সকল মেনু

চাঁদপুরে জাটকা অভিযানের মাধ্যমে আটককৃত মাছ আত্নসাতের অভিযোগ

শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর: জাটকা নিধন প্রতিরোধ মাস শুরু হবার সাথে সাথে চাঁদপুরের প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি, কোষ্টগার্ড এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের  একটি চক্র এ নিয়ে ব্যবসায় মেতে উঠেছে। ফলে ইলিশের বংশ রক্ষার সরকারের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। মাঝপথে কষ্ট পাচ্ছে সাধারণ জেলে এবং ভোক্তারা।  ইলিশ রক্ষা কর্মসূচির আওতায় গত কয়েক বছরের মত চলতি মাসের প্রথম দিন থেকে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলায় চরভৈরবী পর্যন্ত প্রায় ৯০ কিলোমিটার নদী এলাকায় দুই মাসের জন্য সব ধরনের মাছ ধরা নিষেধ করা হয়েছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, কোষ্টগার্ড, নৌ-পুলিশ, নৌ-বাহিনীকে বিশেষ দায়িত্ব প্রদাণ করা হয়েছে। কিন্তু কর্মসূচির শুরু থেকেই দেখা দিয়েছে নানা অসঙ্গতি। জেলেদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না নিয়ে কর্মসূচি শুরু করায় জেলেরা ক্ষুব্দ। তারা সুযোগ পেলেই জাল নিয়ে নদীতে নেমে যাচ্ছে। এই কর্মসূচি চলাকালে জেলেদের প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে চাল সহায়তা হিসেবে দেয়ার কথা। কিন্তু প্রথম কিস্তির চাল এখনো পায়নি জেলেরা। ফলে পেটের দায়ে তারা নদীতে যাচ্ছে এবঙ নির্বিচারে জাটকা শিকার করছে। এদের নিয়ন্ত্রণে যাদের উপর দায়িত্ব প্রদাণ করা হয়েছে তারাও দায়িত্ব পালনে শৈথিল্যতা দেখাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই জাটকা শিকারী ও জাটকা ব্যবসায়ী দাদনদারদের সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ফলে সরকারের ওই কর্মসূচি ভেস্তে যেতে বসেছে।
জানা যায়, জাটকা শিকার বিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য যে জ্বালানি প্রশাসনকে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। জ্বালানির ভুয়া বিল-ভাউচার করে তার টাকা আতœসাৎ করছে একটি চক্র। অভিযানের জন্য ব্যবহৃত জ্বালানি সরকারের অন্য খাত থেকে এনে অভিযানের বরাদ্দের সিংহভাগ আতœসাত করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিগত দিনের বিল-ভাউচার পুংখানুপুঙ্খভাবে যাচাই করলে এবং  এর সাথে জড়িত অধঃস্তন কর্মচারিদের জেরার মুখে ফেললেই এই অভিযোগের সত্যতা বেরিয়ে আসবে বলে সূত্র জানায়। এরপর জেলেদের জন্য যে চাল বরাদ্দ দেয়া হয় তা প্রকৃত জেলেদের অনেকেই পায় না। রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের বিবেচনায় জেলেদের নির্বাচিত করা হয় চালের জন্য। কর্মসূচি শুরু হয়ে যাবার পরও বরাদ্দের চাল পাওয়া যায় না। জেলেদের পুনর্বাসনের জন্য যেসব উপকরণ সরকারের তরফ থেকে দেয়া হয় তা পর্যাপ্ত নয়। তার উপর বরাদ্দের অধিকাংশই চলে যায় কর্মকর্তাদের পকেটে এবং বাদ-বাকিটুকু পায় পছন্দের লোকেরা। ফলে এই কর্মসূচি কোনবারই সফল হয় না। খোদ চাঁদপুর শহর এবং সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতে প্রকাশ্যে জাটকা শিকার, বিকি-কিনি চলছে। পুলিশ ফাঁড়ির পাশেই বসছে জাটকার হাঁট। বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে জাটকা। অথচ কারো কোন খবর নেই। প্রকাশ্যে কারেন্ট জাল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার চলছে। কোন অভিযান নেই। মাঝে মাঝে নদী থেকে কিছু জাল ও জাটকা আটকের নাটক মঞ্চায়ন করে তা একান্ত অনুগত কিছু সাংবাদিকদের দিয়ে ছবি তুলিয়ে বা ভিডিও করিয়ে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে দেয়ানো হচ্ছে সরকারকে আই ওয়াশ করানোর জন্য। অভিযানে আটককৃত বড় মাছ গায়েব করে ফেলা হচ্ছে বা বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। কখনো কখনো তা উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে মন্ত্রী, এমপি, বড় বড় আমলা বা কর্মকর্তাদের কারো কারো বাসায়। এভাবে প্রশাসনেরই যোগসাজশে জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রম চলছে চাঁদপুরে। সবশেষ গত শনিবার রাতে জাটকা বিরোধী অভিযানের মাধ্যমে আটককৃত মাছ নিয়ে তেলেছমতি একটি ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়।
