সকল মেনু

শোক কাটিয়ে উঠার আগেই মুখোমুখি হন সমাজের নির্মমতার দু’নারী

চট্টগ্রাম ব্যুরো : দিলু আরা বেগম। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। লেখাপড়ার দৌঁড় বাল্যশিক্ষা পর্যন্ত। বেড়ে উঠা চট্টগ্রামের বাঁশথালীর অজপাড়া গাঁয়ে। একুশ বছর বয়সেই স্বামীকে হারিয়ে শরীরে বৈধব্যের বেশ উঠে দিলু’র। শোক কাটিয়ে উঠার আগেই মুখোমুখি হন সমাজের নির্মমতার। পরিবারের চেনা মুখগুলো হয়ে উঠে হঠাৎ অচেনা।

ভালবেসে বিয়ে করা স্বামীর সঙ্গে রুমি সেনগুপ্তা’র বিচ্ছেদ ঘটে বিয়ের মাত্র চার বছরের মাথায়। তার কোলে তখন এক মাসের ফুটফুটে সন্তান। বিধ্বস্ত রুমি সমাজের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তারপর জীবন সংগ্রাম। না, থেমে যাননি রুমি, সংগ্রামে সাফল্য এনেছেন। সেই রুমি এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত।

দিলু আরা আর রুমি। একজন অজপাড়া-গাঁয়ের, আরেকজন শহরের শিক্ষিত সমাজে বেড়ে উঠা নারী। কিন্তু দু’জনের পরিণতি একই। দু’জনই জীবনের এক পর্যায়ে পারিবারিক ও সামাজিক পীড়নে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু মুষড়ে পড়েননি। দেখিয়ে দিয়েছেন পুরুষ ছাড়াও নারী সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।

দিলু আরা আর রুমি’র মত সমাজে অকালে সঙ্গী হারানো কিংবা সঙ্গী বিসর্জনে বাধ্য হওয়া প্রতিটি নারীর জীবন এমনই সংগ্রামমুখর। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সমাজের কুৎসিত ও নোংরামোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের কেউ কেউ হয়ে উঠেন একেকজন বিজয়িনী, আবার সংগ্রামে পরাজিত হয়ে কেউ কেউ হারিয়ে যান দৃশ্যপট থেকে চিরদিনের জন্য।

নারী দিবসকে সামনে রেখে দু’জন ভাগ্যবিড়ম্বিতা নারীর সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনচিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছে হটনিউজ২৪বিডি.কম ।
‘অকাল বিধবা আমি, সয়েছি অপমান’
দিলু আরা বেগমের জন্ম বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া গ্রামে। খুব অল্প বয়সে পাশের পিছিয়ে পড়া গ্রাম রত্নপুরের হালিয়াপাড়ার নুরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয়। এক বছরের মাথায় কোল জুড়ে আসে প্রথম সন্তান। তিন বছর পর আরও এক সন্তানের জননী হন দিলু আরা। পরিবারে নুন আনতে পান্তা পুরায় অবস্থা হলেও সুখের অন্ত ছিল না। কিন্তু কপালে তার সুখ সইলো না। দ্বিতীয় সন্তান জন্মানোর মাত্র চল্লিশ দিনের মধ্যে স্বামী মারা যান। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়েন দিলু আরা।

শোক কাটিয়ে উঠার আগেই শুরু হয় বিধবা দিলু আরাকে স্বামীর ঘর থেকে তাঁড়ানোর পায়তারা। কিন্তু মাথা নত করেননি তিনি। মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিলেন।

তখনও মানুষের নিষ্টুরতার শেষ দেখেননি দিলু আরা। কেউ সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসলে তাকে জড়িয়ে চরিত্রে কালিমা লেপন করতে ভুলেন না আপনজনরা। ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসে তাদের কুৎসিত চেহারা। এক পর্যায়ে সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত করার চেষ্টা করেন ভাসুর ও দেবররা। কিন্তু হারার পাত্র নন দিলু। কোন কথা কানে না তুলে সন্তানদের মানুষ করার কাজে লেগে পড়েন। খেয়ে না খেয়ে ছেলেদের পড়ালেখা করান।

দিলু আরা বেগম হটনিউজ২৪বিডি.কমকে বলেন,‘স্বামী মারা যাওয়ার পর চতুর্মূখী চাপে পড়তে হয়েছে আমাকে। বাবার  বাড়িতে গিয়েও বোঝা হতে চাইনি। শ্বশুর বাড়িকেই আঁকড়ে ধরেছিলাম। বিধবা নারী হিসেবে আড়ালে আবডালে কতজনে কত কটু কথা বলেছে। অনেকে সামনা সামনি অপমানও করেছে। সব চোখ বুজে সহ্য করেছি। আল্লাহর কাছে ধৈর্য ধারণের শক্তি চেয়েছি।’

“ভাই ও বাবারা বাড়িতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন।বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি সাফ বলে দিয়েছিলাম, ভিক্ষা করে খাব তবুও বাবার বাড়িতে যাব না। ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ের কথা মনে আসেনি। তাছাড়া আবার বিয়ে করলে মৃত স্বামীর স্মৃতিকেও অপমান করা হতো।” বলে থামেন দিলু আরা।

