সকল মেনু

রংপুরের সাতমাথা অবরুদ্ধ

  জেলা প্রতিনিধি,রংপুর: রংপুরে শ্রমিক ইউনিয়ন এবং মালিক সমিতির মধ্যে চলমান দুইমাস ব্যাপী বিরোধের জের ধরে সোমবার গভীর রাতে মহানগরীর সাতমাথা এলাকায় দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করেছে ৩০নং ওয়ার্ড যুবলীগের সেক্রেটারি ও সিটি করপোরেশনের টোল আদায়কারী ইমরান হোসেনকে (৩৫)।

এ ঘটনায় শ্রমিক ইউনিয়নকে দায়ী করে ইমরানের লোকজন শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি ও মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক এম এ মজিদ, প্যানেল মেয়র ফরিদা কালামের বাড়িঘর, পিকআপ মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়নের শাখা অফিস ভাঙচুর করে। এসময় ৪টি বাস, ১টি অটোরিকশা, ২টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়।

এ ঘটনার চিত্রধারণ করতে গেলে নিহত ইমরান সমর্থিতরা সাতমাথায় চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। লাঞ্ছিত করা হয় ৩ সাংবাদিককে।

এদিকে, এ ঘটনায় মালিক সমিতির ‘সন্ত্রাসীদের’ দায়ী করে মঙ্গলবার সকাল ১০ টা থেকে রংপুর বিভাগের ৫৬ টি রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে শ্রমিক ইউনিয়ন। বিকেল সাড়ে ৪ টা অবধি সাতমাথা এলাকায় ইমরান সমর্থিতরা সশস্ত্র অবস্থায় অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তবে সাড়ে ৫টার দিকে ধর্মঘট স্থগিত করা হয়।

এদিকে, যুবলীগ নেতা হত্যাকাণ্ডের জের ধরে পুরো নগরীতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। যে কোনো সময় আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধতে পারে এমন আশঙ্কায় মাহিগঞ্জ, তাজহাট ও সাতমাথা এলাকায় বিপুল সংখ্যক র‌্যাব ও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদের জিলানী হটনিউজ২৪বিডি.কমকে জানান, সোমবার দিবাগত রাত ২ টার দিকে শহর থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে সাতমাথা এলাকায় ইমরানকে উপুর্যপুরি ছুরিকাঘাত করা হয়। গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

মঙ্গলবার ভোর সাড়ে টায় ইমরান চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ইমরান সাতমাথা বীরভদ্র এলাকার দুলাল মিয়ার ছেলে। ইমরান ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়।

অবরুদ্ধ সাতমাথাসাতমাথা এলাকায় নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বাংলামেইলকে জানান, ইমরান রাত দেড় টার দিকে নগরীর বুড়িরহাট রোডের ডক্টরস ক্লিনিকে কোতোয়ালি থানার ওসি আবদুল কাদের জিলানীর সঙ্গে একটি মামলার বিষয়ে কথা বলে বাড়ির দিকে রওয়ানা হন। তখন তার সঙ্গে কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতাও উপস্থিত ছিলেন । পরে সেখান থেকে বের হয়ে অপর দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ইমরান সাতমাথায় একটি হোটেলে খেতে যান। খাওয়া শেষে হোটেল থেকে বের হওয়া মাত্রই আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা ১০/১২ জন দুর্বৃত্ত তাকে ধারালো দেশিয় অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপুরি ছুরিকাঘাত করে। এরপর তাকে মৃত ভেবে রাস্তায় ফেলে দুটি মাইক্রোবাসে করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে টহলরত পুলিশের ভ্যানে করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানান, যুবলীগ নেতা ইমরানের মুত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ইমারন ও মোটর মালিক সমিতির সমর্থকরা দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে সাতমাথায় জেলা পিকআপ মালিক সমিতির অফিস, মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাতমাথা শাখা অফিসসহ ৩টি যাত্রীবাহী বাস, একটি অটোরিকশা এবং দুটি মোটর সাইকেল ভাঙচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় চিত্রধারণ করতে গেলে চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরাম্যান এহসানুল হক সুমনের কাছ থেকে ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে তা ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। চ্যানেল নাইনের ক্যামেরাম্যান ফুলন চক্রবর্তীর ক্যামেরা ছিনিয়ে নিলেও তাৎক্ষণিকভাবে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান শিশির ক্যামেরাটি উদ্ধার করে দেন।