শনিবার গভীর রাতে হাইমচরের  মেঘনা নদীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তা ও হাইমচর পুলিশের যৌথ অভিযানে যাত্রীবাহী লঞ্চ থেকে প্রায় ১০ মণ ইলিশ মাছ আটক করে রাতেই সোর্সের মাধ্যমে তা বিক্রি করার খবর পাওয়া গেছে। ৩ লাখ টাকার মাছ মাত্র ১০ হাজার টাকায় বিক্রি দেখিয়ে বাকি টাকা নিজেরাই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। লঞ্চ থেকে জব্দকৃত মাছের পরিমাণ নিয়ে হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মৎস্য কর্মকর্তা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়েছেন।
জানা যায়, শনিবার রাত ১২টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আইয়ুব আলী ও হাইমচর থানার এস আই আবুল কালাম মেঘনা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে অভিযান চালান। এ সময় তারা দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা বন্ধন-৭ ও সৌরভী লঞ্চসহ কয়েকটি  লঞ্চে অভিযান চালিয়ে ১০ মণ ইলিশ আটক করে। আটককৃত মাছ চাঁদপুরের এক সোর্সের মাধ্যমে স্পিডবোটযোগে বিক্রি করা হয়। ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে আটককৃত মাছ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি দেখিয়ে বাকি টাকাগুলো নিজেরা আত্মসাৎ করে।
একটি সূত্র থেকে জানা যায়, চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারের সোর্স সাদ্দামের মারফতে প্রশাসন নদীতে অভিযান চালিয়ে মাছগুলো লঞ্চ থেকে আটক করে। আটককৃত মাছগুলো সাদ্দাম স্পিডবোটযোগে তাদের কাছ থেকে নিয়ে রাতেই মাছের আড়তদারের কাছে ৩ লাখ টাকা পরিমাণের মাছ ২ লাখ টাকায় বিক্রি করে। সোর্স সাদ্দাম দেড় লাখ টাকা অভিযানকারীদের হাতে তুলে দেয়। সে টাকা তারা নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। এ ব্যাপারে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আইয়ুব আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদীতে অভিযান চালিয়ে ৮ মণ ইলিশ মাছ জব্দ করা হয়েছে। আটককৃত মাছগুলো পুরাণবাজারের ঠিকাদার সাদ্দামের কাছে নিলামে বিক্রি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাত্র দেড় মণ ইলিশ মাছ লঞ্চ থেকে আটক করে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এদিকে মৎস্য কর্মকর্তার দেয়া তথ্য ৮ মণ মাছের কথা বলার পর তিনি বলেন, কী কারণে মাছের পরিমাণ বেশি বলেছে তা একটু জেনে নেই। মাছ বিক্রির টাকা আত্মসাৎ বিষয় জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদীতে মাছ ধরার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ইউএনও যেহেতু ছিলেন তাহলে তিনিই ভালো জানেন। এদিকে যাত্রীবাহী লঞ্চ থেকে আটক করে মাছ বিক্রির কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ঘটনার সাথে জড়িত প্রশাসনের কর্মকর্তারা পত্রিকায় সংবাদ প্রচার না করার জন্য চেষ্টা তদবির চালিয়ে যান। নীলকমল নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রহমান জানান, রাতে মৎস্য কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাইমচর থানা পুলিশ নিয়ে নদীতে অভিযানের বিষয়টি প্রথমে তিনি জানতে না পারলেও তা পরে জানতে পেরেছেন। তবে নৌ পুলিশকে এ বিষয়ে কোনো অবগত করা হয়নি।
চাঁদপুর নৌ-পুলিশ, কোষ্টগার্ডের বিরুদ্ধেও প্রায়ই এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই দুই বিভাগের কর্মকর্তারা আবার কিছু ফরমায়েশি সাংবাদিক দিয়ে মাঝে মাঝে জাটকা আটক ও জেলেদের সাজা দেয়ানোর নাটকের দৃশ্য প্রচার করান বলেও অনেক সংবাদকর্মীর অভিযোগ। আটককৃত জাটকার প্রকৃত পরিমাণ নিয়েও তারা নানা ছলছুঁতো করেন বলে জানা যায়। তবে নৌ-পুলিশ বা কোষ্টগার্ড কর্মকর্তারা এ ধরনের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top