সকল মেনু

সিডরের ৭ বছর:কান্না থামেনি জেলে পরিবারগুলোর

 এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা: আজ ১৫ নভেম্বর। ২০০৭ সালের এই দিনে ভোলাসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর উপর দিয়ে বয়ে যায় সুপার সাইক্লোন সিডর। সিডরের ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো সেই দুর্বিষহ স্মৃতি ভুলতে পারছেনা সেখানকার মানুষ। সিডরের কথা মনে করে এখনও আঁতকে ওঠেন তারা। স্বজন হারানোদের ব্যথায় এখনো আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে সেখানে। নিখোঁজ ১৫ জেলের ফিরে আসার প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছেন স্বজনরা। অনেকে আবার সর্বশান্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না কেউ।
ভোলা সদর উপজেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের কূলগাজী গ্রামের সহিজল মাঝি সিডরে আঘাত হানার সময় মাছ ধরতে গিয়ে ছিলেন সাগরে। তিন মেয়ে তিন ছেলে, মা-বাবা আর স্ত্রী রেখে সেই যে গেলেন আর ফিরে এলেন না। আসবেন কিনা তাও জানে না তার পরিবার। এখনো তার ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন সহিজলের স্ত্রী। স্বামীর কথা বলতে গেলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। সহিজলের স্ত্রী বলেন, সিডরের সময় সে নদীতে গেছে। বোটে মাছ ধরতে। সে বোট পইর‌্যা গেছে। আর সে ফিরর‌্যা আসে নাই। আর আসবে নাকি হেও জানিনা, আল্লাপাক জানে। ছেলে-সন্তান নিয়া খুব অসহায় আছি। সংসার খুব কষ্টে চলে।

একই গ্রামের কাদির গাছালির মেয়ে জামাই মিলন মাঝিও মাছ ধরতে গিয়ে প্রাণ হারালেন। নিজে সাগরে গিয়ে ডুবে মরে পরিবারকে ফেলে দিয়ে গেলেন বাস্তবতা নামের অথৈ সাগরে। তার স্ত্রী-পূূত্র কন্যা সবাই এখন ছন্নছাড়া সংসারহারা। মেয়ের বাবা কাদির গাছালি বলেন, আমার জামাই সিডরের বইন্যায় মারা গেছে। মারা যাওয়ার পরে হেই সংসার ধ্বংস হইয়্যা গেছে। ধ্বংস হইয়্যা যাওয়ার পরে এহন মাইয়্যায় ১ ছেলে ১ মেয়ে লইয়্যা চিটাগাংএ মাইশ্যের বাসায় কাজ-কর্ম কইর‌্যা খায়। আর দুই ছেলে বাংলাবাজার এতিম খানায় আছে। সিডরে কেউ বাবা-মা, কেউ সন্তান, কেউবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে শোককে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন জীবন্ত লাশ হয়ে। ভোলা সদরের চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে এখনও চলছে  শোকের মাতম। সন্তান হারানো ব্যথা ভুলতে পারছেন না তারা।

স্বজন হারা এক ব্যক্তি বলেন, বাইত্তোন বাইরায়্যা আমরা পদ দিছি সাইক্লোন সেল্টারে। পরে ট্রলারে চড়ছি, ট্রলারে আশেপাশের লোকজন আছিল, হেগোরে লইয়্যা আমরা রওয়ানা দিছি। পরে বাতাসে ব্রীজের লগে বাইজ্যা ভাইংগা-চুইর‌্যা গেছে। ওই ঠেলায় আমার মায়ও মারা গেছে। স্বজনহারা শেফালী নামের গৃহীনি বলেন, বইন্যা পশ্চিম থেকে চাপ দিছে। বাতাসে-তুফানে ঘরডাসহ পইর‌্যা গেছে। তহন আমি নিজে সারতেই দায়, বাচ্চা জেইগ্যা সারাইতে পারছি, সারাইছি। ওইগ্যা সারাইয়ের শক্তি আমার হয় নাই।সেই ভয়ংকর সিডরের আঘাতে ভোলার জেলা সদরসহ চরফ্যাশন, মনপুরা ও বোরহানউদ্দিনে ৫২ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫ কিলোমিটার বেড়িবাধ। এছাড়া কয়েক শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। নিহত হয় ৪২ জন।
ক্ষতিগ্রস্ত নি:স্ব অনেক পরিবার গৃহ নির্মাণ করতে না পেরে ঝুপড়ি ঘরে বেড়িবাধে আশ্রয় নিয়ে দিন পার করছেন। সিডরের বর্ননা করতে গিয়ে তারা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ছেন। ৭টি বছর পেরিয়ে গেলেও আতংক তাদেরকে এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যারা বেঁচে আছেন তারা জানেন না কিভাবে বাঁচলেন কিংবা আগামীতে কিভাবে বাঁচবেন।
আর ট্রলার বাতাসে থামাইয়্যা রাখতারে নায়। ট্রলার গিয়া ব্রীজের লগে বারি খাইয়্যা ভাইংগ্যা গেছে। লগের গা এক্কেরে পাই-ই নাই আর মরা পাইছি। আর আমারে আল্লায় কেমনে বাচাইছে কইতে পারি না।
এমনিতেই ভোলা দুর্যোগ প্রবণ এলাকা। প্রতিবছরই কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভোলাবাসীকে কম-বেশী ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হতে হয়। তবে ঘুর্ণিঝড় মহাসেনের আঘাত ব্যাপক হলেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হওয়ার উদাহরণ টেনে ভোলার জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, আগামীতে সিডরের মত ভয়াবহ বিপর্যয় এলেও ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনার মত যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে তাদের।
এ ব্যাপারে ভোলা জেলা প্রশাসক সেলিম রেজার সাথে আলাপ করলে তিনি বলেন, ভোলা একটি দ্বীপজেলা। যে কোন সময় এখানে সিডরের মত দুর্যোগ আসতে পারে। দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা আছে। আমরা প্রতিমাসে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করি। ইউএনও দেরকে সভা করতে বলি। বিপদ সংকেত ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে জনগণকে জানিয়ে দেই। জেলে-নৌকাগুলোতে লাইফ জ্যাকেট, রেডিও রাখার পরামর্শ দেই। ভোলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখি। লোকজনকে সেখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা রাখি। সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দকৃত ত্রাণ আমাদের কাছে। আমরা এসব করার কারণে বেশ সফলতা পেয়েছি। বিগত মহাসেনে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে। বহুলোককে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top