সকল মেনু

ধ্বংস হচ্ছে নীতি-নৈতিকতা ও সুস্থ সংস্কৃতি

স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলারমুহাম্মদ আবদুল কাহহার : স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলার আগ্রাসনে ধ্বংস হচ্ছে নীতি-নৈতিকতা ও সুস্থ সংস্কৃতি। ঝি-বৌরা এক সময়ে শ্বাশুড়িদের মায়ের মতো শ্রদ্ধা করত, শ্বাশুরি মমতা দিয়ে পুত্র বধুকে মেয়ের মতো আপন করে নিত, পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো, সকলেই যৌথ পরিবারে বসবাস করতে পছন্দ করত, পারিবারিক আয়োজনে বিবাহ বন্ধন হতো, আত্মার বন্ধনে আত্মীয় হতো। কিন্তু এখন লাভ-ম্যারেজ, বিয়ে করে পালিয়ে বেড়ানো, পাখি ড্রেস কিনে না দেয়ায় আত্মহত্যা, পাখি ড্রেস না দেয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ, ঐশীর মতো মেয়ের হাতে বাবা-মা খুন, পরকীয়া, বিবাহ ছাড়া বাবা-মা হওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা নিয়মিত ঘটছে।

নিজের সন্তান, পরিবার বিপদগামী হচ্ছে সে কারণে কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে টিভিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। কিন্তু গোটা দেশের সুস্থ সংস্কৃতি বজায় রাখতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদেশী টিভি চ্যানেল তথা ভারতীয় চ্যানেলগুলো বন্ধ করা উচিত। তথ্যমন্ত্রী সেটা না করে টিভি চ্যানেলের তালিকায় দেশীয় চ্যানেলগুলো প্রথমে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কি অদ্ভুত পদক্ষেপ ! রাজনৈতিক সমাবেশ, বক্তৃতায় দেশে অনিয়ম ঘটবে সে জন্য যদি টিভি, পত্রিকা বন্ধ পারেন তাহলে যে চ্যানেল ও টিভির কারনে নৈতিক অবক্ষয় হয়, শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী, যুব সমাজ ধ্বংস হয়, বৃহৎ স্বার্থে তিনি ওটা বন্ধ করতে পারেন না কেন ? গত বছরের ৭ আগস্ট বাংলাদেশে ভারতীয় তিনটি চ্যানেল-স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলা সম্প্রচার না করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে রিট করা হলেও তা নিষ্পত্তিতে নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ।

ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ওয়ান্টেড’ এর মুক্তিকে কেন্দ্র তা বন্ধের দাবিতে গত ২২ জানুযারি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ঐক্যজোট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালায়ে স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের দেয়ালগুলো হিন্দি সিনেমার পোস্টারে ছেয়ে গেলেও নেই কোনো প্রতিকার, নেই কোনো প্রতিরোধ। কিন্তু শিল্পী সমিতির সভাপতি চিত্রনায়ক শাকিব খান ভারতীয় ছবির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলেছেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো কিছু রাজাকার দেশে রয়ে গেছে।

আর ক’টা দিন পড়েই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ফেব্রুয়ারিজুড়েই শহীদ দিবস পালন করা হয়। ঘরে ঘরে বাংলা ছাপার অক্ষর পৌঁছে দেয়ার জন্যই মাসব্যাপী বই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এমন একটি সময় পরিকল্পিতভাবে ভারতীয় হিন্দি ছবি মুক্তি পাওয়া দুঃখজনক। বাসা বাড়িতে ছোট পর্দায় ছবি দেখার সুযোগ সাড়া বছরই থাকে। কিন্তু বড় পর্দার আয়োজন দেখতে দর্শকরা সিনেমা হলেই ভিড় করে। এ সময়ে আমাদের তরুণ সমাজ ও সাধারণ দর্শক কোনদিকে যাবে- বই মেলায়, নাকি সিনেমা হলে ? হল মালিকরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ভারতমুখী হয়ে পড়ছেন। কিন্তু এসব চলচ্চিত্র আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সে বিষয়ে  তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। তেমনিভাবে সারাদেশে ইংরেজী-হিন্দি-উর্দু চলচ্চিত্রের বাজার মিলছে। এটা যেন কেউ দেখার নেই। মুক্তিযুদ্ধের  সময় আমাদের চলচ্চিত্র যোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতির কিছুটা চর্চা হয়, একথা অস্বীকার করছিনা। তবে সেই চলচ্চিত্র যখন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক দিক বেশি প্রভাব ফেলে তখনি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী বিপত্তি ঘটে। কারো কারো ক্ষেত্রে এমনটি হয় যে, সুস্থ সংস্কৃতি ও অসুস্থ সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। হলিউড (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র জগতের প্রাণকেন্দ্র), বলিউড (ভারতের মুম্বাইয়ে অবস্থিত হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রের পিঠস্থান), ঢালিউড (ঢাকা কেন্দ্রীক চলচ্চিত্র), টালিউড (কলকাতা কেন্দ্রীক বাংলা চলচ্চিত্র) সবখানেই যেন যৌনতা ছড়িয়ে পড়ছে।

