সকল মেনু

মানব পাচারের শীর্ষ রুট বঙ্গোপসাগর

নূরে আলম জীবন,হটনিউজ২৪বিডি.কম: সমুদ্রপথে মানব পাচারের শীর্ষ রুটে পরিণত হয়েছে বঙ্গোপসাগর। মৃত্যুঝুঁকি ও সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও ভাগ্য বদলের আশায় গত দুই মাসেই এ পথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে প্রায় ২১ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী। এ সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেশি।

সম্প্রতি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অধিবাসীদের সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ যাত্রার হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-নভেম্বর সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ৫৪ হাজার মানুষ সমুদ্রপথে অবৈধভাবে যাত্রা করেছে। এদের মধ্যে শুধু বঙ্গোপসাগর দিয়ে যাত্রা করেছে ৫৩ হাজার মানুষ, যাদের বেশির ভাগেরই গন্তব্য থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। আর বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে গিয়ে নির্যাতন ও অনাহারে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৪০ জন। এছাড়া কিছু মানুষ এ দুই দেশ অতিক্রম করে দক্ষিণে ভারত সাগর ধরে আরো এগিয়ে যায়। স্থানীয় সূত্র, গণমাধ্যম ও সমুদ্রযাত্রায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ইউএনএইচসিআর।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘মানব পাচারের দিক দিয়ে বঙ্গোপসাগর একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় রুটে পরিণত হয়েছে। মূলত বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উদ্দেশে মানব পাচার হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য এ চার রাষ্ট্রের সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘রামরুর পক্ষ থেকে আমরা বারবারই বলছি, মানব পাচার রোধে চার রাষ্ট্র মিলে একটি যৌথ কমিশন গঠন করা হোক। পাশাপাশি বৈধ পথে অভিবাসনের সুযোগ বাড়ানো হলে অবৈধ সমুদ্রযাত্রা কমবে।’

জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর দিয়ে বিদেশ যাত্রার হার অক্টোবর-নভেম্বরে সবচেয়ে বেশি থাকে। কারণ বর্ষাকাল শেষে বছরের এই সময়ে সমুদ্র তুলনামূলক শান্ত থাকে। আর প্রতারক চক্র ও জলদস্যুদের সহায়তায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভাগ্যগুণে বেঁচে থাকা শ্রমিকদের অবৈধভাবে কম মজুরিতে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ফিশিং ট্রলারে কাজ দেয়া হচ্ছে।

ইউএনএইচসিআর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অক্টোবর-নভেম্বরে বঙ্গোপসাগর দিয়ে প্রায় ২১ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী বিদেশ যাত্রা করেছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ নারী বলে ধারণা করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর দিয়ে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ অবৈধভাবে বিদেশ যাত্রা করেছে।

সমুদ্রপথে বিদেশ যাত্রার খরচ হিসেবে দালালরা প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ ডলার নিচ্ছে— এমন হিসাব দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত তিন বছরে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে বিদেশ যাত্রা করা লোকজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ বাবদ দালালদের আয় হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি ডলার।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বেশির ভাগ মানুষই সমুদ্রপথে বিদেশ যাওয়ার জন্য দালালদের স্বেচ্ছায় অর্থ দেয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক, এমনকি অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লোকজনকে সমুদ্রপথে পাচারের ঘটনাও ঘটছে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে গত দুই বছরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সমুদ্রপথে যাওয়ার সময় কয়েকজন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যে নৌকা বা ট্রলারে তারা সমুদ্র পাড়ি দেয়, সেগুলোর অবস্থাও জরাজীর্ণ। একইসঙ্গে দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রয়োজনীয় পানি ও খাবারের তীব্র সংকট রয়েছে। উপকূল থেকে অতিরিক্ত আরোহী নৌকায় ওঠানোর জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদম পাচারকারীরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে। তাতে কয়েক সপ্তাহও পার হয়ে যায়।

উল্লেখ্য, বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের সমুদ্রপথে অনেক যাত্রী মারা যায়। অনেকে ক্রুদের নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে, খাদ্য-পানির অভাবে, আবার অনেকে বেপরোয়া হয়ে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেছে। গন্তব্যে পৌঁছানোর পরও অনেক কিছু তাদের জন্য সুখকর হয় না। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পৌঁছার পর শত শত মানুষকে গ্রফতার করেছে কর্তৃপক্ষ। গ্রেফতারদের কেউ কেউ শরণার্থীর মর্যাদা দাবি করছে এবং কাউকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। আবার অনেকে অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে সমুদ্রপথে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখছে।

 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top