সকল মেনু

এক জীবনের গল্প

Aminul-Islam-Mamunআমিনুল ইসলাম মামুন : জীবনের জীবনাচরণ এমনই; সমসাময়িকদের তুলনায় ভিন্ন ধাঁচের। শৈশবের দেয়াল ডিঙিয়ে যখন সে পদার্পণ করল কৈশোরে, তখন কারো বুঝতে অবশিষ্ট রইল না যে সে তার পিতার একজন যোগ্য উত্তরসুরি। কী কথাবার্তায়, কী শিষ্টাচারে, কী নিয়মানুবর্তীতায় সর্ব ক্ষেত্রেই তার পিতার বৈশিষ্ট্যের ছাপ। কিন্তুু কৈশোরের আঙিনা থেকে বিদায় নিয়ে যৌবনের উত্তাল সমুদ্রে যে সে ‘উত্তরসুরি’ সীমারেখাটি অতিক্রম করবে এ কথা ভাববার সুযোগ কারো ছোট্ট মনের আশপাশের কোথাও স্থান করে নিতে সক্ষম হয়নি।
দেহের গড়নটা বেশ চমৎকার জীবনের। চওড়া কপাল। তার সাথে সাযুজ্যের বিন্দুমাত্র অভাব ঘটেনি মুখাবয়বের অবশিষ্টাংশের। চোখ দু’টি শান্ত কিন্তু অনুসন্ধিৎসু। তার বাচনভঙ্গী অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। সংস্কৃতিমনা ও প্রবল বিদ্যাগ্রহের ফলেই এ গুণটি তার রপ্ত হয়েছে। কবিতা আবৃত্তি তার শখের মধ্যে প্রথম স্থানে। বাসায় তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিটাও বেশ সমৃদ্ধ। পিতা ধর্মপ্রাণ মানুষ। সেই সুবাদে পাওয়া বেশ কিছু ধর্মীয় পুস্তক দিয়েই তার লাইব্রেরিটার জন্ম। এরপর যুক্ত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অনেক পুরোনো গ্রন্থ থেকে শুরু করে রবীন্দ্র-নজরুল যুগের লেখকদের বই এবং রাহমান-মাহমুদ যুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের নামজাদা সব লেখকের গ্রন্থ; রয়েছে ইংরেজী সাহিত্যের বহু গ্রন্থও। তার নিজ ধর্মীয় গ্রন্থের পাশাপাশি বাইবেল, বেদ প্রভৃতিও মিতালী গড়েছে। প্রথম প্রথম পিতা এ বিষয়ে ভ্রু সংকোচন করলেও যখন বুঝতে পারলেন জ্ঞানাগ্রহ তার সন্তানকে তাড়া করে ক্লান্ত করছে আর সেই ক্লান্তি দূর করতেই জীবনের এ প্রচেষ্টা, তখন তার ভ্রু’র প্রসারণ ঘটে যথাস্থানে প্রতিস্থাপিত হল। আড্ডায় তার ঝোঁক নেই। তবে একেবারেই যে শূন্যের খাতায় তা-ও নয়; খুবই কম। গত সপ্তাহে কয়েক বন্ধুসহ বেশ ক’ দিন পর আড্ডায় বসেছিল জীবন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। সে ব্যক্তি বিশেষের সমালোচনা শ্রবণ করেছিল; অংশ নেয়নি, অংশ নিয়েছিল আলোচনায়। তবে যে ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের আসন শূন্য কিংবা থাকলেও নগণ্য সে ক্ষেত্রে তার ভূমিকা আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনাতেও গড়াতে পারে। বাংলা সাহিত্যে শব্দ চয়ন প্রসঙ্গে বন্ধুদের সবার মতামত এক হলেও তার মতামত ভিন্ন। ‘সাহিত্যকে মানের সিঁড়িতে ওপরে নিতে হলে সাহিত্যে পুরনো শব্দকে ছেঁটে নতুন নতুন শব্দ চয়ন আবশ্যক’- এক বন্ধুর এ কথা তার কাছে পুরোপুরি সন্তোষজনক মনে হলো না। তার মতামত হলো ‘সাহিত্যকে মানের সিঁড়িতে এগিয়ে নিতে হলে সাহিত্যে নতুন নতুন শব্দের প্রয়োগ যেমন অত্যাবশ্যক, এর পাশাপাশি তেমনি অত্যাবশ্যক পুরাতন শব্দগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখা। তা না হলে এক সময় এ শব্দগুলো ভাষার ভুবন থেকে হারিয়ে যাবে। বিশ্বে এমন অনেক ভাষা ছিল যেগুলোর অস্তিত্ব আজ নেই। ভাষাকে যদি কোন স্বাভাবিক বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে উক্ত ভাষার একেকটি শব্দ ও অক্ষরকে অণু-পরমাণুর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সেই বস্তুই যদি হারিয়ে যেতে পারে, তাহলে বস্তুর ভগ্নাংশ অণু-পরমাণু হারাতে কতক্ষণ। বাবা-মা তাদের সবল-সুন্দর সন্তানটিকে যেমন স্নেহে কাছে টানেন, তেমনি স্নেহে কাছে টানেন অতিশয় দূর্বল, কৃষ্ণবর্ণের সন্তানটিকেও। তা না হলে ‘সভ্যতা’ শব্দের অর্থ হতো ভিন্ন। ভুলে গেলে চলবে না পুরনো বা প্রাচীন শব্দ বলে যাদের ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে, তাদের দিয়েই সূচনা হয়েছে ভাষার কিংবা ভাষার আজকের অবস্থান।
সমসাময়িকদের অনেকে আমাদের সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশকে ‘আধুনিকতার ছোঁয়া’ বললেও জীবনের মতে, এ আধুনিকতাতো নয়ই; বরং আমরা যেটাকে আদিম বলে জানি, তার চেয়েও আদিম। যে সংস্কৃতি নারীর বস্ত্র হরণ করছে, দেহের নগ্নাংশকে অসভ্যতার অধর স্পর্শের জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছে আর পুরুষদের করছে বিপথগামী, সে সংস্কৃতি আধুনিক হওয়ার কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ নেই। ‘অতি আদিম’ এই অর্থে যে, আদিম কালে মানুষ দেহের নগ্নাংশকে স্বল্প পরিধেয় সামগ্রীর মাধ্যমে ঢেকে রাখতো বা রাখার চেষ্টা করতো পরিধেয় সামগ্রীর অভাবে; নিজেদের অনিচ্ছায়। আর এখন রাখছে স্বেচ্ছায়। নিজের সাথে অন্যদের পার্থক্যকে জীবন এটা মনে করে না যে, এই পার্থক্য অন্যদের সাথে তার মেলা-মেশায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বরং সে সকলের সাথে মিশতে পারে অন্য দশ জনের মতো; কখনো কখনো তার চেয়ে কিছুটা বেশিও বলা চলে। এ মেলা-মেশা নারী-পুরূষ সকলের সাথেই সমান। তবে এটার একটা সীমা রেখা টানা আছে তার। তার মতে, এর বাইরে পা গেলেই তা হবে দৃষ্টিকটু।
আজ থেকে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শেষ হয়ে গেল। তাই ভার্সিটিতে যাওয়ার চিন্তা মাথায় নেই জীবনের। দেড় মাস পর ইয়ার ফাইনাল। ভালো একটা পরীক্ষা দিতে পারার চেষ্টা করছে জীবন। অনেক সময় পর্যন্ত মনটাকে চৌ-কোনা টেবিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে রাখতে এক ঘেয়েমী এসে গেল জীবনের। কলমটাকে বইয়ের ভেতর রেখে বইটা বন্ধ করল। তারপর উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ভাবলো, ক্লান্ত মনটাকে ঘুড়ির মতো উড়িয়ে দেয়া যাক। নাটাই-সুতায় আবদ্ধ ঘুড়ির মতো নয়; সুতা কাটা ঘুড়ির ন্যায়। নাটাই-সুতায় আবদ্ধ থাকলে ঘুড়ির স্বাধীনতা কোথাও না কোথাও গিয়ে বাধা প্রাপ্ত হবে। আর সুতা কাটা ঘুড়ি বাতাসের সাথে হারিয়ে যাবে আদিগন্তে। কিন্তু ঘুড়িটা থেমে গেল তার মাধ্যমিক স্কুল জীবনের এক স্মৃতির পাথরে।
এ কাজটা জীবন প্রায়ই করে। এটা হল স্মৃতিকে শাণিত করার একটা কার্যকরী কৌশল। কোন ঘটনা বা বিষয় যতই স্মরণ রাখার যোগ্য হোক না কেন, রোমন্থনের অভাব ঘটলে তা স্ম^ৃতির পাতা থেকে কোন না কোন সময় হারিয়ে যেতে বাধ্য। এতে কারো বিন্দু মাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয় বলে মনে করে জীবন।
সেদিন ছিল শনিবার। টিচার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। টিফিন বিরতির সময় শুরু হল। ছেলে-মেয়েরা একে একে সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। যাচ্ছিল জীবনও। পেছন থেকে একটি কিশোরী কন্ঠের আহবান তাকে থামিয়ে দিল। পেছনে তাকাল সে। কিশোরীটি এগিয়ে এল। ওর নাম তাসমিনা। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সে সপ্তম। দেহের গড়নটা মোটামুটি। শান্ত দু’টি চোখ। গোল-গাল চেহারা। গায়ের রংটা ফর্সা। খুব ছোট্ট স্বরে কথা বলে সে।
: তোমার সাথে একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম।
: ঠিক আছে। কোথায় বসা যায় তাহলে? – জীবন বলল।
: ক্লাসেই বসি- বলেই তাসমিনা বসার জন্য বেঞ্চের দিকে পা বাড়াল। সঙ্গে জীবনও। বসল দু’ জনে। একই বেঞ্চে, খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে। তাসমিনার শান্ত চোখ দুটোর দৃষ্টি পায়ের নিচের মাটির সাথে যেন মিতালী গড়েছে। কথা যেন জীবনের সাথে নয়, মাটির সাথে; গোপন কোন ভাষায়। জীবন একটু মনযোগ দিয়ে তাকাল তাসমিনার প্রতি। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে এল, যেমনটা ছিল না কিছুক্ষণ আগেও।
জীবন ডাকলো তাকে। মাথা তুলে জীবনের দিকে তাকালো তাসমিনা। জীবন বললো- কি কথা বলবে বলেছো। চুপ হয়ে আছো যে?
তাসমিনা কথা ঘোরালো। যে কথা সে জীবনকে বলবে ভেবেছিল তা বলার সাধ্য এখন তার নেই। শুধু বলল, আজ মনটা আমার একদম ভালো নেই জীবন।
: কারণটা শুনি। তাছাড়া কি কথার জন্যইবা আমাকে বসালে এখানে।
: মন ভালো নেই- এ কথাটা বলতে।
জীবন হেসে উঠলো। বলল, মন ভালো নেই, এ কথা বলতে আবার বসতে হয় নাকি। যা হোক খানিক পরেই ভালো হয়ে যাবে।
: কি করে বুঝলে?
: এটা তো বেশ সহজ হিসাব। তোমার মন ভালো নেই- এ কথা আর কাউকে না বলে যখন আমাকে বললে, তখন বুঝতে তেমন একটা সময় নিতে হয় না যে আমার সাথে কথা বললেই ঠিক হয়ে যাবে। যাক, অন্য প্রসঙ্গে আসি। বেশ কয়েক দিন ধরেই বিষয়টা তোমাকে বলবো বলে ভাবছি। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠে না। আজ যখন সুযোগ হয়েছে, তখন যদি অনুমতি দাও বলতে পারি।
: নিশ্চিন্তে বলতে পারো।
: আমি তোমার নামটা একটু পরিবর্তন করে দিতে চাই।
: হঠাৎ করে নাম পরিবর্তন কেন?
জীবন বলল, না এমনিতেই।
: এমনিতেই তো হতে পারে না। আমার নামটা কি তোমার পছন্দ হয় না? আমার কাছে তো সুন্দরই মনে হয়।
: আমার কাছেও তাই মনে হয়। তবে আমার কাছে আরেকটি সুন্দর নাম আছে।
: শুনি তাহলে।
: তাসমিনা নামটি আমার কাছে ডাকতে দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার বলে মনে হয়। একটু বেখাপ্পা লাগে। তাই নামটি সংস্কার করে শুধু আমার জন্য আমি একটি নাম দিতে চাই।
তাসমিনা হাসল। শিশুসুলভ হাসি। বলল, আমার কোন কিছুর ওপর কাউকে আমি কর্তৃত্ব করার সুযোগ দেইনি এবং দেবোও না; শুধু তোমার কথা ভিন্ন। এবার নামটি শুনি।
: ঘরে সবাই তোমাকে কি নামে ডাকে?
: তাসু।
: এ নামটা অবশ্য ছোট্র। মন্দ না। তবে দ্বিতীয় অক্ষরটিতে কাঁচি চালিয়ে তদস্থলে একটা নতুন অক্ষর ‘জ’ বসালে কেমন হয়।
: ‘তাজ’! অসম্ভব সুন্দর!
: একটু বেশি বলা হয়ে গেল যে।
: মোটেই না। বরং তোমার সৃষ্টিশীলতার প্রশংসা যতটুকু করা প্রয়োজন ছিল, ততটুকু প্রকাশেও আমি কার্পণ্য করেছি। আমি সারাটা জীবন ‘তাজ’ হয়ে থাকতে চাই জীবন।
তাসমিনার মুখাবয়বে একটা অব্যক্ত ভাষা প্রকাশ পায়। কানের ডগা লাল হয়ে আসে তার। সে আড়চোখে তাকায় জীবনের দিকে। এমনি সময় রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় মনির স্যার। মনির স্যার তাদের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস নেন। বেশ কড়া মেজাজের মানুষ তিনি। এরপর আরো কিছু সময় কথা হয় দু’ জনের।
টিফিন বিরতির পর পুনরায় ক্লাস শুরু হওয়ার ঘন্টা বাজল। মনির স্যার ক্লাসে প্রবেশ করলেন। কাউকে পড়া জিজ্ঞেস না করে শুধু জীবনকেই ধরলেন তিনি। জীবনের বুঝতে বাকি রইলো না যে পড়া পারুক আর না-ই পারুক, বেত্রাঘাত থেকে আজ তার নিস্তার নেই। কারণ কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি জীবনকে তাসমিনার সাথে বসে থাকতে দেখেছেন। হাতে দুটো বেত। বেত দুটোকে তিনি মোছড়াতে মোছড়াতে বললেন, জীবন দাঁড়াও। সে দাঁড়াল।
: গত দু’ দিন ক্লাসে তোমার উপস্থিতি লক্ষ্য করিনি। তার কারণ অবশ্য আমি জানতে চাইবো না। পড়াও জিজ্ঞাসা নয়। তবে বেঞ্চ থেকে উঠে এসো।
পুরো ক্লাসে পিন পতন নীরবতা। অনেকে একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। তারা ব্যাপারটা বুঝে উঠছে না। জীবন স্যারের টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। পেছনে ব্ল্যাক বোর্ড। তিনি খুব ভারী গলায় বললেন, মেয়েদের সাথে এতো কিসের আলাপ?
জীবন চুপ থাকে। একই ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা একে অপরের সাথে প্রয়োজনে কথা-বার্তা বলতেই পারে। এটা জগতের সব মানুষ মানলেও ব্যতিক্রম শুধু মনির স্যার। তিনি কঠিন দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে এলেন জীবনের দিকে। জীবন তাজের দিকে চোখ ফেরালো। ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো- দেখলো জীবন। মনির স্যার ঠিক তখনি কষে একটা বেত বসালেন জীবনের পিঠে। ওর চোখ স্বাভাবিক। কিন্তু অশ্র“ টলটল করছে তাজের। আষাঢ়ে পুকুর যেমন পানিতে টলমল করে পাড়কে ছুঁই ছুঁই করে উপছে পড়ার মতো অবস্থা, ঠিক তেমন। স্যার পাষাণের মতো ওর পিঠে বেত চালাতে লাগলেন যেন কোন মহা অপরাধের  দরুণ মুনিব তার দাসকে শায়েস্তা করে চলেছে।
তাজের চোখ থেকে টলটল করে অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে লাগলো বেঞ্চের ওপর খুলে রাখা বইয়ের পাতায়। বুকের ভেতর একটা প্রচন্ড কষ্ট অনুভব হয়। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় তার। লজ্জায় তার মাথা হেট হয়ে আসে। মনির স্যার তার ক্রোধ ঝাড়া শেষ করলেন। কিন্তু জীবনের চোখে এক বিন্দু পানিও এলো না। আসতে চেয়েছিল। বেশ কঠোরভাবে নিজেকে সামলে রাখলো। পিঠে দাগ বসেছে, জ্বালাও করছে বেশ। তাজের দিকে তাকালো সে। তাজের চোখের পানিতে সামনে রাখা বইটির বেশ কিছু অংশ ভিজে রয়েছে। জীবনকে স্যারের ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্দ মনে হলো। কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো। পরেই সে টেবিলের ওপর থেকে চকটি নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে দাঁড়ালো। সেখানে সে লিখলো ছোট্র একটি ছড়া-

বেত্রাঘাতে হয় না শেখা
তখন শেখা হয়
শিষ্য-গুরু সম্পর্ক
যখন ভালো রয়।

দরদ মাখা সম্পর্ক
সবার জানা চাই
ভিন্ন কিছু ভাবলে বোকা
তার মতো কেউ নাই।

ক্লাসে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীরা সেদিন জীবনের এ কান্ড দেখে বিস্মিত হল। কেউ কেউ ভাবলো, আজ আর তার পিঠের চামড়া অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু ঘটলো আসলে তার বিপরীত। স্যার চুপসে গেলেন।
সেদিন স্যার আর বেশিক্ষণ ক্লাসে থাকলেন না। এরপর থেকে মনির স্যারের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তিনি বুঝতে পারেন, এ অন্যদের মতো সাধারণ ছেলে নয়; আলাদা। হয়তো ভবিষ্যতে ও হবে একজন অসাধারণ মানুষ, যে সত্য প্রকাশে করবে না কোন দ্বিধা, অন্যায়কে করবে তীর ছুঁড়ে ক্ষত-বিক্ষত, করবে ন্যায়ের পূঁজা।

এর কিছুদিন পর।
তাজ একদিন উপস্থিত হয় জীবনদের বাড়িতে। সে এসেছিল জীবনের এক আত্মীয়ার সঙ্গে। উনি জীবনের বাবার মামাতো বোন, তার ফুফু। একই বাড়ি তাদের। জীবনদের ঘরে চার দিন বেড়ালো তারা। চার দিনে তাজ আর জীবনের মধ্যে তেমন একটা কথা হয়নি শুধু তৃতীয় দিনটি ছাড়া। সে সময়টি তাদের বর্ষাকালীন ছুটি চলছিল। সেদিন বিকেলে জীবন শুয়ে শুয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ পড়ছিল। দীপ্তি এসে তাকে দখিনা জানালা দিয়ে ডাকল। সঙ্গে ছিল তাজ। দীপ্তি জীবনদের বাড়িরই। পুকুরের ওপাড়ে তাদের ঘর। এপাড়ে জীবনদের। একই ক্লাসে পড়ে ওরা। ক্লাসে মেয়েদের মধ্যে প্রথম সে। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয়। আর জীবন চতুর্থ। ক্লাস রোল অনুযায়ী এ হিসাব হলেও পুথিগত বিদ্যা এবং এর বাইরের জ্ঞান মিলিয়ে হিসাব কষলে প্রথম স্থানটি সবাই জীবনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য। দীপ্তি তাকে মাঝে মাঝে বলে ক্লাসের পড়ার বাইরে না গিয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার চিন্তা মাথায় রাখতে। জীবন বলে, শুধু পাঠ্য বইয়ের জ্ঞান তাদের জন্য যারা দায় মুক্তির জন্য পড়ে। তারা পুকুরেই সাঁতার কাটে। তাই তারা সহজেই তীরের সন্ধান পায়। আমি তাদেরকে অনুসরণ করি যারা সমুদ্রে সাঁতার কাটতে চায়। তারা ক্লান্ত নয়। তীরের সন্ধান এত সহজে পাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করে না। তারা মনে করে প্রথম হওয়া বড় কথা নয়, কতটুকু অর্জন করা গেল সেটাই বড় কথা।
জীবন ঝটপট বিছানা থেকে উঠলো। চুলগুলো আঁচড়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দীপ্তিদের ঘরে গেল। ওদের ঘরে ছিল দীপ্তির মা আর ওরা তিন জন। দীপ্তির মা ব্যস্ত রান্নার কাজে। ঘরের সামনের রুমটি বেশ গোছানো। টিনের বেড়ায় ঘড়ির পেন্ডুলাম দুলছে। বিপরীত দিকের বেড়ায় রয়েছে একটি তৈল চিত্র। বেশ বড় ক্যানভাসে আঁকা। সাদা বা নীল রঙের দেয়াল হলে আরো চমৎকার লাগতো। জীবন আসার সঙ্গে সঙ্গেই দীপ্তি উঠে গেল। একটু পর সে বেতের তৈরী ট্রেতে করে কিছু হালকা খাবার নিয়ে এলো। জীবন আর তাজের হাতে দিয়ে দীপ্তি নিজেও একটি প্লেট নিল। সঙ্গে কথাও হচ্ছে।
: বুঝলে তাসমিনা, তোর সুবাদে আজ এই গৃহে নক্ষত্র নেমে এসেছে। – দীপ্তি বলল।
: কেন, নয় বুঝি জীবন আসে না?
: ওকেই জিজ্ঞেস কর। দুই বছরাধিক কাল পূর্বে একবার এসেছিল। এরপর আজ এলো।
জীবন যেন কিছুই শোনেনি। সে দীপ্তির দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, রবি ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ পড়েছো?
দীপ্তি কিছু না বলে তাসমিনার মুখের দিকে তাকাল।
: তাজ, তুমি পড়েছো? – জীবন জিজ্ঞেস করলো।
: সুযোগ পাইনি পড়ার।
: ভুল বললে। বল, সুযোগটা করে নেইনি।
দীপ্তি বলল, সে যাক। তোমাকে এখানে কেন ডেকেছি জান?
: না, জানি না।
: তাসমিনার ‘তাজ’ নামটাতো তোমারই দেয়া, তাই না?
: হ্যাঁ।
: তাজ কেন এসেছ এ বাড়িতে জান?
জীবন হাসল। হাসতে হাসতে বলল, কেন বেড়াতেইতো এসেছে, তাই না তাজ?- তাজের চোখে চোখ রেখে বলল।
তাজ কিছুই বলল না। শুধু অপলক চেয়ে রইল জীবনের দিকে। ঠোঁটে হাসি নেই; নেই চোখেও। চোখ দুটি যেন কিছু চাইছে জীবনের কাছে। তাজ বোঝে তার এ ভাষা জগতের আর কেউ না বুঝলেও জীবন যে বুঝে না তা কিন্তু মোটেই নয়। সে তার বুকের ভেতর মন নামক অনাবাদী অথচ উর্বর জমিটা শুধুমাত্র জীবনের জন্য রেখে দিয়েছে। তার প্রতি জীবনের আচরণে সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে – জীবন কি তাকে সত্যিই ভালবাসে, নাকি বাসে না। জীবনের এ নীরবতা তাকে কষ্ট দেয়।
: জীবন তুমি কি বুঝতে পার তাজ তোমাকে ভালোবাসে?
জীবন মাথা নাড়ায়। হ্যাঁ বোধক জবাব পায় দীপ্তি।
: তাজ আমাকে তার ইচ্ছার কথা বলেছে। সে তোমার হাতে হাত রাখতে চায়- তোমার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চায়।
জীবন কিছুই বলে না। নীরব শ্রোতার ভূমিকা তার। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর জীবন উঠে দাঁড়ায়। কিছু না বলেই নিঃশব্দে তার প্রস্থান হয় সেখান থেকে।
তাজের চোখ ফেটে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ে। ওড়নার আঁচল তুলে নিয়ে সেই অশ্র“কে শোষণ করাচ্ছে। দীপ্তি ওর পাশে গিয়ে বসে। তাজ দীপ্তির কাঁধে তার মাথাটা রাখে। তার কষ্ট দীপ্তির মনে রেখাপাত করে। ওর চোখ দুটিও অশ্র“তে চক চক করে ওঠে। এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত তাজ জীবনের কাছে সেই কথাটি প্রত্যাশা করে। কিন্তু নিষ্ফল হয়।
কিছুদিন পর পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। তাজ ভর্তি হয় গ্রামের একটি কলেজে। আর জীবন ঢাকায়। এরও কিছুদিন পর তাজের বিয়ে ঠিক হয়। পাত্র বিদেশে থাকে। বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর জীবন জানতে পারে। যে দিন সে জানলো সেদিন সে পার্কে গিয়ে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে অশ্র“ বিসর্জন দিয়েছিল। তার এ বিসর্জন দেয়া দেখেনি পৃথিবীর কোন মানব-মানবী। জানবেও না আর কখনো।
আমি’র চলনালাপনীটা বেজে উঠল। মিস কল এসেছে। জীবন ফিরে তাকায়। বলল,
: কখন এলি।
: হলোতো কিছুক্ষণ।
: আমাকে ডাকলি না যে?
: ভাবনায় ছেদ ঘটাতে চাইনি।
এতক্ষণ জীবন আমি’র মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। তার দৃষ্টি ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগল। সে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসল। বলল,
: সে কি রে আমি! তুই প্যান্টের ভেতরে পাঞ্জাবী ইন করেছিস!
: আশ্চর্য হচ্ছিস কেন। প্যান্টের ভেতর যদি গেঞ্জি কিংবা শার্ট ইন করে পরা যায়, তাহলে পাঞ্জাবী দোষ করল কি। আমার মন চেয়েছে তাই আমি করেছি। আমাকে দেখতে মন্দ লাগছে?
জীবন এ কথার জবাব দিল না। বরং জিজ্ঞেস করল অন্য কথা।
: চলনালাপনীটা নিয়েছিস কবে? এক সপ্তাহ ধরে উধাও হয়ে কোথায় ছিলি?
: এক পকেট মারের সাথে কাটালাম। বেশ এনজয় করেছি। ওকে নিয়ে চাঁদের আলোয় স্নান করেছি। ও-ই দিয়েছে চলনালাপনীটা।
সেদিন আমি ফার্মগেট থেকে লোকাল বসে উঠেছিল। বাংলামোটর আসার পর তার ব্যাক পকেট থেকে মানি ব্যাগটা পকেটমারের হস্তগত হচ্ছিল। ধরে ফেলেছিল সে। লোকে উত্তম-মধ্যম দিতে চেয়েছিল। আমি তা করতে দেয়নি। তাকে নিয়ে বাস থেকে নেমে গেল। এরপর তাকে নিয়ে যেতে চাইলে লোকটা ভয় পেয়ে গেল। সে তাকে অভয় দিল। বলল, যদি আমার সাথে চল তাহলে উত্তম-মধ্যম থেকে বাঁচবে। অন্যথায়…। লোকটা রাজী হল। এমনটা হওয়ার মত নয়। লোকটা এ পেশায় নতুন। কাঁচা হাত তাই ধরা পড়েছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার এ পথে আসা। কাজ-কর্ম নেই, তাই এ পথ বেছে নিয়েছিল সে।
সেদিন রাতে আমি লোকটিকে নিয়ে ছাদে জ্যোৎস্নার আলোয় স্নান করেছিল। একেবারে পানিতে স্নানের মতো। আমি’র যুক্তি, শরীরের সবটুকুই জ্যোৎস্নার আলোয় ভেজাতে হবে। তবেই তা হবে জ্যোৎস্নার আলোয় পরিপূর্ণ স্নান।
ছাদে কেউ ছিল না। শুধু ওরা দু’ জন। আমি প্যান্টের বদলে শুধু একটি তোয়ালে পরেছিল। এছাড়া আর কোন বস্ত্র ছিল না তার সর্বাঙ্গে। তপুকেও একটি তোয়ালে দিয়েছিল। তপু পকেটমারটির নাম। সে প্রথমে পরতে চায়নি। লজ্জা করছিল তার। পরে আমি বলল, আমি তাকাব না। দূর থেকে পরে এসো।
তপু তাই করলো। আমি বলল, পানিতে স্নান করতে গেলে শুধু শরীরের নিচের অংশে লজ্জা নিবারণের জন্য থাকবে গামছা বা তোয়লে। কিন্তু চাঁদের আলোয় স্নান করতে গেলে ব্যতিক্রম হবে কেন। তপু, তুমি কি বল?
: বড়ই যুক্তির কথা।
: এমন পরিবেশ চাঁদের আলো তোমার কছে কেমন লাগছে।
: ভালো, খুবই ভালো।
: বুঝলে, চাঁদের আলোর সাথে মানুষের সম্পর্ক যতো নিবিড় হয়, ততোই মানুষের মনটা আলোকিত হয়, চাঁদের মতো আলোকিত।
: তাই বুঝি আমারে চাঁদের আলোয় নিয়ে আসছেন?
: তোমার মাথাটাতো বেশ ভালো। কিন্তু আমার হাতে ধরা পড়লে কেন?
: হয়তো এমন একটা পরিবেশে চাঁদের আলো দেখার জন্য। ভাইজান, আপনার পায়ে ধরি আপনি আমারে একটা কাজ জোগাড় কইরা দেন। আমি আর এই কাজ করুম না। বলতে বলতে তপু আমি’র পা ধরতে হাত বাড়ালো।
আমি তপুকে তা করতে দেয়নি। বলল, ঠিক আছে তাই হবে। তবে এক শর্তে।
: এক শর্ত কেন, দশ শর্ত হইলেও আপত্তি নাই।
: শর্তটা হলো তুমি এই এক সপ্তাহ আমার সাথে ঘুরবে।
এইডা আবার কোন শর্ত হইল নাকি।
সপ্তাহের শেষ দিন আমি তপুকে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিল। তপু চলনালাপনীটা আমিকে দিতে চাইল। কিন্তু আমি তা নিতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত তার অনুরোধে এক মাসের জন্য রাখল। রাখার পেছনে মূল কারণটি হলো সেটিতে অনেকগুলো ফিচার রয়েছে। অনেক দামী সেট বলে কথা। মাস খানেকের মধ্যে আবার আমি তপুকে তা ফিরিয়ে দিবে।
জীবন আমি’র প্যান্টের ভেতর হতে পাঞ্জাবীর ইন্টা খোলালো। এরপর ওকে বসতে বলল। আমি বলল-
: এখন বসবো না। আড্ডা দেয়ার জন্য একটা দোকান ঘর ভাড়া করেছি। তোকে সংবাদটা দিতে এলাম।
আড্ডা দেয়ার জন্য দোকান ঘর ভাড়া নেয়ার কথা শুনে অনেকে বিস্মিত হলেও আমি’র বন্ধুরা কেউ বিস্মিত হয়নি। আমি’র কাজগুলো এমনই অদ্ভুদ।
: আড্ডা দেয়ার জন্য কোন পাগলে তোকে দোকান ভাড়া দিলো?
: উনি পাগল না, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। সরকারী চাকুরী করেন। এ্যাডভান্সটাও করে এসেছি। ভাড়া নিয়েছি মাত্র তিন মাসের জন্য। উনি বললেন, উনার ভাড়াটা পেলেই হল।
: বেশ ভালো।
: তুই মনে হয় খুশি হলি না।
: নিয়ে যখন ফেলেছিস খুশি আর অখুশির কি আছে।
: তুই আসবিতো?
: চেষ্টা করবো।
: সন্ধ্যার পর এলে আমাদের পাবি না। তার আগেই আমরা বন্ধ করে ফেলবো। কারণ আড্ডা দেয়ার জন্য দোকান ভাড়া নিয়েছি। অন্যের সমালোচনামূলক কাজের দায়ভার নিজের কাঁধে নেয়ার জন্য নেইনি। এরপর আমি তার চালনালাপনীতে একটা নাম্বার টিপতে বেরিয়ে পড়ল। জীবন জানালার সামনে এসে বাইরে তাকালো। আকাশে ছেঁড়া-খোঁড়া মেঘের আনাগোনা। হালকা বাতাসও বইছে। আজ চৈত্রের শেষ দিন। এ বৈশাখের আগমনী বার্তা। জীবন আনমনা হয়ে চেয়ে থাকে আকাশের পানে।

