সকল মেনু

বাণিজ্য ও বই মেলার চিত্র : আশা ও প্রাপ্তি

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার :
মেলা এক পরিচিত নাম। বঙ্গাব্দ ও খৃস্টাব্দ সনকে ঘিরে বছরের বিভিন্ন সময় মেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ নেয়। কেউ বিক্রেতা, কেউ ক্রেতা কেউ আবার দর্শনার্থী। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও থেমে নেই মেলার আয়োজন। বিশেষ করে বাণিজ্যমেলা ও বইমেলা। বাণিজ্য মেলা ৩১ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। সেই সাথে ভে¯েত গেছে গোটা দেশের অর্থনীতি। মেলার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে এবং আশা-প্রাপ্তির মধ্যে অনেক ব্যবধান। ব্যবসায়ীরা লাখ-লাখ টাকা ব্যয় করে মেলায় অংশ নেন। কিন্তু তাদের আশা আর পূরণ হয়না। কম লাভে বেশি বিক্রি ব্যসায়ীদের নীতি হলেও সে নীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অবরোধ-হরতালে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়েছে বহুগুণে। পণ্য তৈরী হওয়ার পরে কয়েক হাত বদল হয়ে পণ্যটি বাজারে আসে। সেই মালবাহী গাড়িটি আগুনে পুড়ে যেতে পারে, শ্রমিক, হেলপার, চালক এমনকি মালিকের প্রাণও চলে যেতে পারে। এত বড় ঝুঁকি নিয়েও মেলায় পণ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দিন যায় রাত আসে ক্রেতা বরের দেখা মেলেনা। আশানুরূপ বিক্রি ও ব্যবসায় মন্দাভাবের কারণে ব্যবসায়ীরা আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু কেন এই অবস্থা ? কে দায়ী ?

বাণিজ্য মেলায় প্রত্যহ লক্ষাধিক লোক সমাগম হওযার প্রত্যাশা থাকলেও বিক্রীত টিকেটের হিসেব অনুযায়ী গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার দর্শনার্থী মেলায় গিয়েছেন। শুধু শুক্রবার এলেই সেই সংখ্যাটা আশানুরূপ হয়।  এতে বোঝা যায় জনগণ নিজেকে নিরাপদ বোধ করলেই কেবল ঘর থেকে বের হয়। এ যদি হয় বাণিজ্য মেলা অবস্থা তাহলে বই মেলার অবস্থা কী হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। অবরোধে দর্শনার্থী কম হওয়ায় অর্থনৈতিক ঘাটতি কমিয়ে নিতে ব্যবসায়ীদের অনুররোধে বাণিজ্য মেলার সময় ১০ দিন বৃদ্ধি করা হয়েছে। অথচ বইয়ের প্রকাশকরা গত বছর বই মেলার সময় ১০ দিন বাড়াতে অনুরোধধ করলেও বাংলা একাডেমী তাদেরকে সে সুযোগ দেয়নি। বই মেলায় যদি এবার আশানুরূপ বই বিক্রি না হয় তাহলে লেখক ও প্রকাশকরা হতাশ হয়ে পড়বেন, এটাই বাস্তবতা।