এসময় ইমরান সমর্থকরা রংপুরের উদ্দেশ্যে আসা এক পথচারীকে সাংবাদিক সন্দেহে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করে।

এ ঘটনার পর ইমরান ও মালিক সমিতির সমর্থকরা মিছিল নিয়ে সাড়ে ৮ টায় নগরীর তাজহাট মোড় এলাকায় জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর আওয়ামীলীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক এমএ মজিদ এবং তার ভাবি প্যানেল মেয়র ফরিদা কালামের বাসায় হামলা চালায়। এসময় তারা বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর এবং নারী-শিশুসহ পরিবারের লোকজনকে মারপিট করে। প্রাণভয়ে বাড়ির নারীরা দৌড়ে অন্যত্র গিয়ে রক্ষা পায়। হামলাকারীরা এম এ মজিদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও মসজিদের সামনে থাকা একটি বাসেও আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এলাকাবাসী ও মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা।

তারা একত্রিত হয়ে হামলাকারীদের ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা সাতমাথায় গিয়ে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। এরপর সেখানে শতাধিক পুলিশ আসে এবং মহাসড়কে বেরিকেড দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শী তাজহাট এলাকাবাসী খুরশিদ, রঞ্জন ও হারুন অভিযোগ করে বাংলামেইলকে বলেন, এর আগেও সাবেক কাউন্সিলর আজম গ্রুপ এম এ মজিদের বড় ভাই মরহুম আবুল কালাম আজাদের সময়ে বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। সে সময় পুলিশ আজম গ্রুপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ফাঁকাগুলি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছিল। আর মঙ্গলবার ওই আজম গ্রুপের সন্ত্রাসীরা বর্তমান সেক্রেটারি এম এ মজিদের বাড়িতে আজমের ভাই আবুল হোসেনের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও নারীদের লাঞ্ছিত করলো। কিন্তু পুলিশকে বার বার খবর দেয়া সত্বেও তারা ঘটনা ঘটে যাওয়ার আধাঘণ্টা পর তাজহাট মোড়ে আসে। আমরা এলাকাবাসী যখন এর প্রতিবাদ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন পুলিশ আমাদের সাতমাথার দিকে যেতে দিচ্ছে না।

এ ঘটনার পর সকাল ১০ টায় শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পাদক এম এ মজিদ তার নিজ বাসভবনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘ইমরান হত্যাকাণ্ডের জন্য মোটরমালিক সমিতির সন্ত্রাসীরাই দায়ী। নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সেটির দায় শ্রমিক ইউনিয়নের ওপর চাপানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে’।
তিনি বলেন, ‘তারা আমার বাড়ি ঘর অফিসে হামলা চালিয়েছে, আগুন দিয়েছে। আমার শ্রমিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এই সন্ত্রাসীরাই ৭ সেপ্টেম্বর আমাকে মেরে ফেলার জন্য গুলি চালিয়েছিল। আমি বার বার প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে স্মারকলিপি দেয়ার পরেও তারা আমার ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে’।

এসময় তিনি স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আপনারা জানেন উনি আমাকে বার বার মারার জন্য হুমকি দিচ্ছে। আজকে তারা আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে মারপিট করেছে। আমার দুটি মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তার বাড়িতে হামলা, শ্রমিক কার্যালয় ভাঙচুর, শ্রমিককে মারধরের প্রতিবাদ ও জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে রংপুর বিভাগের ৫৬ টি রুটে একযোগে পরিবহন ধর্মঘট ঘোষণা করেন তিনি’ ।