বৈশাখের প্রথম দিন; পহেলা বৈশাখ। জীবন তার ফুফুর বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। ফুফু জীবনকে বেশ স্নেহ করেন। এমন স্নেহ অন্য কেউ পেলে স্নেহদাতার সংস্পর্শ ছাড়া একটি মুহূর্তও কাটতো না, ছায়ার মতো অনুসরণ করতো তাকে। কিন্তু জীবনের পক্ষে তেমনটি তো নয়ই বরং তার কানা-কড়ি পরিমাণও করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতি সপ্তাহেই ভার্সিটির পড়ার পাশপাশি অন্য আরো দু’ তিনটি বই তার শেষ করা চাই। কোন কারণে কোন সপ্তাহে এর ব্যতিক্রম ঘটলে পরের সপ্তাহে সে তা পূরণ করে নেবেই।
ফুফু তাকে কয়েকদিন আগেই বলেছিলেন এবারের পহেলা বৈশাখের দিনটা যেন তার বাসাতেই কাটানোর সুযোগ করে নেয় জীবন। জীবনও তাই করে। আজকের জন্য হাতে অন্য কোন কাজ রাখেনি সে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওজু করে ফজরের নামাজটা সেরে নিল। এরপর সেভটা। এখন গোসলটা। গোসলে জীবনের বেশ সময় লাগে; অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট। গোসল শেষে রুমে এসে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো। সময় দেখে জীবন দ্রুত তৈরী হতে শুরু করল। আটটা দশ বাজে। অথচ আটটায় তাকে ফুফুর বাসায় থাকার কথা। স্বল্প সময়ে তৈরী হয়ে জীবন বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্যে পৌঁছতে ঘড়ির কাঁটা পৌঁছল দশের ঘরে। এতটা সময় লাগার কথা ছিল না। পথে গাড়ি জ্যামে পড়েছিল। নববর্ষ উপলক্ষে র‌্যালীতে ছেয়ে গিয়েছিল ঢাকার প্রশস্ত অনেক সড়ক। রমনা পার্কের পাশের সড়কটি বন্ধ। সেখানে পার্ক উপচে লোকজন সড়কের ওপর এসে উদ্যাপন করছে বৈশাখের আনন্দ। বাস বিকল্প পথে আসার সময় চোখে পড়ল তরুণীরা শাড়ি পরে দল বেঁধে হেঁটে চলছে। তরুণদের পরণে রয়েছে পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি। তাদের কারো কারো হাতে ঘুড়ি আর নাটাই। কিন্তু সেগুলো উড়ানোর সাধ্য নেই বললেই চলে এই নগর জীবনে।
ফুফুর বাসায় পৌঁছেই জীবনের মনে হলো তার এখানে আসার ব্যাপারে প্রয়োজনটা যেন ছিল তার ফুফাত বোনের। সে-ই তার মাকে প্রভাবিত করেছিল জীবনকে আনতে। জীবনের এই ফুফাত বোনটি কলেজে পড়ে; ইন্টারে। নাম আলো। স্কুল জীবন থেকেই জীবনের প্রতি রয়েছে আলোর দূর্বলতা। সে জীবনকে ভালোবাসে। কিন্তু এর কোন বহিঃপ্রকাশ নেই। কখনো কখনো থাকলেও তা অন্যদের গোচরীভূত হওয়ার মত নয়। জীবন ড্রইং রুমে বসে ছিল। আলো এসে তাকে ডাকলো ডাইনিং টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে বলে। দেরি না করে উঠে গেল সে। আশেপাশে একটু তাকিয়ে চেয়ারটা টেনে বসল। ফুফু এসে তাকে ভাত বেড়ে দিলেন; পান্তা ভাত। সঙ্গে প্লেটে তুলে দিলেন ইলিশ মাছ আর পোড়া মরিচ। বৈশাখের প্রথম দিনে এমন আয়োজন রেস্তোঁরা ভিন্ন কম বাসায়ই করা হয়। আলোর মা প্রতি বছরই এমনটা করে থাকেন। বছরের বিভিন্ন উপলক্ষকে তিনি ঘরের ভেতর উদ্যাপনের চেষ্টা করেন।
জীবন ফুফুর দিকে চোখ তুলে তাকালো। ফুফু বুঝলো ওর ইলিশ ভীতির কথা। ইলিশ মাছকে জীবন বেশ ভয় পায়। কাঁটার ভয়। ইলিশের কাঁটা বেছে খাওয়াতে সে অভ্যস্ত নয়। বাসায় কাঁটা বাছার এ দায়িত্বটা মা’র ওপর বর্তায়। ফুফু আদুরে গলায় শাসনের সুরে বললেন, বেছে খাও।
: ফুফু তুমি তো…
জীবনকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, আমি জানি কি জানিনা তা বলার প্রয়োজন নেই। কাঁটাটা বেছে খাও। সামান্য একটা মাছের কাঁটাতে এত ভয়, জীবন পথের অসংখ্য কাঁটা সরাবে ক্যামনে?
: ও নিয়ে আমি ভাবি না ফুফু।
: ভাবতে হবে, এখন থেকেই তো ভাবতে হবে। বড় হচ্ছিস না দিন দিন?
: পথ যখন চলতেই হবে, কাঁটা সরানোকে ভয় পেলে কি চলবে? চলবে না। ওসব আমি বুঝি। ফুফু বললেন, আমার হাতে অনেক কাজ বাবা। তুমি একটু দেখে-শুনে খেয়ে নাও। জীবন মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করল। ফুফু গেলেন রান্না ঘরে; রান্নার কাজে। আবার প্রয়োজন পড়ল ফুফুর। ডাকল জীবন।
: ফুফু ভাতে পানি লাগবে যে। জগে পানি নেই।
পেছন থেকে একটি হাত জগ ধরে তার প্লেটে পানি ঢেলে দিল। প্রথমে জীবন হাতটাকে ফুফুর হাত ভাবলেও হাতটা যে তার অপরিচিত তা বুঝে উঠল পরক্ষণেই। ফুফুর হাতে সোনার বালা ছিল না, একটু আগেই জীবন তা লক্ষ্য করেছিল। মাথাটা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল জীবন। হাতখানা সরে গেল। অপরিচিত একটি মেয়ে। পরণে শড়ি। শাড়ি পরার ধরণই বলে দিচ্ছে ও সব সময় স্যালোয়ার-কামিজ পরে। আজ শাড়ি পরেছে শখের বশে।
কবরীতে কাঁচা গাঁদা ফুল, দু’ হাতে দু’খানা সোনার বালা, পরণের শাড়িটা বেগুনী রঙ্গের আর শাড়ির পাড়টায় সবুজ আর গোলাপী রঙ্গের মিশ্রন। গায়ের রংটা উজ্জ্বল হওয়াতে অসম্ভব রকম সুন্দর দেখাচ্ছে।
জীবন নির্বাক। চোখে-মুখে কিছু একটা বলবার ভাব ফুঠে উঠেছে তার। ফুফু একটি পানির জগ হাতে নিয়ে জীবনের কাছে এলেন। গলাটা একটু খাকরি দিয়ে বললেন-
: জীবন, ও হচ্ছে অপূর্বা। আলোর সাথে পড়ে। আমাদের আর ওদের হোম ডিষ্ট্রিক্ট একই।
কথার মাঝখানেই অপূর্বা এখান থেকে চলে গেল। জীবন খাওয়া শুরু করল। খাওয়া শেষ করে ড্রইং রুমে গিয়ে বসল সে। বসে বসে একাকী কিছুটা সময় কাটালো। একটু পর আলো আর অপূর্বা এসে সামনে বসলো ওর। আলো অপূর্বাকে দেখিয়ে বলল-
: জীবন ভাই, এ হলো আমার বান্ধবী। নাম অপূর্বা।
: এটুকু ফুফুর কাছ থেকে জানা হয়ে গেছে।
অপূর্বা জীবনের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, আপনি কি করেন?
জীবন অপূর্বার দিকে তাকাল। সে বলতে না বলতেই আলো বলল, উনি ভার্সিটিতে পড়েন। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। অপূর্বা, তুই বস্। আমি একটু ভেতর থেকে চা করে নিয়ে আসি – এই বলে সে উঠল।
অপূর্বা বলল, এই বাসায় আমি প্রায়ই আসি; সপ্তাহে অন্তত দু’ দিন। কিন্তু আপনাকে আর কখনো দেখিনি যে? খুবই কম আসেন এখানে তাই না?
: হ্যাঁ, তাই।
: বোধ হচ্ছে আপনি কথাও কম বলেন।
: আসলে সে রকম না।
: তবে কি বেশি বেশি বলে ধরে নেব? তা-ই বা হবে কেন। সে রকম ধরে নেয়ার মতো কিছুতো লক্ষ্য করছি না।
জীবন খানিকটা হাসল। হাসলে ওকে বেশ লাগে ছোট দু’টি টোল পড়াতে। তবে টোল দু’টি গালের মাঝখানে নয়, তা থেকে আরেকটু গড়িয়ে ওপরের ঠোঁটের প্রন্তদেশের  কিঞ্চিৎ দূরবর্তী স্থানে। এরপর বলল-
: স্বল্প বা অধিক কোনটাই নয়, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুতো বলতেই হয়।
বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকে দু’ জনে। তারপর অপূর্বা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে আরো কিছুক্ষণ। জীবনের দিকে তাকাতেই জীবন অপূর্বাকে লক্ষ্য করে বলল, বৈশাখ আমার প্রিয় মাসগুলোর একটি। আজ সেই মাসের প্রথম দিন। জীবনকে লক্ষ্য করে অপূর্বা বলল, সেই বৈশাখ দেখা দিল প্রকৃতিতে। চৈত্রের দাবদাহ কেটে প্রকৃতি নেবে স্বস্থির নিঃশ্বাস। মনে মনে সে ভাবে, এই বৈশাখে ধানক্ষেত চুষে নেবে বৃষ্টির চুম্বন। কিন্তু একথা মুখফুটিয়ে বলার সাধ্য অপূর্বার নেই যে, আজ নব আশার সঞ্চার হলো তার হৃদয় আকাশে।
জীবন উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে জানালার পাশে গিয়ে গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের প্রকৃতিতে দৃষ্টিপাত করে বলে-
: হয়তো এ বৈশাখই মাতাল হয়ে উঠবে আর প্রকৃতিকে করবে লন্ডভন্ড।
জানালার পর্দাটা বাতাসে কিছুটা উড়ছে আর তা গা-কে স্পর্শ করে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। অপূর্বা বলল, বৈশাখ প্রকৃতিকে উজ্জীবিত করুক, দান করুক নতুন প্রাণ – এটাই কামনা।
অপূর্বার কণ্ঠটা বেশ কাছ থেকেই শোনা গেল। পেছন ফিরে তাকাল জীবন। অপূর্বার চোখে-মুখে আবেগের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চোখে ভর করছে যেন রাজ্যের যতো লজ্জা; সব। সলাজ দৃষ্টিতে জীবনের চোখে কিছুক্ষণ চোখ রাখল সে। হালকা গোলাপী রঙ্গের ঠোঁট দু’টো কিছুটা কেঁপে ওঠে। তার এ আবেগের ছোঁয়া যেন জীবনের মাঝেও বিস্তার লাভ করেছে। অপূর্বা তার দৃষ্টিকে সরিয়ে নেয়।
জীবন এসে বসলো যথাস্থানে; যথাস্থানে বসলো অপূর্বাও। কোন কথা নেই। নিঃশব্দ অবস্থান তাদের। জীবন মাথা তুলে তাকায় অপূর্বার দিকে। এ সময় শোনা যাচ্ছিল চায়ের কাপ নড়ার শব্দ। আলো ট্্ের-তে করে চা নিয়ে আসছে। মুহূর্তে সে চা নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। ট্রে-টা টি টেবিলের ওপর রেখে সে একটি চায়ের কাপ অপূর্বার হাতে তুলে দিল। তিনটি কাপের মধ্যে দ্বিতীয় কাপটি জীবনে দিকে বাড়িয়ে বলল, আপনার কাপে মিষ্টি যথেষ্ট দেয়া হয়েছে। চিনি আরো লাগলে নিয়ে আসতে পারি।
জীবন কাপটি হাতে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলল, ঠিক আছে। এরপর সে চায়ের কাপটি টেবিলের ওপর রেখে আনমনা হয়ে বাইরে চেয়ে রইল।
কিছু সময় অতিবাহিত হলো নীরবতার মধ্য দিয়ে। আলো বলল, জীবন ভাই, আপনিতো কবিতা লিখেন আবৃত্তিও করেন। এ মুহূর্তে একটা কবিতা লিখবেন?
জীবন মাথা নেড়ে বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে সম্মতি জানালো। তবে এ চূড়ান্ত সম্মতি নয়, অর্ধেকটা যেন বাকি। আলো উঠে গিয়ে পাশের পড়ার টেবিল থেকে কাগজ আর কলম নিচ্ছিল। জীবন অপূর্বার দিকে তাকালো। অপূর্বা ঘাড় বাঁকিয়ে বাকি অর্ধেকটা সম্মতির জন্য সায় দিল। জীবনের সম্মতিতে যেন পূর্ণতা এলো। আলো কাগজ-কলম দেয়ার পর সে খানিকক্ষণ চুপ হয়ে রইল। এরপর লিখলো কয়েক পংক্তি।

হে বৈশাখ
এসেছো তুমি ভুবন মাঝে
ভেঙেছো যে কবরী
এতোদিন তুমি কোথায় ছিলে
রাখিনিতো কোন খবরই।

ধরাকে তুমি করেছো উথাল
স্বস্তি দিবে কি তাকে
মানব, চোখে রঙ মেখে আজ
ধরায় যে ছবি আঁকে।

ছবি কি শুধুই ছবিই থাকবে
বাস্তব হবে কি?
অংকিত যেই ছবিটি আজ
দেখেই চলেছি।

এরপর জীবন কবিতাটি পড়ে শোনালো। অভিভূত হলো অপূর্বা। আলো অবশ্য অপূর্বার মতো এতটা হয়নি। কারণ সে জীবনের এ কবি প্রতিভার সাথে পূর্ব পরিচিত। অপূর্বা জীবনের হাত থেকে কাগজটি নিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলল-
: চমৎকার লিখেন তো আপনি! আপনার আঁকা ছবিটি একদিন ফ্রেম ছেড়ে আপনার জীবনে সত্যি হয়ে ধরা দেবে।
জীবন চুপ করে রইল।
অপূর্বা বলল, কিন্তু আপনার কবিতাটির কোন শিরোনাম নেই, উহ্য আপনার নামটিও। দিয়ে দিন না। দিবেন না?
: না, প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
: কিন্তু কোন পাঠক হাতে নিলেইতো ধাক্কা খাবে। এমন চমৎকার একটি কবিতার সাথে তার নাম নেই যিনি এর স্রষ্টা।
: আমি যে কবি হতে চাই না।
: কারণ জানাতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই?
: তা অবশ্য নেই।
: তবে শুনি।
: কবি-সাহিত্যিকগণ সাধারণ মানুষের তুলনায় ভিন্ন। এ ভিন্নতা প্রধানতঃ চিন্তা-চেতনায়। আমি সাধারণ মানুষ হয়ে সংখ্যাধিক্যের সাথে থাকাটাকে পছন্দ করি। কোন ধরণের বিড়ম্বনা পোহাতে চাই না।
চা এতোক্ষণে প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেছে। আলো কৌতুক করে বলল, চা-তো মনে হয় শরবতে রূপান্তরিত হয়েছে। চুমুক দিয়ে দেখেন অপেয় হয়ে উঠেছে কি না।
: হলে কিন্তু অপরাধটা তোমার।
: আমি মাশুল দিতে আপত্তি করবো না।
জীবন চুমুক দিল। আলো বলল, আরেক কাপ বানিয়ে আনতে হবে?
: তা আর দরকার হবে না। অপেয় হয়নি এখনো।
অপূর্বা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, আপনার কবিতাটি আমি নিতে পারি?
: না, পারেন না। কারণ কবি কবিতা লিখেন। যেহেতু আমি কবি হতে চাই না এবং কবির বৈশিষ্ট্য আমার মাঝে বিদ্যমান আছে বলে মনে করি না; সেহেতু রচিত পংক্তিগুলোকে কবিতার পর্যায়ে ফেলাকে আমি অন্যায় বৈ কিছু মনে করবো না।
অপূর্বা বলল, তাহলে আলো প্রথমেই যে বলল আপনি কবিতা লিখেন আর আবৃত্তিও করেন?
: ও যেটাকে কবিতা বলেছে, আসলে সেটা কবিতা নয়, আমার দৃষ্টিতে কয়েকটি সাধারণ পংক্তি মাত্র। আর যেটাকে আবৃত্তি বলেছে, সেটা আবৃত্তি নয়- পাঠ। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আবৃত্তি হলো নিয়মতান্ত্রিক পাঠ আর পাঠ হচ্ছে এর ব্যতিক্রম।
: মানলাম এটি কবিতা নয়। এবার কি অনুমতি পেতে পারি?
: এবার যে ‘না’ বলতে সংকোচ হচ্ছে।
: সংকোচ যখন হচ্ছে, তখন ‘না’ না বলাটাইতো সমিচীন। কি বলেন?
জীবন হাসলো আর মাথা নাড়লো। অপূর্বা বুঝতে পারলো সম্মতি পাওয়া গেছে। সে কবিতাটি একবার পড়ে নিল। তারপর ভাঁজ করলো কাগজটি।
আলো বসা থেকে দাঁড়ালো। জীবনকে বলল, আপনি আমাদেরকে নিয়ে একটু বেড়াতে বের হতে পারবেন?
জীবন ভেবেছিল অপারগতা প্রকাশ করবে। কিন্তু তার আগেই অপূর্বা বলে উঠলো, আপনি কিন্তু না করতে পারবেন না।
তবুও জীবন বলল, বাইরে তাকিয়ে দেখুন। প্রকৃতিতো বাধ সেজে বসে আছে।
আলো বলল, ক্ষণিক বাদেই কেটে যাবে। – বলেই সে চায়ের কাপগুলো ট্রে-তে তুলে নিয়ে ভেতরের রুমের দিকে পা বাড়াল। তাকে অনুসরণ করল অপূর্বাও।
সময় বেশ হয়েছে। দুপুরের খাবারের ঝামেলাও চুকে গেছে এতক্ষণে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে জীবন বাসায় পা বাড়াতে মন স্থির করল। বেড়ানোর ইচ্ছেটা অপূর্ণই রয়ে গেল আলো আর অপূর্বার। আকাশ সেই যে অবুঝ শিশুর মতো ছেঁড়া-খোঁড়া মেঘ বুকে নিয়ে বসে আছে, তার সেই রাগ বাঙ্গানোর সাধ্য যেন এখনো কারো হয়নি বা ইচ্ছে করেই ভাঙ্গাচ্ছে না তার রাগ। আলোর কিছুটা খারাপ লাগলো। আর অপূর্বার মনটাও ভেঙে গেল এমন একটি সোনা মোড়া দিনের শেষ ভাগটা মাটি হলো বলে।
ভেতরে ফুফুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জীবন ড্রইং রুমের সোফায় বসে সু-টা পরে নিচ্ছে। ডান পায়ের ফিতা বাঁধা শেষে বাম পায়ের ফিতায় গিট পড়ে গেল। অপরিচিত একটি মেয়েলি কণ্ঠ কানে প্রবেশ করল। মেয়েটি বলল, আমি কি সাহায্য করতে পারি?
অপরিচিত কণ্ঠ বলে মোটেই আশ্চর্য হয়নি জীবন। বরং আশ্চর্য হয়েছিল তখন, যখন মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি মায়াভরা দু’টি নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। কিছুটা ইতস্তত করে জীবন বলল, থ্যাংস। এইতো হয়ে গেছে।
জুতার ফিতা বাঁধা শেষে জীবন একটু পায়চারী করতে গিয়ে হোঁচট খেল সোফার পায়ায়। অপূর্বা বলল, এখন বের হওয়াটা উচিত হবে না। যাত্রা শুভ হচ্ছে না আপনার।
জীবন বলল, কেন বলুনতো? হোঁচট খেয়েছি বলে?
অপূর্বা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক জবাব দিল।
: অনেকের মাঝেইতো এ নিয়ে কু-সংস্কার রয়েছে। আপনি দেখছি সেই কু-সংস্কারবাদীদের একজন।
অপূর্বা শান্ত-স্থির হয়ে পাথুরে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখগুলো এমন যেন ক্ষণিকের মধ্যেই আকাশের মেঘ ভেঙ্গে হবে শ্রাবণ। জীবন তখন নিজে নিজেই বলতে লাগলো, অবশ্য এর পেছনেও যুক্তি রয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে কোন কিছুতে হোঁচট খাওয়ার অর্থ হল, এ মুহূর্তে হোঁচট খাওয়া ব্যক্তিটি তার অন্য মনস্কতার কারণেই হোঁচট খেয়েছে। আর এ অন্য মনস্কতা নিয়ে রাস্তায় বের হলে ঘটে যেতে পারে যে কোন ধরণের অনাকাঙ্খিত ঘটনা। তাই কিছুক্ষণ বসে এই অন্য মনস্কতা কাটানোর পরই রাস্তায় বের হওয়া উত্তম।
জীবন পুনরায় সোফায় এসে বসল। বসার ধরণটায় ফুটে উঠেছে ব্যক্তিত্বের ছাপ। জীবন একটু নড়ে-চড়ে বসল। তাকালো অপূর্বার দিকে। দেখল ওর চোখ দু’টো পানিতে টলমল করছে। চোখের পাতা পড়লেই পানি গড়িয়ে পড়বে কপোলে। অংকিত হবে অশ্র“মালা। নিমিষেই ঘটলোও তাই। জীবন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বলল, অপূর্বা আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে গলার স্বরও হয়েছে ভারী। স্বর শোনে বোঝাই যাচ্ছিল না যে আমি কিছু সময় পূর্বে কথা বলেছি এই আপনার সাথে।
বহু কষ্টে যেন অপূর্বার মুখ থেকে বাণী নিঃসৃত হল। সে বলল, আপনি কি এখনই চলে যাবেন? কথাটি বলেই চোখের জল বাঁধ ভেঙে আসছে তার। স্পষ্ট কিছু দেখতে পারছে না চোখে। হাত দিয়ে চোখ দু’টোকে আলতো করে মুছে জলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে ভালোভাবে তাকালো জীবনের দিকে। এ কি সত্যি! জীবনের চোখেও জলের হালকা আভাস!
এরপর কিছু সময় নিঃশব্দ শ্রাবণ বয়ে গেল অপূর্বার চোখে। সে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে তা সংবরণের চেষ্টা  করেছিল। কিন্তু শ্রাবণের বৃষ্টি ঠেকায়, এমন সাধ্য কার।
জীবন আরো একটু সামনে এগুলো। স্বল্প ব্যবধানে দাঁড়িয়ে ওরা দু’ জন। নিঃশব্দ অবস্থান। নীরবতা ভেঙে অপূর্বা বলল, আমাদের সম্বোধনটা কি দূরত্ব কমিয়ে ‘তুমি’তে আনা যায় না?
জীবন শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়, কেন যাবে না। তবে আজ নয়, অন্যদিন। জীবন পকেট থেকে রুমাল বের করে দিয়ে অপূর্বাকে চোখ মুছে নিতে বলল। অপূর্বা চোখ মুছে নিল। এর মিনিট দু’য়েক পর আলো আসলো। ভেতরে মাকে সাহায্য করতে কিছুটা ব্যস্ততায় সময় কাটলো তার। এসেই সে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। অপূর্বাকে বলল, বড্ড দেরি হয়ে গেল রে!
অপূর্বার কাছ থেকে কোন জবাব এলো না। শুধু আলোর দিকে এক নজর চোখ তুলে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আলোর কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলো অপূর্বাকে। ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলল, শরীর খারাপ করছে না কি অপূর্বা?
অপূর্বা কোন কথা বলে না। আলোর মুখের দিকে চেয়ে শুধু মাথা নেড়ে না-বোধক জবাব দেয়। জীবন উঠে দাঁড়ালো। বলল, চললাম।
আলো জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। এরপর জীবনের দিকে চোখ তুলে বলল, আকাশটা আরেকটু ফর্সা হয়ে নিক। তারপর বের হলে হয় না?
জীবন মাথা নেড়ে বলল, আর বিলম্ব করা চলে না। আকাশ ফর্সা হওয়ার কোন সম্ভবনা দেখছি না। বরঞ্চ ঝড় না আসতেই যদি বাসায় পৌঁছা যায়, সেটিকে পরম সৌভাগ্য না বলাটা হবে সৃষ্টিকর্তার দয়ার প্রতি চরম অকৃতজ্ঞতা।
আলোর মনটা বেশ ভারী হয়ে উঠলো। সে আশা করেছিল আজ বেড়াতে বের হলে তার হৃদয়ের কথাগুলো প্রকাশ করবে জীবনের কাছে। কিন্তু তা পড়ল পাথর চাপায়। গম্ভীর মুখে সে দরজা পর্যন্ত এগুলো জীবনের সাথে সাথে। সঙ্গে অগ্রসর হল অপূর্বাও। আলো উন্নত দৃষ্টি অবনত করে জীবনকে বলল, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। আজ তো আর হলো না। আবার কবে আসবেন জীবন ভাই?
জীবনের কাছ থেকে অসম্পূর্ণ জবাব এলো। বলল, ‘আসবো, সময় পেলেই আসবো’- এই বলেই জীবন সামনে পা বাড়াল। অপূর্বা আলোর কাছে এসে ওর পিঠে হাত দিতেই আলো কেমন যেন চমকে উঠল। আলোর অন্য মনস্কতা সহজেই টের পেল অপূর্বা। কিন্তু দু’ জনের কেউ এখনো বুঝে উঠতে পারেনি একে অন্যের হৃদয়ের ব্যাকুলতা।
জীবন কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। দৃষ্টিতে তার অনেক চাওয়া, বোঝাই যাচ্ছে তা। কিন্তু এ চাওয়া কার কাছে? অপূর্বা আর আলো ওরা দু’ জন নিজেদের মতো করেই ভেবে নেয়।  এরপর আর পেছনে তাকায় না জীবন। দৃষ্টিটা ফিরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে সে।

দিন গড়িয়ে সপ্তাহ পেরুলো। সপ্তাহ পেরিয়ে পক্ষ, অতঃপর মাস। এ এক মাসের মধ্যে জীবন একবার গিয়েছে আলোদের বাসায়; আজসহ দু’ বার। বাস থেকে নেমে বাসা পর্যন্ত একটা রিক্সা নিল। বাস স্ট্যান্ড থেকে দূরত্ব তেমন নয়, অল্প কয় টাকার ভাড়া মাত্র।
জীবনের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ প্রবল। অপরিণত বৃক্ষে ফল ফলে না। বড় জোর দু’ একটি শাখায় ফলানো যায় কলমের মাধ্যমে। তা-ও তো আর নিজস্ব নয়; ধার করা। সামান্য ঝড়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে কলমের স্থান দিয়ে সেই শাখা। কিন্তু নারীর ভালোবাসার প্লাবন বয়ে যাওয়া মুখাবয়ব আর হৃদয়কে নাড়া দেয়ার মতো চোখের চাহনির কাছে হার মানতেই হবে যে কোন পুরুষকে এ কথা কোন পুরুষ মুখে স্বীকার না করলেও অন্তরে অন্তরে অস্বীকার করার কোন জো নেই। আর সে কারণেই কলমের কাজে নেমে পড়তে হবে।
রিক্সায় বসে আছে জীবন। গতকাল পর্যন্ত তার মনের গহীন কোনে বিন্দুমাত্র স্থান করে নিতে পারেনি এমন ভাবনা। অথচ ফুফুর বাসা থেকে ফেরার পথেই সে ভাবছে, উপায় একটা বের করতেই হবে- হোক চাই বৃক্ষের অপরিপূর্ণ বয়সে ফল প্রদানের জন্য, চাই ভাঙ্গুক তার ডাল। শেষ না হোক পড়ালেখা, বলুকগে লোকে অপরিপক্ক। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। চাকরি একটা আমাকে করতেই হবে এবার তা যা-ই হোক। ভাবনায় ছেদ ঘটলো তার পেছন থেকে ‘জীবন’ নাম ধরে ডাক শোনার পর। জীবন রিক্সা চালকের পিঠে হাত দিয়ে বলল রিক্সা থামাতে। রিক্সা থামাতেই পেছন থেকে আমি এসে পড়ল। জীবনের দিকে তাকিয়েই আমি বুঝলো কিছু একটা ঘটেছে। সে আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই বলল, ঠিক আছে, এখন যা। কাল তোর বাসায় আসবো। তখন কথা হবে।
জীবন যেন একটু বিরক্ত হলো। বলল, কথা না থাকলে ডাকলি কেন?
আমি’র কাছ থেকে কোন জবাব এলো না। গলার স্বরটা স্বভাবিক করে নিয়ে জীবন বলল, কাল না, আজ সন্ধ্যায় আসবি। – এই বলে সে আমি’র কাছ থেকে কোন সম্মতি প্রত্যাশা না করেই রিক্সা চালককে রিক্সা টানতে চোখে ইশারা করল।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর আমি জীবনের বাসায় এলো। জীবনের হাতে ‘ওয়ারস এন্ড: এন আইউইটনেস অ্যাকাউন্ট অব অ্যামেরিক্যান লাষ্ট অ্যাটমিক মিশন’ নামক বইটি; যেটির প্রধান লেখক জাপানের নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা হামলাকারী মার্কিন মেজর জেনারেল চার্লস ডব্লিউ সুইনি। জীবন বইটি বিছানার ওপর খুলে রেখে দরজা খুলতে এলো। আমি রুমে ঢুকেই প্রথমে বইটি হাতে নিল। বইয়ের নামটি দেখেই সে বলল, এই অ্যাটমিক মিশন পড়া রাখ্। তোর ভেতর কে ‘অ্যাটমিক মিশন’ চালালো তাই বল।
অপূর্বার সাথে দেখা হওয়ার পর আজই মাত্র আমি’র সাথে দেখা হলো জীবনের। জীবন ধীরে ধীরে আমিকে অপূর্বার সাথে দেখা হওয়ার দিনটির পুরো ঘটনা খুলে বলল। শ্রোতা হিসেবে আমি’র অবস্থানটা শূন্যের কোটায়। কিন্তু আজ তাকে মনে হচ্ছে পাকা শ্রোতা। জীবনের কথার দাড়ি-কমা পর্যন্ত যেন সে লক্ষ্য করছে।
আমি একটু নড়ে-চড়ে বসল। তারপর বলল, পরের ঘটনা শুনি।
জীবন বলল, দিন পনেরো পূর্বে আমি ফুফুর বাসায় গেলাম। আলোকে জিজ্ঞেস করলাম অপূর্বার কথা। জবাব এলো চাপা চাপা। কিছুই স্পষ্ট মনে হলো না। আমার উদ্দেশ্য যেন ওপাড়ে আর এ পাড়ে আমি নিজে। মাঝখানে কুয়াশা।
আলোর হৃদয় সেদিন যেন প্রচন্ড আহত হয়েছিল। তার অনেক দিনের স্বপ্ন যেন ঠুনকো কাঁচের ন্যায় ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে যেতে বসেছে। প্রচন্ড রাগ জন্ম হলো তার বান্ধবীর প্রতি। কিন্তু জীবনের সামনে সে নিজেকে সামলে নিলেও পরে সে অশ্র“ বিসর্জন দিয়েছে অনেক। অথচ বান্ধবীর কাছে আলো কখনোই বলেনি যে জীবন নামের কাউকে সে তার বুকের ভেতরে আসন দিয়ে বসে আছে। জানে না সেও যাকে কি না সে দিয়ে আছে তার মনটা।
জীবন কিছুটা হাফিয়ে উঠলো। একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আজ আবার গেলাম কুয়াশা সরাতে।
আমি বলল, কুয়াশা কি দূর হলো? না হলে সূর্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হও। কুয়াশা আপনা হতে উবে যাবে।
জীবন যেন আমি’র কথা কিছুই বুঝেনি। তাই আমির কথায় মন্তব্যেরও প্রয়োজন হয়নি তার। সে বলল, আলোর সাথে অপূর্বার কথা হয়েছে। মেয়ে হিসেবে অপূর্বা নাকি বেশ বাস্তববাদী।
আমি বলল, বেশ, বেশ বলেছে সে। এরপর আর জীবন কিছুই বলতে পারেনি। আমিও বুঝে নিল অল্প কথা থেকেই। জীবন বেশ আবেগ প্রবণ হয়ে উঠলো। তার চোখ ভরে এলো পানিতে। আমি’র হাতটা ধরে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে চাপা স্বরে বলল, আমি ভেবেছি চাকুরী খুজতে শুরু করবো। এছাড়া আর উপায় কি বল?
: কিন্তু পড়াশোনা?
: সেটি এখন আমার কাছে গৌণ হয়ে উঠেছে। মূখ্য হয়ে উঠেছে একটা কাজের সংস্থান।
আমি অশান্ত হয়ে উঠল। শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, এ হতেই পারে না জীবন। কাজের সংস্থান তোকে করতে হবে, তবে পড়া-লেখার ওপর কোন বিরূপ প্রভাব ফেলে নয়। আমি তোকে টিউশনির ব্যবস্থা করে দিবো।
জীবনের ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসির রেখা ফুটলো। বলল, আমি বড্ড বোকা, তাই নারে আমি?
: কেন শুনি?
: এই ছোট্ট চিন্তাটাও আমার মাথায় আসেনি, তাই।
: মানুষ যখন প্রচন্ড আবেগের মধ্যে ডুবে থাকে, তখন তার স্বভাবিক চিন্তা শক্তি লোপ পায়। আর সে জন্যই তো বন্ধু-বান্ধব আর পরিচিত জন। আমি কালকের মধ্যেই তোকে একটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুই কোন চিন্তা করিস না। যা কিছু করিস, অন্তত লেখা-পড়ার ক্ষতি করে নয়। কারণ তোর সামনে যাদুর এক হীরক খন্ড ঝলমল করছে যা তুই ছুঁতে পারবি।
জীবন শব্দ করে হাসলো। আমি তার হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
জীবনের সাথে অপূর্বার সাক্ষাৎ হচ্ছে না। কিন্তু দু’ জনই দূর থেকে একে অপরকে গভীরভাবে অনুভব করে। আলোর কাছ থেকে একে অন্যের খোঁজ-খবর নেয়। মাঝে মাঝে বিনিময় হয় উপহার সামগ্রীও। আলো উভয়ের কথা না রেখে পারে না। তবে ওপরে বোঝা যায় না তার ভেতরের ঈর্ষার ধরণ। এ জন্য সে মনে মনে নিজেকেই দায়ী করে। ভাবে, সেদিন ওদের দু’ জনের সাক্ষাৎ না হলেই ভালো হতো।
জীবনের হাতে এখন বেশ কয়েকটি টিউশনি; আমি’র দেয়া একটি টিউশনি দিয়ে শুরু হয়েছিল যা। টিউশনি, ভার্সিটি, বাসায় পড়া-লেখা আর একটা সোনালী ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে জীবন, যে ভবিষ্যতে তার সঙ্গী হবে অপূর্বা।