১৯৭২ সালে এই দেশে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল। তার কয়েক দশক পর ২০১১ সালে ভারতীয় তথা উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর একে এক মুক্তি পায় সংগ্রাম, জোর ও বদলা নামের ৩টি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র। বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থহয়ে কৌশল বদলে ফেলে ২০১৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে ‘যুদ্ধ শিশু’ ও সুন্দরবনের কাহিনী নিয়ে ‘দ্য রোর অব সুন্দরবনস’ নামে দু’টি ভারতীয় চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এতে কেউ আশান্বিত হয়েছেন আবার কেউ হতাশও হয়েছেন। ইতোমধ্যে দেশের ৫০-৮০ সিনেমা হলে ভারতীয় বলিউড চলচ্চিত্র ওয়ান্টেড সুপার হিট ছবি মুক্তির খবর পত্রিকায় এসেছে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠেন তোপের মুখে কোনটি দু’এক দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, আবার কোথাও কোথাও দু’এক দিন বন্ধ থাকার পরে আবার চালু হয়েছে। এই ছবিটি নির্বিঘেœ বাজার করতে পারলে ভারতীয় ডন, ২ থ্রি ইডিয়টস, তারে জামিন পার ও দাবাং এর মতো অন্যন্য ছবিও ক্রমশ বাজার দখল করবে। ফলে দেশীয় চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান ও চলচ্চিত্র কর্মীরা হবে ক্ষতিগ্রস্থ। তবে অধিকাংশ চলচ্চিত্র নির্মাতা মনে করেন, ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাজারকে উন্মুক্ত করতেই নয়া কৌশল অবলম্বন করেছেন। দেশীয় ঐতিহ্য প্রচার করা উদ্দেশ্য নয় বরং বাণিজ্যটাই মূখ্য। হল মালিকদের স্বেচ্ছাচারীতার জন্যই এমনটি হচ্ছে।

গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বরে দৈনিক ইত্তেফাকে তুলে ধরা হয়েছে, নারীকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন ছাড়াও যৌনতা প্রদর্শনে শীর্ষে রয়েছে ভারতীয় সিনেমা। বলিউডের সিনেমায় যেসব নারী চরিত্র উপস্থাপন করা হয়-তার শতকারা ৩৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে যৌনতা প্রদর্শন করে। জাতিসংঘের ‘উম্যান এ- দ্যা রকফেলার ফাউন্ডেশনে’র সহায়তায় বিশ্বের জনপ্রিয় সিনেমায় নারীর চরিত্রের ওপর গবেষণা শেষে এ তথ্য প্রকাশ করেছে গিনা ডেভিস ইন্সটিটিউট নামে একটি সংস্থা। পিটিআইয়ের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে হিন্দুস্থান টাইমস। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু কিছু ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানী চরিত্র ছাড়া অন্যসব চরিত্রে নারীর যৌনতাকে প্রধান্য দেয়া হয়। সেক্সি পোশাকের ক্ষেত্রে জার্মান ও অস্ট্রেলিয়ার পরে ভারতের স্থান। দেশীয় সিনেমা হলে কিছু কিছু ইংরেজি বা হলিউড চলচ্চিত্রের অবাধ প্রদর্শন হলেও সেগুলো ভারতীয় চলচ্চিত্রের চেয়ে কিছুটা ভালো। তবে একথা সত্য যে, বাংলাদেশে হলিউড, ভলিউড, ঢালিউডের সম্প্রচার নিষিদ্ধ হওয়ার দাবী রাখে। অথচ চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস বলেছেন, ভারতীয় হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশে মুক্তি পাচ্ছে তাতে খারাপের কিছু দেখছিনা। তার এ মন্তব্যকে ঘৃণ্যভরে প্রত্যাখ্যান করছি। এ কারণেই শুরুতেই বলছি সুস্থ বিবেক আর অসুস্থ বিবেক দুটোই মানুষকে প্রভাবিত করে। সেজন্য প্রকৃত মানুষ হওযার জন্য সুস্থ বিবেকের বিকল্প নেই। হিন্দি-উর্দু- চলচ্চিত্র আমদানি ও প্রদর্শেনের বিরুদ্ধে অবস্থানের পূর্বে নগ্ন-অশ্লীল-নারীদেহ প্রদর্শন, যৌন সুড়সুড়ি , যৌন আবেদনমূলক পোস্টার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া জরুরী।

অন্যদিকে চলচ্চিত্র কর্মীদের অনেকগুলো দাবীর একটি হলো সেন্সরবোর্ড বাতিল করতে হবে। এটা করতে পারলেই হয়তো তাদের আশা পূর্ণ হবে। দেশীয়রাও ভারতের কাতারে শামীল হতে পারবেন। সে কারণে সেন্সরবোর্ড কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার কারণে আপত্তিকর ছবি, চরিত্র বিধ্বংসি গান, বিতর্কিত চলচ্চিত্রের অনুমোদন পেয়ে যাচ্ছে।

তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে দেখা যায়না এমন বিষয় খুবই কম আছে বলে মনে হয়। ঘরে কিংবা অফিসে অবস্থান করেই যখন ছোট পর্দায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তখন আর সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার প্রয়োজন পড়েনা। তদুপরি সিনেমা হলগুলোতে তারাই যায়, যারা স্বাধীনভাবে বাসায় ছবি দেখতে পারেন না বা বড় পর্দায় ছবি দেখতে চান। অনেক দর্শক মনে করেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মান কমে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত দর্শক হারাতে বসেছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। এ দেশের মানুষ ভারতীয় চ্যানেল অবাধে দেখতে পারে বলেই বাংলার চেয়ে বিদেশি ভাষা, সংস্কৃতি, অনুষ্ঠানের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। দেশীয় চলচ্চিত্র ও বিদেশী চলচ্চিত্রের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য থাকার কারণে বিদেশী চলচ্চিত্র বেশি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে তাদের কাছে, যতদিন চলচ্চিত্রে নগ্নতা-বেহায়াপনা দূর না হবে ততদিনে ভাল কিছু আশা করা অর্থহীন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top