সকল মেনু

যা ঘটতো মাদ্রাসার অন্দরমহলে !

 মেহেদি হাসান : দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ এলাকায় জেলা পরিষদ মার্কেট জামিয়া আলিয়া মাদ্রাসাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যৌন নির্যাতনের পর ওই মাদ্রাসার ছাত্র রায়হানকে (১৪) গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ সোমবার দুপুরে মাদ্রাসাটি বন্ধ করে দেয়। মাদ্রাসাটি পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ফুটবল খেলার মাঠের মত বিশাল জায়গা নিয়ে টাইলস করা বড় একটি ঘর। মাঝখানে শিক্ষকদের থাকার জায়গা। দুপাশের মেঝেতে ছাত্ররা ঘুমায়। আর চৌকির ওপর থাকেন শিক্ষকগণ। ছাত্রদের মশারি নেই, শিক্ষকদের আছে। শিক্ষকদের হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন। ছাত্রদের মোবাইল নিষিদ্ধ। শিক্ষকদের জন্য আছে কম্পিউটার। ছাত্রদের সেখানে প্রবেশে মানা। বিশাল কক্ষের একদিকে রান্নাঘর। সঙ্গে ওযুখানা। পাশেই রয়েছে বাথরুম ও টয়লেট। পুরো রান্নাঘর জুড়েই জমাটবাধা রক্ত। পাশে কিছু হাড়ি পাতিল ও রান্নার জিনিসপত্র পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই রান্না ঘরের মধ্যেই নির্মমভাবে খুন হয়েছে ১৪ বছরের কিশোর রায়হান। তাকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ছাত্ররা জানায়, মাদ্রাসার ভেতরে বহিরাগত প্রবেশ করতে পারে না। এমনকি অভিভাবকও না। শিক্ষক আর ছাত্র ছাড়া কারো প্রবেশের অনুমতি নেই ওই কক্ষটিতে। নিহত রায়হানের বড় ভাই একই মাদ্রাসার ছাত্র রেজওয়ানের ভাষ্য, প্রত্যেক ছাত্র পালাক্রমে ‘হুজুরদের’ থালা বাসন পরিস্কার ও খাবার পরিবেশন করে থাকে। সে অনুযায়ী রোববার রাতে খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব রায়হানের ওপর ছিলো। রাত ৯টার দিকে হুজুরদের খাওয়ানোর পর সবাই পড়তে বসে। রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘুমানোর জন্য সবাই শুয়ে পড়ে। থালা বাসন পরিস্কার করতে গিয়ে রায়হান একটু দেরিতে ঘুমাতে যায়। রাত সাড়ে ১১টার পরের আর কোনো ঘটনা জানেনা রেজওয়ান। সেও ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। রেজওয়ান আরো জানায়, প্রতি ভোরে ফজর নামাজের অন্তত দেড় ঘন্টা আগে সবাই উঠে পড়তে বসে। ওই সময় সিদ্দিক নামে এক ছাত্র ওযু করতে গিয়ে প্রথম দেখতে পায় রায়হান রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে রান্না ঘরের মেঝেতে। তার চিৎকারে সবাই ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আমিও উঠি। গিয়ে দেখি, রায়হানের পাশেই পড়ে আছে একটি রক্তমাখা ছোরা, গত কোরবানিতেও সেটা দিয়ে পশু জবাই করা হয়েছে। রায়হানের পরনে কোনো কাপড় নেই।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত নিহতের চাচা নাহিদ হটনিউজ২৪বিডি.কমকে শোনালেন আরো কিছু হৃদয় বিদারক কাহিনী। দুই শিশুভাই রেজওয়ান আর রায়হানের ওই মাদ্রাসায় পড়তে যাওয়ার পেছনের ইতিহাস। রেজওয়ানের বয়স তখন দুই বছর। আর রায়হানের ছয় মাস। মা ফাতেমা ‘ঘরছাড়া’ হয়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। বাবা মুরাদও অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করে এখন কুমিল্লায় সংসার করছেন। এই দুই ভাইকে দাদী সুরাইয়া বেগম এবং দুই চাচা নাহিদ ও আলমগীর কিছুদিন দেখাশোনা করেছেন। কয়েক বছর হলো দুই ভাইয়ের স্থান হয়েছে ওই মাদ্রাসায়। মাসিক ৮ হাজার টাকা দিয়ে মাদ্রাসায় রেখে পড়াশুনা করাচ্ছিলেন বলে দাবি করেন চাচা নাহিদ।

মা কেন ছেড়ে গিয়েছিলেন-উত্তরে নাহিদ বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। রায়হানের বাবা মুরাদের গৃহ শিক্ষক ছিলেন ফাতেমা। তখন ফাতেমার চেয়ে মুরাদের বয়স অনেক কম। প্রেমের টানে এক পর্যায়ে বিয়ে এবং সংসার। অতঃপর দুই ছেলে রেজওয়ান ও রায়হান। রায়হানের বয়স যখন ছয় তখন যে ফাতেমা ভাগলো, আর কখনো দুই ছেলের খোঁজ নেয়নি ফাতেমা-নাহিদের ভাষ্য।

রায়হানের এই পরিনতি দেখে সোমবার অনেকগুলো অভিভাবক ভীড় জমান সেখানে। কবুতর পাড়া থেকে আসা তারেক হটনিউজ২৪বিডি.কমকে জানান, তার ছেলে সাইদুরকে এখান থেকে নিতে এসেছেন। সাইদুর তাকে বলেছে, ‘আবিদুর নামে এক শিক্ষক রাতের বেলা রায়হানকে মেরে ফেলেছে। ছেলেটার চেহারা ভালো ছিলতো।’

আব্দুর রাজ্জাক নামে হাফেজী বিভাগের এক ছাত্র জানায়, এই মাদ্রাসায় ১৫০ জনের মতো ছাত্র পড়াশুনা করে। এদের দেখাশোনা করেন মাত্র ছয়জন শিক্ষক। আর ছয় শিক্ষককে দেখভাল করেন একজন প্রিন্সিপাল। প্রিন্সিপাল আবুবকর সিদ্দিক গতকালই হজ করে দেশে ফিরেছেন।

রাজ্জাক আরো জানায়, ‘আবিদুর হুজুর ছয় মাস আগে সাদ নামে এক ছাত্রের সঙ্গে রাতের বেলায় খারাপ কাজ করেছিলো। তা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়। তবে সে যাত্রায় আবিদুর হুজুর বেঁচে যায়।’

এ কারণে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ ওই মাদ্রাসার ছয় শিক্ষক, চার খাদেম ও এক বাবুর্চীকে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রিন্সিপাল আবু বকর সিদ্দিক, শিক্ষক শেফায়েত, মাসুদুর রহমান, মোহাম্মদ আমির, আবিদুর রহমান ও মাহফুজুর রহমান রয়েছে। খাদেমরা হলেন, কাওসার, আবু বকর, দেলোয়ার ও আব্দুল মজিদ এবং বাবুর্চী শাহ আলম।

জেলা পরিষদ মার্কেট মসজিদ কমিটির সভাপতি আজিজ মিয়া হটনিউজ২৪বিডি.কমকে জানান, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মাদ্রাসাটি আর চালাবেন না। কারণ, এই মাদ্রাসা ঘিরে অনেক অনৈতিক কাজ চলত বলে অভিযোগ ছিল। রায়হানকে যৌন নির্যাতন চালিয়ে এবং গলা কেটে হত্যার পর সেই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ জন্য এই ধরনের মাদ্রাসা চালু রাখা হবে না বলে মসজিদ কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top