দিন কয়েক গড়িয়েছে।
আজ শুক্রবার। পশ্চিমাকাশে হেলে পড়া সূর্যের আলো ধীরে ধীরে মিষ্টি হয়ে উঠেছে। দালানের গায়ে চুম্বন আঁটা সেই মিষ্টি আলোর স্বাদ গ্রহণ করা যাচ্ছে হর্ষ হৃদয়ে। আবহাওয়াটা বেশ চমৎকার। জীবন আমি’র ভাড়া করা দোকানটায় এলো। আমিসহ বন্ধুদের অনেকেই সেখানে উপস্থিত। সকলেই একজন লোকের কথার দিকে কান পেতে আছে। লোকটিকে জীবনের পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল না। জীবন আসার পর পরই থেমে গেল লোকটির কথা বলা। লোকটি আমিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ইনিই কি জীবন ভাই?
: হ্যাঁ, এ-ই জীবন যার কথা কিছুক্ষণ আগে বলেছিলাম।
জীবন বলল, কি কথা হচ্ছিলোরে আমি?
: চুরি বিদ্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। কিভাবে পকেটমাররা প্রশিক্ষণ নেয় আর যাত্রীদের কাছ থেকে হাইজ্যাক করে শোন।
এরপর আমি তপুকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি চালিয়ে যাও।
তপু ধীর গতিতে গলার স্বর ওঠা-নামার মাধ্যমে হাত দু’টি নেড়ে এমন ভঙ্গিতে বলা শুরু করল যেন সে একজন শিক্ষক হয়ে ক্লাশ নিচ্ছে আর অন্যরা হচ্ছে তার ছাত্র।
: আমি মাত্র চার আনা ট্রেনিং নিয়েই কাজে নেমে পড়েছিলাম। সাধারণত: ষোল আনা ট্রেনিংই দেয়া হয়। ট্রেনিং নেয়ার ব্যাপারটা ট্রেনিং গ্রহীতার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। যেমন আমি লাউ কাটা ট্রেনিংটা নেইনি। এটা আমার ইচ্ছা। কিন্তু এই ট্রেনিংটা ভালোভাবে নেয়া গেলে কেউ সহজে ধরা পড়ে না।
আমি বলল, লাউ কাটা ট্রেনিংটা কেমন শুনি।
তপু আমি’র কথা শেষ হতেই বলতে শুরু করল-
প্রথমে কচি লাউকে বেঁধে ঝুলানো হয়। এরপর সে লাউয়ের ওপর পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ট্রেনিং গ্রহীতাদের প্রত্যেকের হাতে থাকে একটি করে ধারালো ব্লেড। প্রথমে একজন আসে। তাকে বলা হয় লাউয়ের ওপর জড়ানো ঐ পাতলা কাপড়টা এমন ভাবে কাটার জন্য যাতে লাউয়ের গায়ে ব্লেডের আঁচড় না লাগে। যদি কাপড় কেটে ব্লেড লাউয়ের গায়ে লেগে যায় তাহলে কচি লাউ থেকে কষ বেরুতে শুরু করবে এবং পুনরায় প্র¯ু—তি নিতে হবে। এভাবে এক এক করে সকলের ডাক পড়ে। কাটার সময় লাউটি কিঞ্চিত নড়তে পারে; বেশি নড়লে সেজন্যও পুনরায় প্র¯ু—তি নেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। টানা সাতদিন যে এ কাজে সফলতা দেখাতে পারবে তাকেই অপারেশনের অনুমতি দেয়া হয়। এছাড়াও রয়েছে ‘বন্ধু প্রশিক্ষণ’, ‘যাত্রী বেচা-কেনা’ প্রশিক্ষণ প্রভৃতি।
একটু ভেবে তপু পুনরায় বলতে লাগল। ‘বন্ধু প্রশিক্ষণ’ হল, কিভাবে যাত্রীদের সাথে বন্ধুত্ব করে ছিনতাই করা যায়। আর ‘যাত্রী বেচা-কেনা প্রশিক্ষণ’ একটু ভিন্ন ধাঁচের। এটি চালু হয়েছে বেশি দিন হয়নি। এ পদ্ধতিতে দূরপাল্লার যানবাহনের মধ্যে যাত্রীবেশে উঠে চলন্ত গাড়িতে নিজ সীমানার মধ্যে অপারেশন চালানো না গেলে অন্য সীমানার ছিনতাইকারীদের হাতে টাকার বিনিময়ে যাত্রীদের বিক্রি করে দেয়া হয়। এটা করা হয় সাধারণত পেট্রোল পাম্প বা রেস্তোঁরায় যখন বাস থামে, তখন। সে সময় ক্রেতারা বাসের স্টাফ হিসেবে উঠে। বাসের অন্য যাত্রীরা মনে করে, যে সব যাত্রী উঠেনি তাদের গন্তব্য হয়তো এখানেই। কোন যাত্রীর কাছ থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে তা-ই বুঝিয়ে দেয়া হয়। ক্রেতারা নির্দ্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই সুযোগ মতো ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে কিংবা গাড়ির গতি ধীর করতে বলে। এ সময় তাদের রাস্তায় অপেক্ষমান সদস্যরা গাড়িতে উঠে অপারেশন শেষ করে আবার সকলে নেমে যায়। এজন্য বাসের চালক আর হেলপারদেরকে পার্সেন্টেজ দিতে হয়। তপু ক্ষণিক থামলো। এরপর হেসে বলল, ছিনতাইকারীদের একটা সংগঠনও রয়েছে। বৎসরে একবার করে নির্বাচনও হয়। লড়াইও হয়, বড়ই কঠিন লড়াই। আমি যে গ্র“পের সাথে ছিলাম, সেই গ্র“পের লিডার আবার ঐ কমিটির সহ-সভাপতি। শুনেছি তিনি এবার সভাপতি পদের জন্য প্রার্থী হবেন। …
তপুর কথা শেষ হতে না হতেই রাস্তার মোড় থেকে কতগুলো লোকের চিৎকার শোনা গেল- ধর, ধর শালারে, মার শালারে ইত্যাদি। সবাই দৌড়ে গেল সেদিকে। লোকজন একটি লোককে যে যার মতো করে মারছে; কিল, ঘুষি, লাথি ইত্যাদি। তদুপরি মুখের কথায় তো বেড়া দেয়া নেই কারো। জীবন, আমি, তপুসহ ওরা সবাই একটু দূরে দাড়িয়ে। একজন লোক রিক্সায় করে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। জড়ো হওয়া লোকগুলোর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে সে রিক্সাচালককে বলল, রিক্সা থামাতে। রিক্সায় বসে সে এক পায়ের ওপর থেকে আরেক পা নামাতে নামাতে আমিকে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি হইছে ভাই?
: রিক্সা থামিয়ে ছিনতাই করে যাওয়ার সময় ধরা পড়েছে। তা-ও মাত্র একজন। চারজন ছিল।
লোকটি পুরো হাতার শার্ট পরা ছিল। হাতে ছিল চলনালাপনী। সে রিক্সা থেকে নেমে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিল। এরপর  চলনালাপনীটা রিক্সাঅলার হাতে দিয়ে বলল, একটু ধরো। আমিও একটু অংশগ্রহণ করি সবার সাথে। দু’পা সামনে এগিয়েই আবার পেছনে তাকিয়ে রিক্সাঅলাকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, দেখিস আবার তুই চান্স নিস না। জীবনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ভাই একটু লক্ষ্য রাইখেন। এরপর লোকটি ছিনতাইকারীকে উত্তম-মধ্যম দিতে গিয়ে তা না দিয়েই ফিরে এসে রিক্সায় বসে চলনালাপনীটা হাতে নিয়ে আবার জীবনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ভাইজান, আপনারা কি সবার সাথে অংশ নিয়েছেন?
জীবন মাথা নেড়ে না-সূচক ইঙ্গিত করল। লোকটি বলল, ভালই করেছেন। আমি গিয়েও পারলাম না। লোকটার জন্য মায়া লাগলো। ওর শইল্লের ওপর দিয়া খুব গেছে। মনে হয় বাঁচবে না। আপনারা ভাই সইরা পড়েন। পুলিশ আসলে বিপদে পড়তে পারেন। – এই বলে সে চালককে রিক্সা টানতে বলল। চালক রিক্সা টানতে শুরু করলে লোকটি আবার আরাম করে পায়ের ওপর পা তুলে বসল। জীবন লোকটির কান্ড দেখে হেসে বলল, বড় আজব প্রকৃতির লোক।
জীবন ও তার বন্ধুরা সেখানে আর বিলম্ব করার চেষ্টা করেনি। সবাই যার যার বাসার উদ্দেশ্যে স্থান ত্যাগ করলো। প্রায় ঘন্টাখানেক পর জানা গেল লোকটি মারা গেছে। পুলিশ এসে কয়েক জনকে জিজ্ঞেসাবাদের পর তাদের নাম-ঠিকানা লিখে রেখে লাশটি থানায় নিয়ে গেল।
যতোই দিন যাচ্ছে, ততোই বাড়ছে ছাত্র পরিবারগুলোর সাথে জীবনের সম্পর্ক। এক ছাত্রের বাসায়তো তার চলাচল রান্নাঘর পর্যন্তই ছিল। এ অনুমতি তার ছাত্রের মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। গৃহকর্তৃকে সে সম্বোধন করে খালাম্মা বলে। তার এ ছাত্রের বোনটির সাথে জীবনের সম্বোধনটি ‘আপনি’ পর্যন্তই পড়ে রইলো যদিও জীবন তার চেয়ে পাঁচ-ছয় বছরের বড়। উভয়ের কেউই যেন এ সম্বোধনে কিছুটাও শিথিলতা আনার পক্ষপাতি নয়। হয়তো গৃহকর্তৃ জীবনকে দেখে পূর্বেই এমন ধারণা করেছেন যার ফলে তিনি তাকে অনেকটা নিজের ছেলের মতো ভাবতে শুরু করেছেন। মাঝে মাঝে এ পরিবারের সকলের সাথে চলে জীবনের একত্রে বসে খাওয়া-দাওয়া, উচ্চ হাসির আলোচনা প্রভৃতি। মাঝে মাঝে ছাত্রের মায়ের অনুরোধে ছাত্র আর তার বোনকে নিয়ে বাহিরেও ঘুরে আসে জীবন।
একদিন জীবন টিউশনিতে এসে অনেকটা নির্বাক হয়ে গেল। তিন দিন তার শরীর খারাপ থাকার কারণে পড়াতে আসা সম্ভব হয়নি। ঘরের বাইরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হৈ-হুল্লোড় করছে এই সন্ধ্যার পরও। বিয়ের আমেজ বিরাজ করছে ঘরের ভেতরে-বাহিরে। আশিক এসে খবর দিল আজ নিলুর বিয়ে। কিছুক্ষণ পর জীবন তার ছাত্র আশিককে জিজ্ঞেস করল, ‘‘খালাম্মা কোথায়?’’
: ভেতরে আছে। ডাকবো স্যার?
জীবন মাথা নেড়ে জবাব দিল। এরপর সোফায় বসল। কিছুক্ষণ পর আশিকের মা এলে জীবন দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে কোন প্রসঙ্গ না টেনে সোজা অভিযোগ তুলে বলল, খালাম্মা এটাতো অন্যায়। বোনের বিয়ে হচ্ছে আর ভাই জানে না?
জীবনের প্রশ্নে আশিকের মা কিছুটা লজ্জাবোধ করলেন। এরপর মুখে হাসি নিয়ে বললেন, ভাই ছাড়া বোনকে তুলে দেয়া যায় না বলেইতো বিধাতা তোমাকে যথাসময়ে এখানে এনে হাজির করেছেন। তিন দিন ধরে ছিলে কোথায়?
: শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। জ্বর জ্বর করছিল।
: আজ কেমন বোধ করছো?
: ভালো, বেশ ভালো।
: তোমাকে খবর দিতে পারিনি বলে কিছু মনে করো না বাবা। তুমিতো ভালো করেই জান আমার বাসায় কোন বয়স্ক পুরুষ লোক নেই। তোমার খালুজানতো বিদেশের মাটিতে।
: কিন্তু খালাম্মা, এতো অল্প সময়ে …
আশিকের মা জীবনকে আর বলতে না দিয়ে বললেন, আজ বিকেলে ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছিল নিলুকে। দেখেই তারা বলল, আজই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে। উঠিয়ে নেয়ার কাজটা পরে হবে। ছেলে নিলুর চাচীর আত্মীয়। যতটুকু জানা গেল, ছেলে মন্দ না। তাই নিলুর চাচা তোমার খালুর সাথে ফোনে যোগাযোগ করে বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলেন।
ভদ্র মহিলা কিছুক্ষণ অন্য মনস্ক ছিলেন। হঠাৎ বললেন, সে কি! আমি তোমাকে নিয়ে এখানে কথা বলছি কেন! ভেতরে এসো।
জীবন বলল, ভেতরে লোকজন যে।
: ওতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই। সবাই আমাদের নিজস্ব মানুষ- এই বলে তিনি ভেতরের দিকে পা বাড়ালেন। জীবনও তার পেছনে পেছনে অগ্রসর হতে লাগল। নিলুর কাছে যেতেই নববধুর সাজে সে এসে জীবনকে সালাম করল। ওর চোখে হাসি নেই। জল টলমল করছে। জীবন কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলো। এতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকা এতোসব নারীর মাঝ থেকে ফিরে এসে এখন সে কিছুটা হালকা বোধ করছে।
বর পক্ষের এক আত্মীয়ের বাসা ছিল পাশেই। কিছুক্ষণ পর বরযাত্রী এলো এবং রাত সাড়ে দশটার মধ্যেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো।
বিয়ের পর পেরুলো দিন পনেরো-এর মতো। জীবন যথা নিয়মেই আসছে ছাত্রের বাসায়। পড়া শেষে যথা নিয়মে আজও তাকে বসতে হলো। কিছু না খেয়ে খালি মুখে যাওয়াতে যেন অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। ট্রেতে করে নাস্তা এলো। অন্যান্য দিন নিলু নিজেই নিয়ে আসতো। আজ সে বাসায় নেই, বেড়াতে গিয়েছে তার আত্মীয়ের বাসায়। নাস্তা নিয়ে এলো অপরিচিত একটি মেয়ে। মেয়েটি বিয়ের দিন নিলুর পাশেই ছিল। জীবনের হালকা স্মরণ আসছে সেদিন নিলুর পাশে যারা ছিল তাদের মাঝে এ মেয়েটিও ছিল। তৎক্ষণাৎ আশিক ভেতর থেকে দ্রুত পায়ে এসে বলল, স্যার ইনি আমার কাজিন। সেদিন বিয়েতে আপনাকে দেখেছিল। আমাদের বাসাতে বেড়াবে আরো কয়েক দিন। স্যার, আমি আসি- এই বলে সে আবার দ্রুত পায়ে ভেতরের দিকে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই বাথরুমের দরজা লাগানোর শব্দ শোনা গেল। জীবন বুঝলো বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়েছে বলে ফিরে এসে পরিচয়টা করিয়ে দিয়ে গেল সে।
মেয়েটি জীবনকে সালাম দিল এতোক্ষণ পর। যেন সে বিগত মুহূর্তগুলো বাকশুন্য ছিল। জীবন মাথা নেড়ে সালামের জবাব দিয়ে বলল, বসুন।
টি টেবিলের দু’ পাশে ওরা দু’ জন মুখোমুখি বসলো। মাঝখানে টেবিলের ওপর কি নাস্তা রাখা আছে সেদিকে লক্ষ্য করেনি জীবন। মেয়েটি মাথা নত করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। গায়ের রঙটা উজ্জ্বল নয়, কিন্তু কালোর খাতায়ও তোলা যায় না তাকে। প্রথম দর্শনের মুহূর্তে জীবন লক্ষ্য করেছিল একটি দাঁতের ওপর আরেকটি দাঁত। তবে একেবারে সামনে নয়, সামনে থেকে দু’টি দাঁতের বামে। স্বাস্থ্য ভালো। অঙ্গে যৌবনের উত্তাল ঢেউ। গায়ের রঙটা অনুজ্জ্বল হলেও মন্দ লাগার মতো নয়। তবে চোখ দু’টি খুবই আকর্ষণীয়। জীবনে অনেক নারীর দেখা পেয়েছে জীবন; দেখেছে তাদের জলভরা, জলহীনা নয়ন। কিন্তু মেয়েদের চোখ যে এতো আকর্ষণীয় হতে পারে তা সে এর পূর্বে আর কখনো দেখেনি এবং কল্পনাও করেনি। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে কতগুলো পরিচিত নারীর মুখ ভেসে উঠল, ভেসে উঠল তাদের দু’টি আঁখি। কোনটি সাধারণ, কোনটি রুক্ষ, কোনটি মায়াবী, কোনটি জল ছলছল, কোনটি হাসির ঝিলিক ছড়ানো, কোনটি বেদনার আবার কোনটি রহস্যাবৃত। কিন্তু এ সকলের চাইতে ভিন্ন। জীবন এবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কি?
: অপরূপা। মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে জবাব দিল।
: বাহ্, চমৎকার নামতো! নামের সাথে রয়েছে বাহ্যিক মিলও। মেয়েটি এমনভাবে কিঞ্চিৎ হাসলো যেন জীবন তাকে বিদ্রুপ করেছে।
: জীবন বলল, এমন করে হাসলেন কেন?
: সত্যকে চাপা দিয়েছেন, তাই।
: কেমন করে?
অপরূপা এবার সোজা করল মাথাটা। বলল, আমি কালো। নামটা অবশ্য জন্মের পর পরই রাখা হয়েছিল বলে সবাই তাই বলে ডাকে। ডাকে বলে কি আর নামের সাথে বাহ্যিক মিল আছে? মোটেই না। তাছাড়া …
জীবন অপরূপাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তাছাড়া একটা দাঁতের ওপর আরেকটা দাঁত- এই তো?
অপরূপা কিছুটা লজ্জাবোধ করল। সে মাথা নেড়ে সায় দিল। জীবন বলল, যাকে যেমন করে সৃষ্টি করলে সুন্দর দেখাবে, স্রষ্টা তাকে তেমন করেই সৃষ্টি করেন।
: তবে যে আমরা মানুষে মানুষে সুন্দর-অসুন্দর বলে উভয়ের মাঝে প্রভেদের দেয়াল টানি?
: এখানেই আমাদের যত ছল-ছাতুরী স্রষ্টার সাথে। ফর্সা মানুষকে আমরা বলি সুন্দর আর কালো মানুষকে বলি অসুন্দর। আসলে স্রষ্টা যা সৃষ্টি করেন, তা-ই সুন্দর। তিনি আমাদের সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠান নিষ্পাপ হিসেবে। পরবর্তীতে আমরা হয়ে যাই পাপী। কিন্তু কালো মানুষকে আমরা অসুন্দর বলতে দ্বিধা করি না অথচ দ্বিধা করি পাপী মানুষকে অসুন্দর বলতে। নিজেদের ত্র“টি ঢাকবার জন্য স্রষ্টার সাথে এ আমাদের ছল-ছাতুরী নয় কি? আর আপনিতো সত্যিই অপরূপা। আপনার মাঝে এমন কিছু আছে যা অনেকের মাঝে নেই। আমিতো রীতিমতো দেখছি আপনার মাঝে এমন একটি বিষয় রয়েছে যা আমি অতীতে আর কোন নারীর মাঝে দেখিনি।
অপরূপা খুবই পুলকিত হলো। এই পুলকিত হওয়াটা যতটা তার প্রতি জীবনের ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শনের কারণে, তারচে বেশি হলো জীবনের বিশ্লেষণী ক্ষমতার জন্য। উতাল চোখ দু’টি তুলে সে জীবনের চোখের দিকে তাকাতেই সে দেখে, জীবন তার পাপড়ি মেলা চোখের পাতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। জীবন কিছুটা লজ্জা পায়, লজ্জা বোধ করে অপরূপাও। অপরূপা অপরাধীর ন্যায় বলল, দেখেন আমি কেমন অন্যায়টা করে ফেললাম। আপনার সাথে শুধু কথাই বলে চলেছি অথচ খাওয়ায় যে বিঘœ ঘটিয়ে চলেছি সে কথা একবারেই ভুলে গেছি।
জীবন ট্রে-তে রাখা পিঠাগুলোর দিতে তাকাতেই অবাক হলো। ট্রে-তে আরও রয়েছে কলা, মিষ্টি, চা আর একগ্লাস পানি। শুকনো পিঠাগুলোতে লেখা রয়েছে ‘জীবন’।
লেখাটি পিঠা তৈরীর মূল উপাদানের সাথে লালচে রঙের ব্যবহারে করা হয়েছে। জীবন চোখ তুলে তাকালো অপরূপার দিকে। অপরূপা জীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। জীবন তাকাতেই সে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল। জীবন একটা পিঠা হাতে নিয়ে বলল, বাহ্, বেশ সুন্দর! আপনার সৃষ্টিশীলতার তারিফ না করে পারছি না। কিন্তু কি প্রয়োজন ছিল এতো শ্রম এ কাজে অপচয় করার?
অপরূপা এর কোন জবাব দিল না। শুধু মনে মনে ভাবলো, এ অপচয় নয়। এর মাঝে রয়েছে আমার নিয়ন্ত্রিত আবেগ আর অনেক স্বপ্ন। ‘ও হ্যাঁ, আপনি এখনো নিচ্ছেন না যে?’- ভাবনার জাল ছিঁড়ে বলল অপরূপা।
বেশ সময় গড়ানোর পর জীবন ঘড়ির দিকে তাকালো। একটু বিলম্ব হয়ে গেছে তার। খাওয়া শেষে সে প্রস্থানের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালো। অপরূপাও দাঁড়ালো তার সাথে। কিছু একটা যেন বলতে চায় অপরূপা। বলতে পারছে না। যেন কণ্ঠনালীতে আঁটকে আছে কথাটি। জীবন জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবেন?
অপরূপা মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথা নেড়ে না বোধক জবাব দিল।
দিন যেতে লাগলো এক এক করে। যথা নিয়মে পড়াতে আসে জীবন। দেখা হয়, কথা হয় ওদের দু’ জনের। এরই মধ্যে একদিন কথা-বার্তা শেষে যাওয়ার সময় অপরূপা একগুচ্ছ ফুল এনে জীবনের হাতে দেয়। নিলুর মা বাসায় নেই। বেড়াতে গিয়েছেন গ্রামে। জীবন হাসি মুখে ফুলগুলো গ্রহণ করে ধন্যবাদ জানাতেই অপরূপা একটি ভাঁজ করা সাদা কাগজ জীবনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। জীবন একটু থামে। তার সামনে ভেসে উঠে অপূর্বার মুখ। একটু হেসে সে হাত বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করেই সেটি নেয়। এরপর বেরিয়ে পড়ে জীবন। ফুলগুলো নিয়ে বাসায় এলে জীবনকে তার মায়ের জেরার সম্মুখীন হতে হয়। কে দিয়েছে, কেন দিয়েছে, কতোদিন থেকে পরিচয়, আর কিছু দিয়েছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। জীবন সবই সত্য বলল শুধু সত্যকে আড়াল করল ‘আর কিছু দিয়েছে কি না’- এ প্রশ্নটির ক্ষেত্রে। শুধু জানার জন্য জীবনকে মায়ের এতোসব জিজ্ঞাসা। সন্দেহ বা অন্য কোন কারণে নয়। মা বেশ করেই জানেন জীবন ভেবে-চিন্তেই কাজ করে। আবেগ আর ক্রোধের নিয়ন্ত্রণে সে লাগাম টেনে ধরতে জানে শক্ত হাতে। সমস্যা থেকে উত্তোরণের পথ খুঁজে নিতে পারে জীবন নিজেই। সুতরাং জীবনের ব্যাপারে চিন্তা মানেই অনর্থক চিন্তা।
রাত অনেক হয়েছে। পড়ার টেবিলে জীবন। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। জীবন অপরূপার দেয়া ভাঁজ করা সেই কাগজটি খুলল। তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না তার চোখে মুখে। চিঠিটা খোলার পূর্বে সে যা ধারণা করেছিল তাই নিয়ে লেখা চিঠিটি।
এরপর সময় এলো চিঠির জবাব দেয়ার। এর মাঝে অপরূপা আর জীবনের সম্পর্কের দূরত্ব আরও কমতে থাকে। অপরূপার ইচ্ছায় সে এখন জীবনের কাছ থেকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধিত হচ্ছে। কিন্তু কি দেবে চিঠির জবাব তা ভাবতে গিয়ে অপূর্বা আর অপরূপাকে নিয়ে তার মাঝে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলশ্র“তিতে আর জবাব দেয়া হয়ে উঠে না। চিঠির জবাব না পেয়ে অপরূপা জীবনের সাথে আর দেখা দেয় না। পাঁচ দিন পর নিলু একটা চিঠি এনে দেয় জীবনকে। জীবন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। নিলু বুঝতে পারে। সে বলে, জীবন ভাই, অপরূপা বাড়িতে চলে গেছে। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আপনাদের দু’ জনের ব্যাপার এটা। কি বলতে কি বলে শেষে আপনার আর আমার সম্পর্কের মাঝে দেয়াল তৈরীর সূচনা হলে তা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। ভবিষ্যতেও হওয়ার নয়।
নিলুর কথা শুনে জীবনের চোখ জলে চকচক করে উঠলো। কিছু না বলে জীবন পা বাড়ালো।
জীবনের বাসার অদূরে একটি চায়ের দোকান। এখানে সে প্রয়োজন ছাড়া বসে না। দোকানে এসে বসল সে। পকেট থেকে চিঠিটা বের করে নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলো তাতে। অপরূপা চিঠির এক অংশে লিখেছে, ‘কিন্তু আমার চিঠির উত্তর না পাওয়ার অর্থ যাই হোক, আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো অমৃত্যু।’ চিঠিতে অপরূপার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাও ছিল। চিঠিটা পড়া শেষে জীবন বিষণœ মুখে বেরিয়ে পড়ল দোকান থেকে। দোকানের মালিক শান্ত চাচা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল জীবনের দিকে। তিনি মনে মনে বললেন, ‘জীবনের হলোটা কি? কিছুটা অন্য রকম মনে হলে ওকে!’