এদিকে ধর্মঘটের খবর ছড়িয়ে পড়ায় মালিক সমিতির লোকজন রংপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে পৌনে ১২টায় জেলা মোটর মালিক সমিতির বুকিং ক্লার্ক শাহিনুর রহমান শাহীনের নেতৃত্বে ইমরানের হত্যকারীদের গ্রেপ্তার এবং বাস ভাঙচুরের প্রতিবাদে বাস টার্মিনালে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।

মোটরমালিক সমিতির বুকিং ক্লার্ক ও জাতীয় যুব সংহতির যুগ্ম কোষাধ্যক্ষ শাহীনুর রহমান শাহীন বাংলামেইলকে জানান, ‘ইমরান হত্যাকাণ্ডের জন্য মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের মজিদ ও তার ভাগনে আশরাফুল দায়ী। তার নামে আরও একটি হত্যা মামলা আছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তাকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত আমরা মাঠ ছেড়ে চলে যাবো না। তিনি বলেন, আমরা যে কোনো মূল্যে বাস চালাবো’।

বিকেল সাড়ে ৪ টা পর্যন্ত ইমরান ও মোটর মালিক সমিতির সমর্থকদের সাতমাথায় সশস্ত্র অবস্থান করতে দেখা গেছে। পুলিশ ওই সময় পর্যন্ত সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। পুলিশ দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে তাজহাট মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে এবং পশ্চিমে রেললাইনের পাশে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব অবস্থান করছিল। সাতমাথায় সকল ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে।

আকস্মিক ধর্মঘটের কারণে রংপুর বিভাগের ৮ জেলার ৫৬ টি রুটে সব ধরনের পরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে যাতায়াত এবং পণ্য আনা নেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছে সংশ্লিষ্টরা। পরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পরিবহন ধর্মঘট স্থগিত করা হয়।

বিকেল ৪টায় মেডিকেলে উপস্থিত কোতোয়ালি থানার তদন্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান হটনিউজ২৪বিডি.কমকে জানান, ইমরানের লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এদিকে ইমরানের বাবা দুলাল মিয়া ছেলের এমন মৃত্যুর খবর শুনে হার্ট অ্যাটাক করেছেন। তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা এখনও আশংকামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন কর্মরত চিকিৎসকরা।

ইমরানের ছোট ভাই বিপ্লব জানান, ‘ভাইকে ছুরিকাঘাত করার ঘটনাটি আমরা পারিবারিকভাবে রাত আড়াইটায় শুনেছি। পরে রাত সাড়ে চারটায় চিকিৎসাধীন অবস্থান মারা যান।’

তিনি বলেন, ‘মেয়র সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়েছেন। ওনার সাথে কথা বলে জানাজার ব্যবস্থা করা হবে। এসময় বিপ্লব বলেন, ‘কারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে তা আমরা শনাক্তের কাজ করছি। আমার বাবাও এখন মৃত্যু শয্যায়। আমরা এখন চাপে আছি। কারা হত্যা করেছে তা বলতে পারছি না’।

রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নুল আবেদীন হটনিউজ২৪বিডি.কমকে জানান, পরিস্থিতি এখন শান্ত আছে। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত গত প্রায় দুই মাস ধরে মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং পিকআপ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে মোটরমালিক সমিতি এবং ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা মালিক শ্রমিক কল্যাণ সমিতির মধ্যে তীব্র বিরোধ চলে আসছে। উভয়পক্ষই সাংবাদিক সম্মেলন, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, স্মারকলিপি দিয়ে উভয়পক্ষের নেতাদের গ্রেপ্তারে আলটিমেটামের ওপর আলটিমেটাম দিয়ে আসছে।

উল্লেখ্য রংপুর জেলা মোটরমালিক সমিতির বর্তমান সেক্রেটারি স্থানীয় সরকার ও  সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এবং ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা মালিক শ্রমিক কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি প্রতিমন্ত্রীর ভাই মহিউদ্দিন মহি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top