সকল মেনু

মুসল্লিদের দানের ৪০ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ সালামের বিরুদ্ধে

হটনিউজ, ঢাকা :: রাজধানীর ফকিরেরপুল জামে মসজিদে মুসল্লিদের দানের অন্তত ৪০ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ উঠেছে। মসজিদ কমিটি গত দুই দশকে এ টাকা নয়-ছয় করেছে বলে অভিযোগ করেছে সংশ্লিষ্টরা।

বিএনপির কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আবদুস সালাম এই মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি। তিনি মসজিদের মোতোয়াল্লির দায়িত্বেও আছেন। তার নেতৃত্বাধীন কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে সাত বছর আগে। তবে এখনো মসজিদের সব আয়-ব্যয়ের হিসাব তিনিই দেখাশোনা করেন।

সেই হিসাবে ব্যাপক গরমিল ধরা পড়েছে। এ ছাড়া এখতিয়ার না থাকলেও সম্প্রতি আবদুস সালাম আরেকজনকে মসজিদের পরিচালক নিযুক্ত করেছেন।

টাকা তছরুপের বিষয়ে সোমবার ধর্ম মন্ত্রণালয়ে একটি অভিযোগও দাখিল করা হয়েছে। এতে মসজিদের মোতোয়াল্লিসহ নতুন কমিটি অনুমোদনের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন মসজিদের জমিদাতার ছেলে খলিলুর রহমান।

কিন্তু মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত করার পর সোমবার রাতেই মতিঝিল থানার পুলিশ খলিলুর রহমান ও আজম খান নামে প্রস্তাবিত নতুন কমিটির দুজনকে থানায় নিয়ে যায়। সারা রাত তাদের মতিঝিল থানায় আটক রেখে গতকাল মঙ্গলবার মতিঝিল থানায় পেন্ডিং মামলায় আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ।

এ বিষয় জানতে চাইলে মতিঝিল থানার ওসি জানান, খলিল ও আজমের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তবে মঙ্গলবার তারেক জিয়ার মিছিল আছে- এমন কর্মসূচির জন্য তাদের বিএনপির কর্মী সন্দেহে আটক করা হয়।

সোমবার রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে খলিলুর রহমান জানান, ফকিরেরপুল জামে মসজিদের  জমিদাতার সন্তান হলেও দুই দশক ধরে তারা মসজিদের পরিচালনায় তেমন মনোযোগ দিতে পারেননি। সম্প্রতি মসজিদের ছাদের ওপর থেকে পানির ট্যাংক পড়ে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর পরই তারা মসজিদের সব বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি আয়-ব্যয়ের হিসাব চাওয়া হলে আবদুস সালাম যে হিসাব দেন তাতে ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়। এ বিষয়ে ওয়াকফ প্রশাসনের প্রশাসকের কাছেও আবেদন জানানো হয়েছে।

প্রশাসন আজ বুধবার ফকিরের পুল জামে মসজিদ সরেজমিন তদন্তের জন্য সময় নির্ধারণ করেছে।

ওয়াকফ প্রশাসনের পরিদর্শক রেজাউল করিম সরদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা মসজিদের বিষয়টি তদন্তের জন্য বুধবার সময় নির্ধারণ করেছি। ওইদিন মসজিদের সব মুসল্লি ও সংশ্লিষ্টদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। তদন্তের সময় মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সদস্যদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখাতেও বলা হয়েছে।

জানা গেছে, ফকিরেরপুল মসজিদটির প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৫ সালে। তবে ১৯৭৯ সালে স্থানীয় হাজী গোলাম মোস্তফা এবং তার আগে তার বাবা হাজী ইউনুসের দেওয়া ১৯ শতাংশ জমির ওপরেই সংস্কার করে মসজিদটি চালু করা হয়।

মরহুম হাজী গোলাম মোস্তফার ছেলে খলিলুর রহমান জানান, তারা চার ভাই মসজিদ কমিটির সদস্য থাকলেও এতদিন আয়-ব্যয়ের কোনো খোঁজ রাখেননি। ২০০০ সালে বিএনপি নেতা আবুস সালাম জমিদাতার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে মসজিদের মোতোয়াল্লি নিযুক্ত হন। ২০০৪ সালে গঠিত নতুন কমিটিতেও তিনি সেক্রটারি হন। সেই কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ২০০৭ সালে। এরপর আর কোনো কমিটি হয়নি।