চোখে স্বপ্ন আর কর্মব্যস্ততায় সময় কিভাবে এত দ্রুত বয়ে যেতে পারে তা জীবন এই প্রথম উপলব্ধি করল। তার মনে হয় এই তো মাত্র ক’দিন হল সে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। আর এখন তার সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। অপূর্বার সামনেও এখন ফাইনাল পরীক্ষা। এ সময় তাদের দু’জনের কেহই একে অন্যের ব্যাপারে খুব বেশি ভাবা ঠিক নয়; ঠিক নয় তেমন দেখা-সাক্ষাৎও। জীবন ভাবে, এ সময়গুলো দু’ জনের জন্যই মূল্যবান। তাই সে অপূর্বার সাথে সাক্ষাতের পরিমাণ কমিয়ে আনতে লাগলো। এটা যতটা না জীবনের জন্য প্রয়োজন; তার চেয়ে বেশি অপূর্বার জন্য বলে মনে করে সে। তাই সে ফুফুর বাসায় এলেও আলোর মাধ্যমে অপূর্বাকে খোঁজ-খবর দেয়া থেকে বিরত থাকতে লাগল। আলো এতে বেশ করে ভাবতে শুরু করে জীবনকে নিয়ে। সে মনে করে হয়তো কোন কারণে জীবন আর অপূর্বার সম্পর্কে ভাটা পড়তে শুরু করেছে।
আলোর পরীক্ষার আর কয়েক মাস বাকি। বাবা-মা তার জন্য একজন শিক্ষক খুঁজছেন পরীক্ষা-পূর্ব এ কয়েক মাস আলোর পড়া-শোনাটা একটু তদারকি করার জন্য। এজন্য জীবনকে বলা হলে তার সায় পাওয়া যায়। জীবন তার ফুফু-ফুফাকে এ-ও বলে নিয়েছে যে তারও সামনে পরীক্ষা। সে রুটিন মানতে পারবে না। যখন সময় পাবে, তখনই আসবে। সপ্তাহে চার দিন, তিন দিন, দু’ দিন এমনকি এক দিনও হতে পারে। ফুফা বললেন, সেটা তোমার ইচ্ছা। ফাইনাল পরীক্ষা ওর। সেটা ভেবে তুমি আসবে।
জীবনের ওপর যেন দায়িত্বটা বেড়ে গেল। সে অনুযায়ী জীবন আসছে আলোদের বাসায়। জীবনের টিউশনির টাকা থেকে বাবা-মাকে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মাঝে মাঝে এটা-সেটা কিনে নেয় বাসায়। নিজে খরচ করে প্রয়োজন অনুযায়ী। বাদ বাকিটা ফেলে রাখে ব্যাংকে।
আজ সন্ধ্যার পর আলোদের বাসায় এসেছে জীবন। বিকেলে একটা আলোচনা সভায় গিয়েছিল বলেই সন্ধ্যার পর হওয়া। এটি ছিল রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যের ওপর তুলনামূলক আলোচনা। তার ভার্সিটির বন্ধুরা ছিল এটির আয়োজক। প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে বন্ধুরা তার সহযোগিতা চাইলে জীবন বন্ধুদেরকে সহযোগিতা করে। এটি তার এক বন্ধুর নামে লিখা ও পঠিত হয়। প্রবন্ধটি প্রশংসিত হওয়ায় জীবনের কাছে ভালো লাগে। অনুষ্ঠান শেষে বন্ধুরা তাকে ধন্যবাদ জানায়। জীবন বলে, “এতে ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই। আয়োজনে ব্যস্ত ছিলি বলে তোরা আমার সাহায্য চেয়েছিস। নইলে শামীম নিজেই তো খুব ভালো প্রবন্ধ লিখতে পারে।’’ জীবনের এমন মনোভাবের কারণে বন্ধুরা তাকে বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। জীবন বরাবরই এমন। তাই মাঝে মাঝে তার বন্ধুরা মন্তব্য করে “বড় মনের মানুষ না হলে কারো কাছ থেকে এমন কিছু আশা করাটা কল্পনাতীত।’’
জীবন সামনের রুমটায় শুয়ে আছে। তার বুকের ওপর একটা বই, তাতে চোখ বুলাচ্ছে সে। দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির ঘন্টার কাঁটাটি দশের ঘর অতিক্রম  করেছে পূর্বেই। ভোজন পর্বটা সেরেছে অনেক আগে। জীবন আলোকে বলল, রাত অনেক না হলেও আমি ঘুমাবো আলো। আমার বড্ড ক্লান্তি লাগছে আজ। আলোটা নিভিয়ে দিয়ে তুই নিজের রুমে গিয়ে পড়। আলো শোনলো শুধু, জবাব দেয়নি কোনো।
টেবিলের একপাশ থেকে টেবিল ফ্যানের বাতাস তার মুখের ওপর ঝাপটা দিয়ে তার পর গিয়ে পড়ে জীবনের গায়ে। একটু পরে আলোর কবরীটি খুলে পড়ে। ফ্যানের নরম বাতাসে কেশগুলো তার পিঠের ওপর আষাঢ়ের দূরন্ত আকাশ-আঁচলের ন্যায় উড়তে লাগল। পার্থক্য কিছুটা রয়েছে বৈকি। আষাঢ়ের আকাশ-আঁচল বন্ধনহীন, আর এখানে তা নয়; এই যা। চুলের সাথে যেন উড়ছে আলোর মনটাও। কল্পনার জাল ছড়িয়ে দেয় সে দূর, বহু দূর। ভাবে সে “আমার নৃত্যরত কেশগুলোও কি তার কাছে কোন বার্তা বইয়ে দিচ্ছে না? সে কি বোঝে না আমি বুকের ভেতর একটা স্বপ্ন-পাহাড় বইছি?’’
জীবন বইটি বন্ধ করে আলোর দিকে তাকালো। দেখল ওর দীঘল কালো চুলগুলো উড়ছে বাতাসে। মালিকের চেষ্টায় যে পূর্ণ অবহেলা সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণের, তাতে সন্দেহের অবকাশ না থাকারই কথা জীবনের। কিন্তু সে বলে, আলো, চুলগুলো বেঁধে নাও। পুরুষ মানুষের নজর লাগলে ঝরতে শুরু করবে যে।
আলো পেছনে হাত ঘুরিয়ে দূরন্ত কেশগুলোকে শাসানোর চেষ্টা করে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় যে তার অবহেলা রয়েছে, তা আবারো ধরা পড়ে জীবনের চোখে। জীবন বলে, আলো এদিকে তাকাও।
আলো ক্ষণিক বিলম্বে মাথা ঘুরিয়ে চোখ তুলে তাকায় জীবনের দিকে। ওর চোখ দু’টি ভিজে আছে পানিতে। কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়েছে, তার চিহ্নও রয়েছে দুই কপোলে। জীবন বুঝলো, ও এতোক্ষণ পড়েনি, পাঠকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল মাত্র। আর বাস্তবটা হলো চোখের পানি, যা সে আড়াল করে রেখেছিল এতোক্ষণ।
জীবন জিজ্ঞেস করে, তোর কি হয়েছে শুনি?
আলোর কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সে নিজেই বলে, টেবিল ফ্যান এতো নিকটে রেখে বসতে নেই। এতে বাতাসটা বেশ করে চোখে লাগে। আয়নায় গিয়ে দেখ অশ্র“ গড়িয়ে চোখ ফুলে চোখের দশা হয়েছে কি! যা, এক মূহুর্তও নয় আর এখানে। হাত-মুখ ধুয়ে ঘুমিয়ে পড়।
আলো উঠে দাঁড়ায়। যে কথা বলবে ভেবেছিল জীবনকে, সে কথা বলবার মতো সাহস খুঁজে পায়নি সে। নীরবে সে এলো চুলে বেরিয়ে গেল।
একঝাঁক কষ্টের পায়রার দাপাদাপি বুকে নিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো আলো। মুখটা ধুয়ে নেয়া কিংবা মশারি খাটানো কোনটারই বিন্দুমাত্র প্রয়োজন অনুভূত হয়নি তার কাছে। সারারাত মিলাতে পারেনি চোখের দু’টি পাতা। নীরবে অশ্র“ গড়িয়েছে শুধু। আর নোনা জলে তৃষ্ণা মিটিয়েছে তৃষ্ণার্ত শিমুল তুলা।
সকাল সাতটা। সোনালী নরোম রোদ্দুর ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে রুক্ষতায়। জীবন নাস্তা খাওয়া শেষে প্রস্তুত হলো ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আলোর চোখ দু’টো ঘুমে ঢুলু ঢুলু। শব্দহীন পায়ে জীবনের কক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে ধাক্কা খেল সে নিজের কাছেই। জীবনও লজ্জিত হল কিছুটা। একটু পর সে আবার গলা খাকরি দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। জীবন হাত ঘড়িটা পরতে পরতে বলল, আলোর মাঝে অন্ধকার, এ কেমন ব্যাপার!
: কেমন অন্ধকার?
: অন্ধকার কেমন হয় জান না? আয়নার সামনে গিয়ে দেখ প্রতিবিম্ব কি বলে। মুখটা এতো মলিন কেন?
আলো কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর জবাব দেয়, অন্ধকারতো আলোর পাশেই থাকে। জ্বলন্ত প্রদীপের নিচে লক্ষ্য করাটাই তার প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
জীবন জুতা পরছিল। ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বলল, আজ ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরবো। এখানে আসা হবে না।
: বাসায় কি খুব প্রয়োজন?
: খুব নয়, মোটামুটি।
: আজ ক্যাম্পাস থেকে এখানে আসা যায় না? সন্ধ্যার পর না হয় বাসায় ফিরবেন।
: তা যায়। মনে হচ্ছে প্রয়োজনটা অন্য?
আলো নীরবতা অবলম্বন করে। জীবন বলল, ঠিক আছে তাই হবে। আমি এসে লাঞ্চ করবো।
আলো শুধু মাথা নাড়ালো। তারপর কোন কথা না বলেই পা বাড়াল। জীবনও বেরিয়ে পড়ল ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে।
একটা থেকে দু’টা এ সময়টাকেই মূলত লাঞ্চ আওয়ার ধরা হয়। কিন্তু দু’টা পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা যখন আড়াইটার ঘরে গিয়ে পৌঁছলো তখনো এলো না জীবন। আলোও লাঞ্চ করেনি এখনো; জীবনসহ একত্রে করবে এই প্রত্যাশায়। মিনিট দশেক পরেই এসে পড়ল জীবন। একত্রে লাঞ্চ সারলো দু’ জনে।
জীবন লাঞ্চ করার পর ড্রইং রুমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য ঘুমানো নয়, বিশ্রাম নেয়া। একটু পরে আলো আসতেই সে উঠে বসল। আলোও বসল সোফায়। বলল, একটু ঘুরতে বেরুতে চেয়েছিলাম।
: কোথায়? আর ঘুরতে বেরুবার এতো প্রয়োজনই বা পড়ল কেন?
আলো একটু রুক্ষ স্বরেই বলল, কেন কলেজ আর বাসা এর বাইরে কোথাও কি যেতে মানা?
জীবন মৃদু হাসল। বলল, তা হবে কেন। কোথায় যাবে বলো?
: প্রকৃতির কাছে; তা যেখানেই হোক।
: তবুও।
: ধানমন্ডি লেকের ধারে সবুজের স্নিগ্ধ ছায়াতলে।
: সেখানে গেলেতো পুরোপুরি প্রকৃতির কাছে যাওয়া হবে না। কৃত্রিমতার ছোঁয়া সেখানে স্পষ্ট।
: কৃত্রিমতার ছোঁয়া ছাড়া প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখা কি সম্ভব?
জীবন এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে বলল, বাহ্ বেশ চমৎকার কথা বলেছিস তো। তাহলে ফুফুর কাছে বলে নে।
: আপনি ভেবেছেন মায়ের কাছে না বলেই আমি আপনাকে বলেছি?
: ঠিক আছে। কখন বেরুতে চাস?
: দশ মিনিটের মধ্যেই।
: তৈরি হয়ে নে। আমিও হচ্ছি।
লেকের ধারে হাঁটছে দু’ জনে। কথা হচ্ছে, হচ্ছে সশব্দে হাসিও। আলোর মুখে হাসি থাকলেও বুকের ভেতরটায় ধড়পড় করছে। বলতে গিয়ে বলা হয়ে ওঠেনি এতক্ষণেও মনের কথাটি। কিন্তু চোখে তার আবেগের প্রকাশ। হাঁটতে হাঁটতে সময় পার করছিল ওরা রৌদ্রজ্জ্বল দিনে গাছের ছায়া, পাখির ডাকাডাকি আর কখনো কখনো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা রৌদ্র-চুম্বনের মধ্য দিয়ে। হঠাৎ আবহাওয়ায় পরিবর্তন দেখা গেল। কিছুক্ষণ পূর্বের সতেজ সূর্যটাকে গিলে ফেলল একখন্ড মেঘ। বৃষ্টিও পড়তে শুরু করল ছোট ছোট ফোঁটায়। জীবন আর আলো একটি ছাতার নিচে এসে বসল। ইট-পাথরের তৈরী এ ছাতাটি বহনযোগ্য ছাতার তুলনায় অনেক বড় হলেও অধিক উচ্চতা সম্পন্ন বলে বাতাসে বৃষ্টির ছিঁটে ফোঁটা এসে গায়ে লাগে। জীবন আলোর গা ঘেঁষে বসে। আলো আশেপাশে তাকায়। যা দু’ একজন লোক কিছুক্ষণ পূর্বে দেখা গিয়েছিল, তারাও এখন নেই। পুরো জনমানব শূন্য পরিবেশ। আলো জীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, সূর্যের আলোটা কত অল্প সময়েই না হজম করে ফেলল একখন্ড মেঘ।
: একটু বাদেই তা কেটে যাবে। সূর্যের ওপরের ওই বৃহৎ মেঘ খন্ডটি ছাড়া আর বড় কোন মেঘের আনাগোনা নেই আকাশে। কিন্তু আলো, তোমার মুখের আলোটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে দেখছি। সকালে কেমন মলিন ছিল মুখটি আর এখন চাঁদের মতো।
: সকালে যে সূর্যের আলো ছিল, আর এখন যে সামান্য অন্ধকার পরিবেশ তাই এমন মনে হচ্ছে হয়তো। সূর্যের আলো ওঠলে আবার পরিবেশের মলিনতা দূর হয়ে তা এই মুখটাকে ছেয়ে নেয় কি না কে জানে।
জীবন চুপ হয়ে রইল। কথা শেষে আলোও চুপ থাকে কিছুক্ষণ। যে কথাটি বলার জন্য জীবনকে এখানে নিয়ে আসা, যা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ নিস্তেজ হয়ে আসে অজানা ভয় আর লজ্জায়, বুকের ভেতরটা ফেটে হয় চৌচির, এবার সেই কথাটি বলতে চায় আলো। জীবনের দিকে চোখ তুলে বলে, জীবন ভাই…।
না বলে থেমে গেল আলো। জীবনের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নেয় সে। জীবন বলল, কি বলতে গিয়ে থামলে বলো?
আলো কিছুই বলে না। বুকের ভেতর ধ্বক্ ধ্বক্ শব্দটা কেবলই বেড়ে চলছে। জীবন বলল, কিছুই বলছিস না যে?
আলো তবুও নীরব থাকে। কয়েক মিনিট কেটে যায় এভাবে। সূর্যের ওপর থেকে ততক্ষণে মেঘের খন্ডটি সরে গেছে। রোদ্র এসে পড়ছে সবুজ পাতার ওপর। বিকেলের রোদ বলে তাতে রয়েছে মিষ্টি ছোঁয়া। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাওয়া সবুজ ঘাসগুলোর ওপর সেই আলো পতিত হয়ে একটা দারুণ পরিবেশ সৃষ্টি হল। ভেজা পালক নিয়ে পাখিরা গাছের পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে এ ডাল থেকে ও ডালে উড়া-উড়ি করছে। আলো জীবনের দিকে চোখ তুলে তাকায়। জীবন পায়ের ওপর পা তুলে লেকের স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
আলো বেশ আবেগ প্রবণ হয়ে ওঠে। মনস্থির করে সকল ভয় আর লজ্জা উপেক্ষা করে সে প্রকাশ করবে মনের না বলা কথাটি। ডান হাতটি বাড়িয়ে দেয় সে জীবনের বাম বাহুর দিকে। জীবন লেকের ওপর থেকে চোখ দু’টি সরিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো সংযত করে নেয় নিজের হাতকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্পর্শ না করেও লজ্জা তার চোখ দু’টিকে এমন করে ঘিরে ধরেছে যে খুলতেও লজ্জা হচ্ছিল তার।
জীবন বলল, চল বাসায় ফেরা যাক।
আলো কিছুই বলল না, মাথা নেড়েও কোন সায় দেয়নি সে। শুধু উঠে দাঁড়াল আর জীবন যখন পথ চলতে লাগলো, তখন সে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করল।
সন্ধ্যার পূর্বক্ষণেই দু’ জন বাসায় পৌঁছল। জীবন দেরি না করেই আবার বেরিয়ে পড়ল নিজ বাসার উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যা হল ঘন্টাখানেক পূর্বেই। মনটা খুব খারাপ আলোর। তাই বারান্দায় বসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছে সে এ সময়টুকু। এইমাত্র পড়ার টেবিলে এসে বসল সে। দেখল, টেবিলের বামপাশে সাজিয়ে রাখা বইগুলোর ওপর চিঠির মত একটি সাদা কাগজ ভাঁজ করা। হাত বাড়িয়ে সেটি নিল সে। আলোর মলিন মুখমন্ডলে নেমে এলো অমানিশা। চিঠিটা পড়তে লাগল সে মনে মনে। চিঠিটা অসমাপ্ত থাকা অবস্থায় তার প্রচন্ড ক্ষোভ হয় লিখিয়ের ওপর। চিঠিখানা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সে তা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে বাইরের দিকে। জানালার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে সে তাকিয়ে দেখে এতক্ষণে আকাশে চাঁদ উঠল। অনমনা হয়ে সে চেয়ে থাকে চাঁদের শরীরে। দু’ ফোটা অশ্র“ গড়িয়ে আসতে থাকে তার দু’ গালের দিকে।

জীবনের অনার্স ফাইনাল হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হলো; হলো আলোর পরীক্ষাও। দিন কুড়ি হল আলো জীবনকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল অপূর্বাদের বাসায়। হঠাৎ গিয়েছিল তারা; না জানিয়েই। আলো বলেছিল বেড়াতে বেরুবে। কিন্তু কোথায় তা বলতে না বলতেই জীবন বলল, তাহলে চল, অপূর্বাদের বাসায় ঘুরে আসি। কি বলিস?
আলো মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। ক্ষণিকের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল দু’ জনে।
পড়ন্ত বিকেল। দুই দালানের মাঝ দিয়ে বিকেলের রোদ্দুর একটি বিশালাকার কড়ই গাছের পাতার ফাঁক গলে গলে যে স্থানটিতে এসে পড়ল, সে স্থানে এসে থামলো রিক্সাটি। বেশ লাগছিল পতিত আলোর টুকরোগুলো। আলো বেশ কয়েকবার এসেছিল এখানে। রিক্সার ভাড়া চুকিয়ে দেয়ার পর আলো দক্ষিণের পাঁচতলা দালানটিতে প্রবেশ করল। জীবন অনুসরণ করছিল তাকে। স্ব-বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ তার। অতি শান্ত, নমনীয় সে। কিন্তু চোখ দু’টি তার যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় যা কিছুর দিকে সে তাকায়, তার  অধিকাংশকেই। আলো কলিংবেল টিপতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। দরজাটা পুরোপুরি না খুলতেই অপূর্বার মুখটি স্থির হয়ে দেখা দিল জীবন আর আলোর সম্মুখে। নড়চড় নেই, একেবারে পাথুরে মূর্তি যেন। অপূর্বা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। কি এক অজানা কারণে তার বুকের ভেতর হার্ট-বীটটা বেড়েছে বলে প্রচন্ডভাবে অনুভূত হচ্ছে তার। আলো আরেকটু সামনে এগিয়ে অপূর্বার কাধে হাত দিয়ে বলল, “অবিশ্বাস্য মনে হলেও তা নয়। সামনে দাঁড়ানো উনি জীবন ভাই…।’’- বলতে বলতে সবাই সামনে পা বাড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।
কথা হচ্ছিলো তিন জনে। এরই মধ্যে এলো এলিনা। সে অপূর্বাদের প্রতিবেশী। থাকে পাশের ফ্ল্যাটে। আলো অপূর্বাদের বাসায় আসা-যাওয়ার সুবাদে তার সাথে এলিনার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে সম্পর্কটা গড়িয়ে এখন বন্ধুত্বে। তাদের সম্পর্কে বোঝা যায় না এলিনা আলো আর অপূর্বার প্রায় দু’ বছরের বড়। এলিনা এসে ক্ষণিক বসলো। এরপর কথা বলতে বলতে আলো আর এলিনা বেরিয়ে গেল এলিনাদের বাসার দিকে। তাদের প্রস্থানের পর যেন জীবন আর অপূর্বা কথার খেই হারিয়ে ফেলল। নিঃশব্দ কক্ষে তখনি প্রবেশ করল অপূর্বার মা। জীবন দাঁড়িয়ে সালাম দিয়েই জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
অপূর্বার মা জবাব না দিতেই অপূর্বা জীবনকে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয় পেয়ে তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ ভালো। তুমি কেমন আছ?
: জ্বী, বেশ ভালো। – জীবন শান্ত স্বরে বলল।
অপূর্বার মা বসল। বসল জীবনও। মিনিট দু’য়েক কথা বলে উঠলেন তিনি। অপূর্বাকে বললেন, ভেতরে এসো।
অপূর্বার মুখটায় হঠাৎ যেন অন্ধকার নেমে এলো। অপরাধীর ন্যায় মায়ের পেছন পেছন অগ্রসর হলো সে। একবার পেছন ফিরে তাকাতে চেয়েছিল। কিন্তু চেয়েও তা পারেনি। নিজের কাছেই হেরে গেল সে।
জীবন একা বসে আছে। চোখ বুলাচ্ছে সে পুরোটা কক্ষের মধ্যে। কক্ষে অনেকটা প্রাকৃতিক পরিবেশ বিরাজ করছে। কয়েকটি ফুলের টব আর প্রতিটি জানালার গ্রীল পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে সবুজ মানি প্লান্ট। স্বাস্থ্যকর শীতল পরিবেশ ঘরটির মধ্যে বিরাজমান। পশ্চিমের জানালা দিয়ে মানি প্ল্যান্টের পাতাগুলো কাঁপিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে মৃদু বাতাস। জীবন কিছুক্ষণ পরিবেশটা উপভোগ করল হৃদয়ের চোখ দিয়ে। এরপর আবার সেই নিঃশব্দে একাকী বসে থাকা।
একটু পরেই এলো অপূর্বা। কিছুক্ষণ পূর্বে মুখের ওপরে চেপে বসা কালচে মেখ খন্ডটি এখন আর নেই। বাতাস যেন উড়িয়ে নিয়েছে তা কোন এক অজানা গন্তব্যে। তার হাতে একটা বড় ট্রে। তাতে রয়েছে আপ্যায়নের উপাদান। ট্রে-খানা টেবিলের ওপর রেখে আবার বসল অপূর্বা। বলল, যখন মা এলেন, ততক্ষণেও আপনার পরিচয়টা তাকে জানিয়ে আসিনি বলে আমাকে হালকা বকেছেন।
: আপনার মা বকতে পারেন বলে তো আমার মনে হয় না।
: বকা বলতে-“শুধু ডাঙ্গর হচ্ছিস, বুদ্ধি-শুদ্ধিতো কিছুই হলো না’’- এই যা।
: সেই ডাঙ্গর মেয়েটা যার সামনে বসে আছে তার সম্পর্কে নিশ্চয়ই তার প্রাপ্য বিরূপ মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি।
: মন্তব্য করেছেন তো বটেই। তবে বিরূপ কি না জানি না। তা হলো, “ছেলেটা সামাজিক। করে কি ও?’’ আমি বললাম, ভার্সিটিতে পড়ে। মনে হলো মা তেমন খুশি হতে পারেন নি।
জীবন হাসল। বলল, কি বললে খুশি হতেন?
: হয়তো যদি বলতাম, সবেমাত্র ভার্সিটি শেষ করেছে।
কথাটি বলার পর অপূর্বার চোখ দু’টি যেন লজ্জায় কিছুটা ভারী হয়ে উঠল। জীবন প্রসঙ্গ পাল্টাল। বলল, “দেখলেন, আলো এখনো এলো না। যাওয়ার সময়টা হয়ে এলো।’’
: আসুক না, বিলম্বে ফিরলে অসুবিধাতো নেই। নাকি?
: তা নেই।
: ও আসুক। আপনি আমাদের বাসাটা ঘুরে দেখুন।
জীবন বলল, না তার দরকার কি? তাছাড়া আমিতো শুধু আপনারই পরিচিত- সবারতো নয়। কে কি ভেবে বসে কে জানে।
: আমাদের বাসায় অতসব ভাববার মতো কেউ নেই। বাবা-মা, আমি আর ছোট ভাই। বড় দুই ভাই থাকেন দেশের বাইরে। বড় বোন স্বামীর বাড়ি। আর এ মুহূর্তে শুধু আমি, আপনি, মা আর কাজের মেয়ে।
জীবন সরাসরি না করতে পারছে না। এটি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধ। তবে এর পেছনে রয়েছে অপূর্বার অব্যক্ত উদ্দেশ্য। তবুও সে বলল, “কিন্তু …।
অপূর্বা জীবনকে আর বলতে না দিয়ে বলল, বলেছিতো কোন সমস্যা নেই। যাকে অন্তরে বয়ে চলেছি সর্বক্ষণ তাকে অন্দরে নিলে কোন সমস্যা যদি হয়ও তা ম্যানেজ করার ক্ষমতা কি একেবারেই নেই?
কথাটা বলার পর অপূর্বা থমকে গেল নিজে নিজেই। ভাবলো, কথাটা এভাবে বলা বোধ হয় ঠিক হয়নি। কিভাবে যে বলে ফেললাম! আবার নিজেকে নিজেই বুঝালো, মিথ্যে বলা যদি অন্যায় হয়, তাহলে সত্য গোপন করাও মিথ্যার সামিল এবং তাও অন্যায়।
জীবন উঠে দাঁড়ালো। অপূর্বার চোখে চোখ রেখে স্থির ছিল কিছুটা সময়। অপূর্বার চোখ দু’টি যেন লাজের ভারে নুয়ে আসছে। জীবনের চোখ থেকে নিজের চোখ দু’টি নামিয়ে সে সামনের দিকে পা বাড়ালো। সঙ্গে পা বাড়ালো জীবনও। ড্রইং রুমটির মতো ভেতরের রুমগুলোও বেশ গুছানো। দেয়ালের গায়ে ঝুলানো রয়েছে কুটির শিল্পের নানান জিনিস। বারান্দায় রয়েছে ঝুলন্ত বেশ কয়েকটি ফুলের টব। টবগুলোতে ফুল ফুটে আছে। হাল্কা ঘ্রাণও নাকে এসে লাগে। দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে আসে। সবশেষে অপূর্বা এসে প্রবেশ করল তার কক্ষে। সামনে এগিয়ে এক পায়ের উপর আরেক পা ঝুলিয়ে খাটের উপর বসল সে। এরপর বসল জীবনও। বসার পর জীবনের চোখে পড়ল সামনের টেবিলটির ওপর। এটি অপূর্বার পড়ার টেবিল। চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে হকচকিয়ে ওঠল। খাট থেকে নেমে সামনে এগুলো সে। জীবনকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারাটা ঘর দেখানোর অপূর্বার মূল উদ্দেশ্য ছিল মূলতঃ এটি। অপূর্বাও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। জীবন দেখলো টেবিলের কিছু ওপরে দেয়ালের গায়ে লাগানো রয়েছে সেদিনের ‘বৈশাখ’কে নিয়ে লেখা পংক্তিগুলো। কম্পিউটারে কম্পোজ করা। যে লিখেছে তার নাম নেই। পাশে রয়েছে দু’টি রজনীগন্ধার স্টিক দাঁড় করানো। নিচে পড়ে আছে তিন চারটি শুকনো গোলাপ। জীবন জিঙ্গাসু ভঙ্গিতে অপূর্বার দিকে তাকাতেই সে বলল, “স্বপ্নকে লালন করা কি অপরাধ?’’
জীবন বলল, তা নয়। কিন্তু পংক্তিগুলোর সারার্থানুযায়ী সেখানেতো গাঁথা আছে অন্য কারো স্বপ্ন।
অপূর্বা জীবনের খুবই নিকটে এসে দাঁড়ালো। বলল, সে স্বপ্নে কি কোন নারী জড়িত নেই? আর সেই নারী কি এ মুহুর্তে আপনা হতে অতি দূরে?
জীবন এ কথার কোন জবাব সরাসরি দেয়ার চেষ্টা করলো না। একটু ভাল করে তাকাতেই সে লক্ষ্য করল তার হাফ শার্ট পরা নগ্ন বাহুটিকে স্পর্শ করে আছে আরেকটি নগ্ন বাহু। অপূর্বা তার নরোম বাহুটি সরিয়ে নিয়ে কিছুটা দূরে সরে এক পলক জীবনের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার ফিরিয়ে নেয় দৃষ্টি। কিছুটা সময় নিঃশব্দে কাটায় দু’ জনে। এরপর নীরবতা ভেঙ্গে জীবন বলল, আপনি সেদিন কি বলেছিলেন স্বরণ আছে? অপূর্বা ফিসফিস শব্দে বলল, কি বলেছিলাম?
: বলেছিলেন আমাদের সম্পর্কটা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে আনা যায় কি না।
: আর আপনি তো বলেছিলেন অন্য দিনের কথা।
: সেই দিনটি যদি হয় আজ?
অপূর্বা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠল। তার চোখ-মুখ জুড়ে খেলে যাচ্ছে লজ্জার উত্তাল ঢেউ। তবুও যেন বাঁধ ভাঙ্গা আবেগ কোন বাধা মানতে চায় না। সে দূরত্ব কমিয়ে জীবনের অতি নিকটে এসে দাঁড়ায়। জীবন অপূর্বার হাত দু’টি নিজ হাতে তুলে নিয়ে চুম্বন এঁটে দিয়ে বলে, তোমার কোমল দু’টি হাত স্বর্গ হতে তৈরী যেন।
এরপর অপূর্বা চোখের ইশারায় জীবনকে বলল তার উন্নত শিরটি অবনত করতে। জীবন মস্তক অবনত করতেই অপূর্বা এঁটে দেয় দু’টি চুম্বন; কপোল ও কপালে। এরপর সে বলল, একই স্বর্গে হবে বাস তোমার আর আমার।
বেশ কিছুট সময় গড়িয়ে গেল দু’ জনের কথোপকথনে। এরপর তারা এসে বসল ড্রইং রুমের পূর্বস্থানে। ক্ষণিক পরেই কলিং বেল বাজল। আলো এসেছে। সঙ্গে এলিনাও। একত্রে বসল সবাই। কথা বলতে বলতে আপ্যায়ন গ্রহণ করছিল তারা। আলো অপূর্বার বেশ কিছুটা দূরে বসেছিল। এবার সে উঠে এসে বসল অপূর্বার গা ঘেঁষে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে অপূর্বাকে ফিসফিস করে কি যেন বলল, তা জীবন আর এলিনা দু’ জনের কেউ বুঝল না। একটু পরেই দু’ জন উঠে ভেতরের রুমের দিকে গেল। জীবন আর এলিনা দু’ জন বসে কথা বলছিল।
অপূর্বার রুমে গিয়ে দাঁড়াল দু’ জনে। যে কথা আলো এতোটা দিন বলতে চেয়েছিল জীবনকে, বলতে গিয়ে গলায় বেধে গিয়েছিল বারবার, আজ সে কথা সে বলতে চায় জীবনকে, অপরের কণ্ঠে। কিন্তু একথা বলতে তার মতো অপূর্বার গন্ডদেশেও যে পড়তে পারে বাধা তা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে আলো। তবুও সে অপূর্বাকে বলবে বলে ঠিক করে। এ শুধু যে জীবনকে বলার জন্য তা নয়, জীবন আর অপূর্বা উভয়ের সম্পর্কের এক পাশ হতে শেকল দিয়ে টেনে ধরাও আরেকটি উদ্দেশ্য। অপূর্বাকে বলতে গিয়ে থেমে যায় সে, যখন তার দৃষ্টি পড়ে টেবিলের ওপরের দিকে দেয়ালে সাঁটা জীবনের সেদিনের সেই পংক্তিগুলো ওপর। তদুপরি তার পাশে রয়েছে ঘ্রাণ ছড়ানো ফুল।
অপূর্বা বলল, ওটা জীবন ভাইয়ের সেদিনের লেখা পংক্তিগুলো। তুই কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলি বল।
আলোর বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কষ্ট এসে চেপে ধরে তার কণ্ঠ। চোখ থেকে বেরুতে চায় অশ্র“। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়। গলায় কিছুটা ব্যথা অনুভব করে সে। মুখে একটু কৃত্রিম হাসি এনে আলো বলল, অনেক কথা। বাসায় আসবি। এখন আসলে সময় নেই। তখন সব খুলে বলবো।
অপূর্বা লক্ষ্য করল আলোর কথাগুলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা, অস্বাভাবিক। আলোর কথায়  সে মাথা নেড়ে সায় দিল। এরপর আলোর কাঁধে হাত বাড়াল অপূর্বা। আলোর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, চলি, সময় করে বাসায় আসবি।
অপূর্বার কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে মনে হলো না। সে আলোর পেছন পেছন অগ্রসর হল। ওরা দু’ জন সামনের রুমে আসতেই জীবন দাঁড়িয়ে বলল, অপূর্বা, আজ তাহলে উঠবো।
এরপর চোখে ইশারা করতেই অপূর্বা বলল, মা’র হাই প্রেশার আছে। মাথা ঘোরাচ্ছে তাই শুয়ে আছেন।
ক্ষণিকের মধ্যে দু’ জনের চোখে চোখে হয়ে গেল কিছু কথা। ফলে মুখ খুলে আর বিদায় নিতে হলো না। বেরিয়ে পড়ল আলো আর জীবন। দশ-বারো পা সামনে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দৃষ্টি ফিরায় জীবন। দেখে, অপূর্বা আর এলিনা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্বা স্মিত হাসি হেসে হাত নাড়ালো। জীবন মৃদু হাসি হেসে এর জবাব দিয়ে এগুতে লাগল। তাদের এ বিদায়ী মুহুর্তটা আলো প্রত্যক্ষ করল গভীরভাবে। তাই বুকের ভেতর কষ্টের তীরটাও বিধেছে ভালো করে। রিক্সায় শুধু পাথরের মতো বসেছিল গন্ত্যব্যে পৌঁছার অপেক্ষায়। এক সময় জীবন জিজ্ঞেস করল, এমন চুপচাপ বসে আছিস কেন?
আলো কোন কথা বলে না। জীবন বলল, আমার একটা আনন্দের সংবাদ দেবো তোকে। তুই শুনলে হয়তো বিশ্বাসই করবি না প্রথমে। পরে অবশ্য…।
আলোর চোখের দিকে তাকাতেই জীবন থেমে গেল। যেন হিমালয় গলে তার নহর বইছে আলোর চোখ দিয়ে। শত চেষ্টা করেও আলো নিজেকে সংবরণ করতে পারেনি। জীবন তাকাতেই সে ওড়নার আচলে মুখ লুকালো। কিন্তু অশ্র“ধারা রোধ করতে পারলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই ভিজে ওঠে ওড়নার আঁচলও। আলোকে কিছুটা টলতে দেখে জীবন রিক্সার হুডটা তুলে নিল। এরপর আলোকে আগলে নিল বুকের কাছে। আলোর চোখের অশ্র“ প্রবাহ যেন ক্রমেই বেড়ে উঠছে। জীবন কারণ জানতে চায়। আলোর মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না; নির্বাক সে। এক সময় সে জলভরা দু’টি চোখ তুলে তাকায় জীবনের মুখের দিকে। কী করুণ অসহায় চোখ দু’টি তার! দেখে খারাপ লাগে জীবনের। জীবন পকেট থেকে রুমাল বের করে আলোর চোখ মুছে দিচ্ছে। আলো মুছতে না দিয়ে জীবনের হাতটি দু’ হাতে জড়িয়ে নেয়।
আজকের দিনটা বেশ চমৎকার। আবেগ যেন ছড়িয়ে আছে সারা প্রকৃতিতে। শান্ত নরোম রোদ আর মৃদু বায়ু প্রবাহ এই বিকেলটাকে যেমনি আবেগময় করে তুলেছে, তেমনি আবেগময় করে তুলেছে আলোর মনটাও। বারান্দায় একটি মোড়ার উপর বসে সে বই পড়ছে আর অবলোকন করছে প্রকৃতিকে। অপূর্বা আসার কথা আজ। অথচ তার আসার এখনো কোন নাম-গন্ধ নেই। একটু পর পর সামনের রুমের দরজা খুলে হেঁটে আসে আলো। তারপর আবার এসে বসে বারান্দায়। কোমল বাতাস এসে তাকে ছুঁয়ে যায় নিরবচ্ছিন্নভাবে আর খোলা চুলগুলোকে দিয়ে যায় মৃদু নাড়ন। সে হারিয়ে যায় দিন কুড়ি আগের সেই স্মৃতিতে যে স্মৃতি আজ পর্যন্ত তার কাছে অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া স্মৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। তার স্বপ্নে লালিত প্রিয় মানুষটিকে স্পর্শ করার স্মৃতি, প্রিয় মানুষটি তাকে বুকে আগলে নেয়ার স্মৃতি। ভাবতেই একটা শিহরণ জেগে ওঠে তার রক্ত কণিকায়। স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে এক সময় সে হারিয়ে যায় স্বপ্নের সীমাহীন সমুদ্রে। ঠিক এ সময় ডাক পড়ে ‘আলেয়া’, ‘আলেয়া’ বলে।
আলোর মূল নামটা আলেয়া। কিন্তু সবাই তাকে ডাকে আলো বলে শুধু মা আর বাবা ছাড়া। আলো উঠে যায় মা’র কাছে। মা বললেন, কে যেন এসেছে, দরজাটা খুলে দে।
আলো এগিয়ে গিয়ে দরজাটি খুলে দেয়। দেখে অপূর্বা এসেছে। ভেতরে আসে ওরা। আলোর রুমে বসে কথা বলছে তারা। এ কথা, ও কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। মূল কথায় নয়। বান্ধবী হিসেবে ওরা দু’জন একেবারে পারফেক্ট। একে অপরের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে অতীতে। ভবিষ্যতের কথা বাদ দিলে ওদের মতো বান্ধবী পাওয়া পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।
বেশ কিছু সময় ধরে আলো চুপচাপ বসে থাকে। বুকের ভেতর বহু বছরের লালিত স্বপ্নের কথা এই প্রথম সে মন খুলে কাউকে জানাচ্ছে। অপূর্বাও চুপচাপ। সে বসে আছে আলোর মুখের দিকে চেয়ে। আলো অপূর্বার দিকে চোখ তুলে তাকায়। এরপর ঠোঁট দু’টি নড়ে ওঠল তার। বলল, যে কারণে তোকে আসতে বলেছি সেটি হলো, আমার হয়ে তুই একজনকে কিছু কথা বলতে হবে। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বলাটা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ওর সাথে এ বিষয়টা বলতে গেলে আমার বুকের ভেতরটায় একটা মোচড় দেয়। শত সাহস সঞ্চয় করেও তখন আর পারি না, কণ্ঠটা স্তব্দ হয়ে আসে। বলতে না পারার যন্ত্রণায় আমার অন্তরটা পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। পারবি তুই অপূর্বা? – বলতে বলতে আলো অপূর্বার হাত চেপে ধরল।
অপূর্বা হেসে উঠে বলল, এসব তো সাধারণ কথা, সবাই যা বলে, তা।
: আমিও যে সাধারণ। তাই সাধারণ কথাই বলার চেষ্টা করি। তুই কিন্তু প্রশ্নের জবাবটাই দেসনি অপূর্বা।
: এ কোন কাজ হলো না কি। বল তুই ছেলেটা কে?
: ওকে তুই চিনিস। ভার্সিটিতে পড়ে সে। সেই যেদিন থেকে আমি ‘ভালোলাগা’, ‘ভালোবাসা’ শব্দ দু’টির অর্থ বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকেই তাকে আমি ভালোবাসি। বলতে পারিস তার সংস্পর্শই আমাকে শব্দ দু’টির অর্থ বুঝতে সহায়তা করেছে। কিন্তু এতো বছরেও …।
অপূর্বা মুখের দিকে তাকাতেই থেমে গেল আলো। অপূর্বার হাসি মাখা মুখটি ভরে এলো মলিনতায়। আলোকে থামতে দেখে বলল, ছেলেটি কে শুনি?
: জীবন।
: অপূর্বার মলিন মুখটায় একটা অসহায় ভাব ফুটে ওঠল। এ যেন কপোত হারা এক নিঃসঙ্গ কপোতী তার অসহায়ত্বের ভারে ন্যূজ্ব। আলো একটিবারও ভেবে দেখলো না জীবনের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারিত সেই শব্দ কতটা বেদনা নিয়ে তীরের বেগে বিদ্ধ হতে পারে অপূর্বার অন্তরে। কতটা রক্তক্ষরণ হতে পারে তার হৃদয়ের প্রান্তরে।
আলো অপূর্বাকে এমন করে বসে থাকতে দেখে বলল, আমারও যে কোন উপায় নেই অপূর্বা। তোর আর আমার মাঝে এতোই মিল যে নিজেদের অজান্তেও আমরা মিলিত হয়েছি একই বিন্দুতে।
অপূর্বার চোখ কোন বাঁধ মানলো না। নিজেকে সামলে রাখতে চেষ্টা করলো। কিন্তু এ যেন উত্তাল সমুদ্রে বাঁধ দেয়ার মতোই বৃথা চেষ্টা। এভাবে অনেকটা সময় পার করে দেয় অপূর্বা। আলোও কোন কথা বলে না। সেও আধো কান্না মুখে বসেছিল এতোক্ষণ। একটু পর তার চোখ থেকেও অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আলো চোখের জল ঝরিয়ে যেন কিছুটা হালকা হল। কিন্তু হালকা হতে পারেনি অপূর্বা। নীরবে অশ্র“ বিসর্জন দিয়ে চলেছে সে। আলো চোখ মুছে অপূর্বার চিবুক স্পর্শ করে বলল, আমার ও যে কিছু করার নেই রে অপূর্বা! তোর যন্ত্রণা যে আমি বুঝি না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমার ভেতর যে ভালবাসার বৃক্ষটাকে আমি লালন করতে করতে এতোটুকু সময় পার করে এসেছি, সে আজ ডালপালা গজিয়ে হয়েছে অনেক বিশাল। ইচ্ছা করলেই যে আমি তাকে হৃদয়ের জমিন থেকে সমূলে উপড়ে ফেলতে পারছি না। আর যদি এমনটি কখনো করতেই হয়, তাহলে তার পূর্বে স্রষ্টার কাছে আমি আমার কবর প্রার্থণা করবো। এ ছাড়া আমার আর কোন গত্যন্তর থাকবে না।
অপূর্বার চোখ দু’টি হঠাৎ কেমন যেন ঝলসে উঠল। চট্ করে সে আলোর গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। আলো চুপ হয়ে বসে রইল, যেন চড়টা পড়েছে কোন জড় পদার্থের গায়। ক্ষণিক পর অপূর্বা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোর মতো আমার পক্ষেও যে জীবনকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু তোর জন্য আমি তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করবো। তোর কাছে শুধু একটা অনুরোধ, তুই তোর হয়ে আমাকে জীবনের কাছে যেতে বলিস না। এ আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব আলো, একেবারেই অসম্ভব!
বলতে বলতে অপূর্বার চোখ আবার জলে ভরে এলো। অশ্র“ বিসর্জন দিতে দিতে এক সময় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আলো অস্থির হয়ে উঠলো। বালিশের ওপর থেকে তোয়ালেটা নিয়ে চোখ দু’টি মুছে মাকে ডাকলো। তিনি দৌড়ে এলেন। মাথায় পানি দিলেন, ভেজা গামছা দিয়ে মুখ মুছে দিলেন। কিছু সময় পর তার জ্ঞান ফিরে এলো। আলোর মা তখন কোন কারণ জানতে চান নি কারো কাছ থেকে। অপূর্বা যখন পুরোপুরি সুস্থ বোধ করল, তখন সে বাসায় ফিরে গেল। পরে তিনি আলেয়ার কাছ থেকে এ বিষয়ে অবগত হলেন। তিনি শুধু শোনলেন। ‘এ বিষয়ে আর যেন কেউ কিছু না জানে’- এই বলে আলেয়াকে সাবধান করা ছাড়া আর কিছুই বলেননি।

