সকল মেনু

চিরঞ্জীব ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া হে প্রিয়, আবার আসো ফিরে

 আবুল কালাম আজাদ: আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তোবা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তোবা হাঁস হব- কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গির ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;
আজ খুব বেশি মনে পড়ছে আধুনিক কালের মহত্তম কবি জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার লাইনগুলো। আর এটি মনে পড়ার কারণটি হলো আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার জন্মদিন। ১৯৪২ সালের এই দিনে তিনি জন্ম নিয়ে ছিলেন রংপুরের পীরগঞ্জে। আর এই সুবাদে গড়ে উঠেছিল এ মানুষটির সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। তিনি ছিলেন আমার স্বজন, একান্তই আপনজন। তিনি নানা ব্যস্ততার মাঝেও যখন পীরগঞ্জে যেতেন আর তখন আমিও ছুটে যেতাম তাঁর কাছে। রয়েছে অনেক অনেক স্মৃতি। আজ ভাবতেই অবাক লাগে তিনি আমাদের মাঝে নেই। ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০৯ সালের ৯ মে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে দীর্ঘদিন কিডনির সমস্যাসহ হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টে ভুগে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সে মারা যান। তিনি যখনই বাড়িতে যেতেন তখনই বলতেন আমি যেখানেই থাকি কিন্তু আমার আত্মাটি পরে থাকে পীরগঞ্জে। পীরগঞ্জের মাটি এবং মানুষ মিশে রয়েছে আমার আত্মায়। তাই মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর গ্রামে তাঁর বাবা-মার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
দেশবরেণ্য পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ৭৩তম জন্মদিন আজ। এ উপলক্ষে পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ, মহাজোটের শরীক দলসমুহ এবং আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন স্মৃতিচারণ, ফাতেহ পাঠ, কবর জিয়ারত, মিলাদ মাহফিল ও গরিবদের মাঝে খাবার বিতরণসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ওই দিন সকালে কবরে পুস্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে কর্মসূচির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে বলে জানান, প্রয়াত বিজ্ঞানীর ভাতিজা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজিমুল ইসলাম শামীম।
বঙ্গবন্ধুর জামাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি তাঁর মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। ওয়াজেদ মিয়া তাঁর কর্মের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বেঁচে থাকবেন। তিনি স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের কারণে কিছুদিন কারাবরণ করেন। ১৯৭১ সালে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এর আগে ও পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। তাই তিনি বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসেরও একজন অগ্রসৈনিক।
বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। তাদের মধ্যে মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন খুবই কম। কিন্তু ড. ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি মৌলিক চিন্তাকে বিষয়কেন্দ্রিকভাবে সুবিন্যস্ত করেছিলেন। তাই তাঁর লেখনিতে অনুসন্ধিৎসু আলো ফেলতেন। যে আলো আজো ছড়িয়ে পড়ছে। তাই রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রাণপুরুষ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিষ্ঠা করা হয় ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
হে প্রিয়, আবার আসো ফিরেÑ আমাদের মাঝে। আমাদের পীরগঞ্জ তথা, আমাদের বাংলায়। তুমি নেই, এ যেমন ধ্রুব সত্য আবার তোমার সৃষ্টি, তোমার কর্ম দেখলেই মনে হয়; তুমি আছো; তুমি রবে আমাদেরই মাঝে; আমাদের হৃদয়ে।
জীবন ও কর্ম : ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আব্দুল কাদের মিয়া ও মাতা মরহুমা ময়জুনেসার চার পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ। গ্রামের প্রাইমারি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী ও পীরগঞ্জ উপজেলার হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন শেষে তিনি ১৯৫২ সালে রংপুর শহরের সরকারি জেলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে এই স্কুল থেকে ডিস্টিংশনসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন এবং ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৬১-’৬২ শিক্ষা বছরের জন্য হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হন। ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৩-’৬৪ শিক্ষা বছরে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ‘ডিপ্লোমা অব ইম্পেরিয়াল কলেজ কোর্স’ কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের ‘ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে তাকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকার আণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে পদস্থ করা হয়।
তিনি ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা হোসেন পুতুল। ১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাকে এসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। এই সুবাদে তিনি ১৯৬৯-’৭৩ ও ১৯৮৩ সালগুলোয় ওই গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবার ৬ মাস ধরে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বও থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরুয়ে শহরের ‘আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ আণবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লির ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি অনেক জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান বিষয়ক সম্মেলনে যোগদান করেন। তার অনেক গবেষণামূলক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকা-ের পর দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসিত জীবন কাটান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পদার্থ বিজ্ঞান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্রদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার লেখা ৪৬৪ পৃষ্ঠার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এবং ৩২০ পৃষ্ঠার ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত হয়। বহুল রাজনৈতিক ঘটনা সংবলিত এ দুটি গ্রন্থ সুধী পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।
১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের জন্য তিনি পরপর দুবার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি পরপর তিনবার ওই বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থ বিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৭ সালে দুবছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তাছাড়াও তিনি ওই বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সদস্য। ১৯৮৯ সালে দুবছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তাছাড়া তিনি ওই বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর দুটি দুবছরের মেয়াদকালের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি পরপর দুটি দুবছর মেয়াদকালের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি ওই সমিতির একজন আজীবন সদস্য। ১৯৯১-১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘেরও সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর তিনটি দুবছরের মেয়াদকালের জন্য তিনি ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতি’র সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ওই সমিতির একজন আজীবন সদস্য।
তিনি ঢাকার রংপুর জেলা সমিতির আজীবন সদস্য এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দুবছর মেয়াদকালের জন্য এই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এবং ঢাকার বৃহত্তম রংপুর কল্যাণ সমিতি; উত্তরবঙ্গ জনকল্যাণ সমিতি; রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরাম; বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ এবং রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার মির্জাপুর বছিরউদ্দিন মহাবিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
আবুল কালাম আজাদ : সাংবাদিক, শিল্পসমালোচক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top