সকল মেনু

মুক্তিযোদ্ধা তালিকা আর কতবার পরিবর্তন হবে?

12

হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা: রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তন হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। এটা যেন একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সব সরকারই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির আড়ালে এই তালিকা প্রণয়ন করেছে। ফলে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি এ তালিকা। কবে এ তালিকার পরিবর্তন, সংযোজন-বিয়োজন বন্ধ হবে তা কেউ বলতে পারছেন না।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এখন কোন দল করেন সেটা দেখার বিষয় নয়।’

তিনি বলেন, ‘আজকে যে মুক্তিযোদ্ধা জামায়াত করেন তিনিও মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু আদর্শচ্যুত। কারণ একজন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করলে তার অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়া যায় কিন্তু সার্টিফিকেট বাতিল করা যায় না। কাজেই এবারের তালিকা আর পরিবর্তন করার প্রয়োজন হবে না। সঠিক তালিকা তৈরির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।’

৬ বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে, কিন্তু এবার পরিবর্তনটা খুব কম করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন এই মন্ত্রী।

এদিকে সরকারের তৈরি মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়  বলেন, ‘ওই তালিকা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শুধু তাই নয় যেসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে সুবিধা নিয়েছেন তা ফেরত আনা সম্ভব না হলেও তাদেরকে তালিকাভুক্ত করে শাস্তি দিতে হবে।’

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ৬ বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা পরিবর্তন, সংযোজন বিয়োজন হয়েছে। ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। একটি জাতীয় কমিটির আওতায় প্রায় দু’বছর কার্যক্রম চালিয়ে ১৯৮৬-৮৭ সালে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৪৫৮ জন। এটি জাতীয় তালিকা হিসেবে পরিচিত। তবে  এ তালিকাটি স্থগিত করা হয়েছে।

এ সম্পর্কে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বলেন, ‘এটা অগ্রহণযোগ্য। এ তালিকার মাধ্যমে ৩০ বছর আগে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা হয়েছিল। এটা স্থগিত করা মহাভুল। এতে অসম্মান করা হবে মুক্তিযোদ্ধাদের।’

দ্বিতীয়বার ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার আমিন আহমদ চৌধুরী বীর বিক্রম চট্টগ্রামের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার থেকে রেকর্ড সংগ্রহ করে ৬৯ হাজার ৮৩৩ মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা প্রণয়ন করেন। এ তালিকা পরে ৮ খণ্ড বই আকারে প্রকাশিত হয়। ভারতে প্রশিক্ষণকালীন মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই যে ফরম পূরণ করেছিলেন সেসব ফরম ভারতের সেনাবাহিনী সংরক্ষণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে ভারত সরকার এই ফরমগুলো সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে হস্তান্তর করে। এ তালিকাটি কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা হিসেবে পরিচিত।

তৃতীয়বার ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকার আমলে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তৎকালীন আহ্বায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আজম আমিনুল হক বীর উত্তম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি তালিকা প্রণয়ন করেন। ওই তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬ হাজার, যা ভোটার সূচক তালিকা হিসেবে পরিচিত।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চতুর্থবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন করা হয়। ওই তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন।

পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় গঠন, পরবর্তী মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সাদত হুসাইনকে আহ্বায়ক এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. মমতাজ উদ্দিনকে সদস্য সচিব করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি করে পঞ্চমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়। এ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। সেই সংখ্যা দেখে হতবাক হন অনেকেই।

ষষ্ঠবারের মতো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তবে এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করণ ও তালিকাভুক্ত অমুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জেলা, উপজেলা কমিটি গঠন নিয়ে চলছে নানা রকম লুকোচুরি।

আসলে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কত, কেন জতীয় তালিকা স্থগিত করা হলো? জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম  মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার। অর্থাৎ সব গেজেট মিলিয়ে লাল মুক্তি বার্তায় ১ লাখ ৫৩ হাজার, গত বিএনপি সরকারের আমলে ৪৪ হাজার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১১ হাজার।’

তিনি বলেন, ‘কোনো তালিকা পরিবর্তন, বাতিল বা স্থগিত করা হয়নি। শুধুমাত্র সংযোজন-বিয়োজন করা হচ্ছে। তবে আপনারা জানেন মাত্র কয়েকজন সচিবের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আসলে তা নয়, ৩ থেকে ৪ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়েছে।’

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিবন্ধনের জন্য সর্বমোট আবেদন পড়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ১৩৯ জন। এটা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করলে ৩০ থেকে ৪০ হাজারে দাঁড়াবে বলে জানান মন্ত্রী।

স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি জাতীয় তালিকা প্রণীত হয়নি? এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় তালিকা না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা না থাকলে জাতির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সত্যিকার ইতিহাসের জন্য তালিকা থাকা বাঞ্ছনীয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকা যে ভুয়া হতে পারে তা আমার আগে জানা ছিল না।’

কীভাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা জন্ম নিল এ প্রসঙ্গে মোজাম্মেল বলেন, ‘ভুয়ারা যে কাগজপত্র দিয়েছেন তা সঠিক ছিল না। তারা সাক্ষ্যও বানিয়ে নিয়ে এসেছে। মন্ত্রণালয়ে সাক্ষ্যদের নমুনা স্বাক্ষর ছিল না….. আর এভাবেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার জন্ম।’

তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তাও আছেন, তারা এমনভাবে কাগজপত্র তৈরি করে দিয়েছেন যাতে ধরা না যায়। অর্থাৎ একটি জালিয়াত চক্র ছিল। যেমন জমিজমার কাগজপত্র জালিয়াতি করার মতো, যেটা সহজে ধরা যায় না।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top