সকল মেনু

ডাক্তারদের কমিশন বানিজ্য!

খ্যাতিমান একজন চিকিৎসক রোগী দেখেন রাজধানীর ধানমণ্ডিতে একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতাল কাম ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সম্প্রতি একদিন ওই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রাত সাড়ে ১১টায়ও রোগীর ভিড় ওই চিকিৎসকের চেম্বারের ওয়েটিং রুমে। চিকিৎসকের চেম্বারেও আছেন কয়েকজন রোগী। একপর্যায়ে চেম্বারের এক সহকারী বললেন, ‘স্যার, আপনার চা খাওয়ার টাইম হয়েছে। ওরা বসে আছে।’ চিকিৎসক বললেন, ‘ওহ্ আচ্ছা। আর রোগী দিও না, চা রেডি করো আর ওদের পাঠাও।’ খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বিশেষ ধরনের ব্যাগ হাতে চার-পাঁচজন তরুণ দাঁড়ানো দরজার বাইরে। কিছুটা চাপাস্বরে নিজেদের মধ্যে চলছে আলাপচারিতা। একজন বলছেন, ‘আজ আমি ক্যাশ এনেছি, চেক করানো যায়নি।’ আরেকজন বললেন, ‘ইদানীং স্যার চেক নিয়ে ঝামেলা করেন, তাই আমিও ক্যাশই নিয়ে আসি। কিন্তু আমার অফিস আবার ক্যাশ দিতে চায় না।’ সহকারী এসে ডাক দিতেই এঁদের একজন ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়লেন। তিন-চার মিনিট পর তিনি বেরিয়ে আসতেই ঢুকলেন আরেকজন।
একে একে ওই তরুণদের সবাই চেম্বারে ঢুকে ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাইরে এসে জড়ো হন ফুটপাতের চায়ের দোকানে। একজন অনেকটা উঁচু স্বরেই অন্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই চাকরি আর ভালো লাগছে না; ব্যাটা আজকেও ধমকাইছে- কমিশন বাড়াইয়া না দিলে নাকি আর রোগী পাঠাবে না।’
নাম-পরিচয় গোপন রেখে ওই তরুণের সঙ্গে গল্প জমিয়ে জানা যায়, তিনি ধানমণ্ডি এলাকারই একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ‘মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ’ হিসেবে চাকরি করছেন ১১ মাস ধরে। তাঁর কাজ হচ্ছে ডাক্তারদের চেম্বার ‘ভিজিট’ করা। দুই ধরনের ভিজিট করতে হয় একেকজনের চেম্বারে। আগে গিয়ে রোগী পাঠানোর জন্য ‘পটাতে’ বা প্রভাবিত করতে হয়, আর পরে গিয়ে ‘কমিশন’ বুঝিয়ে দিতে হয়। তাঁদের প্রতিষ্ঠানেই এমন কাজের জন্য আছে রীতিমতো একটি মার্কেটিং বিভাগ। সেখানে একজন মার্কেটিং ম্যানেজারের নেতৃত্বে আছেন বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ২০ জন কর্মী, যাঁদের চাকরিই হচ্ছে ডাক্তারের কাছ থেকে রোগী আর রোগীর জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার তালিকা আদায় করা এবং পরে ওই তালিকা অনুসারে কমিশনের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আসা।
প্রায় একই কাজের অভিজ্ঞতা জানান পাশের আরেক কর্মী। তবে তিনি ঠিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নন, একটি হাসপাতালের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ। তাঁর কাজেও আছে কিছুটা ভিন্নতা। তিনি ডাক্তারের চেম্বার ভিজিট করেন রোগী ভাগিয়ে নিতে। এ ক্ষেত্রে আইসিইউর রোগীদের দিকে তাঁর টার্গেট বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ জানান, সাধারণত প্রস্রাব-পায়খানা, রক্ত, কফের মতো পরীক্ষার জন্য রোগীর কাছ থেকে আদায় করা ফির ২০-৩০ শতাংশ কমিশন নেন চিকিৎসকরা। অন্যান্য পরীক্ষা ও প্রযুক্তিভেদে ৩০-৫০ শতাংশও কমিশন দিতে হয়। হাসপাতালের রোগী পাঠানোর ক্ষেত্রে সাধারণত ১০-২০ শতাংশ, থেরাপির ক্ষেত্রে ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দেওয়া হয়। কমিশনের টাকা কেউ নেন মাসে, কেউ সপ্তাহে বা দিনে। এ ছাড়া কেউ নেন নগদ আবার কেউ চান চেকে বা নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।