অবরোধ-হরতালে দেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন। দেড় লাখ হকার পরিবারে দুই বেলা খাবার জুটছেনা। তারপরেও ভারী হচ্ছে ঋণের বোঝা। চলমান টানা অবরোধ-হরতালে গত মাসে (জানুয়ারি) ট্যানারী মালিকদের ৪৫৯ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী গত এক মাসে (জানুয়ারি) তার আগের মাসের চাইতে চার কোটি ডলারেরও বেশি রেমেটেন্স কমেছে। (ইত্তেফাক, ০৩ ফেব্রুয়ারী’১৫)। আইন করে হরতাল বন্ধ করার দাবি দোকান মালিক সমিতির। ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ হিসেবে রাজনৈতিক ব্যানারে মানববন্ধন করেছেন। তবে মানববন্ধনের সুফল তারা পাচ্ছেন বলে মনে হয়না। কারণ ব্যবসায়ী নেতারা যখন রাজনীতিবিদদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তখন সাধারণ ব্যবসায়ীদের বিপত্তিতে পরতেই হয়। ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, তারা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মানববন্ধন করবেন, পতাকা মিছিল করবেন, বিক্রি বন্ধ করে সারাদেশ অচল করে দিবেন। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে বিলম্ব কেন ? যখন দু-নেত্রী সিদ্ধান্তই নিয়েছেন কেউ কারো কথা রাখবেন না, এমনকি ব্যবসায়ী ও জনগণের কথা ও উপেক্ষা করা হচ্ছে, তখন আর দেরী কেন। আপনারা যদি নিরপেক্ষ কর্মসূচী দেন, তাহলে আশাকরি আপনাদের সাথে দেশবাসী থাকবে। আর যদি এক পেশে কথা বলেন, শুধু সহিংসতা বন্ধের শ্লোগান, মানববন্ধনসহ যে কোন কর্মসূচীই গ্রহণ করুন না কেন  করেন না কেন তা কতটা কার্যকর হবে তা সহজেই অনুমেয়।

অর্থনৈতিক মন্দাভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ সম্পর্কে রাজনীতিবীদদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা একে অপরে দোষারোপ করেন। আর দোষারোপ করাই নাকি রাজনৈতিক সংস্কৃতি। একটি উন্নত রাষ্ট্রের যতগুলা বৈশিষ্ট্য থাকে তার সিংহ ভাগ আমাদের দেশে অনুপস্থিত। রাজনৈতিক মন্দাভাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যা বলে তার মূল কথা হলো, বড় দু’দলের সমঝোতা, সংলাপ, হরতাল, অবরোধের মতো সকল কর্মসূচীর প্রত্যাহার, নাসকতা বন্ধ, অর্থবহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কায়করী স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে সুষ্ঠু একটা নির্বাচন। এর ফলে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। নতুবা সাধারণ প্রাণ দিতে হবে।

রাজনীতি যখন ধ্বংসাত্মক খেলা তখন কে যাবে ঐ বাণিজ্য মেলায় ? কে যাবে বই মেলায় ? মেলা বিনোদনের একটি অংশ। মানসিক প্রশান্তি থাকলে পরেই মেলায় উপচে পড়া ভিড় থাকে। আমার এক ভাই যখন রুজি-রোযগার করতে পারছেনা, চাকরি খুঁজেও পাচ্ছেনা, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম আয় করছে, হাসপাতালে চিৎকার করছে, সন্তান তার বাবা ও বোনকে হারিয়ে আল্লাহ বলে চিৎকার করছে, তখন জীবনের ঝুকি নিয়ে খুব কম লোকই রাস্তায় বের হয়। প্রবন্ধটি যখন লিখছিলাম তখন ব্রেকিং নিউজ ছিল, ‘কুমিল্লার লাকসামে যাত্রীবাহী নৈশ কোচে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, মৃত্যু ৭, অগ্নিদগ্ধ আরো ১৬। এ কেমন নিষ্ঠুরতা ? ঘুমন্ত মানুষের উপর হামলা। কে নেবে এর দায়ভার ? সরকারের আশ্বাসেই নিরাপত্তা দেয়ার কথা শুনে হয়তো গাড়িটি বেড় হয়েছিল। গাড়ীর মালিক যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঠিক সেই মুহুর্তে তার গাড়িটি পুড়ে গেছে ! পুড়ছে  অনেকগুলো তাজা প্রাণ ! নিরাপত্তার নামে কেন এই মিথ্যা আশ্বাস ? যারা একটি গাড়ীকে নিরাপত্তা দিযে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনা, তারা কি করে ১৫ লক্ষ শিক্ষার্থীকে নিরাপদে বাসায় পৌছ দিবে ?