সময় দ্রুত করে বয়ে চলল। এরই মধ্যে জীবনের অনার্সের রেজাল্ট হল, সে ভর্তি হলো মাস্টার্সে। অপূর্বা আর আলোর ডিগ্রীর ক্লাসও শুরু হল মাস গড়িয়েছে। আলো একদিন মাকে ডেকে বসালো তার রুমে। বলল, জীবনকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা, আশা-আকাঙ্খার কথা যা সে আজো বলতে পারেনি জীবনকে। আলোর মা শোনলেন নীরবে। এরপর আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, এ সম্ভব নয় আলেয়া। তোর আর জীবনের মাঝে যে অনেক ব্যবধান।
আলো বলল, তা কেমন মা?
: জীবন অতি শান্ত প্রকৃতির ছেলে। জ্ঞানের দিক থেকে তার মতো ছেলে কমই হয়। আর যে যেমন তার জন্য তেমনই জোটাতে হয়। তাছাড়া ওর বাবা-মা’র এতো সকালে এমন কোন ইচ্ছা আছে বলে আমার জানা নেই। ছেলে মানুষ। পড়া-লেখা শেষ করবে, চাকরি নেবে, তারপর হয়তো ভাববে তার বাবা-মা এবং সেও।
: কিন্তু জীবন ভাই কি এখনই ভাবছে না?
: ও কি ভাবছে, কিভাবে ভাবছে তা বুঝে ওঠা সত্যিই দুস্কর। তবে ও ভুল করার মতো ছেলেও নয়; ওর ছোট্র অতীত তাই বলে।
: তবে মা তুমি কি চাও তোমার ভাইয়ের ছেলে অপূর্বাকে নিয়ে ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন দেখুক?
আলোর মা কিছুটা রেগে ওঠলেন আলোর ওপর। বললেন, সেটাও সম্ভবের বাহিরে। হয়তো ভুল করে সে ক্ষণিকের মোহে মরিচিকার পেছনে ছুটছে আর মরিচিকা ছুটছে খাঁটি বস্তুটির দিকে। কিন্তু এ ভুলের মধ্যেই যে সে ডুবে থাকবে তা ভাবাটাও ঠিক হবে না আলেয়া।
মায়ের কথা থেকে আলো তার রেগে ওঠা তেমন বুঝতে না পারলেও যখন দেখল তিনি কথা শেষ করে আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে উঠে গেলেন, তখন আর বুঝতে অসুবিধা হলো না। তখন আলোর বোধদয় হল যে, মায়ের সাথে এভাবে এতো খোলামেলাভাবে কথাটা বলা তিনি মেনে নিলেও তা যে সহজের নয় তা তার উঠে যাওয়া থেকেই স্পষ্ট। কিছুক্ষণ মৌন থেকে সে রান্না ঘরে গিয়ে মায়ের সাথে কাজে যোগ দিল তাকে কিছুটা হালকা করার জন্য।
আলো রান্না ঘরে মায়ের পাশে বসে আরেকটা বটি নিয়ে তরকারি কুটতে লাগল। মনে তার ভেসে ওঠে জীবনকে নিয়ে নানা কল্পনা, নানা অতীত। আর মাঝে মাঝে সে চোখ তুলে তাকায় মায়ের মুখের দিকে। হঠাৎ একবার চোখাচোখি হয় দু’ জনে। মা বললেন, কিছু বলবি মনে হয়- বলেই তিনি আবার তরকারি কুটতে লাগলেন।
আলো বলল, মা, জীবন আর আমার মাঝে বিদ্যমান ব্যবধানটা কি অনতিক্রম্য?
আলোর মা’র ক্রোধের যেন বাঁধ ভাঙ্গল। “লেখাপড়া শিখে কি লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছিস?…’’ ইত্যাদি বলে তিনি ইচ্ছা মতো বকলেন আলেয়াকে।
আবেগ আলোয়াকে ঘিরে আছে বহুক্ষণ থেকে। নইলে মাকে কিছুটা হালকা করতে গিয়ে তা কেন ক্রোধের কারণ হয়ে উঠবে ওই আবেগ প্রবণ একটি কথা বলে। তরকারি কুটা শেষ না হতেই সে উঠে এসে বসল তার রুমের চেয়ারে। চোখ দু’টি তার পানিতে ছলছল করে ওঠলো। দু’ ফোটা গড়িয়েও পড়ল নিচের দিকে।
ঠিক পরদিন জীবন বাসায় এলো। ফুফুর সাথে কথা শেষ করে সে আলোর রুমে বিছানার ওপর পা তুলে বসল। আলো বসলো পড়ার টেবিলের সামনে। চেয়ারটা ঘুরিয়ে সে জীবনের দিকে মুখ করে বসা। কুশলাদি বিনিময় পর্বটা পূর্বেই হয়ে গেছে। জীবন অপূর্বার কথা জিজ্ঞেস করতেই আলো বলল, জীবন ভাই, ওর জীবনে আপনি এখন শুধুই অতীত। বিশ্বাস করা বা না করা দু’টিই আপনার ব্যাপার।
কয়েকদিন আগেও জীবন যখন এসেছিল আলোদের বাসায়, তখন অপূর্বা সম্পর্কে জীবনের এক প্রশ্নের জবাবে আলো বলেছিল, অপূর্বা এ মুহূর্তে তার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে চায় না। একাকীই থাকতে চায় সে আপাতত। অপূর্বার এমন জবাব জীবন হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, অপূর্বা ছাড়া যদি জীবন বাঁচতে না পারে, জীবন ছাড়া অপূর্বা বাঁচে কেমন করে? আলো বলেছিল, বাঁচা না বাঁচা আপনাদের ব্যাপার… ইত্যাদি।
কিন্তু আজকের কথাটি জীবন বিশ্বাস না করে পারল না যখন অপূর্বার টেবিলের ওপর দেয়ালে লাগানো সেই পংক্তিগুলো অক্ষত অবস্থায় জীবনের দিকে বাড়িয়ে দিল কথাটি বলতে বলতে। জীবন হাত বাড়িয়ে সেই পংক্তিগুলো নিতেই যেন চমকে ওঠল। বুকের ভেতর তার একটা সশব্দ কাল বোশেখি বইতে শুরু করল। ভাল করে দেখে নেয় সে সেই কাগজটি। সত্যিই তাই! জীবনের মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না। সে আলোকে লক্ষ্য করে কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু বলতে পারে না। আলো বুঝতে পারে। সে ভাবতে থাকে কিভাবে সে এ মুহূর্তে জীবনকে বলবে অপূর্বার জীবনে আসা দ্বিতীয় ছেলেটির কথা। ভেবে এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় এই মুহূর্তে না বলার। বেশ কিছু সময় উভয়ে নীরব থাকার পর জীবন আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলে, এ কি করে সম্ভব আলো! জীবনে এই প্রথম অংক কষে ফল মিলালাম। ভাবলাম ভুল হতে পারার ধারণাটাই ভুল হবে।
আলো কোন কথা বলে না। সে বুঝতে পারে জীবনের প্রতিটি রক্ত কণিকায় মিশে আছে অপূর্বা। এ সহজে ঝেড়ে ফেলার মতো নয় । এ আঘাত তাকে কতটা আহত করতে পারে তা অননুমেয় নয়। কিন্তুু নিজের এ বোধশক্তির কাছে হার মানে সে। অপূর্বা যেমনি করে বিরাজমান জীবনের মাঝে, তেমনি করে যে আলোর মাঝেও বিরাজমান জীবন।
জীবনের ভালবাসায় ছিল না কোন খাঁদ। তাই কষ্টের বিষাক্ত তীরটাও তার মস্তিস্কে বিদ্ধ হয় সবেগে। বিদ্ধ হওয়া এ বিষাক্ত তীরের যন্ত্রণা জীবনের জীবন প্রবাহ কোনদিকে বেঁকে নিয়ে যায় তা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারে। প্রাপ্ত বয়সে সুচিন্তিত প্রেম বলেই জীবনের মাঝে আবেগও ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু এতদিন তা ছিল সু-নিয়ন্ত্রিত। আজ যেন তা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এলোমেলো পথে গতি নিতে শুরু করেছে শুধুমাত্র তার লেখা আর অপূর্বার সাজানো সেই পঙক্তিগুলো হাতে পেয়ে। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে সে আলোকে বলে, অপূর্বার কাছে যদি আমি অতীত হই তাহলে বর্র্তমানটা তুই আমাকে খুলে বল।
আলো চুপ থাকে। জীবন পুনরায় তাকে অনুরোধ করলে সে আরো কিছুটা সময় চুপ থেকে তারপর বলল, আমাদের ক্লাশ শুরু হল কিছুদিন হল। সপ্তাহখানেক  পূর্বে আমি আর আপূর্বা যখন ক্লাস শেষে বের হলাম, দেখলাম অপরিচিত অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে একটি ছেলে যে আমাদের পথ আগলে দাঁড়াল। নতুন ক্লাস, নতুন ক্যাম্পাস। সর্বোপরি সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশ। এমন পরিবেশে মদ্যপ, মাতাল, রক্ত ওঠা চোখ নিয়ে একটা ছেলে আমাদের সমনে দাঁড়ালে আমাদের যে কি করার আছে তা আমরা ভেবে পাচ্ছিলাম না। বরং ভড়কে গেলাম আমরা। সে বলল, অপূর্বাকে সে পছন্দ করে। জানা নেই, শোনা নেই অথচ সে বলছে এমন কথা। আমরা ধরে নিয়েছি সে একটা বিকৃত মস্তিষ্কের লোক। শেষে কোন কথা না বলে আমরা পাশ কেটে চলে আসি।
পরদিন ক্যাম্পাস থেকে বের হবার পথে গেটে দেখলাম তাকে। কিন্তু কিছু বলল না। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা একটা রিক্সা নিলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখি আমাদের সামনে একটি রিক্সা এসে থেমেছে। আমাদের ড্রাইভার রিক্সা না থামিয়ে পারল না। আমরা দু’ জনেই রিক্সাতে বসা। ছেলেটি পকেট থেকে একটি গোলাপের কলি বের করে অপূর্বার হাতে দিয়ে  বলল, এটি আপনার জন্য।
তারপর সে রিক্সায় উঠে চলে গেল। পরদিন আমরা খোঁজ নিয়ে জানলাম ছেলেটিও আমাদের সাথে ভর্তি হয়েছে অন্য ডিপার্টমেন্টে। ইন্টার পাশ করেছে এ কলেজ থেকেই। দ্বিতীয় বর্ষে থাকা অবস্থাতেই সে বখে যায় সঙ্গ দোষে। তার পদচারণা শুরু হয় অন্ধকার জগতেও। সরকারী কলেজ বলে যে যে যার যার মত করে চলে। ছাত্র-শিক্ষক কেউই কারো ব্যাপারে প্রয়োজন ছাড়া নাক গলাতে চায় না। ছেলেটির এমন আচরণ অব্যাহত থাকে। কিন্তু ছেলেটিকে তেমন ক্ষতিকর মনে হয়নি অপূর্বার কাছে। তাই অপূর্বা ছেলেটিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। গতকাল অপূর্বা আমার হাতে আপনার লেখা এই কবিতাটি দিয়ে বলল আপনাকে দিতে আর বলার জন্য ওকে ক্ষমা করতে। আমাকে লক্ষ্য করে বলল, তোর সাথে আমার একটা দুরত্ব তৈরী হয়ে গেল আমার নতুন অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে- এই বলে সে চলে গেল। আমি ওকে ডাকলাম। কিন্তু সে পেছনে একটিবারের জন্যও তাকালোনা। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। আজও ক্লাশে এসেছে সে। দায়সারা গোছের একটু কথা বললেও বসেছে আলাদা বেঞ্চে। ভীষণ কষ্ট হল আমার। যার সাথে এতগুলো সময় কাটালাম, সে আজ সরে গেল দূরে। – কথাগুলো বলতে বলতে আলোর কণ্ঠ যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। তাকিয়ে দেখে জীবনের চোখে পানি টলমল করছে। পানি টলমল চোখ নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান হলো জীবনের।
রোকনের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পেছনে প্রথম দিকে অপূর্বার ইচ্ছার ঘাটতি থাকলেও দিন যতই গড়াতে লাগল ততই সে ঘাটতি পূরণ হতে থাকে। কিন্তু অতীত স্মৃতি তাকে মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে যায়। আর সেটুকু এড়াতে একসময় রোকনের প্রতি তার ভালবাসার অপূর্ণ অংশও পরিপূর্ণ করে নেয় সে। ক্যাম্পাসে একত্রে হাঁটা-চলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র পর্যন্ত দুই জনের পদাঙ্ক অঙ্কিত হয় পাশাপাশি। তার সমগ্র সত্তা জুড়ে এখন শুধু রোকনের আবাস। শুধু মাঝে মাঝে একটু আধটু মনে পড়ে জীবনকে। তাও স্বাদহীন অন্য দু’ দশটি স্মৃতির মতো। কিন্তু দিন দিন হতাশা চেপে ধরে জীবনকে। সে হতাশা থেকে মুক্তি পেতে চায়। কিভাবে মিলতে পারে এ মুক্তি আমি’র কাছে জানতে চায় সে। আমি বলে, ঘটে যাওয়া অতীতকে অস্বীকার করতে। জীবন বলে, আমার প্রেমকে তুই এতোই মূল্যহীন ভাবছিস যে আমি সেটি ভুলে যেতে পারি?
: তাহলে জোর করে আদায় করে নে – ভ্রু কুঁচকে বলে আমি।
: সে তো দেহ, মন নয়। সোনালী ডিম ধারণ করা নীড়কে মূল্যবান স্থানে রাখা গেলেও মূল জিনিসটি দখল না নিয়ে কোন লাভ নেইরে আমি। বলতে বলতে দাঁড়ায় সে, আর হাসে। হাসতে হাসতে সে চলে যায়। আমি’র কাছে সেই হাসি কেমন যেন মনে হয়।
আমি’র প্রকৃত নাম আমির আলী। অতি হেয়ালী স্বভাবের সে। যখন যা মন চায় তখন সে তাই করে। অন্যদের তুলনায় আলাদা কিসিমের বলে অন্যরা তার নামে কিছুটা ভিন্নতা এনে তাকে আমি বলে ডাকে।
আজ হঠাৎ আলোদের ক্যাম্পাসে আগমন জীবনের। ইন ছাড়া শার্ট পরা তার। শেভ হয়নি সপ্তাহ খানেক হল। শরীরটাও ভেঙ্গেছে কিছুটা। মুখের হাসিটা উবে গেছে এরও আগে। ক্লাস শেষে শহীদ মিনারের কোলে জীবনকে বসে থাকতে দেখে আলো স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা দ্রুত গতিতে হেঁটে আসে তার দিকে।
: কেমন আছেন জীবন ভাই? এখানে কেন? বাসায় চলেন।
: বেশ ভাল আছি। এখানে এসেছি প্রাণের খোঁজে।
: চলেন, বাসায় কথা হবে। আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। – এই বলে সে জীবনের হাত ধরে তাকে বসা থেকে টেনে তুলল। জীবন দাঁড়াল। বলল, আমার ভেতর যে আগুনের লেলিহান শিখা। এ শিখা শব্দ রূপে নিঃসৃত হবার পর হৃদয় পোড়াতে পারে। তার চেয়ে বরং এখানেই বসি।
আলো বললো, আজ সবাই কাকার বাসায় গেছে। আসবেন সন্ধ্যায়। আমি বাসায় তালা লাগিয়ে এসেছি, চলেন।
আলো হাঁটতে শুরু করল। শেষে পেছন পেছন অগ্রসর হতে লাগল জীবনও।
তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে আলোর রুমে গিয়ে বসল দু’ জনে। একটু পরেই আলো ওঠল। জানালার পর্দাগুলো তুলে দিয়ে অন্য রুমে গেল সে। অল্প সময়ের মধ্যেই মিষ্টি আর কোমল পানীয় নিয়ে এলো ফ্রিজ থেকে । একটি রসগোল্লা নিজে কাটা চামচ দিয়ে তুলে নিয়ে প্লেটটা এগিয়ে দিল জীবনের দিকে। সেও নিল। আলো নিজ থেকেই বলল, আজ অপূর্বাকে ক্লাসের শুরুর দিকটায় দেখেছি, শেষের দিকটায় দেখিনি।
আলোর কথা শেষ হতেই জীবন বলল, কেমন আছে সে ?
: ভাল। খুব ভাল।
অবুঝ শিশুর মতো জীবন বলল, আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করে?
আলো এ কথার কোন জবাব না দিয়ে বলল, রোকন আর অপূর্বার সম্পর্কটা এখন খুবই চমৎকার। অনেক ছেলে-মেয়ের কাছে রীতিমতো ঈর্ষণীয়। মানুষ বলে, অভ্যাস নাকি বদলানো যায় না। কিন্তু রোকন তা পেরেছে। আমাদের অনেকের সাথে ওর মাঝে মধ্যে কথা হয়। ওকে বন্ধু হিসেবে আমাদের মোটামুটি ভাল লাগে।
কথাগুলো আলো চমৎকারভাবে বলে গেলেও জীবনের ভেতরটা যেন ভেঙ্গে-চুরে একাকার হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় চুপ থেকে তারপর সে বলল, তুই আমাকে একটা কাজ করে দিতে পারবি আলো?
: সম্ভবের মধ্যে হলে কেন দেব না, অবশ্যই দেব।
: আমাদের দূরত্বটা তুই দূর করে দিবি। পারবি না?
: এটি এখন আর কিছুতেই সম্ভব নয় জীবন ভাই। হাঁড়ি একবার ভাঙলে সেটা কি জোড়া নেয়? নেয় না। নিলেও আগের মতো কাজ হয় না।
আলোর কথাটা জীবনের তোলপাড় করা বুকের ভেতরটায় কষ্টের ঢেউ বইয়ে দিয়ে পড়ো পড়ো আশার তীরটা যেন বেশ কিছু দূর ভেঙ্গে দিল। সেই ঢেউ বুক ভেদ করে ভাসিয়ে দিল পুরো চোখের জমিন। টস্টস্ করে পানি পড়তে থাকে। জীবন মাথাটা নিচুই করে রাখে। চোখ দু’টি তার রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। আলো জীবনের পাশে গিয়ে বসে। জীবনের এমন অবস্থা দেখে ওর চোখ দু’টিও ঝাপসা হয়ে আসে পানিতে। কিন্তু বাঁধ ভাঙ্গে না। দু’ হাতে জীবনের মাথাটা তুলে ওর চোখে তাকিয়ে বলল, আমি কি পারি না অপূর্বার শূন্য স্থানটা পূরণ করতে?
জীবন নিজেকে সামলে নিয়ে ভেজা চোখে বলল, সে তো মিথ্যে শান্ত্বনা। তাছাড়া…।
জীবনের কথা শেষ না হতেই আলো বলল, এ মিথ্যে শান্ত্বনা নয় জীবন ভাই। এ আমার বুকের ভেতর এতোকাল জমে থাকা স্বপ্নের প্রকাশ।
: সম্ভব নয় আলো। অপূর্বা মিশে আছে আমার রক্তের প্রতিটি কণায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে। দেহের সব রক্ত ফেলে দিয়ে কি নতুন করে প্রবেশ করানো যায় আলো? যায় না। তার পূর্বেই মৃত্যু ঘটে মানুষটির।
জীবন উঠে চলল বাসার উদ্দেশ্যে। আলোর কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করাটা যে অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই হবে না, তা সে অনুমান করে নেয়।
শান্ত চাচার দোকানটায় দু’ চারজন কাস্টমার দেখা যাচ্ছে। জীবন বাহির থেকে তাকিয়ে দেখে। ওদের কাউকে তার পরিচিত মনে না হওয়ায় দোকানে ঢুকে সে। একটা চা আর একটা সিগারেট দিতে বলে ছোট্ট ছেলেটাকে। ওর নাম রাজা। রাজা সিগারেট আর চা দিয়ে যায়। সঙ্গে একটা দেশলাইয়ের বক্স। কয়েক চুমুক চা খাওয়ার পর সিগারেটটা ধরায় সে। ধোঁয়াটা ভেতরে নিতেই তালুতে উঠে যায়। সঙ্গে সঙ্গে কাশতে শুরু করে। শান্ত চাচা এগিয়ে আসেন। এক গ্লাস পানি ঢেলে দিয়ে হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে চায়ের প্লেটে রেখে বললেন, যেটা যার কাজ না, তাকে সেটা করতে যাওয়াও ঠিক না। রাজা এক কাপ দুধ দিয়ে যা, সরসহ। পানিটুকু খেয়ে নাও।
রাজা দুধ নিয়ে এল। জীবন বলল, এখন খাব না চাচা উঠি।
: উঠবা কেন বাবা, আরেকটু বসো। আজকের গরুর দুধটা কিন্তু খুব ভালো।
: না চাচা, খাবো না।
: তাহলে ছাগলেরটা দেই?
জীবন মাথা নাড়ল। না বোধক জবাব পেলেন শান্ত চাচা।
: তোমার হইছে কি জীবন? দিন দিন ঘাটি যাইতেছ। ক্যামন ক্যামন যেন মনে হয় তোমারে। কারণডা কি খুইলা কওন যাইবো?
জীবন কোন জবাব না দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, যাই চাচা। এই নেন টাকাটা – বলেই সে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে হাঁটতে লাগল। পেছন থেকে রাজা ডাক দিয়ে বলল, সিগারেটটা নিয়া গেলেন না?
জীবন শোনেও না শোনার ভান করে বেরিয়ে গেল। রাজা টেবিলটা মুছতে লাগল। শান্ত চাচা চিন্তিত চোখে জীবনের চলে যাওয়া দেখে মনে মনে বলল, জীবনটার কি থেকে কি হলো, সামনেইবা কি হয় কে জানে! আহ্! – একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শান্ত চাচা।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠল। বালিশের কোলে মাথা রাখা জীবন শত চেষ্টা করেও চোখের পাতা মিলাতে পারে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময় শোয়া থেকে উঠে বসে। কিছু সময় গম্ভীর হয়ে বসে থাকার পর লাইটটা জ্বালিয়ে টেবিলে গিয়ে বসে। অপূর্বাকে একখানা চিঠি লিখবে বলে মনস্থির করে। রাইটিং প্যাড নেই বলে লিখবার খাতা থেকে দু’টি পাতা ছিঁড়ে নেয়। তারপর কলমটা খুলে বসে। কিন্তু লেখা হচ্ছে না এক কলমও। লিখবার কথাগুলো ভেতরেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লিখবার ইচ্ছাতে ঘাটতি নেই তার। ভেতরের অব্যক্ত ভাষাগুলো তাকে কষ্টে অস্থির করে তোলে। বুক যেন তার ফেটে যেতে চায়। চোখ ভরে ওঠে পানিতে। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখে লিখবার পাতাগুলোর অনেকটা ভিজে গেছে চোখের পানিতে। কলমটা হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে বাতিটা নিভিয়ে আবার মাথা ঠেকায় বালিশের গায়। কষ্ট যেন তাকে আরো চেপে ধরে। ঠোঁট কামড়ে এবার সে কষ্টের দাপাদাপি ঠেকাতে নিজেই চেপে ধরে নিজের বুক। তার কাছে মনে হয়, তার চোখ থেকে অশ্র“ ঝরার সাথে সাথে বাইরে ডাল ছড়ানো আম্র বৃক্ষটি থেকেও ঝরে পড়ছে পাতা। সেই পত্র পতন শব্দ তিমির রাতের নীরবতা ভেঙ্গে ঝন্ঝন্ শব্দে তার কানে এসে বাজে। আবার শোনতে পায় সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত নারকেল বৃক্ষের পাতার ঝন্ঝন্ শব্দ থেকে শান্ত্বনার বাণী – ‘ঘুমিয়ে পড় জীবন…।’
গভীর রাতের নিস্তব্দতায় নদী যেমন কলকল শব্দে বয়ে চলে স্বচ্ছ জলের ধারায়, তেমনি করে শান্ত্বনার বাণী শোনতে শোনতে চোখের নদীর অশ্র“ধারা বইয়ে দিতে দিতে নিজের অজান্তে কখন যে চোখ দু’টি তার বুঁজে আসে তা সে নিজেই জানে না।
ভোর হল। মসজিদে ফজরের আজান হল বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে। মা নামাজ শেষ করে জীবনের ঘরে এসে বাতিটা জ্বালালেন। দেখলেন জীবন গভীর নিন্দ্রায় আচ্ছন্ন। টেবিলের উপর দৃষ্টি পড়তেই এগিয়ে এলেন। দেখলেন, সাদা পৃষ্ঠাগুলোর কিছু অংশ পানিতে ভিজে তারপর শুকিয়ে কিছুটা বেঁকে-কুঁকে আছে। তিনি এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা না করে বতিটা নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
দিনটা বেশ আলোকউজ্জ্বল। ফুরফুরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে সেই সকাল থেকেই। সূর্যটা হেলে আছে পশ্চিমাকাশে। আজ আলো কলেজে থাকতেই জীবন তাদের বাসায় যায়। ফুফুর সাথে কথা বলে এক ফাঁকে আলোর পার্সোনাল ডায়েরী থেকে অপূর্বার বাসার ফোন নাম্বারটি নিয়ে নেয় সে। ওর নিজের কাছেও ছিল নাম্বারটি। ইনডেক্সটি হারিয়ে গেছে বেশ কিছুদিন পূর্বে। জীবন দোকান থেকে ডায়াল করে। রিসিভার তোলে কাজের মেয়েটি। বিপরীত পাশ থেকে কণ্ঠ শুনেই জীবন বুঝতে পারে এ অপূর্বার কণ্ঠ নয়, নয় তার মায়ের কণ্ঠও। পরিচয় জানতে চাইলে জবাব আসে-
: জরিনা।
: আমি অপূূর্বাকে চাইছি।
: আপনার নাম কি?
: জীবন।
: জরিনা রিসিভারটা রেখে অপূর্বাকে বলল। অপূর্বা বেশ আগ্রহ নিয়ে তড়িৎ এলো ফোন সেটের কাছে। ক্ষণিকের জন্য যেন সে ভুলে গিয়েছে জীবনের সাথে তার সম্পর্কের মাটি চাপার কথা। একটু থেমে তারপর যেন স্মরণে এলো বিষয়টি। ধীরে হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিয়ে বলে-
: কেমন আছ?
: খোদার পর যেমন রেখেছ। তুমি?
অপূর্বা কোন জবাব দেয় না। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবনের মুখখানি বেদনার এক প্রতীক রূপে। মনে পড়ে অতীতের কিছু খন্ড স্মৃতি। নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। খুবই খারাপ লাগে।
: চুপ করে আছো যে অপূর্বা?
অপূর্বার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে জীবন বলে, আলোর কাছ থেকে অনেক কথা শুনেছি। তোমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে। কখন কোথায় সেটা তোমার ইচ্ছা! এই ‘অপরাধী’ যদি কোন ‘অপরাধ’ করে থাকে তাহলে সে তা জ্ঞাত হতে চায়, নিজেকে শুধরে নিয়ে মুক্ত বাতাসে দু’ হাত ছড়িয়ে তারপর জড়িয়ে নিতে চায় তার স্বপ্নকে, স্বর্নালী ভবিষ্যতকে। আমি যে আর সইতে পারি না অপূর্বা! কিছু বলো, চুপ করে থেকো না! – বলতে বলতে জীবনের চোখের কোণে অশ্র“ জমে ওঠে। ওপাশ থেকে শোনতে পায়, ‘এই অপরাধীকে ক্ষমা কর জীবন। আমি অতীতকে ভুলবার চেষ্টা করছি। যদি তুমি একটি মুহূর্তের জন্যও আমাকে ভালোবেসে থাক, তাহলে সেই দাবী নিয়েই বলছি, তুমিও আমার মতো অতীতকে ভুলে যাও জীবন।’
জীবন চোখের সামনে দেখতে পেল বিশাল আকাশ দু’ পাশে ভেঙ্গে পড়ছে আর তার অন্তরালে থাকা নিকশ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে জগৎটাকে।
রিসিভারটি রেখে দিয়ে অপূর্বা নিজের রুমে গিয়ে বসে থাকে আর নিজের অজান্তেই তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে  পড়ে ক’ ফোটা অশ্র“।
জীবন ফোনের দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ল। বুকের ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনকে নেভাতে সে রিক্সা নিয়ে রওনা হয় বারের দিকে।