আবদুস সালাম এখনো নিজেকে মসজিদের সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে যাবতীয় আয়-ব্যয়ের হিসাবে স্বাক্ষর করে যাচ্ছেন।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি ওয়াকফ প্রশাসকের কাছে একটি হিসাব জমা দেন। তাতে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে দোকান ভাড়া বাবদ আট লাখ ৮৮ হাজার টাকা এবং জুম্মার নামাজের সময় মুসল্লিদের দান থেকে মসজিদের আয় হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৬ টাকা। এককালীন অনুদান দেখানো হয়েছে আরো চার লাখ ৫১ হাজার ৫৮৫ টাকা। সব মিলিয়ে ২০১৩ সালে মসজিদের আয় দেখানো হয়েছে ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৭০৪ টাকা। আর একই বছরে ব্যয়ের দেখানো হয়েছে ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৩৮৯ টাকা।

তবে হাজী গোলাম মোস্তফার পারিবারিক সূত্রের দাবি, প্রতি বছর শুধু মসজিদের দোকান ভাড়া থেকেই আয় হওয়ার কথা ৫০ লাখ টাকা। প্রতি জুম্মার নামাজের দিন ওঠে ২৫ হাজার টাকা, প্রতি বছর কোরবানীর চামড়ার বিক্রি থেকেও দান হিসেবে আসে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা, মসজিদের ছাদে একটি মোবাইল অপরারেটরের বসানো টাওয়ার থেকে বছরে আসে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তির কাছ থেকে এককালীন অনুদান আসে অন্তত ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে গত দুই দশকে মসজিদটিতে কমপক্ষে ৮৮ থেকে ৯০ কোটি টাকা জমা হওয়ার কথা।

মসজিদ পাচ তলা করার কথা। অথচ এখন পর্যন্ত কেবল দুই তলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ তলার কেবল ছাদ ঢালাই হয়েছে। আর কোনো কাজ হয়নি। যে দুই তলা নির্মাণ করা হয়েছে সেখানেও কাজে আর্থিক অনেক অনিয়ম হয়েছে। গত দুই দশকে মসজিদ কমিটির সদস্যরা কমপক্ষে ৪০ কোটি টাকা তছরুপ করেছেন। আগের সব হিসাব খতিয়ে দেখলেই এ সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।

গতকাল ধর্ম মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে খলিলুর রহমান জানান, তাদের পরিবার থেকে সম্প্রতি একটি সভা করে তাদের তৃতীয় বোনের বড় ছেলে মাজেদুর রশিদ (মজিদ) কে মোতোয়াল্লি কাম সেক্রেটারি করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রির সহায়তা চান তিনি।

মসজিদের গত কয়েক বছরের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মসজিদের দানের টাকায় কমিটির সদস্যরা হজ যাত্রীদের জন্য ইহরামের কাপড়, টুপি কিনে দিয়েছেন। যদিও দানের টাকায় এসব খরচ করার কোন বিধান নেই। সরেজমিনে গতকাল দেখা গেছে, মসজিদের ছাদের উপর সাবেক কমিটির সদস্যরা একটি বিশাল বাগান করেছেন। ছাদের ওই বাগান দেখাশোনার জন্য একজন মালিও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, মসজিদের আয়ের কোনো হিসাব না রাখলেও কারণে-অকারণে খরচের একটি তালিকা করে রেখেছে কমিটির সদস্যরা। যার বেশিরভাগই অযৌক্তিক ব্যয় বলে মনে করছেন মুসল্লিরা।

এলাকাবাসী বলছে, এখতিয়ার না থাকলেও আবদুস সালাম ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের সভাপতি নাসিরুল ইসলাম মল্লিক ওরফে পিন্টুকে মসজিদের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। অথচ পিন্টুর ক্লাবে প্রতিদিন মত জুয়ার আসর বসার অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।

এখন যখন পুরনো আয়-ব্যয়ের হিসাব দেওয়ার কথা ওঠছে তখন আবদুস সালাম নিজে সরে গিয়ে পিন্টুর ঘাড়ে দায় চাপিয়ে পার পেতে চাইছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গতকাল রাতে আব্দুস সালাম বলেন, ’আমি রাজনৈতিক কারণে ব্যস্ত ছিলাম, তাই নতুন কমিটির অনুমোদন দিতে পারিনি।’ সম্প্রতি মসজিদের ছাদ থেকে অস্থায়ী পানির ট্যাংক পড়ে একজন দোকান কর্মচারী নিহত হওয়ার বিষয়ে জানতে জাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি দেশের বাইরে ছিলাম।’

নাসিরুল ইসলাম মল্লিক পিন্টুকে পরিচালক করার বিষয়ে বলেন, ‘ওটা আমি করিনি। এলাকার লোকজন করেছে।’

দানের টাকা তছরুপের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সামনা-সামনি দেখা কইরেন। আগে নিউজ কইরেন না।’

সম্পাদনায় / জীবন

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top