পরক্ষণে বললেন,‘সেসব দিনের কথা ভুলার নয়। প্রতিটি কাঁটা বুকের মাঝে গেঁথে আছে এখনো। কত বেলা যে না খেয়ে ছিলাম তার ইয়াত্তা নেই। ক্ষুধা মেটাতে কত অখাদ্য-কুখাদ্য যে খেয়েছি। তা এখন মনে পড়লে গা শিউরে উঠে।’

দিলু আরা বলেন,‘হাস-মুরগি ও ছাগল লালন পালন করে দুই সন্তানকে পড়িয়েছি। এক ছেলে হাফেজ ও ‍মাওলানা। অন্য ছেলে ডিগ্রী পাশ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। নিজেও খেয়ে না খেয়ে দু’ পয়সা জমানোর চেষ্টা করেছি। একদিন দেবর ও ভাসুরদের না জানিয়ে শ্বশুর আমার ছেলেদের নামে কিছু জমি লিখে দেন। সেগুলো দখলে নিতেও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। ছেলেরা বড় হওয়ার পর জমির দখল পেয়েছি।’

“এরপর আস্তে আস্তে নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছি। ছেলেরা পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করার পর বাড়ির পাশে নতুন ভিটা বানিয়ে সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করেছি।’ আনন্দে ছলছল চোখে কথাগুলো বলছিলেন জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক নারী দিলু‍ আরা বেগম।

‘ পিছু নিল পশুস্বভাবী পুরুষগুলো’
রুমি সেনগুপ্তা। বয়স ৪০। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক(মানবসম্পদ)।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ভালো লাগতে শুরু করে এক তরুন চিকিৎসককে। তারপর মন দেওয়া-নেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই দুজনে বিয়ে করে ফেললেন।

কিন্তু এরপরই স্বামীর স্বরূপ উন্মোচিত হতে থাকে তার কাছে। বাড়তে থাকে সম্পর্কের তিক্ততা। চারবছরের মাথায় বিচ্ছেদ। এর একমাস আগেই কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে শিশু সন্তান।

রুমির বর্ণনায়, বিচ্ছেদ যতটা সহজে বলা যায়, একজন নারীর জন্য বিচ্ছেদ তত সোজা নয়। শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে দিনের পর দিন হাজির হতে হয়েছে আইনজীবীদের দ্বারে দ্বারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আইনও যেন সব পুরুষের পক্ষে। এগিয়ে আসলেন বন্ধুরা। অবশেষে আদালতের নির্দেশে চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ।

তবুও কি মুক্তি মেলে? নিপীড়ন যেন আরও বাড়লো। একজনের পীড়ন থেকে বেরিয়ে এসে হাজার জনের পীড়নের শিকারে পরিণত হলেন রুমি। বিচ্ছেদের কথা জানাজানি হওয়ার পর পশুস্বভাবী পুরুষগুলো পিছু নিল।

আত্মীয়-স্বজনরাও ছাড়লেন না। দুঃখের দিনে কাছে ছিলেন না কেউ। কিন্তু বিচ্ছেদের পরই শুরু হয় তাদের উৎপীড়ন। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ করে যেন মস্ত বড় পাপ করেছেন। চাকরিস্থলে সহকর্মীদের ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ। চারপাশটা বিষিয়ে উঠেছিল তার।

বললেন, ‘সেসময় আমার পরিবার পাশে না থাকলে হয়তো আমার বেঁচে থাকা হতো না। আমার জন্য আমার ছোট দুই বোন ও মা-বাবাকে কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু আমি আমার শিশু সন্তানের মুখ চেয়ে সব সহ্য করেছি।’

পরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহকারি ব্যবস্থাপক(মানবসম্পদ) হিসেবে কাজ নেন অর্থনীতিতে মাস্টার্স পাশ করা রুমি সেনগুপ্তা।

এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুই বোনকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তারাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এখন অসুস্থ মা-বাবার সেবা ও পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া মেয়েকে নিয়ে দিব্যি সুখে আছেন রুমি। ভয়াবহ কষ্টের মধ্য দিয়ে নিজের জীবনে উন্নতি এনেছেন। স্বামীকে দূর থেকে দেখিয়ে দিয়েছেন আলাদাভাবে ভালোই আছেন।

রুমি বললেন, ‘বিয়ে দেওয়ার জন্য আমার পরিবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমার মেয়ের কথা চিন্তা করে সে পথে আগাতে ইচ্ছে হয়নি। আমার জীবন শেষ করেছে এক পাষণ্ড। আমিতো আর আমার মেয়ের ভবিষ্যতকে নষ্ট করতে পারি না।’

প্রতিনিয়ত সমাজের বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করা এ নারী, এখন মেয়ের ভবিষ্যত নিশ্চিতে লড়াই করছেন। নিজ শক্তিতে কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে হয়ে উঠেছেন একজন মমতাময়ী মা ও একজন লড়াকু নারী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top