সকল মেনু

মেঘনা নদীতে বালুখেকোদের থাবা; হুমকির মুখে ভোলা

ভোলা প্রতিনিধি: মেঘনা নদীর বুক থেকে ড্রেজার দিয়ে এভাবেই বালু তুলছে বালুখেকো প্রভাবশালী চক্র। পাশে সেই বালু বালুবাহী কার্গো দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভোলায়। ভোলর মেঘনা নদীর বুকে বালুখেকোদের থাবা পড়েছে। মেঘনার তলদেশ থেকে তিনটি ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার ফুট বালু তুলছে ভোলা ও লক্ষ্মীপুরের বালুখেকো প্রভাবশালী একটি চক্র। এর মধ্যে ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নকীব, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজু গোলদার, লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর মেম্বার, বাবুল মেম্বার প্রমূখ নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। প্রায় ১ মাস ধরে নদী থেকে তোলা এসব বালু শহরের বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সদর উপজেলা ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় পুকুর-নিচু জমি ভরাট ভবন নির্মাণসহ নানা কাজে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অবাধে নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে একদিকে যেমন নদীতে জেলেদের জাল ফেলে মাছ ধরতে অসুবিধি হচ্ছে। অন্যদিকে ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলা। ফলে ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনার ব্লক বাঁধ প্রকল্প। এতে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। প্রশাসনের অনুমিত ছাড়া মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার বিষয়টি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচিত হলেও রহস্যজনক কারণে প্রশাসন বালুখেকোদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা।
স্থানীয়রা জানায়, সরকারের অনুমতি না নিয়ে মেঘনা নদীর মাঝখান থেকে প্রতিদিন অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকার বালু তুলছে বালুখেকো একটি চক্র। অবাধে নদী থেকে বালু তোলার কারণে একদিকে যেমন নদীতে জেলেদের মাছ ধরতে অসুবিধা হচ্ছে। অন্যদিকে ভেঙে যাচ্ছে ফসলী জমি। এতে হুমকির মুখে পড়েছে ভোলা শহর। ভেস্্তে যাচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনার বাঁধ প্রকল্প। প্রতিদিন নদী থেকে ৩টি ড্রেজার দিয়ে ১ লাখ ফুট থেকে দেড় লাখ ফুট বালু তোলা হচ্ছে। যার মূল্য ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা। গত ১ মাসে প্রায় ৬ কোটি টাকার বালু তুলছে বালুখেকো প্রভাবশালী চক্রটি। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা বালু তোলার কাজে জড়িত থাকার কারণে প্রশাসন তাদেরকে কিছু বলছেনা।
ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসীন্দা কৃষক সাহাবুদ্দিন বলেন, মেঘনার তীরে আমার কিছু জমি রয়েছে। ওই জমিতে চাষবাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছি। কিন্তু বালুখেকো প্রভাবশালী চক্র ড্রেজার দিয়ে মেঘনা নদী থেকে বালু তোলায় মেঘনা নদীতে আমাদের ফসলী জমি ভাইংগা যায়। তিনি আরো বলেন, গত বর্ষায় তার ফসলী জমি পানিতে ডুইব্যা গেছে। এতে তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় জেলে হাদিস মাঝি বলেন, মেঘনা নদীর মাছ খান দিয়ে ড্রেজারের মাধ্যমে বালু তোলায় জেলেরা নদীতে জাল ফেলতে পারছেনা। এছাড়া নদী থেকে বালু তোলায় মেঘনা নদীতে ভেঙে যায় জমি। এভাবে বালু তোলার কারণে বঙ্গের চর, খালেশপুর ও কালুপুর মেঘনায় ভেঙে গেছে। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনকি সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নকীব ও আওয়ামী লীগ প্রভাবশালী নেতা নজরুল ইসলাম নজু গোলদার মেঘনা নদী থেকে এসব বালু তুলছনে বলেও জানান তিনি।
ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের মেঘনা নদীর মাঝে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাকিব ড্রেজার-৩ এমবি ভাই ভাই সোনারগাঁও ও হেপিরিমা ড্রেজিং প্রকল্প নামের ৩টি ড্রেজার দিয়ে মেঘনা নদীর মধ্য থেকে বালু তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি ৩টি ড্রেজারের মাধ্যমে উত্তোলিত সেই বালু নদী থেকে বেশ কয়েকটি বলবো (বালুবাহী কার্গো) দিয়ে বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভোলা শহরে। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা এসব বালু বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করছেন বলে বলে জানা গেছে।