ঢাকাসহ দেশের প্রায় সবখানে বেশির ভাগ চিকিৎসকের আয়ের অন্যতম পথ হচ্ছে ‘কমিশন’। চিকিৎসাসেবা নিয়ে কাজ করা একাধিক গবেষক বলেন, ডাক্তারদের কমিশন বাণিজ্যের পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে। তৈরি হচ্ছে কমিশনের নিত্যনতুন খাত। বলা যায়, ডাক্তাররা দশ হাতে কমিশন কামান। সেই সঙ্গে ডাক্তারদের কমিশন ঘিরে গড়ে উঠেছে এক ধরনের বাণিজ্যিক পরিকাঠামো। এর ফলে রোগীর চিকিৎসাসেবা গ্রহণে ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ কম্পানির মতো সংশ্লিষ্ট সব খাতও নিজেদের ব্যবসায়িক লাভজনক কৌশলের অংশ হিসেবে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত আছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যই চালু রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। আর আর্থসামাজিক-নৈতিক অবক্ষয়ের চক্রে পড়ে একশ্রেণির চিকিৎসক গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন এ কমিশনের জোয়ারে। এ কমিশন বাণিজ্যের প্রভাবে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গরিব মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে আরো নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। এ কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করা গেলে অবশ্যই রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় ও হয়রানি অনেকাংশে কমে যাবে।
আন্তর্জাতিক উদারময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) হেলথ ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিং রিসার্চ গ্রুপের সমন্বয়কারী ড. জাহাঙ্গীর এ এম খান জানান, সর্বশেষ এক গবেষণা অনুসারে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ শতাংশ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে। অন্যদিকে ধনী-গরিব নির্বিশেষে ৬৪ শতাংশ মানুষকে নিজ পকেটের টাকা খরচ করে চিকিৎসাসেবা কিনতে হচ্ছে। চিকিৎসার পেছনে মানুষের নির্ধারিত আয়ের বড় অংশ ব্যয় হওয়া ছাড়াও ভিটামাটি, ফসলি জমি, গৃহপালিত পশু ও জরুরি ব্যবহার্য জিনিসপত্র বিক্রি, ঋণ করা, মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার মতো উপায় বেছে নিতে হয়।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির এক প্রতিবেদনেও ডাক্তারদের এ কমিশন বাণিজ্যের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, চিকিৎসকদের সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশনভিত্তিক অলিখিত চুক্তির মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে এ কমিশনের হার ৩০-৫০ শতাংশ এবং দালালদের ক্ষেত্রে কমিশন ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডাক্তাররা আগের মতো কেবল ডায়াগনস্টিক বা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে প্রস্রাব-পায়খানা বা কফ-রক্ত পরীক্ষা থেকেই কমিশন নেন না, এর পাশাপাশি নতুন নতুন প্রযুক্তিনির্ভর সব ধরনের পরীক্ষাই এসেছে কমিশনের আওতায়। ডিজিটাল এক্সরে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইকো, কালার ডপলার, সিটি স্ক্যান, এমআরআইয়ের মতো নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। এসবে কমিশনের হারও বেশি। রোগের বিভাজন অনুসারে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি বা পরীক্ষার ভিত্তিতে ভাগ হয়ে থাকে কমিশন। এ ছাড়া আছে হাসপাতালে রোগী পাঠানোর জন্য কমিশন। এ ক্ষেত্রে আইসিইউ বা সিসিইউয়ে রোগী পাঠানোর জন্য রয়েছে বিশেষ কমিশন। আছে অপারেশনের