সকল মেনু

কামারুজ্জামানের পালা এবার

 মেহেদি হাসান : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো. কামারুজ্জামানের চূড়ান্ত রায় যেকোনো দিন ঘোষণা করবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে অবকাশকালীন ছুটি চলছে। অবকাশ শেষ হওয়ার পর আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ যেকোনো দিন ঘোষণা করতে পারেন কামারুজ্জামানের চূড়ান্ত রায়। কী আছে কামারুজ্জামানের ভাগ্যে? মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আমৃত্য কারাদণ্ড, মেয়াদভিত্তিক সাজা- নাকি খালাস? আপিলের চূড়ান্ত রায়েই তা নির্ধারিত হবে। এটি হবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তৃতীয় কোনো চূড়ান্ত রায়। চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষে  মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন আদালত। ওই একই দিনে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে  ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।  এর আগে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। গত বছরের ৯ মে  কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডের রায়  ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গত বছরের ৬ জুন  ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন কামারুজ্জামান। আপিলে ২ হাজার ৫৬৪টি মূল ডকুমেন্ট, ১২৪টি গ্রাউন্ডসহ সর্বমোট ১০৫ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট জমা দেওয়া হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন কামারুজ্জামানের মামলার আপিল শুনানির জন্য জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। বেঞ্চের অপর তিন বিচারপতি হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এ বছরের ১৮ মে থেকে কামারুজ্জামানের মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়। আপিলে উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থান শেষে  গত ১৭ সেপ্টেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষামাণ রাখেন আদালত।

আপিল শুনানির শেষ দিনে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দাবি করেন, বিচারিক আদালতে যে পাঁচটি অভিযোগে কামারুজ্জামান দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, এর প্রতিটি অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। এজন্য আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য।

অপরদিকে কামারুজ্জামানের আইনজীবী এস এম শাহজাহান দাবি করেন, প্রতিটি অভিযোগের সঙ্গেই রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী ও দালিলিক নথি উপস্থাপন করেছে। কিন্তু সাক্ষীদের জবানবন্দিতে দেওয়া ঘটনার বর্ণনায় যেমন অসংগতি রয়েছে, তেমনি অভিযোগের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্যও রয়েছে। নিজেদের আনা অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাই আসামিকে অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়ার আবেদন জানান তিনি।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

১. বদিউজ্জামানকে হত্যা : এ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে সারা রাত নির্যাতন করে পরদিন হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।

২. অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতন : দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন।

৩. সোহাগপুর গণহত্যা : তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৫ জুলাই আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং নারীদের ধর্ষণ করে। এটি কামারুজ্জামানের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে করা হয়। সেদিন ওই গ্রামে নাম জানা ৪৪ জনসহ ১৬৪ জন পুরুষকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার দিন থেকে সোহাগপুর গ্রাম ‘বিধবাপল্লি’ নামে পরিচিত।

৪. গোলাম মোস্তফাকে হত্যা : চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৩ আগস্ট কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা গোলাম মোস্তফাকে ধরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে কামারুজ্জামান ও আলবদররা তাকে গুলি করে হত্যা করে।

৫. লিয়াকত-মুজিবুরকে নির্যাতন ও ১০ জনকে হত্যা : পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে রমজান মাসের মাঝামাঝি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুরের চকবাজার থেকে লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমানকে অপহরণ করে বাঁথিয়া ভবনের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাদের নির্যাতনের পর থানায় চার দিন আটকে রাখা হয়। পরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে ওই দুজনসহ ১৩ জনকে ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরে লিয়াকত, মুজিবুরসহ তিনজনকে সরিয়ে নিয়ে ১০ জনকে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের কাছে সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

৬. টুনু হত্যা : ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে ময়মনসিংহের জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। টুনুকে সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

৭. দারাসহ ছয় হত্যা : সপ্তম ও শেষ অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ রমজান কামারুজ্জামান আলবদর সদস্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের গোলাপজান রোডের টেপা মিয়া ও তার বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরদিন সকালে আলবদররা ওই দুজনসহ সাতজনকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে হাত বেঁধে সারিতে দাঁড় করায়। প্রথমে টেপা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে গেলে তিনি নদীতে লাফ দেন। আলবদররা গুলি করলে তার পায়ে লাগে। তবে তিনি পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু অন্য ছয়জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।

কামারুজ্জামানের আপিলের রায় প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমরা আশা করছি, একাত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট পরিচালনাকারী পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর আলবদর বাহিনীর নেতা কামারুজ্জামানের আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে।’

কামারুজ্জামানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ তাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে কোনো অভিযোগ নির্ভরযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। আমরা উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি। আমরা আশা করি, এর মাধ্যমে তিনি খালাস পাবেন।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top