এমবি ভাই ভাই সোনারগাঁও ড্রেজারের সুপারভাইজার মোঃ নুর হোসনে ও ষ্টাফ মাসুদ রানা জানান, লক্ষ্মীপুর জেলার মজু চৌধুরীর হাট এলাকার আলমগীর মেম্বার ও ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নকীব নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় পুকুর-নিচু জমি ভরাট ভবন নির্মাণসহ নানা কাজে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছেন। তারা আরো জানান, গত এক সপ্তাহ যাবত তারা এখানে বালু তুলছে। তবে রাকিব ড্রেজার ১ মাস ধরে এখানে বালু তুলছে। নদী থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার ফুট বালু তুলছেন। চুক্তির ভিত্তিতে তারা ভোলার মেঘনা নদী থেকে ড্রেজিং দিয়ে বালু তুলছেন। প্রতি ফুট বালুর মূল্য ৫০ পয়সা হিসেব নির্ধারণ কওে যে বালু উত্তোলিত হয় তার অর্ধেক বালুর মূল্য তাদেরকে দিতে হবে। সে হিসাব অনুযায়ী গত এক সপ্তাহে তারা ১ লাথ ১৪ হাজার ফুট বালু তুলেছেন। যার মূল্য প্রায় ৫৭ হাজার টাকা। এ বিষয়ে প্রশাসনের কোন অনুমতি নেই বলেও জানান তারা।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, প্রতি ফুট বালুর মূল্য ৫ টাকা থেকে ১৪ টাকা। সে হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে তারা ১ লাখ টাকা থেকে ৩ লাখ টাকার বালু তুলছে।
আনোয়ার হোসনে নামের ভোলার এক বালু ব্যবসায়ী বলেন, নদী থেকে বালু উত্তোলন করে যে বালু পুকুর ভরাটের কাজে ব্যবহৃত হয় সেই বালুর নাম ভিডি বালু। এ বালুর মূল্য প্রতি ফুট ৫ টাকা। নদীর উত্তোলিত যে বালু নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয় সেই বালুর নাম টোক বালু। এ বালুর মূল্য প্রতি ফুট ১৪ টাকা।
রাকিব ড্রেজার-৩ এর ম্যানজোর মতিউর রহমান, ষ্টাফ মোঃ রাসেল ও আল ইসলাম জানান, ফারুক, বাবুল মেম্বার ও শরিফ মোল্লা তাদেরকে ভোলায় বালু তোলার জন্য এনেছেন। প্রতিদিন নদী থেকে প্রায় ২০ হাজার ফুট বালু তুলে ৪-৫টি বালুবাহী বলবো (কার্গো) দিয়ে বালু সরবারহ করা হচ্ছে। ভোলার বজলু মাঝির মাধ্যমে এসব বালু বিভিন্ন এলাকায় নেয়া হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে তারা এখানে নদী থেকে বালু তুলছেন। নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার বিষয়ে তারাও প্রশাসনের কোন অনুমতিপত্র দেখাতে পরেননি।
হেপিরিমা ড্রেজিং প্রকল্প নামের ড্রেজিংয়ের কয়েকজন ষ্টাফ জানান, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম নজু গোলদার এ বালু তুলছেন। তারা আরো জানান, শুধু নকীব ও নজু গোলদারই নয়, বালুর টাকার ভাগ ভোলার আওয়ামী লীগের অনকে নেতার পকেটে চলে যায়।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নকীব বলেন, আমি এ বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। কে বা কারা আমার নাম ভাঙিয়ে এ কাজ করছেন। তিনি আরো বলেন, লক্ষ্মীপুরের আলমগীর মেম্বারসহ একটি চক্র মেঘনা থেকে অবৈধভাবে বালু তুলছে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভোলার নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল হেকিম জানান, ভোলার মেঘনা থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি তার জানা নেই। তিনি এ বিষয়ে ভোলা সদর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
ভোলা সদর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড এসএম ফরিদউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ভোলার মেঘনা থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি জানা নেই জেলা প্রশাসক মোঃ সেলিম রেজার। তিনি বলেন, মেঘনা থেকে বালু উত্তোলন অবৈধ। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ভোলার মেঘনা থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ে গত রবিবার সকালে জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও উত্থাপিত হয়েছে। ওই সভায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনরে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top