ছয় মাস পর।

নিজ ব্যাংক একাউন্টে টিউশনি বাবদ যা কিছু টাকা জমিয়েছিল জীবন তার পুরোটাই সে নিঃশেষ করেছে মদের বোতলের পেছনে। এখন বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার করে চালিয়ে যাচ্ছে সেই কাজ। মায়ের কাছ থেকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন কাজের কথা বলে কিছু কিছু টাকা নিতো আর তাও ঢালতো মদের পেয়ালায়। এখন মা তেমন একটা দেন না তার কানে আশপাশ থেকে নানা কথা যেতে শুরু করার পর।
চেহারায় মদ গ্রহণের আভাস স্পষ্ট। একে একে সব টিউশনি গেল। একটা মদ্যপ ছেলেকে জেনে-শোনে কে-বা রাখে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে। চোখ দুটো ফোলা ফোলা। শেইভ করে অনিয়মিত। সে কারণে মুখ ভর্তি থাকে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে। চলা ফেরা নিয়ম-নীতিহীন। তার আগেরকার প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই এখন নিঃশেষ হওয়ার পথে। তবে হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া জীবন মাঝে মাঝে আশায় বুক বাঁধে এই ভেবে যে, অপূর্বার সাথে যদি তার ব্যবধান চুকে আসে, তাহলে সে এমন জীবন ত্যাগ করে অতীত জীবনকে গ্রহণ করবে পুনরায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই যে সে গিয়ে পৌঁছেছে রসাতলে, দেহের ভেতরটা নষ্ট হবার আর যে তেমন একটা অবশিষ্ট নেই, সেই বিষয়ে সে তেমন একটা ওয়াকিবহালও নয়। হবেই বা কেমন করে। মা কয়েক দিন বলেছে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু সে রাজী হল না। সব বয়সে সন্তানের ওপর প্রভাব খাটানো যায় না – এসে পড়ে স্বেচ্ছা সায়ের বিষয়টি। এ ক্ষেত্রেও হয়েছে তেমনটি। তাই মায়ের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার চেষ্টার ফলাফল হয় শূন্য।
মন যেখানে ছুটে যায়, দেহও ছুটে যেতে চায় সেখানে। এ স্রষ্টা প্রদত্ত প্রাণী মাত্রেরই বৈশিষ্ট্য। কেউ এ নিয়মকে উপেক্ষা করতে পারে না যদিও সে কখনো কখনো তদস্থানে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে শারীরিক উপস্থিতি ঘটাতে না পারে। সেখানেও কথা থেকে যায়। কল্পনার জাল ছড়িয়ে দিয়ে সে স্থানে গিয়ে বর্তমান হয় সে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম নয় জীবনও। অপূর্বার কথা যখনই মনে পড়ে, তখনই ছুটে যেতে চায় তার কাছে। কিন্তু সেই চাওয়া পর্যবসিত হয় ব্যর্থতায়। তৃষ্ণার্ত কাক যেমন পানির সন্ধান না পেলে ছটফট করতে থাকে, বুকটা শুকিয়ে হয় চৌচির; অপূর্বাকে না দেখার তৃষ্ণায় মাঝে মাঝে জীবনের অবস্থাও হয় তাই। আর সেই তৃষ্ণা মেটাতেই সে মাস তিনেক পূর্বে অপূর্বাদের ক্যাম্পাসে গিয়েছিল। কিন্তু তৃষ্ণার্ত তৃষ্ণা নিয়েই ফিরে এল।
আবার গেল তারও মাসখানেক পর। ক্লাস শেষে মাঠের পাশ দিয়ে পথ ধরে হাঁটছিল অপূর্বা। পাশ থেকে ডাক এলো, অপূর্বা একটু দাঁড়াবে?
অপূর্বা পাশে তাকায়। প্রথমে চিনে উঠতে সমস্যা হচ্ছিল। তবে তা কাটিয়ে ওঠতে সময়ও তেমন একটা লাগেনি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এলোমেলো চুল আর স্বাস্থ্যের যে অবস্থা হয়েছে তাতে চিনতে একটু সমস্যা হওয়ারই কথা। একটু এগিয়ে দু’ জনে একটা ঝাউ গাছের নিচে দাঁড়াল। জীবন জিজ্ঞেস করল,  কেমন আছ?
: আমার কথা থাক। এ কী অবস্থা হয়েছে আপনার!
: আমি বেশ ভাল আছি। কিন্তু তোমার কথা থাকবে কেন?
অপূর্বা জবাব এড়িয়ে বলল, এই যদি হয় বেশ ভালো থাকা, মন্দ থাকাকে তাহলে কি বলবেন?
জীবন এ কথার জবাব না দিয়ে বলল, তোমাকে দেখি না কতদিন হল! না দেখার যন্ত্রণা আর সইতে পারছিলাম না অপূর্বা! আরেকদিন এসেছিলাম। আজও যদি সেদিনের মতো দেখা না হতো, তাহলে হয়তো উন্মাদ হয়ে যেতাম। কিন্তু তোমারও যে শরীর-মন কোনটাই ভাল নেই, তা বেশ করে বুঝা যাচ্ছে। হয়েছে কি শুনি?
জীবনের কথায় অপূর্বার মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠতে চাইল। কিন্তু মনটাকে কিছুটা শক্ত করে নিল। তার পূর্বেই চোখ টলমল করে ওঠল পানিতে। সেই পানি আঙ্গুলের পিঠ দিয়ে মুছতে না মুছতেই রোকন এসে উপস্থিত।
: তুমি এখানে, আর আমি খুঁজে খুঁজে…। কথা শেষ না করেই অপূর্বা আর জীবনের দিকে তাকাল রোকন। বলল, ছেলেটা কে অপূর্বা?
জিজ্ঞাসার ধরণটা ভালো মনে হলো না অপূর্বার। তবুও একটু সময় নিয়ে সে জবাব দিল, জীবন ভাই।
রোকন জীবন সম্পর্কে পূর্বেই জেনেছে অপূর্বার কাছ থেকে। ফলে চিনতে তার বিলম্ব হলো না। জীবনকে উদ্দ্যেশ্য করে রোকন বলল, এখনতো দেখছি পুরোপুরিই পাগল হয়ে গেছে। লোকালয় ছেড়ে বনবাসে চলে গেলেইতো হয়। যুগে যুগে এই পাগলরা বুঝি থেকেই গেল।
কথাটা যেন জীবনের চাইতে অপূর্বার গায়েই বেশি লাগল। তাই প্রতিক্রিয়ারও দেরি হলো না।
: উনি যে তোমার চেয়ে বয়সে সিনিয়র তা তোমার অজানা নয়। পুরোপুরি না পারো ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধটুকু নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করো। নিজের মতো দেহের মাপকাঠিতে সবাইকে বিচার করো না। তুমি যা বলেছো, সেটি যদি উনি হয়েই থাকেন, তা উনি হয়েছেন অর্জিত অধিকার হারিয়ে। আর তুমি কি এখনই ভুলে গেলে যে, অধিকার জন্মানোর পূর্বেই তুমিও একদিন এমনটি হতে বসেছিলে?
রোকন আর অপূর্বার মধ্যে তর্ক চলতে থাকল। অপূর্বার কয়েকজন বান্ধবীও একে একে এসে জড়ো হয়েছে। এরা আলোরও বান্ধবী। আলো আজ ক্লাসে আসেনি। জীবন এখানে বিলম্ব করাটাকে সমীচিন মনে করলো না। তার চলে যাওয়ার সময় বান্ধবীদের মধ্যে দু’ জন একে অপরকে বলল, জীবন ভাই না?
: হ্যাঁ। কী মানুষ কী হয়েছে!
এ ঘটনার পর থেকে অপূর্বা রোকনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। আগে মাঝে মাঝে বোরকা ব্যবহার করলেও কয়েকদিন থেকে নিয়মিতই তা ব্যবহার করছে সে। অপূর্বার এই এড়িয়ে চলাকে রোকন সহজে মেনে নিতে পারছিল না। এ নিয়েও তাদের মধ্যে একদিন তর্ক-বিতর্ক হয় পথ চলতে চলতে। তখন সোয়া তিনটার মতো বাজে। ক্যাম্পাসের অদূরে প্রেক্ষাগৃহটির সামনে যখন পৌঁছল, তখন তাদের তর্ক-বিতর্কের ঝড় আরো কিছুটা গতি নিয়ে বইতে শুরু করল। রোকন উত্তেজিত হয়ে উঠল। উত্তেজিত হলে একজন মানুষ যেমন হিতায়িত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে, ঘটিয়ে বসে অবিবেচকের মতো কান্ড – এ ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। উত্তেজনার বশে সে অপূর্বার স্কার্ফটা টান দিয়ে খুলে ফেলল। ফলে অপূর্বাও উত্তেজিত হলো আগের তুলনায় আরো কিছুটা। আর তখনি রোকন একটা চড় বসালো অপূর্বার গালে। অপূর্বা চিৎকার করে উঠলো। আশপাশ থেকে এবং প্রেক্ষাগৃহ হতে বেরিয়ে আসতে থাকা লোকজন ছুটে এসে প্রহার শুরু করল রোকনকে। কেউ বলল, ওরে আমি চিনি। শালা মাস্তান। আবার কেউ কেউ বলল, কত্তোবড় সাহস, রাস্তা-ঘাটে মাইয়া মানুষের বোরকা টাইন্যা খুইল্যা ফালায়। মার ইচ্ছা মতন।
এভাবে চলল কিছুক্ষণ। কেউ শুনতে চাইলো না তার কথা। অপূর্বাও চেষ্টা করল লোকজনকে নিবৃত্ত করতে। কিছু সময় পর সমর্থ হল অপূর্বা। কিন্তু ততক্ষণে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। এর মধ্যে অতি উৎসাহী কিছু লোক চায়ের কাপ আর পিরিচও ভেঙ্গেছে তার মাথায়। অশ্র“সিক্ত নয়নে অপূর্বাই আবার তাকে নিয়ে রওনা হল হাসপাতালে। এ বাঙ্গালী নারীর ধর্ম। যাকে একবার ভালোবাসে, কাছে তো বটেই, দূরে থাকলেও তার জন্য প্রাণ কাঁদতে চায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে প্রায় এক ঘন্টা পর ডাক্তাররা তাকে ছেড়ে দেয়। দু’ জন একত্রে বেরিয়ে এল। অপূর্বা কোন কথা না বলে একটি রিক্সা নিয়ে বাসায় চলল। রোকন আরেকটি রিক্সা না পাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপূর্বার চলে যাওয়া প্রত্যক্ষ করল।
পরদিন ক্যাম্পাসে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু তাদের দু’ জনের কেউই ক্যাম্পাসে নেই।
সপ্তাহ খানেক পর উভয়কেই দেখা যাচ্ছে ক্যাম্পাসে। নাটকীয় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করল সবাই। আগের চাইতেও যেন শক্ত হয়েছে রোকন আর অপূর্বার সম্পর্কটা। তাদেরকে দেখে অনেকের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল যে এমন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু আসমার জিজ্ঞাসার জবাবে অপূর্বা সত্য প্রকাশে দ্বিধা করলো না। এতে কেউ কেউ রোকনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ব্যক্তিত্ব বলতে কিছুই নেই ওর। আবার কেউ কেউ বলল অন্য কথা, এটাই হলো সত্যিকারের প্রেম।
এই নাটকীয়তার কারণ অন্য সবারই অজানা। অপূর্বা কয়েকদিন ক্লাসে না এসে নিয়মিত ক্লাসের নাম করে বাসা থেকে বেরিয়ে রোকনের সাথে সাক্ষাৎ কর্মে নিয়োজিত থেকে রোকনকে একান্তই নিজের করে নিল। উভয়েই ঘুচিয়ে নিল তাদের মধ্যকার ব্যবধান। এর দুই দিন পর ক্লাসে এলো আলো। গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল সে। তারা ঢাকায় এসেছিল দুই দিন আগেই। ক্লাসে এসে জানতে পারল জীবন এসেছিল। জানলো সেদিনের ঘটনাটি। জীবনের প্রতি এমন অপমান সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল আলোর। চোখ তার ভেসে যাচ্ছিল পানিতে। ক্লাস চলাকালে পুরোটা সময় এমনিভাবে পার করল সে। অপূর্বা জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস? কোথায় ছিলি এই ক’ দিন?
: গিয়েছিলাম গ্রামে। শুনলাম জীবন ভাই এসেছিল তোর খোঁজে?
শুধু আলোর মুখটাই এতক্ষণ মলিন ছিল। অপূর্বার মুখে কিছু হাসি থাকলেও তা উবে গেছে এরই মধ্যে। মাথা নেড়ে আলোর কথার জবাব দিয়ে অপূর্বা বলল, দেখে খারাপ লাগল। কষ্ট হল খুব। সেই আগের মতো এখন নেই। কেমন যেন হয়ে গেছে। – বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অপূর্বা।
আলোর মেজাজটা চড়ে আছে। সে বলল, আর তোর খারাপ লাগল বলেই কি রোকন তাকে অপমান করল? তুই কি ছিলি না সাথে? জীবন ভাইকে কষ্টের ওপর কষ্ট বুকে নিয়ে ফিরে যেতে হল আর তুই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলি? আমার মামাতো ভাই তোকে ভালোবেসে এখন পাগল প্রায়। তুইওতো তাকে একদিন ভালোবেসেছিলি অথচ তোর সেই ভালোবাসার মানুষটি অপমানিত হয়ে গেল তোর কাছে এসে – এ তুই কিভাবে সহ্য করলি অপূর্বা, কিভাবে! – বলতে বলতে আলোর রাগ পড়ে গিয়ে চোখ ভরে এলো পানিতে। সে শব্দ করে কান্না করতে লাগল। অপূর্বা আলোকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখেও অশ্র“ধারা বইতে লাগল। এভাবে অতিবাহিত হল কিছুটা সময়।
অপূর্বা নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আলোকে বলল, কারো অপমান খোদা সহ্য করতে পারে না। তাই রোকনকেও অপমানিত হতে হয়েছে। সেটা তুই পরে জানতে পারবি। – অপূর্বা নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিয়ে কথাগুলো বলল। আলো শুধু শুনলো। কিন্তু এখনো সে নিজেকে স্বাভাবিক করে আনতে পারেনি। তার চোখে এখনো পানি। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, কাল রাত দশটা পর্যন্ত ছিলাম জীবন ভাইদের বাসায়। আব্বুসহ গিয়েছিলাম। তখনো বাসায় ফেরেনি। মামীর কাছ থেকে জানলাম, এখন কোন কোন রাতে বাসায় ফেরে না। টেবিলের ওপর বই পত্রে জমে আছে ধুলা-বালি। অথচ এই বই কিনা একদিন ছিল তার জীবনের একটা অংশ। চোখে-মুখে নাকি মাদকাসক্তের  চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আশেপাশের লোকজন নানা কথা বলে। খাবার-দাবারের কোন ঠিক নেই। কারো সাথে তেমন কোন কথাও বলে না। যতক্ষণ বাসায় থাকে চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। মামী শুধু নামাজ শেষে চোখের পানি ফেলেন। মামাতো তা-ও পারেন না। তিনি যেন দিন দিন কাঠ হয়ে যাচ্ছেন। জীবন ভাইয়ের এ অবস্থার জন্য শুধু কি তিনিই দায়ী? তুই আর আমিও কি দায়ী নই অপূর্বা, বল! – বলতে বলতে আলো ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে শুরু করল। জীবনের এমন অবস্থায় কষ্টে যেন তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। অপূর্বার চোখের কোণ বেয়েও অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে দুই হাত মুখের ওপর চেপে ধরে গড়িয়ে পড়তে থাকা অশ্র“কে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করল।
সাত মাস পর। এখন দিন দিন জীবনের অবস্থা আরো অবনতির দিকে গড়াতে লাগল। ডাক্তার দেখানো? কে শোনে কার কথা। মা’তো সব আশা ছেড়ে দিয়ে এখন শুধু চোখের পানি ফেলছেন। এই বিকেলেও তিনি বারান্দায় বসে বসে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে তসবিহ গুনছিলেন। এ সময় এলেন একজন প্রতিবেশী। দরজা খুলে দিয়ে তাকে নিয়ে আবার বসলেন বারান্দায়। উভয়ের মধ্যে প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময় হলো। এরপর জীবনের মা বললেন, রোকেয়ার মা, আপনি তো এখন আর তেমন একটা আসেন না আমাদের বাসায়। কারণ কি রোকেয়ার মা?
: না ভাবী অন্য কোন কারণ নেই। মেয়ে বিয়ে দেয়ার পর থেকে বাসার ঝামেলা যেন বেড়ে গেল। সময় করতে পারি না বলে আসাও হয়ে ওঠে না। সে যাক, যা জানতে আসা। জীবনকে নিয়ে লোকমুখে অনেক কথা শুনি। শোনতে শোনতে কান ভারী হয়ে এল। কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আসলে বিষয়টা কি সত্য?
জীবনের মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যা শুনেছেন সবই সত্য। সত্য না হলে লোকে আগে তো বলেনি। এখন বলতে যাবে কেন।
জীবনের মা’র কথায় রোকেয়ার মা যেন কিছুটা বিরক্ত হলেন। বললেন, না ভাবী, মা হয়ে অন্য দশ জনের মতো আপনিও জীবন বাবাজী সম্পর্কে এমন মন্তব্য করলেন, এটা আমার কাছে ভাল ঠেকলো না।
: সবই কপাল রোকেয়ার মা, সবই কপাল! নইলে কি ছেলে কি হল! এমন হবে কেন। – বলতে বলতে জীবনের মা’র চোখে পানি চকচক করে উঠলো।
রোকেয়ার মা শান্ত্বনা দিয়ে বললেন, খোদার ইচ্ছায় সব ঠিক হয়ে যাবে ভাবী। চিন্তা না করে খোদার কাছে শুধু দোয়া করেন।
: চিন্তা তো এমনিতেই এসে যায়। দেহ তো গেল মাথাটাও প্রায় গেল। কিভাবে নিজেকে শান্ত্বনা দেই আর চিন্তামুক্ত থাকি বলেন। তবুও খোদার কাছে বলি, তিনি যদি রক্ষা করেন।
শনিবার। সপ্তাহের প্রথম দিন। ক্লাশ শেষ করে রুম থেকে বের হতে হতে আসমা তার বান্ধবীদের বলল তাদের বাসায় আসতে। দিনের বাকিটা সময় সবাই হৈ চৈ করে কাটাবে। আসমা বলল, বাসায় আজ কেউ নেই। শুধু আমি। ছিল কাজের মেয়েটা। সে-ও সকালে ওর মায়ের সাথে দেখা করার জন্য গেছে। ফিরবে সন্ধ্যায়। সবাই মিলে রান্না করে খাবো। বেশ মজা হবে। যাবি?
আলো ছাড়া আসমার সব বান্ধবীই ছিল। অপূর্বা সবার সাথে সায় দিতে কিছুটা ইতস্তত করল। আসমা বুঝলো। সে রোকনকে লক্ষ্য করে বলল, রোকন ভাইও যাবেন আমাদের সাথে। আপনি না করতে পারবেন না কিন্তু রোকন ভাই।
অপূর্বা বলল, এতোগুলো মেয়ের সাথে একটা ছেলে, এটা কেমন দেখায়। আবার ওকে বাদ দিয়ে আমার যাওয়াটাইবা কেমন হয়। তাই বলি কি আসমা, তোরা যা।
শিল্পী রসিকতা করে বলল, তুই কি বলছিস এতোগুলো মেয়ের সাথে এতোগুলো ছেলে হলে ভালো হয়? ভালো হলেও আমাদের যে কিছুই করার নেই। আমাদের তো তোর মতো চাঁদ কপাল না।
অপূর্বা বলল, আমি আসলে সে ভাবে বলিনি শিল্পী। ঠিক আছে চল – বলেই সবাই হাঁটতে লাগল সামনের দিকে।
রান্না-বান্না হল। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো একটু আগে। হৈ হুল্লোড় করে সবাই বেশ মজা করল। বান্ধবীদের সাথে এমন মজা করে কাটানোর মতো দিন এর আগে কখনো এসেছে কি না তা কারোই স্মরণে আসছে না। রোকন সামনের রুমে বসে বসে টিভি দেখছিল। মাঝে মাঝে সবার হাসি-ঠাট্টায় সেও ভেতরে গিয়ে অংশ নিচ্ছিল। এরপর আসমার সব বান্ধবী এসে বসলো সামনের কক্ষে, টিভি সেটের সামনে। রোকন রিমোর্টটি একটু দূরে সরিয়ে রেখে চুপচাপ বসে রইলো। কেউই যেন নির্দ্দিষ্ট কোন চ্যানেলে স্বস্থি পাচ্ছে না। স্বস্থি যতটুকু, তা যেন শুধু চ্যানেল বদলেই।
ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা চার পেরিয়েছে; মিনিটেরটা পৌঁছলো ছয়-এ। সামনের রুমে এতোক্ষণ টিভি দেখার পাশাপাশি নানা কথা, আর সেই সঙ্গে প্রাণ খোলা হাসিও। এরপর বান্ধবীরা সবাই একত্রে উঠলো ভেতরের রুমের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নেবে সবাই। তারপর যার যার গন্তব্যে রওনা হবে ওরা।
সবার সঙ্গে উঠল অপূর্বাও। সবার পেছনে সে। রুম থেকে বের হওয়ার জন্য সে পা বাড়ানো মাত্রই রোকন পেছন থেকে তার হাত চেপে ধরল। অপূর্বা থামল। জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকালো সে। রোকন ফিসফিস শব্দ করে বলল, আরেকটু বসো। অপূর্বা দেখল রোকনের মুখাবয়বে, কথার স্বরে একটা তৃষ্ণার ছাপ। সে বুঝেও না বুঝার ভান করে বলল, এখন বসবো না। এতক্ষণ বসেছি যে তাতে হয়নি?
: না হয়নি। হয়নি বলেইতো আরেকটু বসতে বললাম।
অপূর্বার বুকের ভেতরটায় ধ্বক্ ধ্বক্ শব্দ হচ্ছে বলে তার মনে হলো। সমস্ত মুখে ফুটে উঠল লজ্জার ছাপ। একটু চেষ্টা করল রোকনের হাত থেকে হাতটা সরিয়ে নিতে। রোকন বলল, প্লীজ অপূর্বা!
অপূর্বা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কি যেন ভেবে দরজাটা সামান্য ধাক্কা দিয়ে বললো, ঠিক আছে বসবো। যা বলবার তড়িৎ বলে নাও – বলেই সে বিছানার পাশে এসে বসল।
রোকন ফিস ফিস করে কানে কানে বলবার কথা বলে নিল। অপূর্বা বলল, ঠিক আছে দু’টির বেশি নয়। রোকন অপূর্বাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। এক হাত তার অপূর্বাকে জড়িয়ে রাখল আর অন্য হাত অপূর্বার কপালে। এরপর চুম্বন আঁটলো। প্রথমটি কপালে আর দ্বিতীয়টি অধরে। কিন্তু তৃষ্ণা যেন তার না কমে বাড়লো আরো শতগুন। আর অপূর্বার তনুও ততক্ষণে সেই তৃষ্ণা মেটানোর আকাঙ্খায় ‘না’ না করার উপযোগী হয়ে ওঠল। রোকন বালিশের কোলে রাখলো অপূর্বার শির। তারপর পুনরায় চুম্বন আঁটলো কপাল থেকে কপোলে। ক্রমান্বয়ে অধর, চিবুক, কন্ঠনালী এবং …। এভাবে চলতে থাকল। জ্যৈষ্ঠের খরতাপে তপ্ত ভূমি এক ফসলা বৃষ্টির জন্য যেমন উন্মুখ থাকে আর সেই কাঙ্খিত বৃষ্টি শুরু হলে ভূমি যেমন পেতে থাকে স্বস্থি, তেমনি রোকন স্ব-আকাঙ্খা আর অপূর্বার প্রথমে অস্বীকৃতি থেকে পরে ইচ্ছা, দু’য়ে মিলে আবেগের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তপ্ত ভূমিকে শীতল করতে থাকল আর মেটাতে লাগল সেই পিপাসা। পরিবেশটাকে প্রতিকূল মনে হলো না তাদের। জানালার পর্দা টানা রয়েছে, টিভিও চলছে শব্দ করে। জানালার পর্দা ভেদ করা হালকা আলো আর টিভি থেকে নির্গত নীলাভ আলোক রশ্মি মিলে একটা শান্ত আর মিষ্টি আলোর সৃষ্টি হল যা আবেগময় পরিবেশ সৃষ্টিতে অনেকটা ভূমিকা রাখলো। কিন্তু অপূর্বার বান্ধবীরা যে তার কাছে এসে পড়তে পারে, সেই চিন্তা একটুও কাজ করেনি তাদের দু’ জনের কারো মাথায়।
মিনিট দশেক পর শিল্পী এসে দরজার পর্দাটা একটু সরাতেই হতবাক! দরজার বেশ খানিকটা খোলা ছিল বলে তা আর খুলবার প্রয়োজন হয়নি। সে ভেতরে গিয়ে আসমাসহ সবাইকে বলল। একে একে সবাই নীরবে পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখে গেল বাঁধ ভাঙ্গা আবেগের গতিময়তা।
ভেতরের রুমটায় বসে বসে আসমা আনমনা হয়ে কি যেন ভাবছে। তাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। দিলরুবা আসমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করল। কিন্তু জিজ্ঞেস না করতেই আসমা বলল, শোন্। যদি কিছুক্ষণ আগে আমাদের কোন গেষ্ট আসতো, তাহলে কেমন কেলেঙ্কারিটাই না হতো ভাবতে পারিস কেউ? আমার নিজের চোখকে এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার সে বলল, যাই হবার হয়েছে। কিন্তু বান্ধবী হিসেবে আমাদের ভূমিকাটা এখানে কেমন হবে জানিস? ভূমিকাটা হবে যা এখানে ঘটেছে তার কিছুই ঘটেনি, যা আমরা দেখেছি তার কিছুই আমরা দেখিনি। ওদের বিষয় ওদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক। আমরা এটাকে মাটি চাপা দিলাম। ধরে নেবো ওই সময়টুকু আমরা শুয়ে ছিলাম এবং তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম।
সবাই আসমার সাথে একমত পোষণ করল। তারা সবাই একটি প্রশ্ন মাথায় নিয়ে শুয়ে পড়ল। – এ কি স্বপ্ন না সত্যি? আর তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠছিল একটি কুৎসিত নারীর ছায়া।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। আসমা সামনের রুমে প্রবেশ করল। অপূর্বা সোফায় আর রোকন বিছানায় বসে বসে টিভি দেখছিল। আসমা স্বভাবিক স্বরে আর স্বভাবিক মেজাজেই বলল, কোন চ্যানেল দেখছিস। আমরা তো ঘুমিয়ে ওঠলাম।
আসমার মধ্যে স্বাভাবিকতা থাকলেও সে যে তাদের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়নি, তা ভাববার মত অতটা বোকাও নয় অপূর্বা। তাই তার চোখটায় লজ্জা ভর করল। এমনি সময় অন্যরাও এসে পড়ল। অপূর্বা হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে এখনি বেরুতে হবে। বেশ দেরী হয়ে গেছে। মা চিন্তা করবে।
আসমা বলল, রোকন ভাই যাবে না?
অপূর্বা কোন জবাব না দিয়ে রোকন ছাড়া অন্য সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, আমি চললাম আসমা। – বলেই সে বাসা থেকে নেমে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে বিদায় নিয়ে রোকনসহ অন্য সকলেও বেরিয়ে পড়ল কথা বলতে বলতে।

পাঁচ সপ্তাহ পর।
জীবন বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে দশ দিন হল। শেষ যেদিন এসেছিল, তাও তিন দিন পর মাতাল অবস্থায়। কিন্তু কারো প্রতি কোন অনাকাঙ্খিত আচরণ তার কাছ থেকে প্রকাশ পায়নি।
বাবা-মা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠলেন। বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন এক এক করে সব শেষ করলেন। কোথা থেকেও জানা গেল না তার সন্ধান। সব শেষে এলেন আলোদের বাসায়। আলোদের বাসায়ও পাওয়া গেল না তার খবর। চিন্তায় জীবনের মায়ের চোখের নিচ কালো হয়ে উঠেছে। দানা-পানিও মুখে ওঠে না। নানা অশুভ চিন্তা মনটাকে দখল করে নেয় মাঝে মাঝে। তখন চোখ ফেটে পানি বের হয়, বুক ফেটে যেতে চায় কষ্টে। সন্তানের জন্য মায়ের কত টান, তা এই রমনীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে ধরা পড়বে অতি সহজেই। আলোর মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে চোখের পানিতে বুক ভাসালেন তিনি। কী সেই কান্নার ভাষা!
আলো উদ্বেগাকুল হয়ে উঠলো। তাই সে জীবনের মা বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই বেরিয়ে পড়ল অপূর্বাদের বাসার দিকে।
সন্ধ্যা হওয়ার আধ ঘন্টা বাকি প্রায়। ফ্যাকাশে মুখে আলো ঢুকলো অপূর্বাদের বাসায়। কয়েক দিন থেকে কলেজ বন্ধ যাচ্ছে, যাবে আরো কয়েক দিন। অপূর্বা যেন আলোর আসার প্রতীক্ষায় ছিল। তারপর অপূর্বার রুমে গিয়ে বসলো ওরা দু’ জনে। সে কথা বলবার পূর্বেই আলো বলল, তোর কাছে আমি একটা প্রাণ ভিক্ষা চাইতে এসেছি অপূর্বা। আর সেটা জীবন ভাইয়ের…।
আরো কিছু বলার ছিল তার। বলতে না বলতেই চোখে তার পানি এল আর মুখের ভাষা গেল হারিয়ে। খানিকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে তারপর অপূর্বার হাত ধরে বলল, একটা মানুষের জন্য আজ একটা পরিবার পাগল প্রায়। আর এর পুরোটাকে শুধু তুই-ই রক্ষা করতে পারিস অপূর্বা। তুই জীবন ভাইকে কাছে টেনে নে অপূর্বা!
অপূর্বা আলোকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নীরব কান্না করল। তারপর বলল, আমার যে সবই শেষ হয়ে গেছে আলো। আমি আমার ভেতরে আরেকটা মানুষকে বয়ে চলেছি!
আলো বাক শূন্য হয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখে-মুখে তার অবিশ্বাসের ছাপ। বিশ্বাসহীন দৃষ্টিতে সে নির্বাক তাকিয়ে রইল অপূর্বার মুখপানে। অপূর্বা তখন বলল, বিশ্বাস করিস আর না-ই করিস, এ সত্য। পুরোপুরিই সত্য। কিন্তু কেউ জানে না এখনো। আমি আগামী কালই যেতাম তোর কাছে। আমি এখন কি করব আলেয়া! – বলতে বলতে তার চোখ থেকে অশ্র“ গড়াতে লাগল।
এরপর আলোর জিজ্ঞাসার জবাবে সে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলল, বিশ্বাস কর আলো, প্রথমে আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু …।
আলো অপূর্বাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখনকার কথা বল।
অপূর্বা গত কয়েকদিন থেকে তার শারীরিক নানা পরিবর্তনের বর্ণনা দিল। আরো বলল, সন্দেহ ঘনীভূত হবার কারণে সবার অজান্তে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগের কথা। তারপর বলল, ডাক্তারের কথা শোনার পর অনেক কষ্টে বাসায় ফিরে এলাম। বাসার কেউ জানতে পারলে আমাকে কেটে নদীতে ভাসাবে।
আলো ভাবলো, একটা বাসায় এতোগুলো বান্ধবীর উপস্থিতিতে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল আর তারা ঘটনাটি সম্পর্কে অনবগত রয়েছে, এমনটি হতেই পারে না। তবুও সে আসমার কাছ থেকে পরোক্ষভাবে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়ার কথা ভাবলো। আলো নিজেকে শক্ত করল। তারপর বলল, রোকন ভাইকে ভেবেছিলাম পরিবর্তন হয়েছে। এখন দেখি কুকুরের লেজ। যোগাযোগ হয়েছিল সহসা ওর সাথে?
: বন্ধে হয়নি। তার আগে হয়েছে। কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।
এরপর নীরব থাকে দু’ জনে কিছুটা সময়। তারপর অপূর্বা অশ্র“সিক্ত নয়নে আলোকে বলল, আজ জীবন ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। কেমন আছে রে উনি আলেয়া? – বলেই অঝোরে চোখের পানি ফেলতে লাগল। আলো কিছুটা সময় ঠোঁট কামড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলেও চোখের কোণে দু’ ফোটা অশ্র“ জমা হল তার। বলল, জীবন যেমন মানুষের একটা, কালে কালে জগত সংসারে জীবনরা একজনই আসে। ওরা সোনা নয় হীরাও নয়, তারচে অনেক দামী, অন্য কিছু। তাই আমরা ওদের চিনি না। কালে কালে ওরা এসে জানিয়ে দিয়ে যায়, একটা মানুষের একটাই মন; আর তা শুধু একজনের জন্যই। সেটাকে ভাড়া করা যায় না।
এরপর আবার নিজেকে কিছুটা শক্ত করে বলল, আমি বিষয়টা নিয়ে আরেকটু ভাবি। – বলেই সে উঠলো। আলো পরদিনই আসমার বাসায় যায়। আসমা তাকে জানালো যে তারা সবাই সেদিন স্বচক্ষে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু বিষয়টা যে নতুন প্রাণ পর্যন্ত গড়াবে, তা তারা কেউই ভাবেনি।
আলো ভাবলো, এতোগুলো চোখ যখন সাক্ষী হয়ে গেছে, তখন বিকল্প কোন ব্যবস্থা নিলেও ভবিষ্যতে অপূর্বা কারো ঘরে যাওয়ার পর তার কানে ঘটনাটি পৌঁছে যেতে পারে। তখন ভাঙতে পারে তার সংসার। তার চেয়ে ভালো, যেখানকার সমস্যা সেখানেই সমাধান করা যায় কি না।
এ দিনই আলো আবার এলো অপূর্বাদের বাসায়। বলল, অনেক ভেবেছি অপূর্বা। কিন্তু আমাকে শূন্য হাতে ফিরে যেতে হলেও জীবন ভাইকে নিয়ে ভাববার তোর আর কোন সুযোগ নেই। সমাজে তোকে বাঁচতে হবে, আর তা-ই করবো। তুই তৈরী থাকবি। যে কোন মুহূর্তে তোকে এসে নিয়ে যাব কাজী অফিসে। শুধু রোকনকে খুঁজে পেলেই হয়। তবে যা-ই করবো, কৌশলে।
দু’ দিন পর উভয় পরিবারের অজান্তেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হল অপূর্বা আর রোকন। সেখানে উপস্থিত ছিল আলো, আসমা, শিল্পীসহ অন্য বান্ধবীরাও।
তারও সাতদিন পর জীবন এল আলোদের বাসায়। কোথায় ছিল, কোথায় খেয়েছে বা আদৌ খেয়েছে কিনা, ফুফু আর আলোর এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করেনি সে। তবে খুবই যে ক্ষুধার্ত তা বোঝা গেল যখন সে নিজেই ফুফুকে বলল খাবার দিতে। খাওয়া-দাওয়া শেষে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম তার চোখ দু’টোকে আচ্ছন্ন করে নিল। কিছুটা সময় পর আলো এসে বসল অনতি দূরে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠল জীবনের সেই চেহারা; সেই শান্ত দু’টি চোখ যা এখন শুধুই স্মৃতির পাতা খুলে দেখতে হয়।
দিন গেল, রাত গেল। পরদিন হঠাৎই জীবন আলোকে জিজ্ঞেস করে বসল, অপূর্বা কেমন আছে রে আলো?
আলো চুপ করে মনে মনে আবার ভাবল, কালে কালে জগত সংসারে জীবনরা একজনই আসে। ওদের দেহ মন ওভাবেই গড়া।
জীবন আলোর চুপ করে  থাকা দেখে বলল, তুই কি এখনো বুঝিস না আমি তাকে কতোটা ভালোবাসি?
আলো অশ্র“সিক্ত নয়নে আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলল, জানতে একটু বিলম্ব হয়ে গেল জীবন ভাই। আর তাই আপনার স্মৃতি বুকে নিয়েই স্বামীর ঘরে …।
আলোর কথা শেষ না হতেই সে হাত তুলে কথা থামাতে বলল আলোকে। তার বুকের ভেতর একটা বেদনার সুর বেজে ওঠল। চোখ থেকে তার জলধারা বইতে লাগল বিরামহীন ভাবে; সেই জলধারা দেখে আলেয়ার মনে হলো জগতের বুক থেকে ঝরে পড়ছে সত্যিকারের সব ভালোবাসা।