বাণিজ্য মেলা শেষ না হতেই প্রচলিত নিয়মে শুরু হয়েছে বই মেলা। বই মেলায় প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা ভিন্নরকম। বরাবরের মতো ক্রেতা ও দর্শনার্থীকে বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বাংলা একাডেমির গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। রাজধানী শহরের কোথাও যদি কোন ভিআইপি গাড়ি নিয়ে বের হন তখন সাধারণ মানুষকে দীর্ঘ সময় জানযটে আটকা পড়তে হয়, তেমনি বই মেলায় আগত  দর্শনার্থীদেরও নিরাপত্তার অযুহাতে দু’ঘণ্টার অধিক সময় পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এই অনিয়মটাকেও হয়তো কেউ আবার রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে প্রচার করবেন। বাংলা একাডেমীর অভ্যন্তরের কিছু রাস্তা পাকা না হওয়ায় সেখানের পরিবেশও ছিল ধূলাবালিতে একাকার। প্রধানমন্ত্রী আসার পূর্বে পানি ছিটানো হলেও পরবর্তীতে আর পানি ছিটাতে দেখা যায়নি। তাছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে গত বছরের তুলনায এ বছর স্টলের ভাড়া বৃদ্ধি করায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি চাপ সহ্য করতে হয়েছে। উদ্যানের অভ্যন্তরে অপরিকল্পিতভাবে হকারদের প্রবেশ ছিল চোখে পড়ার মতো। মেলার আশে পাশে বেশ কিছু নিরিবিলি স্থানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় সেসব স্থানে কতিপয় জুটি ও তরুণ-তরুণীকে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। এ নিয়ে দর্শনার্থীদের কেউ কেউ বিরুপ মন্তব্য করেছেন।

মেলার প্রথম দিনে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কয়েকজন এমপি, মন্ত্রী ব্যতীত বড় কোন কবি সাহিত্যিকদের দেখা মেলেনি। নিরাপত্তা চাদরে বেষ্টিত ছিল গোটা এলাকা। বলতে গেলে সাধারণ মানুষের চেয়ে নিরাপত্তাকর্মীর্দে উপস্থিতিই বেশি ছিল। এতদসত্ত্বেও টিএসসি এলাকায় দু’টি ককটেলের বিস্ফোরণ হওয়ার শব্দ পাওয়া গেছে। এভাবে জীবন ঝুঁকিতে মেলায় অংশ নেয়া সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। কয়েকজন দোকান মালিকের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি, প্রথম দিনে তাদের বেঁচাকেনা তেমন একটা হয়না। শখের বশত অনেকেই গোটা এলাকা ঘুরে দেখতেই আসেন। প্রকাশরা বলেছেন, হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে তাদের বিক্রি তেমন একটি হবেনা। বরং অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানকে লোকশানের বোঝা বইতে হবে। বড় দু’টি দল যেন অতিশীঘ্রই সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরী করেন তাহলেই তারা সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। হরতাল-অবরোধে যান চলাচল বন্ধ থাকায় ছাপাখানার চাহিদানুপাতে কাঁচামাল কাগজের সরবরাহ না থাকায় নতুন বই বাজারে আসতে বিলম্ব হচ্ছে। শেষ মুহুর্তে তড়িঘড়ি করে বই ছাপানোর জন্য লেখক, প্রকাশক ব্যস্ত হয়ে পড়ায় কিছুটা হলেও ত্রুটি থেকে যায়।

আমাদের দুই নেত্রী যদি এক টেবিলে বসে সহমর্মিতা দেখিয়ে দলীয় চিন্তার উর্ধ্বে উঠে দেশপ্রেমের চিন্তা নিয়ে জনগণের মনের কথা বুঝতে চেষ্টা করতেন তাহলে শুধু মেলা সংশ্লিষ্টগণ নন, বরং দেশের সকল স্তরের ব্যবসায়ী এবং জনগণ এক অনিশ্চয়তায় ভরা জীবন থেকে মুক্তি পেতেন। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পেত দেশ। সকল শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের আশা ও প্রাপ্তির মাঝে সম্পর্ক খুঁজে পেত। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাধারণ মানুষ ও সোনার বাংলাদেশ ফিরে পেত এক নতুন দিগন্ত্। আমরা সেই প্রত্যাশাতেই আছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top