড় কই, মাগুর, কোরাল, বোয়াল ও গলদা চিংড়ি। মেঘনা নদী থেকে ধরে আনা টাটকা ইলিশ ও চর থেকে আনা কাঁচা দুধের স্বাদই আলাদা।
ঐতিহাসিক বেভারিজ মনপুরার নামকরন নিয়ে লিখেছেন, জনৈক মনগাজি নামের ব্যক্তি সে সময়ের জমিদার থেকে মনপুরায় জমি লিজ নেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য যুগে। তখন তার নামানুষারে এ দ্বীপের নাম করণ হয় মনপুরা। জনৈক ব্যক্তিদের মতে মনগাজি নামের লোকটি বাঘের থাবায় প্রাণ হারালে তখন তার নামানুসারে নাম করণ করা হয় মনপুরা। স্থানীয়দের মতে এখানকার খাটি দুধ খেয়ে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা দেখে মানুষের মন ভরে যেত। এজন্য এর নামকরণ করা হয় মনপুরা। তবে মনপুরার নামকরণ নিয়ে এখনও মতবিরোধ রয়েছে।
১৮৩৩ সালে মনপুরাকে ভোলা জেলার অধীনে চিরস্থায়ী বন্ধোবস্ত দেয়া হয়। ১৯৮৩ সালে মনপুরাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। এভাবে এগিয়ে যায় আজকের মনপুরা। আয়তন ৩৭ হাজার ৩শ’ ১৯ বর্গ মিটার। ইউনিয়ন ৪টি, গ্রাম ৩৮ টি, জনসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষাধিক। কৃষি জমি ৩০ হাজার ৫শ’ ৪ একর, বনায়ন ১১ হাজার ১শ’ ১৯ বর্গমিটার, রাস্তার দু-পাশে বনায়ন ১শ’ কিলোমিটার, সর্ব মোট রাস্তা ৫শ’ ৬৬ কিলোমিটার। প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪০ টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৮টি, নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১টি, মাদ্রাসা মোট ১০ টি, কলেজ ২ টি, শিক্ষার হার শতকরা ৬০ ভাগ। মসজিদ ১শ’ ১০টি, মন্দির ১৩টি, সাইক্লোন সেন্টার ২৭টি, হাট বাজার ১১টি, নলকূপ ৫শ’ ৫০টি, আদর্শ গ্রাম ২১টি।
অনুন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থাই মনপুরার প্রধান সমস্যা। মন চাইলে যে কেউ মনপুরা আসতে বা যেতে পরবেনা। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্চে রুটিন মাফিক। প্রতিদিন ঢাকা থেকে একটি লঞ্চ বিকাল সাড়ে ৫টার সময় হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে মনপুরা হয়ে পরদিন সকাল ৯টায় হাতিয়া পৌছে। ঐ লঞ্চটি আবার হাতিয়া থেকে ছাড়ে দুপুর সাড়ে ১২ টায়। মনপুরাতে আসে দুপুর ১ টায় এবং ১ ঘন্টা যাত্রা বিরতি থাকে রামনেওয়াজ লঞ্চঘাটে। মনপুরার মানুষ যে লঞ্চে করে ঢাকা থেকে মনপুরা আসেন আবার ঐ একই লঞ্চে করে ঢাকায় চলে যান। এছাড়া ঢাকা কিংবা বরিশাল থেকে ভোলা হয়ে তজুমুদ্দিন সি-ট্রাক ঘাট থেকে মনপুরা যাওয়া যায়। সী-ট্রাকটি প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০ টায় মনপুরা হাজীর হাট ঘাট থেকে ছেড়ে দুপুর ১২টায় তজুমদ্দিন সী-ট্রাক ঘাটে পৌছে। আবার ঐ দিন বিকেল ৩ টায় তজুমদ্দিন সী-ট্রাক ঘাট থেকে ছেড়ে বিকেল ৬ টায় মনপুরার হাজীর হাট সী-ট্রাক ঘাটে পৌছে।
অপরদিকে চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাট থেকে মনপুরার সাকুচিয়া জনতা বাজার রুটে দৈনিক ২ টি লঞ্চ চলাচল করে। এছাড়া প্রতিদিন সাকুচিয়া থেকে রামনেওয়াজ হয়ে আলেকজান্ডারের উদ্দেশ্যে একটি লঞ্চ যাত্রা করে। ঐ রুটে দৈনিক শতশত মানুষ যাতায়াত করে। এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নদী পথটি ভয়ানক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় এ সময়ে এই রুটে আরেকটি সী-ট্রাকের দাবী জানিয়েছেন যাত্রীরা। বর্তমানে ব্যক্তি মালিকানায় সীমিত পরিসরে স্পীড বোট চলাচল করছে। উদ্যোগটি মনপুরাকে বহুদুর নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
মনপুরাতে ভালোমানের পর্যটন হোটেল না থাকায় পর্যটকরা যেতে খুব একটা আগ্রহী হননা। সরকারী বা বেসরকারীভাবে তজুমদ্দিন রুটে এবং চরফ্যাশন মনপুরা রুটে স্পীড বোট সার্ভিস চালু করলে পর্যটকরা কম সময়ে মনপুরা আসতে পারবেন। মনপুরায় ভাল মানের হোটেল গড়ে উঠলে পর্যটকদের অগমন বাড়বে, প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার ব্যাবস্থা করলে মনপুরা হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।
মনপুরার মানুষ সহজ সরল প্রকৃতির। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে বসবাস করে। এখানকার মানুষ অতিথি পরায়ন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে যে কাউকে আপন করে নেয়। এখানকার মানুষ কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল। মনপুরার শতকরা ৮০ ভাগ লোক কৃষক ও মৎস্যজীবি।
রুপালী সৌন্দর্যের দ্বীপ মনপুরার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যাক্তি ও প্রশাসনের সাথে আলাপ হয় মনপুরায় পর্যটন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে। মনপুরা উপজেলা আ’লীগের সম্পাদক অধ্যাপক এ কে এম শাহজাহান, মনপুরা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম ও মনোয়ারা বেগম মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মহিউদ্দিন জানান, এখানকার অপার সম্ভাবনা নিয়ে মানুষ তেমন ভাবছেননা। তাছাড়া শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে এ দ্বীপের সম্ভাবনা মূল ¯্রােত থেকে অনেক দুরে। উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।
মনপুরা শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সম্পাদক প্রভাষক মাওলানা রফিকুল ইসলাম জানান, মনপুরাকে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে বাঁচাতে পারলে, পাশাপাশি সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের বদৌলতে মনপুরা হতে পারে আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র।
মনপুরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এরশাদ হোসেন খাঁন বলেন, এ দ্বীপটি ভোলা জেলার মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও নানা উপকরণ ছড়িয়ে আছে এ দ্বীপে। মনপুরার অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, ভাল মানের হোটেল, যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতিসহ বিভিন্ন সুবিধা বাড়াতে পারলে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ নীলাভূমি রুপালী দ্বীপ মনপুরায়।
মনপুরা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগ সভাপতি মিসেস সেলিনা আক্তার চৌধূরী জানান, একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার একটি স্বপ্ন মনপুরাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top