গৃহহীন, মদ্যপ আর পূর্ণ মস্তিষ্ক বিকৃত ছেলে এবং জীবন সঙ্গীর গত হওয়ার ব্যথা বুকে নিয়ে দিনাতিপাত করছেন জীবনের মা। ছেলে কোথায় থাকে তা তার অজানা। বহুবার জিজ্ঞাসা করেও ছেলের কাছ থেকে মা কোন জবাব পায়নি। যখন টাকার প্রয়োজন হয় তখন আসে। তারপরও কর্জ করে সারা। আশপাশের লোকজন এখন ধার চাইলে না করে। আগে ছেলের এ ঋণগ্রস্ততা ঠেকাতে মা টাকা দিতে কোন কথা বলতেন না। কিন্তু লাভের গোড়ায় শূন্য। বছর তিনেক পূর্বে একবার টাকা দেয়া বন্ধ করে দিলেন মা। তাতে বরং ফলাফল হল বিপরীত। অর্থাভাবে মদ না ছেড়ে নানা জনের কাছ থেকে ঋণ করে তা তো চালিয়ে যেতেই লাগল, তার ওপর বাসায় আসাও দিল বন্ধ করে। বেশ কিছুদিন পর যখন আবার ফিরে এলো, তখন মা সন্তানকে না দেখার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কিছু কিছু টাকা দিতে শুরু করেন। সেই ধারা অব্যাহত রইল।
একটা লোক কয়েক বছর ধরে পথে পথে ঘুরে। কখনো এ নগর কখনো অন্য নগর আবার কখনো বা নগর পেরিয়ে নিভৃত পল্লীতে। কেউ বলে মাতাল, কেউ বলে পাগল, কেউ বলে দুই-ই। কিন্তু পাগলামি করতে গিয়ে কারো ওপর চড়াও হয় না সে। নগরীর পথ ধরে যখন হাঁটে, তখন বড় বড় দালানের বারান্দা আর জানালার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজে। লোকে বোঝে না। কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করে না তেমন। মাঝে মাঝে দু’ একজন জিজ্ঞেস করলেও জবাব আসে না। প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে একসময় চোখে পানি টলমল করে ওঠে। লোকজন তখন ভয়ে দূরে সরে যায়। কখনো কখনো কারো জিজ্ঞাসারও প্রয়োজন হয় না, হাসতে থাকে নিজে নিজেই। গঞ্জ আর নগরীর পথ ধরে অজানা গন্তব্যের দিকে এগুতে এগুতে এমনি করে উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। হাসির শব্দে পথের পাশের বৃক্ষরাজি আর দালানগুলোও যেন কেঁপে ওঠে এক সময়। পথিকদের অনেকেই ভাবে, এই শীর্ণ দেহে এত উচ্চস্বরে হাসছে কিভাবে? ওর তো রীতিমত দিন ফুরিয়ে এলো।
আলোর পরের ঘরে পা রাখার পাঁচ বছর হয়ে গেল। একটি কন্যা সন্তানও এলো তার ঘরে। বিয়ের পূর্বে সে বাবা-মাকে বেশ করে বলেছিল জীবনকে সে বিয়ে করবে। এ নিয়ে অনেক হয়েছে। বাবা-মায়ের কথার জবাবে আলো বলেছিল, ও পাগল নয়। আর যদি তোমাদের ভাষায় তা হয়েই থাকে তাহলে আমিই তাকে স্বাভাবিক করে তুলব। তোমরা শুধু সেই সুযোগটা আমাকে দাও। তোমাদের কাছে এ আমার শেষ চাওয়া।
কিন্তু তার সেই চাওয়া অপূর্ণই রইল। ঘোমটা মাথায় তুলে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে তীর বিদ্ধ আহত পাখির ন্যায় তাকে মেনে নিতে হলো অদৃষ্টের লিখন। বউ সেজে পা রাখল স্বামীর বাড়ি। স্বামী তার মস্ত বড় লোক। শ্বশুর-শাশুড়ির স্নেহও কম জোটে না। অতীতকে ভুলে থাকতে যা প্রয়োজন তার কমতি নেই কোনো। এখন আর আলোর খুব একটা মনে পড়ে না জীবন নামে একটা ছেলেকে এক সময় সে ভালোবেসেছিল, যার জন্য ফেলেছিল চোখের পানি। মনে পড়ে না একদিন তার শিক্ষকও ছিল জীবন। সুখ-স্বাচ্ছন্দের মাঝে ডুবে থাকলে অতীতের কষ্টের কথা মনের গহীন কোনে উঁকি দেয়ার সুযোগ না পেতে পেতে যেমন হয়, আলোর ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। স্বামী, সংসার আর একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সুখের দিন বয়ে চলছে তার।
রোকন এখন দেশের নামকরা বিজনেস ম্যাগনেট। একমাত্র পুত্র সন্তান ‘পৃথিবী’কে নিয়ে চলছে অপূর্বা আর রোকনের সংসার। এখন তার বয়স আট। ঘরে বাইরে তার দুষ্টামিতে মা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। বাড়ি-গাড়ি, অর্থ সম্পদ কোনটাতে তার অপূর্ণতা নেই। চাকর-চাকরাণী সদা তৈরী থাকে হুকুম পালনের অপেক্ষায়। সোনায় ভরা সর্বাঙ্গ তার সোনার রঙ্গে ঝলমল করে। দেহ আর অলঙ্কারে তার কাছ থেকে চোখ ফেরানো দায়। কিন্তু চিত্ত তার সুখ শূন্য – সে খবর রাখে কে। স্বামীর সাথে বনিবনার অভাব, সে খবর তো পড়ে থাকে চার দেয়ালের মধ্যে। তখন তার মনে পড়ে অতীতকে। সে সময় মন বলে আরেকবার জীবনের দেখা পেলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে। সে মন থেকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তার পায়ের ধুলির স্পর্শ থেকে তাকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। বিনিময়ে যদি সে চায় বনবাসে গিয়ে তার সাথে ঘর বাঁধতে, তাতেও সে রাজি। তবুও সে অর্থ নয়, বিত্ত নয়- চায় একটু মানসিক প্রশান্তি। কিন্তু কোথায় পাবে তাকে, তা জানা নেই তার। আলোর বিয়ে হয়েছে কোথায় তাও তার জানা নেই। আগে যেখানে বাসা ছিল তাও বদল হয়েছে। যখন খুব কষ্ট হয় তার, তখন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে মনে মনে খোদার কাছে চায় ইহ জীবনে আর একটিবার জীবনের দেখা পেতে।
জীবনের বন্ধু-বান্ধবদের প্রায় সবাই বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করেছে। ব্যতিক্রম শুধু জীবন আর আমি। আমি সেই যেমনটি ছিল আট বছর পূর্বেও, এখনো ঠিক তেমনটিই আছে। যখন যা মাথায় আসে, তখন তাই করে বসে। কোন কোন ক্ষেত্রে মনে হয় পূর্বের চেয়ে এখন কিছুটা বেশিও। আর যে অপরূপা এক সময় জীবনকে ভালোবেসে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে একখানা পত্র লিখেছিল আর তাতে লেখা ছিল ‘আমি কুমারীই থাকবো আপনার অপেক্ষায়- অমৃত্যু।’ সেই অপরূপা এখনো সবুজ শ্যামল নিভৃত পল্লীতে প্রহর গুনছে জীবনের প্রতীক্ষায়। ছোট দুই বোন অনামিকা আর অনন্যার বিয়ে হয়েছে ইতিমধ্যেই। বাবা-মায়ের অনেক চাপ সত্ত্বেও তাকে রাজি করানো যায়নি। এখন লোকজনের চোখে সে ‘বুড়ি’। সম্বন্ধও এখন আর আসে না। পল্লীর ছায়া ঘেরা স্নিগ্ধ পরিবেশে থেকেও বয়সের ভার যেন তার দেহের সেই যৌবনের উত্তাল ঢেউ কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে। কিন্তু নয়ন দু’টির আকর্ষণীয়তাকে এখনো ছুঁতে পারেনি বয়সের ভার। প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে এতগুলো বছর পার করেও সে যেন ক্লান্ত নয়, হতাশ নয়। মনে মনে সে ভাবে, জীবন শুধুই তার, জীবনের জন্যই জগতে তার আগমন।
এমনি প্রতীক্ষায় দিন যায় অপরূপার। হঠাৎ একদিন সে জীবনের খোঁজে ছোটে ঢাকায়। কিন্তু ঢাকায় খালার বাসায় এসে জানতে পারল জীবন উন্মাদ হয়ে গেছে, মদ খেয়ে দেহটাকে নিয়েছে রসাতলে।
রাতটা বহু কষ্টে পার হল তার চোখ থেকে পানির নহর বইতে বইতে। সারারাত মনে মনে ভাবলো, এমন সোনার মানুষটাকে কে এমন করে নাশ করল?
পূর্বাকাশে সূর্য যখন সতেজ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটতে শুরু করল, তখন আশিককে নিয়ে অপরূপা এলো জীবনদের বাসায়। জীবনের মা’র সাথে কথা বলে বুঝলো মরণের আর তেমন সময় বাকি নেই। জীবনের মায়ের অশ্র“ বিসর্জনে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি অপরূপা। মনে মনে খোদার কাছে বলল, হে খোদা, জীবনে আর একটিবার তাকে প্রাণ ভরে দেখার সুযোগ করে দাও! আমি যে তাকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছি!
জীবনের এই শেষ বেলায় নিজের আগমনে অপরূপা ব্যথার আগুনে পুড়ে দগ্ধ হবার পাশাপাশি নিজেকে অপরাধী মনে করল। তাই তো অপরূপার মন নিঃশব্দে আর্তনাদ করে ওঠে- কেন দূরে ছিলাম এতোদিন! নইলে হয়েতো রোধ করতে পারতাম জীবনের এই অবেলায় ঝরে যাওয়া!
সূর্য পশ্চিম দিগন্তে নরম আলো নিয়ে হেলে পড়েছে। মনটা কেমন যেন করছে অপূর্বার। ভালো লাগছে না কোন কিছুই। পাঁচতলা বাড়িটার দ্বিতীয় তলায় নিজেদের বসবাস। উত্তর আর পূর্ব দু’ পাশে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। পুবের বারান্দা দিয়ে দৃষ্টিপাত করলে প্রশস্ত গলি পেরিয়ে চোখ পড়ে প্রধান সড়কের ওপর। বেশির ভাগ বাড়িই একতলা দোতলা। প্রায় সব বাড়ির আশপাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে দু’ চারটি বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। দিনের শেষ ভাগটা বাদে গলিতে লোকজনের আনাগোনা কমই থাকে। বিকেলে ছেলেরা গলির পাশের দু’ একটি খালি জমিতে খেলাধুলা আর দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে।
অপূর্বা উত্তর পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এখানটায় দাঁড়ালে পথিকদের দৃষ্টিতে পড়তে হয় না পূর্ব পাশের বারান্দার মতো। সবুজ বৃক্ষ দৃষ্টিগোচার হয় আরো বেশি।
গলিতে একজন পাগলের আগমনে ছেলেদের অনেকে খেলাধুলা রেখে তাকে উত্যাক্ত করতে ছুটে এলো। কোন কথা বলে না সে। শুধু তার চোখে যে দু’ একটি উঁচু দালান ধরা পড়ে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলে, কেউ বোঝে না। দিন কয়েক পূর্বে লোকটি আরো দু’বার এসেছিল। ছেলেরা তাকে ঢিল ছুঁড়ে বিভিন্নভাবে উত্যাক্ত করে প্রধান সড়ক পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়ে এসেছিল। কিন্তু সে দিনের তুলনায় আজ লোকটিকে আরো দূর্বল দেখাচ্ছে। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে তার। লোকটি নিজেই এখন বোঝে এ তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। মাঝে মাঝে রক্ত বমি হয়। আজ সকালেও বেশ হয়েছে। কথা বলারও শক্তি নেই তার। ছেলেদের উত্যক্তে তাদের দিকে হাত বাড়ায়- যেন কিছু একটা বলতে চায়। ছেলেরা আরো উৎসাহী হয়ে ওঠে তাকে বিরক্ত করতে, ঢিল ছুঁড়তে। ছেলেদের উত্ত্যক্তে গলির শেষ প্রান্তে প্রধান সড়কের কাছাকাছি এলে দুই পা তার ঝিমিয়ে আসে। কিছুক্ষেণের মধ্যে যে তার প্রাণ প্রদীপ নিভে যাবে, তাতে আর তার সন্দেহ রইলো না। প্রচন্ড পানির পিপাসা পেয়েছে। গলির পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে ইশারায় একগ্লাস পানি চাইল ছেলেদের কাছে। তারা নানা উক্তি আর ঢিল ছুঁড়ে তাকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করল আরো বেশি করে। হঠাৎ তিন ভাগের এক ভাগ সমপরিমাণ একটা ইট  এসে পড়ল তার কপালে। মুহূর্তের মধ্যেই তীব্র বেগে রক্ত ঝরতে শুরু করল। ছেলেদের কেউ কেউ দৌড়ে পালিয়ে গেল, কেউ কেউ নিঃশব্দে দূরে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করতে লাগল। জীবনে এই শেষবারের মত মুখ খুলল লোকটি। বলল, বাবা আমাকে এক গ্লাস পানি দিবে কেউ?
টিং টিং করে বাসার কলিং বেলটা অনবরত বাজতেই লাগল। উত্তরের বারান্দা থেকে অপূর্বা এসে দরজা খুলতেই পাশের বাসার একটা ছেলে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, আন্টি পৃথিবী একটা পাগলের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।
অপূর্বা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, কোথায়?
: গলির মাথায়।
: মহল্লার বাইরের লোকজন আছে কেউ?
: আমি যখন এলাম, তখন পর্যন্ত দেখিনি।
অপূর্বা দ্রুত ঘরে ঢুকল। স্যাভলনের বোতলটা আর এক টুকরো কাপড় নিয়ে মাথার ওপর ঘোমটা টানতে টানতে বাসা থেকে বাইরে পা বাড়াতেই ছেলেটি বলল, আন্টি লোকটি একগ্লাস পানি খেতে চেয়েছিল।
ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে এক বোতল পানি নিয়ে ছেলেটির হাতে দিয়ে বলল, তুই আয় রাজু- বলেই ব্যস্ত পায়ে হাঁটতে লাগল। পেছনে চলল রাজু। আর বাসার কাজের মেয়ে জরিনাও ছুটলো পিছুপিছু।
ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দুরে থাকতেই অপূর্বার দৃষ্টি পড়ে পথের ধারে পড়ে থাকা লোকটির অসাড় দেহটির প্রতি। চেনা চেনা লাগছে। আরো দুই পা সামনে যেতেই চিনতে পারে লোকটিকে। থমকে দাঁড়ায় সে। পা দুটো আর সামনে চলে না। ক্ষণিক পরেই কান্না জড়ানো শব্দে ‘একি হলোরে…’ বলে গগনবিদারী চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে মাটিতে বসে স্যাভলন আর কাপড় দিয়ে তার মাথার রক্তক্ষরণ রোধের চেষ্টা করতে লাগল। অপূর্বা যতই সেই চেষ্টা করতে লাগল, ততই যেন রক্ত ক্ষরণ হতে লাগল তার নিজের বুকের ভেতরে। দু’ চোখ দিয়ে অশ্র“ধারা বইতে লাগল তার। মনে মনে একটা ভীতি- ‘বাঁচবে তো!’
লোকটির কোন চেতন নেই। পাশ থেকে কেউ কেউ বলল, ‘পাগলটা বোধ হয় মরেছে।’ একজন দুঃখ করে বলল, মাঝে মাঝে পাগলটারে এখানে সেখানে দেখতাম। বড় ভাল ছিল। বিদায়ের কালে প্রিয়জনের স্পর্শও ভাগ্যে জুটলো না তার। হায়রে কপাল!

হঠাৎ লোকটির চোখের পাতা নড়ে ওঠল। এতোক্ষণ কি ঘটল তাকে নিয়ে, কিছুই জানে না সে। জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান যখন ফিরল, তখন চোখ খোলার চেষ্টা করল শেষ তৃষ্ণা নিবারণ আর শেষ বারের মতো এই পৃথিবীর আলো দেখার জন্য। এ যে তার জীবনের বিদায় বেলা তা অপূর্বা বুঝতে পারে। কষ্টে তার বুক ফাটে। চোখের সম্মুখে সেই প্রিয়জনের চির বিদায়, এটা জানে না পৃথিবীর আর কেউ। জীবন যখন চোখ খুলল, তখন সে চোখের সামনে দেখে তার অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীর মুখ। অশ্র“ টলটল চোখ দু’টি আর কষ্টমাখা মুখাবয়ব দেখে তার মনে হয়, সেই পৃথিবীর বুকে বইছে প্রবল ঝড়। তৃষ্ণা নিবারণের কথা ভুলে চোখ মেলে সে চেয়ে থাকে প্রিয় মুখটির দিকে। মরণকালে শেষবারের মতো চোখ দু’টি তার পানিতে টলমল করে ওঠে। ক্ষণিকের মধ্যেই সে চোখ মুদলো চিরদিনের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে অপূর্বার ‘না’ ‘না’ আর্তনাদে যেন আসমান-জমিন কেঁপে ওঠল। এরপর আর কি হল সে কিছুই জানে না।
সন্ধ্যার আঁধার যখন চারদিকে নামি নামি করছে, তখন চোখ খুলে দেখে সে বিছানায় শায়িত। ধীর পায়ে অপূর্বা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। জরিনা পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, এখন আর ভয়ের কিছু নাই আম্মা। পুলিশ আইসা যখন খালুজানের নাম শোনলো, তদন্ত-ফদন্ত না কইরা লাশটা নিয়া গেছে। লোকটার পকেটে নাকি তার এক বন্ধুর ঠিকানা পাওন গেছে। হায়রে পাগল, মরণ বুঝি তোর এখানেই ছিল!
অপূর্বা নির্বাক তাকিয়ে থাকে মরণের সেই জায়গাটির দিকে। বুক তার আরো ব্যথায় ভরে ওঠে; নয়ন ভরে ওঠে অশ্র“তে। সেই অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে থাকে গাল বেয়ে ফ্লোরে।
পরদিন সকাল ন’টার দিকে আশিক খবর নিয়ে এল বাসায়। মা দরজা খুলতেই উদ্বিগ্ন চোখে মাকে বলল, মা স্যার মারা গেছে! অপরূপা পাশে দাঁড়ানো ছিল। সে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, আশিক কোন স্যার মারা গেল রে?
: জীবন স্যার।
অপরূপা কোন প্রশ্ন না করে পাগলের মত ছুটল। আশিকের মা বলল, একটু দাঁড়া। আমিও যাবো।
এ কথার বিন্দু মাত্রও তার কানে যায়নি। সে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে একটা রিক্সায় উঠল। পেছন থেকে আশিকও দৌড়ে এসে তার পাশে উঠে বসল। রিক্সা থেকে নেমে যখন বাড়ির প্রথম প্রবেশ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করল, তখন চোখে পড়ল একটি খাটের ওপর সাদা কাফন জড়ানো একটি লাশ। কিছুক্ষণের মধ্যে কবরস্থ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে লাশটি। কান্না জড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে লাশটির দিকে ছুটতেই ভেতর থেকে দু’টি মেয়ে এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল ভেতরে। তারপর চোখে তার বর্ষা নামল;  বিলাপ করল কাতোক্ষণ। অনেকের বুঝানোয় সেই বিলাপ থামলেও চোখ থেকে তার অশ্র“ধারা নেমেই চলল নীরবে।
শেষ দেখাটি সবাই দেখে নিয়েছে আগেই। আর কখনো পৃথিবীতে দেখা যাবে না এই মুখ। লাশের খাট যখন নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই তৈরী হল, তখন সাদা দাড়িওয়ালা একজন লোক এসে বলল, আরেকজন লোক এখনো দেখার বাকি আছে। একটু খুলুন।
মৌলভী সাহেব মাথার অংশটা উন্মুক্ত করলেন। কয়েকজন মহিলা অপরূপাকে এনে দাঁড় করালো লাশের পাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে মৌলভী সাহেব সাদা কাপড়ে পুনরায় আবৃত করে দিলেন উন্মুক্ত অংশটি। অপরূপার চোখের সামনে থেকে চিরদিনের মত আড়াল হয়ে গেল সেই মুখ, আড়াল হয়ে গেল মায়াবী পৃথিবীর বুক থেকেও।
চারজন কাঁধে তুলল লাশের খাট। তারপর ‘মিন্হা খালাকনাকুম্, ওয়া ফি হা…’ বলতে বলতে সকল পুরুষ মিলে এগিয়ে যেতে লাগল লাশটি কররস্থ করার জন্য। ভেতর থেকে অনেক মহিলার কান্না শোনা গেল। মায়ের কান্নার শব্দ আলাদা হয়ে ভেসে এল সবার কানে।
অপরূপা নির্বাক তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল। ক্ষণিক বাদে তার দু’ হাতে পরা সোনার অলঙ্কার দু’টি খুলে পড়ল ইট-সিমেন্টর ঢালাইয়ের ওপর যার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল সে। ঢং ঢং শব্দে সেই চুঁড়ি দু’টি দুই দিকে গড়িয়ে গেল বহুদূর পর্যন্ত।