কমিশনও। আরো আছে ক্যান্সার রোগীদের জন্য কেমোথেরাপি, অর্থোপেডিক রোগীদের জন্য ফিজিওথেরাপি, কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালিসিসের কমিশন। অর্থোপেডিক রোগীদের শরীরে সংযোজন করা বা হাড় জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত নানা উপকরণ; হৃদরোগীর শরীরে সংযোজন করা বাল্ব, রিং বা অন্য উপাদান, চোখের রোগীর চোখে সংযোজন করা লেন্সের মতো উপকরণ; দাঁতের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নকল দাঁত প্রতিস্থাপন বা অন্যান্য সংস্কারের কাজে ব্যবহৃত উপকরণ এবং কানের নানা ডিভাইস থেকেও নিয়মিত কমিশন জোটে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ ডাক্তারের। এমনকি ওষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই বহুল প্রচলতি ওষুধ কম্পানির কাছ থেকে কমিশনের নামে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি বা চোরাই পথে আসা দামি ওষুধ থেকেও কমিশন পেয়ে থাকেন প্যাকেজের আওতায় চিকিৎসা করা বেশির ভাগ চিকিৎসক। একজন মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ বলেন, ‘খুব কমসংখ্যক ডাক্তার পাওয়া যায় যাঁদের আমরা প্রভাবিত করতে পারি না বা তাঁরা কমিশন নেন না। আবার কেউ কেউ আছেন সাধারণত কমিশন নিলেও গরিব বা পরিচিত রোগীদের ক্ষেত্রে কমিশন না রাখা বা ডিসকাউন্টের জন্য প্রেসক্রিপশনের কোনায় লিখে দেন বা সাংকেতিক কিছু মার্ক করে দেন।’
একটি হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, কেবল হাসপাতালের নিযুক্ত কর্মীই নয়, এর বাইরে ভাসমান দালালদের মাধ্যমেও বিভিন্নভাবে কমিশনের ব্যবস্থা রয়েছে ডাক্তারদের। সাধারণত ছোট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের নিজস্ব কর্মী থাকে না। এসব ক্ষেত্রেই ভাসমান দালালদের তৎপরতা বেশি থাকে। এরা ডাক্তার ও বিভিন্ন হাসপাতাল বা ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। আবার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল এলাকা থেকেও রোগীদের প্রভাবিত করে কিংবা জবরদস্তি করে নিয়ে যায়।
কমিশন বন্ধ করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ : অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ‘কমিশন বাণিজ্যের জন্য কেবল চিকিৎসকদের দায়ী করলে চলবে না, সংশ্লিষ্ট সবাই এর জন্য দায়ী। তাই সংশ্লিষ্ট সব সেক্টর থেকে যার যার মতো করে এ কমিশন বাণিজ্য বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে। আর সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। প্রয়োজন মনিটরিং ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। বিশেষ করে ডাক্তারদের নৈতিকতা চর্চার বিষয়ে বিএমডিসি, ওষুধ কম্পানির ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, হাসপাতাল বা ডায়গনস্টিক সেন্টারের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই কমিশন বাণিজ্য ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএমএর বর্তমান মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘কমিশন বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করা যাবে না। আমরা এ অনৈতিক চর্চা বন্ধ করার পথ খুঁজছি। এ ক্ষেত্রে সবারই এগিয়ে আসা দরকার। কারণ এটি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্যই বড় একটি ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা নিজেদের ব্যবসার জন্য এ কমিশন দেওয়ার প্রবণতা চালু রেখেছে তাদেরও থামানো জরুরি হয়ে পড়েছে।’

 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top