সকল মেনু

ভোলায় ট্রলার ডুবি : প্রিয়জনকে হারিয়ে পরিবারগুলোতে চলছে আহাজারি

Pic--(1)--04--02--15ভোলা প্রতিনিধি : নদীতে যাওয়ার আগে বাবা কথা দিয়েছিল মাছ শিকার করে বাড়িতে ফিরেই আমাকে একটি স্কুল ব্যাগ কিনে দিবে, মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়ে মসজিদে ইমামতি করবে। কিন্তু কোথায় বাবা, বাবা তো এখনও ফিরে এলোনা। বাবাকে দেখতে চাই। কান্না জড়িত কণ্ঠে এ কথাগুলোই বলছিল মেঘনায় মাছ শিকারে গিয়ে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ শরীফ হোসেনের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে সুমাইয়া হোসেন। সে জানায়, আমাদের দেখার কেউ নেই, ছোট বোনের বয়স তিন মাস। কখন বাবা আসবে, আমার বাবারে ফিরিয়ে দাও।
টগবকে তরুন সিরাজ (১৯), সেও যায় মাছ শিকারে, ৬ দিনেও খোঁজ মেলেনি তার। সিরাজের বাবা নাছির মাঝি, বয়সের ভাবে নূজ্য প্রায়, তবুও মেঘনার কূলে ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ছেলে ফিরে আসবে কী না তা জানা নেই তার।
সিরাজের বাবা নাছির মাঝি বলেন, টাকা রোজগারের জন্য ছেলে মাছ শিকারে গেছে, কিন্তু আজো ফিরে এলোনা, তাকে না পেলে আমার তিন মেয়েকে দেখবে কে। ওর উপার্জিত টাকা দিয়েই তো তাদের বিয়ে দেবো বলে ভেবে রেখেছি, কোথায় গেলো আমার ছেলে। এক বাবাকে হারিয়ে এক সন্তান আর ছেলেকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ বাব- এমন অবস্থা শুধু তাদের একার নয়, যেন একই কষ্টের বন্ধনে গাঁথা ৫ জেলে পরিবার।
মেঘনায় মাছ শিকারে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলার ডুবির ঘটনার ৬ দিনেও ফিরে আসেনি ভোলার তজুমদ্দিনের হতভাগ্য চার জেলে। ৪র্থ দিন পর একজনের ও ৫ম দিনে আরও দুটি মৃতদেহ পাওয়া গেলেও বাকিরা জীবিত ফিরে আসবেন এমন আশায় মেঘনা তীরে কান্না-আহাজারিতে তাদের খুঁজে ফিরছেন স্বজনরা।
উপজেলা প্রশাসন ও কোস্টগার্ড নিখোঁজদের খোঁজে বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযান চালিয়েও কারো সন্ধান পাচ্ছেন না। এতে যেন আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে গেছে তাদের। সময় যত যাচ্ছে ঠিত ততই অস্থির হয়ে পড়ছেন স্বজনহারা এসব পরিবারের সদস্যরা। জেলে পল্লীর কেউ তাদের শান্তনা দেয়ার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
কেয়ামূলা গ্রামের দরিদ্র জেলে শরীফ হোসেন। স্ত্রী ও ছোট ২ মেয়ে নিয়ে তার সংসার। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা স্ত্রী-সন্তানেরা। স্ত্রী কেঁদে কেঁদে বাকরদ্ধ প্রায়। শোকে কাতর স্ত্রী কারো সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না। কোলে তার তিন মাস বয়সী শিশু সাদিয়া।
শরীফের পিতা বেলায়েত হোসেন বলেন, নদীর পাড়ে ছেলের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় বসে থাকি, অন্য জেলেরাও তাদের খোঁজ করছেন কিন্তু তাদের পাচ্ছিনা।

একই গ্রামের শাজাহান পন্ডিতের ছেলে রাজিব (২০)। প্রথম বারের মত মাছ ধরার পেশায় হাতে খড়ি হয় তার। কিন্তু প্রথম দিনের ট্রলার ডুবে নিখোঁজ রয়েছেন তিনি। ছেলেকে হারিয়ে কাঁদছেন বাবা-মা। তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
হাজী কান্দি গ্রামের নিখোঁজ জেলে সিরাজের বোন ফাতেমা। ৫ দিন ধরে নদীর তীরে ভাইকে খুঁজছেন। বার বার সজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছেন। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমাদের দেখাশুনা করার কেউ নেই, ভাইকে না পেলে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
সিরাজের মা কহিনুর বেগম ছেলের চিন্তায় অস্থির, তিনিও দুর্ঘটনার পর থেকে মেঘনা তীরেই আছেন। ছেলেকে না নিয়ে ফিরে যাবেন না বলে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। অবিরাম অশ্রু ঝরছে তার, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। দুর্ঘটনার পর থেকে নিখোঁজদের সন্ধানে নদীতে টহল দিচ্ছে কোস্টগার্ডের টিম। মেঘনার বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরেও কোনো মৃতদেহের সন্ধান পায়নি।
অভিযান দলের নেতৃত্বদানকারী তজুমদ্দিন কোস্টগার্ড কন্টিজেন্ট কমান্ডার কবির আলম বলেন, সোমবার একটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে, এছাড়া কোনো জেলেকে পাওয়া যায়নি। তবে নিখোঁজদের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে।
তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুজ্জামান বলেন, নিখোঁজদের উদ্ধারে পুলিশ ও কোস্টগার্ড তৎপরতা চালাচ্ছে। মনপুরা ও হাতিয়াসহ বিভিন্ন থানায় আমারা উদ্ধার অভিযানের জন্য যোগাযোগ রাখছি। ওইসব এলাকা থেকে তারাও নিখোঁজদের উদ্ধাওে চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, যাদের মৃতদেহ পাওয়া যাবে তাদের দাফনের জন্য প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার করে টাকা দেয়া হবে। এছাড়া, মৃত প্রত্যেক পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top