সময় দ্রুত করে বয়ে চলল। এরই মধ্যে জীবনের অনার্সের রেজাল্ট হল, সে ভর্তি হলো মাস্টার্সে। অপূর্বা আর আলোর ডিগ্রীর ক্লাসও শুরু হল মাস গড়িয়েছে। আলো একদিন মাকে ডেকে বসালো তার রুমে। বলল, জীবনকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা, আশা-আকাঙ্খার কথা যা সে আজো বলতে পারেনি জীবনকে। আলোর মা শোনলেন নীরবে। এরপর আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, এ সম্ভব নয় আলেয়া। তোর আর জীবনের মাঝে যে অনেক ব্যবধান।
আলো বলল, তা কেমন মা?
: জীবন অতি শান্ত প্রকৃতির ছেলে। জ্ঞানের দিক থেকে তার মতো ছেলে কমই হয়। আর যে যেমন তার জন্য তেমনই জোটাতে হয়। তাছাড়া ওর বাবা-মা’র এতো সকালে এমন কোন ইচ্ছা আছে বলে আমার জানা নেই। ছেলে মানুষ। পড়া-লেখা শেষ করবে, চাকরি নেবে, তারপর হয়তো ভাববে তার বাবা-মা এবং সেও।
: কিন্তু জীবন ভাই কি এখনই ভাবছে না?
: ও কি ভাবছে, কিভাবে ভাবছে তা বুঝে ওঠা সত্যিই দুস্কর। তবে ও ভুল করার মতো ছেলেও নয়; ওর ছোট্র অতীত তাই বলে।
: তবে মা তুমি কি চাও তোমার ভাইয়ের ছেলে অপূর্বাকে নিয়ে ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন দেখুক?
আলোর মা কিছুটা রেগে ওঠলেন আলোর ওপর। বললেন, সেটাও সম্ভবের বাহিরে। হয়তো ভুল করে সে ক্ষণিকের মোহে মরিচিকার পেছনে ছুটছে আর মরিচিকা ছুটছে খাঁটি বস্তুটির দিকে। কিন্তু এ ভুলের মধ্যেই যে সে ডুবে থাকবে তা ভাবাটাও ঠিক হবে না আলেয়া।
মায়ের কথা থেকে আলো তার রেগে ওঠা তেমন বুঝতে না পারলেও যখন দেখল তিনি কথা শেষ করে আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে উঠে গেলেন, তখন আর বুঝতে অসুবিধা হলো না। তখন আলোর বোধদয় হল যে, মায়ের সাথে এভাবে এতো খোলামেলাভাবে কথাটা বলা তিনি মেনে নিলেও তা যে সহজের নয় তা তার উঠে যাওয়া থেকেই স্পষ্ট। কিছুক্ষণ মৌন থেকে সে রান্না ঘরে গিয়ে মায়ের সাথে কাজে যোগ দিল তাকে কিছুটা হালকা করার জন্য।
আলো রান্না ঘরে মায়ের পাশে বসে আরেকটা বটি নিয়ে তরকারি কুটতে লাগল। মনে তার ভেসে ওঠে জীবনকে নিয়ে নানা কল্পনা, নানা অতীত। আর মাঝে মাঝে সে চোখ তুলে তাকায় মায়ের মুখের দিকে। হঠাৎ একবার চোখাচোখি হয় দু’ জনে। মা বললেন, কিছু বলবি মনে হয়- বলেই তিনি আবার তরকারি কুটতে লাগলেন।
আলো বলল, মা, জীবন আর আমার মাঝে বিদ্যমান ব্যবধানটা কি অনতিক্রম্য?
আলোর মা’র ক্রোধের যেন বাঁধ ভাঙ্গল। “লেখাপড়া শিখে কি লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছিস?…’’ ইত্যাদি বলে তিনি ইচ্ছা মতো বকলেন আলেয়াকে।
আবেগ আলোয়াকে ঘিরে আছে বহুক্ষণ থেকে। নইলে মাকে কিছুটা হালকা করতে গিয়ে তা কেন ক্রোধের কারণ হয়ে উঠবে ওই আবেগ প্রবণ একটি কথা বলে। তরকারি কুটা শেষ না হতেই সে উঠে এসে বসল তার রুমের চেয়ারে। চোখ দু’টি তার পানিতে ছলছল করে ওঠলো। দু’ ফোটা গড়িয়েও পড়ল নিচের দিকে।
ঠিক পরদিন জীবন বাসায় এলো। ফুফুর সাথে কথা শেষ করে সে আলোর রুমে বিছানার ওপর পা তুলে বসল। আলো বসলো পড়ার টেবিলের সামনে। চেয়ারটা ঘুরিয়ে সে জীবনের দিকে মুখ করে বসা। কুশলাদি বিনিময় পর্বটা পূর্বেই হয়ে গেছে। জীবন অপূর্বার কথা জিজ্ঞেস করতেই আলো বলল, জীবন ভাই, ওর জীবনে আপনি এখন শুধুই অতীত। বিশ্বাস করা বা না করা দু’টিই আপনার ব্যাপার।
কয়েকদিন আগেও জীবন যখন এসেছিল আলোদের বাসায়, তখন অপূর্বা সম্পর্কে জীবনের এক প্রশ্নের জবাবে আলো বলেছিল, অপূর্বা এ মুহূর্তে তার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে চায় না। একাকীই থাকতে চায় সে আপাতত। অপূর্বার এমন জবাব জীবন হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, অপূর্বা ছাড়া যদি জীবন বাঁচতে না পারে, জীবন ছাড়া অপূর্বা বাঁচে কেমন করে? আলো বলেছিল, বাঁচা না বাঁচা আপনাদের ব্যাপার… ইত্যাদি।
কিন্তু আজকের কথাটি জীবন বিশ্বাস না করে পারল না যখন অপূর্বার টেবিলের ওপর দেয়ালে লাগানো সেই পংক্তিগুলো অক্ষত অবস্থায় জীবনের দিকে বাড়িয়ে দিল কথাটি বলতে বলতে। জীবন হাত বাড়িয়ে সেই পংক্তিগুলো নিতেই যেন চমকে ওঠল। বুকের ভেতর তার একটা সশব্দ কাল বোশেখি বইতে শুরু করল। ভাল করে দেখে নেয় সে সেই কাগজটি। সত্যিই তাই! জীবনের মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না। সে আলোকে লক্ষ্য করে কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু বলতে পারে না। আলো বুঝতে পারে। সে ভাবতে থাকে কিভাবে সে এ মুহূর্তে জীবনকে বলবে অপূর্বার জীবনে আসা দ্বিতীয় ছেলেটির কথা। ভেবে এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় এই মুহূর্তে না বলার। বেশ কিছু সময় উভয়ে নীরব থাকার পর জীবন আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলে, এ কি করে সম্ভব আলো! জীবনে এই প্রথম অংক কষে ফল মিলালাম। ভাবলাম ভুল হতে পারার ধারণাটাই ভুল হবে।
আলো কোন কথা বলে না। সে বুঝতে পারে জীবনের প্রতিটি রক্ত কণিকায় মিশে আছে অপূর্বা। এ সহজে ঝেড়ে ফেলার মতো নয় । এ আঘাত তাকে কতটা আহত করতে পারে তা অননুমেয় নয়। কিন্তুু নিজের এ বোধশক্তির কাছে হার মানে সে। অপূর্বা যেমনি করে বিরাজমান জীবনের মাঝে, তেমনি করে যে আলোর মাঝেও বিরাজমান জীবন।
জীবনের ভালবাসায় ছিল না কোন খাঁদ। তাই কষ্টের বিষাক্ত তীরটাও তার মস্তিস্কে বিদ্ধ হয় সবেগে। বিদ্ধ হওয়া এ বিষাক্ত তীরের যন্ত্রণা জীবনের জীবন প্রবাহ কোনদিকে বেঁকে নিয়ে যায় তা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারে। প্রাপ্ত বয়সে সুচিন্তিত প্রেম বলেই জীবনের মাঝে আবেগও ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু এতদিন তা ছিল সু-নিয়ন্ত্রিত। আজ যেন তা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এলোমেলো পথে গতি নিতে শুরু করেছে শুধুমাত্র তার লেখা আর অপূর্বার সাজানো সেই পঙক্তিগুলো হাতে পেয়ে। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে সে আলোকে বলে, অপূর্বার কাছে যদি আমি অতীত হই তাহলে বর্র্তমানটা তুই আমাকে খুলে বল।
আলো চুপ থাকে। জীবন পুনরায় তাকে অনুরোধ করলে সে আরো কিছুটা সময় চুপ থেকে তারপর বলল, আমাদের ক্লাশ শুরু হল কিছুদিন হল। সপ্তাহখানেক  পূর্বে আমি আর আপূর্বা যখন ক্লাস শেষে বের হলাম, দেখলাম অপরিচিত অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে একটি ছেলে যে আমাদের পথ আগলে দাঁড়াল। নতুন ক্লাস, নতুন ক্যাম্পাস। সর্বোপরি সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশ। এমন পরিবেশে মদ্যপ, মাতাল, রক্ত ওঠা চোখ নিয়ে একটা ছেলে আমাদের সমনে দাঁড়ালে আমাদের যে কি করার আছে তা আমরা ভেবে পাচ্ছিলাম না। বরং ভড়কে গেলাম আমরা। সে বলল, অপূর্বাকে সে পছন্দ করে। জানা নেই, শোনা নেই অথচ সে বলছে এমন কথা। আমরা ধরে নিয়েছি সে একটা বিকৃত মস্তিষ্কের লোক। শেষে কোন কথা না বলে আমরা পাশ কেটে চলে আসি।
পরদিন ক্যাম্পাস থেকে বের হবার পথে গেটে দেখলাম তাকে। কিন্তু কিছু বলল না। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা একটা রিক্সা নিলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখি আমাদের সামনে একটি রিক্সা এসে থেমেছে। আমাদের ড্রাইভার রিক্সা না থামিয়ে পারল না। আমরা দু’ জনেই রিক্সাতে বসা। ছেলেটি পকেট থেকে একটি গোলাপের কলি বের করে অপূর্বার হাতে দিয়ে  বলল, এটি আপনার জন্য।
তারপর সে রিক্সায় উঠে চলে গেল। পরদিন আমরা খোঁজ নিয়ে জানলাম ছেলেটিও আমাদের সাথে ভর্তি হয়েছে অন্য ডিপার্টমেন্টে। ইন্টার পাশ করেছে এ কলেজ থেকেই। দ্বিতীয় বর্ষে থাকা অবস্থাতেই সে বখে যায় সঙ্গ দোষে। তার পদচারণা শুরু হয় অন্ধকার জগতেও। সরকারী কলেজ বলে যে যে যার যার মত করে চলে। ছাত্র-শিক্ষক কেউই কারো ব্যাপারে প্রয়োজন ছাড়া নাক গলাতে চায় না। ছেলেটির এমন আচরণ অব্যাহত থাকে। কিন্তু ছেলেটিকে তেমন ক্ষতিকর মনে হয়নি অপূর্বার কাছে। তাই অপূর্বা ছেলেটিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। গতকাল অপূর্বা আমার হাতে আপনার লেখা এই কবিতাটি দিয়ে বলল আপনাকে দিতে আর বলার জন্য ওকে ক্ষমা করতে। আমাকে লক্ষ্য করে বলল, তোর সাথে আমার একটা দুরত্ব তৈরী হয়ে গেল আমার নতুন অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে- এই বলে সে চলে গেল। আমি ওকে ডাকলাম। কিন্তু সে পেছনে একটিবারের জন্যও তাকালোনা। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। আজও ক্লাশে এসেছে সে। দায়সারা গোছের একটু কথা বললেও বসেছে আলাদা বেঞ্চে। ভীষণ কষ্ট হল আমার। যার সাথে এতগুলো সময় কাটালাম, সে আজ সরে গেল দূরে। – কথাগুলো বলতে বলতে আলোর কণ্ঠ যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। তাকিয়ে দেখে জীবনের চোখে পানি টলমল করছে। পানি টলমল চোখ নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান হলো জীবনের।
রোকনের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পেছনে প্রথম দিকে অপূর্বার ইচ্ছার ঘাটতি থাকলেও দিন যতই গড়াতে লাগল ততই সে ঘাটতি পূরণ হতে থাকে। কিন্তু অতীত স্মৃতি তাকে মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে যায়। আর সেটুকু এড়াতে একসময় রোকনের প্রতি তার ভালবাসার অপূর্ণ অংশও পরিপূর্ণ করে নেয় সে। ক্যাম্পাসে একত্রে হাঁটা-চলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র পর্যন্ত দুই জনের পদাঙ্ক অঙ্কিত হয় পাশাপাশি। তার সমগ্র সত্তা জুড়ে এখন শুধু রোকনের আবাস। শুধু মাঝে মাঝে একটু আধটু মনে পড়ে জীবনকে। তাও স্বাদহীন অন্য দু’ দশটি স্মৃতির মতো। কিন্তু দিন দিন হতাশা চেপে ধরে জীবনকে। সে হতাশা থেকে মুক্তি পেতে চায়। কিভাবে মিলতে পারে এ মুক্তি আমি’র কাছে জানতে চায় সে। আমি বলে, ঘটে যাওয়া অতীতকে অস্বীকার করতে। জীবন বলে, আমার প্রেমকে তুই এতোই মূল্যহীন ভাবছিস যে আমি সেটি ভুলে যেতে পারি?
: তাহলে জোর করে আদায় করে নে – ভ্রু কুঁচকে বলে আমি।
: সে তো দেহ, মন নয়। সোনালী ডিম ধারণ করা নীড়কে মূল্যবান স্থানে রাখা গেলেও মূল জিনিসটি দখল না নিয়ে কোন লাভ নেইরে আমি। বলতে বলতে দাঁড়ায় সে, আর হাসে। হাসতে হাসতে সে চলে যায়। আমি’র কাছে সেই হাসি কেমন যেন মনে হয়।
আমি’র প্রকৃত নাম আমির আলী। অতি হেয়ালী স্বভাবের সে। যখন যা মন চায় তখন সে তাই করে। অন্যদের তুলনায় আলাদা কিসিমের বলে অন্যরা তার নামে কিছুটা ভিন্নতা এনে তাকে আমি বলে ডাকে।
আজ হঠাৎ আলোদের ক্যাম্পাসে আগমন জীবনের। ইন ছাড়া শার্ট পরা তার। শেভ হয়নি সপ্তাহ খানেক হল। শরীরটাও ভেঙ্গেছে কিছুটা। মুখের হাসিটা উবে গেছে এরও আগে। ক্লাস শেষে শহীদ মিনারের কোলে জীবনকে বসে থাকতে দেখে আলো স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা দ্রুত গতিতে হেঁটে আসে তার দিকে।
: কেমন আছেন জীবন ভাই? এখানে কেন? বাসায় চলেন।
: বেশ ভাল আছি। এখানে এসেছি প্রাণের খোঁজে।
: চলেন, বাসায় কথা হবে। আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। – এই বলে সে জীবনের হাত ধরে তাকে বসা থেকে টেনে তুলল। জীবন দাঁড়াল। বলল, আমার ভেতর যে আগুনের লেলিহান শিখা। এ শিখা শব্দ রূপে নিঃসৃত হবার পর হৃদয় পোড়াতে পারে। তার চেয়ে বরং এখানেই বসি।
আলো বললো, আজ সবাই কাকার বাসায় গেছে। আসবেন সন্ধ্যায়। আমি বাসায় তালা লাগিয়ে এসেছি, চলেন।
আলো হাঁটতে শুরু করল। শেষে পেছন পেছন অগ্রসর হতে লাগল জীবনও।
তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে আলোর রুমে গিয়ে বসল দু’ জনে। একটু পরেই আলো ওঠল। জানালার পর্দাগুলো তুলে দিয়ে অন্য রুমে গেল সে। অল্প সময়ের মধ্যেই মিষ্টি আর কোমল পানীয় নিয়ে এলো ফ্রিজ থেকে । একটি রসগোল্লা নিজে কাটা চামচ দিয়ে তুলে নিয়ে প্লেটটা এগিয়ে দিল জীবনের দিকে। সেও নিল। আলো নিজ থেকেই বলল, আজ অপূর্বাকে ক্লাসের শুরুর দিকটায় দেখেছি, শেষের দিকটায় দেখিনি।
আলোর কথা শেষ হতেই জীবন বলল, কেমন আছে সে ?
: ভাল। খুব ভাল।
অবুঝ শিশুর মতো জীবন বলল, আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করে?
আলো এ কথার কোন জবাব না দিয়ে বলল, রোকন আর অপূর্বার সম্পর্কটা এখন খুবই চমৎকার। অনেক ছেলে-মেয়ের কাছে রীতিমতো ঈর্ষণীয়। মানুষ বলে, অভ্যাস নাকি বদলানো যায় না। কিন্তু রোকন তা পেরেছে। আমাদের অনেকের সাথে ওর মাঝে মধ্যে কথা হয়। ওকে বন্ধু হিসেবে আমাদের মোটামুটি ভাল লাগে।
কথাগুলো আলো চমৎকারভাবে বলে গেলেও জীবনের ভেতরটা যেন ভেঙ্গে-চুরে একাকার হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় চুপ থেকে তারপর সে বলল, তুই আমাকে একটা কাজ করে দিতে পারবি আলো?
: সম্ভবের মধ্যে হলে কেন দেব না, অবশ্যই দেব।
: আমাদের দূরত্বটা তুই দূর করে দিবি। পারবি না?
: এটি এখন আর কিছুতেই সম্ভব নয় জীবন ভাই। হাঁড়ি একবার ভাঙলে সেটা কি জোড়া নেয়? নেয় না। নিলেও আগের মতো কাজ হয় না।
আলোর কথাটা জীবনের তোলপাড় করা বুকের ভেতরটায় কষ্টের ঢেউ বইয়ে দিয়ে পড়ো পড়ো আশার তীরটা যেন বেশ কিছু দূর ভেঙ্গে দিল। সেই ঢেউ বুক ভেদ করে ভাসিয়ে দিল পুরো চোখের জমিন। টস্টস্ করে পানি পড়তে থাকে। জীবন মাথাটা নিচুই করে রাখে। চোখ দু’টি তার রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। আলো জীবনের পাশে গিয়ে বসে। জীবনের এমন অবস্থা দেখে ওর চোখ দু’টিও ঝাপসা হয়ে আসে পানিতে। কিন্তু বাঁধ ভাঙ্গে না। দু’ হাতে জীবনের মাথাটা তুলে ওর চোখে তাকিয়ে বলল, আমি কি পারি না অপূর্বার শূন্য স্থানটা পূরণ করতে?
জীবন নিজেকে সামলে নিয়ে ভেজা চোখে বলল, সে তো মিথ্যে শান্ত্বনা। তাছাড়া…।
জীবনের কথা শেষ না হতেই আলো বলল, এ মিথ্যে শান্ত্বনা নয় জীবন ভাই। এ আমার বুকের ভেতর এতোকাল জমে থাকা স্বপ্নের প্রকাশ।
: সম্ভব নয় আলো। অপূর্বা মিশে আছে আমার রক্তের প্রতিটি কণায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে। দেহের সব রক্ত ফেলে দিয়ে কি নতুন করে প্রবেশ করানো যায় আলো? যায় না। তার পূর্বেই মৃত্যু ঘটে মানুষটির।
জীবন উঠে চলল বাসার উদ্দেশ্যে। আলোর কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করাটা যে অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই হবে না, তা সে অনুমান করে নেয়।
শান্ত চাচার দোকানটায় দু’ চারজন কাস্টমার দেখা যাচ্ছে। জীবন বাহির থেকে তাকিয়ে দেখে। ওদের কাউকে তার পরিচিত মনে না হওয়ায় দোকানে ঢুকে সে। একটা চা আর একটা সিগারেট দিতে বলে ছোট্ট ছেলেটাকে। ওর নাম রাজা। রাজা সিগারেট আর চা দিয়ে যায়। সঙ্গে একটা দেশলাইয়ের বক্স। কয়েক চুমুক চা খাওয়ার পর সিগারেটটা ধরায় সে। ধোঁয়াটা ভেতরে নিতেই তালুতে উঠে যায়। সঙ্গে সঙ্গে কাশতে শুরু করে। শান্ত চাচা এগিয়ে আসেন। এক গ্লাস পানি ঢেলে দিয়ে হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে চায়ের প্লেটে রেখে বললেন, যেটা যার কাজ না, তাকে সেটা করতে যাওয়াও ঠিক না। রাজা এক কাপ দুধ দিয়ে যা, সরসহ। পানিটুকু খেয়ে নাও।
রাজা দুধ নিয়ে এল। জীবন বলল, এখন খাব না চাচা উঠি।
: উঠবা কেন বাবা, আরেকটু বসো। আজকের গরুর দুধটা কিন্তু খুব ভালো।
: না চাচা, খাবো না।
: তাহলে ছাগলেরটা দেই?
জীবন মাথা নাড়ল। না বোধক জবাব পেলেন শান্ত চাচা।
: তোমার হইছে কি জীবন? দিন দিন ঘাটি যাইতেছ। ক্যামন ক্যামন যেন মনে হয় তোমারে। কারণডা কি খুইলা কওন যাইবো?
জীবন কোন জবাব না দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, যাই চাচা। এই নেন টাকাটা – বলেই সে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে হাঁটতে লাগল। পেছন থেকে রাজা ডাক দিয়ে বলল, সিগারেটটা নিয়া গেলেন না?
জীবন শোনেও না শোনার ভান করে বেরিয়ে গেল। রাজা টেবিলটা মুছতে লাগল। শান্ত চাচা চিন্তিত চোখে জীবনের চলে যাওয়া দেখে মনে মনে বলল, জীবনটার কি থেকে কি হলো, সামনেইবা কি হয় কে জানে! আহ্! – একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শান্ত চাচা।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠল। বালিশের কোলে মাথা রাখা জীবন শত চেষ্টা করেও চোখের পাতা মিলাতে পারে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময় শোয়া থেকে উঠে বসে। কিছু সময় গম্ভীর হয়ে বসে থাকার পর লাইটটা জ্বালিয়ে টেবিলে গিয়ে বসে। অপূর্বাকে একখানা চিঠি লিখবে বলে মনস্থির করে। রাইটিং প্যাড নেই বলে লিখবার খাতা থেকে দু’টি পাতা ছিঁড়ে নেয়। তারপর কলমটা খুলে বসে। কিন্তু লেখা হচ্ছে না এক কলমও। লিখবার কথাগুলো ভেতরেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লিখবার ইচ্ছাতে ঘাটতি নেই তার। ভেতরের অব্যক্ত ভাষাগুলো তাকে কষ্টে অস্থির করে তোলে। বুক যেন তার ফেটে যেতে চায়। চোখ ভরে ওঠে পানিতে। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখে লিখবার পাতাগুলোর অনেকটা ভিজে গেছে চোখের পানিতে। কলমটা হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে বাতিটা নিভিয়ে আবার মাথা ঠেকায় বালিশের গায়। কষ্ট যেন তাকে আরো চেপে ধরে। ঠোঁট কামড়ে এবার সে কষ্টের দাপাদাপি ঠেকাতে নিজেই চেপে ধরে নিজের বুক। তার কাছে মনে হয়, তার চোখ থেকে অশ্র“ ঝরার সাথে সাথে বাইরে ডাল ছড়ানো আম্র বৃক্ষটি থেকেও ঝরে পড়ছে পাতা। সেই পত্র পতন শব্দ তিমির রাতের নীরবতা ভেঙ্গে ঝন্ঝন্ শব্দে তার কানে এসে বাজে। আবার শোনতে পায় সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত নারকেল বৃক্ষের পাতার ঝন্ঝন্ শব্দ থেকে শান্ত্বনার বাণী – ‘ঘুমিয়ে পড় জীবন…।’
গভীর রাতের নিস্তব্দতায় নদী যেমন কলকল শব্দে বয়ে চলে স্বচ্ছ জলের ধারায়, তেমনি করে শান্ত্বনার বাণী শোনতে শোনতে চোখের নদীর অশ্র“ধারা বইয়ে দিতে দিতে নিজের অজান্তে কখন যে চোখ দু’টি তার বুঁজে আসে তা সে নিজেই জানে না।
ভোর হল। মসজিদে ফজরের আজান হল বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে। মা নামাজ শেষ করে জীবনের ঘরে এসে বাতিটা জ্বালালেন। দেখলেন জীবন গভীর নিন্দ্রায় আচ্ছন্ন। টেবিলের উপর দৃষ্টি পড়তেই এগিয়ে এলেন। দেখলেন, সাদা পৃষ্ঠাগুলোর কিছু অংশ পানিতে ভিজে তারপর শুকিয়ে কিছুটা বেঁকে-কুঁকে আছে। তিনি এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা না করে বতিটা নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
দিনটা বেশ আলোকউজ্জ্বল। ফুরফুরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে সেই সকাল থেকেই। সূর্যটা হেলে আছে পশ্চিমাকাশে। আজ আলো কলেজে থাকতেই জীবন তাদের বাসায় যায়। ফুফুর সাথে কথা বলে এক ফাঁকে আলোর পার্সোনাল ডায়েরী থেকে অপূর্বার বাসার ফোন নাম্বারটি নিয়ে নেয় সে। ওর নিজের কাছেও ছিল নাম্বারটি। ইনডেক্সটি হারিয়ে গেছে বেশ কিছুদিন পূর্বে। জীবন দোকান থেকে ডায়াল করে। রিসিভার তোলে কাজের মেয়েটি। বিপরীত পাশ থেকে কণ্ঠ শুনেই জীবন বুঝতে পারে এ অপূর্বার কণ্ঠ নয়, নয় তার মায়ের কণ্ঠও। পরিচয় জানতে চাইলে জবাব আসে-
: জরিনা।
: আমি অপূূর্বাকে চাইছি।
: আপনার নাম কি?
: জীবন।
: জরিনা রিসিভারটা রেখে অপূর্বাকে বলল। অপূর্বা বেশ আগ্রহ নিয়ে তড়িৎ এলো ফোন সেটের কাছে। ক্ষণিকের জন্য যেন সে ভুলে গিয়েছে জীবনের সাথে তার সম্পর্কের মাটি চাপার কথা। একটু থেমে তারপর যেন স্মরণে এলো বিষয়টি। ধীরে হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিয়ে বলে-
: কেমন আছ?
: খোদার পর যেমন রেখেছ। তুমি?
অপূর্বা কোন জবাব দেয় না। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবনের মুখখানি বেদনার এক প্রতীক রূপে। মনে পড়ে অতীতের কিছু খন্ড স্মৃতি। নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। খুবই খারাপ লাগে।
: চুপ করে আছো যে অপূর্বা?
অপূর্বার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে জীবন বলে, আলোর কাছ থেকে অনেক কথা শুনেছি। তোমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে। কখন কোথায় সেটা তোমার ইচ্ছা! এই ‘অপরাধী’ যদি কোন ‘অপরাধ’ করে থাকে তাহলে সে তা জ্ঞাত হতে চায়, নিজেকে শুধরে নিয়ে মুক্ত বাতাসে দু’ হাত ছড়িয়ে তারপর জড়িয়ে নিতে চায় তার স্বপ্নকে, স্বর্নালী ভবিষ্যতকে। আমি যে আর সইতে পারি না অপূর্বা! কিছু বলো, চুপ করে থেকো না! – বলতে বলতে জীবনের চোখের কোণে অশ্র“ জমে ওঠে। ওপাশ থেকে শোনতে পায়, ‘এই অপরাধীকে ক্ষমা কর জীবন। আমি অতীতকে ভুলবার চেষ্টা করছি। যদি তুমি একটি মুহূর্তের জন্যও আমাকে ভালোবেসে থাক, তাহলে সেই দাবী নিয়েই বলছি, তুমিও আমার মতো অতীতকে ভুলে যাও জীবন।’
জীবন চোখের সামনে দেখতে পেল বিশাল আকাশ দু’ পাশে ভেঙ্গে পড়ছে আর তার অন্তরালে থাকা নিকশ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে জগৎটাকে।
রিসিভারটি রেখে দিয়ে অপূর্বা নিজের রুমে গিয়ে বসে থাকে আর নিজের অজান্তেই তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে  পড়ে ক’ ফোটা অশ্র“।
জীবন ফোনের দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ল। বুকের ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনকে নেভাতে সে রিক্সা নিয়ে রওনা হয় বারের দিকে।

ছয় মাস পর।

নিজ ব্যাংক একাউন্টে টিউশনি বাবদ যা কিছু টাকা জমিয়েছিল জীবন তার পুরোটাই সে নিঃশেষ করেছে মদের বোতলের পেছনে। এখন বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার করে চালিয়ে যাচ্ছে সেই কাজ। মায়ের কাছ থেকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন কাজের কথা বলে কিছু কিছু টাকা নিতো আর তাও ঢালতো মদের পেয়ালায়। এখন মা তেমন একটা দেন না তার কানে আশপাশ থেকে নানা কথা যেতে শুরু করার পর।
চেহারায় মদ গ্রহণের আভাস স্পষ্ট। একে একে সব টিউশনি গেল। একটা মদ্যপ ছেলেকে জেনে-শোনে কে-বা রাখে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে। চোখ দুটো ফোলা ফোলা। শেইভ করে অনিয়মিত। সে কারণে মুখ ভর্তি থাকে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে। চলা ফেরা নিয়ম-নীতিহীন। তার আগেরকার প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই এখন নিঃশেষ হওয়ার পথে। তবে হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া জীবন মাঝে মাঝে আশায় বুক বাঁধে এই ভেবে যে, অপূর্বার সাথে যদি তার ব্যবধান চুকে আসে, তাহলে সে এমন জীবন ত্যাগ করে অতীত জীবনকে গ্রহণ করবে পুনরায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই যে সে গিয়ে পৌঁছেছে রসাতলে, দেহের ভেতরটা নষ্ট হবার আর যে তেমন একটা অবশিষ্ট নেই, সেই বিষয়ে সে তেমন একটা ওয়াকিবহালও নয়। হবেই বা কেমন করে। মা কয়েক দিন বলেছে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু সে রাজী হল না। সব বয়সে সন্তানের ওপর প্রভাব খাটানো যায় না – এসে পড়ে স্বেচ্ছা সায়ের বিষয়টি। এ ক্ষেত্রেও হয়েছে তেমনটি। তাই মায়ের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার চেষ্টার ফলাফল হয় শূন্য।
মন যেখানে ছুটে যায়, দেহও ছুটে যেতে চায় সেখানে। এ স্রষ্টা প্রদত্ত প্রাণী মাত্রেরই বৈশিষ্ট্য। কেউ এ নিয়মকে উপেক্ষা করতে পারে না যদিও সে কখনো কখনো তদস্থানে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে শারীরিক উপস্থিতি ঘটাতে না পারে। সেখানেও কথা থেকে যায়। কল্পনার জাল ছড়িয়ে দিয়ে সে স্থানে গিয়ে বর্তমান হয় সে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম নয় জীবনও। অপূর্বার কথা যখনই মনে পড়ে, তখনই ছুটে যেতে চায় তার কাছে। কিন্তু সেই চাওয়া পর্যবসিত হয় ব্যর্থতায়। তৃষ্ণার্ত কাক যেমন পানির সন্ধান না পেলে ছটফট করতে থাকে, বুকটা শুকিয়ে হয় চৌচির; অপূর্বাকে না দেখার তৃষ্ণায় মাঝে মাঝে জীবনের অবস্থাও হয় তাই। আর সেই তৃষ্ণা মেটাতেই সে মাস তিনেক পূর্বে অপূর্বাদের ক্যাম্পাসে গিয়েছিল। কিন্তু তৃষ্ণার্ত তৃষ্ণা নিয়েই ফিরে এল।
আবার গেল তারও মাসখানেক পর। ক্লাস শেষে মাঠের পাশ দিয়ে পথ ধরে হাঁটছিল অপূর্বা। পাশ থেকে ডাক এলো, অপূর্বা একটু দাঁড়াবে?
অপূর্বা পাশে তাকায়। প্রথমে চিনে উঠতে সমস্যা হচ্ছিল। তবে তা কাটিয়ে ওঠতে সময়ও তেমন একটা লাগেনি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এলোমেলো চুল আর স্বাস্থ্যের যে অবস্থা হয়েছে তাতে চিনতে একটু সমস্যা হওয়ারই কথা। একটু এগিয়ে দু’ জনে একটা ঝাউ গাছের নিচে দাঁড়াল। জীবন জিজ্ঞেস করল,  কেমন আছ?
: আমার কথা থাক। এ কী অবস্থা হয়েছে আপনার!
: আমি বেশ ভাল আছি। কিন্তু তোমার কথা থাকবে কেন?
অপূর্বা জবাব এড়িয়ে বলল, এই যদি হয় বেশ ভালো থাকা, মন্দ থাকাকে তাহলে কি বলবেন?
জীবন এ কথার জবাব না দিয়ে বলল, তোমাকে দেখি না কতদিন হল! না দেখার যন্ত্রণা আর সইতে পারছিলাম না অপূর্বা! আরেকদিন এসেছিলাম। আজও যদি সেদিনের মতো দেখা না হতো, তাহলে হয়তো উন্মাদ হয়ে যেতাম। কিন্তু তোমারও যে শরীর-মন কোনটাই ভাল নেই, তা বেশ করে বুঝা যাচ্ছে। হয়েছে কি শুনি?
জীবনের কথায় অপূর্বার মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠতে চাইল। কিন্তু মনটাকে কিছুটা শক্ত করে নিল। তার পূর্বেই চোখ টলমল করে ওঠল পানিতে। সেই পানি আঙ্গুলের পিঠ দিয়ে মুছতে না মুছতেই রোকন এসে উপস্থিত।
: তুমি এখানে, আর আমি খুঁজে খুঁজে…। কথা শেষ না করেই অপূর্বা আর জীবনের দিকে তাকাল রোকন। বলল, ছেলেটা কে অপূর্বা?
জিজ্ঞাসার ধরণটা ভালো মনে হলো না অপূর্বার। তবুও একটু সময় নিয়ে সে জবাব দিল, জীবন ভাই।
রোকন জীবন সম্পর্কে পূর্বেই জেনেছে অপূর্বার কাছ থেকে। ফলে চিনতে তার বিলম্ব হলো না। জীবনকে উদ্দ্যেশ্য করে রোকন বলল, এখনতো দেখছি পুরোপুরিই পাগল হয়ে গেছে। লোকালয় ছেড়ে বনবাসে চলে গেলেইতো হয়। যুগে যুগে এই পাগলরা বুঝি থেকেই গেল।
কথাটা যেন জীবনের চাইতে অপূর্বার গায়েই বেশি লাগল। তাই প্রতিক্রিয়ারও দেরি হলো না।
: উনি যে তোমার চেয়ে বয়সে সিনিয়র তা তোমার অজানা নয়। পুরোপুরি না পারো ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধটুকু নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করো। নিজের মতো দেহের মাপকাঠিতে সবাইকে বিচার করো না। তুমি যা বলেছো, সেটি যদি উনি হয়েই থাকেন, তা উনি হয়েছেন অর্জিত অধিকার হারিয়ে। আর তুমি কি এখনই ভুলে গেলে যে, অধিকার জন্মানোর পূর্বেই তুমিও একদিন এমনটি হতে বসেছিলে?
রোকন আর অপূর্বার মধ্যে তর্ক চলতে থাকল। অপূর্বার কয়েকজন বান্ধবীও একে একে এসে জড়ো হয়েছে। এরা আলোরও বান্ধবী। আলো আজ ক্লাসে আসেনি। জীবন এখানে বিলম্ব করাটাকে সমীচিন মনে করলো না। তার চলে যাওয়ার সময় বান্ধবীদের মধ্যে দু’ জন একে অপরকে বলল, জীবন ভাই না?
: হ্যাঁ। কী মানুষ কী হয়েছে!
এ ঘটনার পর থেকে অপূর্বা রোকনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। আগে মাঝে মাঝে বোরকা ব্যবহার করলেও কয়েকদিন থেকে নিয়মিতই তা ব্যবহার করছে সে। অপূর্বার এই এড়িয়ে চলাকে রোকন সহজে মেনে নিতে পারছিল না। এ নিয়েও তাদের মধ্যে একদিন তর্ক-বিতর্ক হয় পথ চলতে চলতে। তখন সোয়া তিনটার মতো বাজে। ক্যাম্পাসের অদূরে প্রেক্ষাগৃহটির সামনে যখন পৌঁছল, তখন তাদের তর্ক-বিতর্কের ঝড় আরো কিছুটা গতি নিয়ে বইতে শুরু করল। রোকন উত্তেজিত হয়ে উঠল। উত্তেজিত হলে একজন মানুষ যেমন হিতায়িত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে, ঘটিয়ে বসে অবিবেচকের মতো কান্ড – এ ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। উত্তেজনার বশে সে অপূর্বার স্কার্ফটা টান দিয়ে খুলে ফেলল। ফলে অপূর্বাও উত্তেজিত হলো আগের তুলনায় আরো কিছুটা। আর তখনি রোকন একটা চড় বসালো অপূর্বার গালে। অপূর্বা চিৎকার করে উঠলো। আশপাশ থেকে এবং প্রেক্ষাগৃহ হতে বেরিয়ে আসতে থাকা লোকজন ছুটে এসে প্রহার শুরু করল রোকনকে। কেউ বলল, ওরে আমি চিনি। শালা মাস্তান। আবার কেউ কেউ বলল, কত্তোবড় সাহস, রাস্তা-ঘাটে মাইয়া মানুষের বোরকা টাইন্যা খুইল্যা ফালায়। মার ইচ্ছা মতন।
এভাবে চলল কিছুক্ষণ। কেউ শুনতে চাইলো না তার কথা। অপূর্বাও চেষ্টা করল লোকজনকে নিবৃত্ত করতে। কিছু সময় পর সমর্থ হল অপূর্বা। কিন্তু ততক্ষণে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। এর মধ্যে অতি উৎসাহী কিছু লোক চায়ের কাপ আর পিরিচও ভেঙ্গেছে তার মাথায়। অশ্র“সিক্ত নয়নে অপূর্বাই আবার তাকে নিয়ে রওনা হল হাসপাতালে। এ বাঙ্গালী নারীর ধর্ম। যাকে একবার ভালোবাসে, কাছে তো বটেই, দূরে থাকলেও তার জন্য প্রাণ কাঁদতে চায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে প্রায় এক ঘন্টা পর ডাক্তাররা তাকে ছেড়ে দেয়। দু’ জন একত্রে বেরিয়ে এল। অপূর্বা কোন কথা না বলে একটি রিক্সা নিয়ে বাসায় চলল। রোকন আরেকটি রিক্সা না পাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপূর্বার চলে যাওয়া প্রত্যক্ষ করল।
পরদিন ক্যাম্পাসে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু তাদের দু’ জনের কেউই ক্যাম্পাসে নেই।
সপ্তাহ খানেক পর উভয়কেই দেখা যাচ্ছে ক্যাম্পাসে। নাটকীয় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করল সবাই। আগের চাইতেও যেন শক্ত হয়েছে রোকন আর অপূর্বার সম্পর্কটা। তাদেরকে দেখে অনেকের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল যে এমন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু আসমার জিজ্ঞাসার জবাবে অপূর্বা সত্য প্রকাশে দ্বিধা করলো না। এতে কেউ কেউ রোকনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ব্যক্তিত্ব বলতে কিছুই নেই ওর। আবার কেউ কেউ বলল অন্য কথা, এটাই হলো সত্যিকারের প্রেম।
এই নাটকীয়তার কারণ অন্য সবারই অজানা। অপূর্বা কয়েকদিন ক্লাসে না এসে নিয়মিত ক্লাসের নাম করে বাসা থেকে বেরিয়ে রোকনের সাথে সাক্ষাৎ কর্মে নিয়োজিত থেকে রোকনকে একান্তই নিজের করে নিল। উভয়েই ঘুচিয়ে নিল তাদের মধ্যকার ব্যবধান। এর দুই দিন পর ক্লাসে এলো আলো। গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল সে। তারা ঢাকায় এসেছিল দুই দিন আগেই। ক্লাসে এসে জানতে পারল জীবন এসেছিল। জানলো সেদিনের ঘটনাটি। জীবনের প্রতি এমন অপমান সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল আলোর। চোখ তার ভেসে যাচ্ছিল পানিতে। ক্লাস চলাকালে পুরোটা সময় এমনিভাবে পার করল সে। অপূর্বা জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস? কোথায় ছিলি এই ক’ দিন?
: গিয়েছিলাম গ্রামে। শুনলাম জীবন ভাই এসেছিল তোর খোঁজে?
শুধু আলোর মুখটাই এতক্ষণ মলিন ছিল। অপূর্বার মুখে কিছু হাসি থাকলেও তা উবে গেছে এরই মধ্যে। মাথা নেড়ে আলোর কথার জবাব দিয়ে অপূর্বা বলল, দেখে খারাপ লাগল। কষ্ট হল খুব। সেই আগের মতো এখন নেই। কেমন যেন হয়ে গেছে। – বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অপূর্বা।
আলোর মেজাজটা চড়ে আছে। সে বলল, আর তোর খারাপ লাগল বলেই কি রোকন তাকে অপমান করল? তুই কি ছিলি না সাথে? জীবন ভাইকে কষ্টের ওপর কষ্ট বুকে নিয়ে ফিরে যেতে হল আর তুই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলি? আমার মামাতো ভাই তোকে ভালোবেসে এখন পাগল প্রায়। তুইওতো তাকে একদিন ভালোবেসেছিলি অথচ তোর সেই ভালোবাসার মানুষটি অপমানিত হয়ে গেল তোর কাছে এসে – এ তুই কিভাবে সহ্য করলি অপূর্বা, কিভাবে! – বলতে বলতে আলোর রাগ পড়ে গিয়ে চোখ ভরে এলো পানিতে। সে শব্দ করে কান্না করতে লাগল। অপূর্বা আলোকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখেও অশ্র“ধারা বইতে লাগল। এভাবে অতিবাহিত হল কিছুটা সময়।
অপূর্বা নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আলোকে বলল, কারো অপমান খোদা সহ্য করতে পারে না। তাই রোকনকেও অপমানিত হতে হয়েছে। সেটা তুই পরে জানতে পারবি। – অপূর্বা নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিয়ে কথাগুলো বলল। আলো শুধু শুনলো। কিন্তু এখনো সে নিজেকে স্বাভাবিক করে আনতে পারেনি। তার চোখে এখনো পানি। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, কাল রাত দশটা পর্যন্ত ছিলাম জীবন ভাইদের বাসায়। আব্বুসহ গিয়েছিলাম। তখনো বাসায় ফেরেনি। মামীর কাছ থেকে জানলাম, এখন কোন কোন রাতে বাসায় ফেরে না। টেবিলের ওপর বই পত্রে জমে আছে ধুলা-বালি। অথচ এই বই কিনা একদিন ছিল তার জীবনের একটা অংশ। চোখে-মুখে নাকি মাদকাসক্তের  চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আশেপাশের লোকজন নানা কথা বলে। খাবার-দাবারের কোন ঠিক নেই। কারো সাথে তেমন কোন কথাও বলে না। যতক্ষণ বাসায় থাকে চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। মামী শুধু নামাজ শেষে চোখের পানি ফেলেন। মামাতো তা-ও পারেন না। তিনি যেন দিন দিন কাঠ হয়ে যাচ্ছেন। জীবন ভাইয়ের এ অবস্থার জন্য শুধু কি তিনিই দায়ী? তুই আর আমিও কি দায়ী নই অপূর্বা, বল! – বলতে বলতে আলো ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে শুরু করল। জীবনের এমন অবস্থায় কষ্টে যেন তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। অপূর্বার চোখের কোণ বেয়েও অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে দুই হাত মুখের ওপর চেপে ধরে গড়িয়ে পড়তে থাকা অশ্র“কে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করল।
সাত মাস পর।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top