সকল মেনু

এবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ-এম এ হান্নান

 আছাদুজ্জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম, ঢাকা: এবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হবে। আর তাতে থাকবে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর। অনিয়ম-দুর্নীতি, জালিয়াতি রোধ এবং একাত্তরের বীর সেনানীদের মর্যাদা ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতেই এ ব্যবস্থা নিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে নানা বিতর্কের পর এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা জানালেন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা নতুন সচিব এম এ হান্নান।

হটনিউজ২৪বিডি.কমকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে এ উদ্যোগ ছাড়াও বিগত সময়ের নানা আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন তিনি।

তার কথায় আগের আরও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্রও উঠে এসেছে। পাঠকের কাছে পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: মুক্তিযোদ্ধা সনদ এবং বিদেশি অতিথিদের ক্রেস্ট দেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?

এম এ হান্নান: শুধু মন্ত্রণালয় নয়, দেশের ভাবমুর্তিও ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। চরম ইমেজ সংকটে ভুগছিল এই মন্ত্রণালয়। বাইরে মন্ত্রণালয় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। এরমধ্যে প্রথমত- ভুয়া সনদপত্র বা অমুক্তিযোদ্ধাদের সনদপত্র ইস্যু করা। দ্বিতীয় হল- বিদেশি অতিথিদের সম্মানিত করতে ক্রেস্ট দেওয়ায় অনিয়ম বা দুর্নীতি করা। সে কারণে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ভুলুণ্ঠিত হয়েছে।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: নতুন সচিব হিসেবে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর আপনার প্রথম পদক্ষেপ কী ছিল?

এম এ হান্নান- আমি প্রথমে চেষ্টা করেছি একটা সিস্টেমে আনার জন্য। এখানে আগে ফাইলের স্তুপ পড়ে থাকতো। দুই থেকে তিনশ ফাইল পড়ে থাকতো সচিবের কক্ষে। এখন দেখেন আমার এখানে একটি ফাইলও নেই।

আমি দিনের কাজ দিনে শেষ করি। আমি অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছি প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন শেষ করতে হবে।

আগে দেখেছেন প্রচুর ভিড় থাকতো এই মন্ত্রণালয়ে। দুইজন লোকের মাথার উপর ৪০জন থাকতো। এখন ভিড় কমেছে। পরিবেশও পরিচ্ছন্ন হয়েছে।

একটা ফাইলে ২৫টি সনদপত্র থাকতো। তাতে দেখা যেতো দুইটাতে অনুসন্ধান করলাম, আর বাকি ২৩জন লোক ভোগান্তিতে পড়তেন। সেটাকে আমরা প্রথমে পাঁচটায় নামিয়ে আনি। তাতেও দেখা যায় একটি অনুসন্ধান (কোয়েরি) করলে বাকি ৪জন লোক সাফার করে। তাই এখন প্রতিটি সনদের জন্য আলাদা ফাইল করেছি। এইটা এখন একটা সিস্টেমে চলে এসেছে।

মাত্র এক মাসের মতো হলো আমি এই মন্ত্রণালয়ে এসেছি। আমার তো ঠিক করতে সময় লাগবে না। আমি এসেই প্রত্যেক অফিস ভিজিট করেছি। প্রতিটি রুমে গিয়েছি, কে কোথায় কী করে। যার কারণে সবাই তটস্থ আছে। কোনো সময় না সচিব আসে! মন্ত্রীও তাই করেন। ফাইল পেন্ডিং আছে কিনা দেখার জন্য।
হটনিউজ২৪বিডি.কম: আর কী কোনোভাবেই অনিয়ম-দুর্নীতি হবে না?

এম এ হান্নান- আমার হাতে যেনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ স্বাক্ষরিত না হয় তার চেষ্টা করছি। অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ রাখা হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধা সনদের ক্ষেত্রে প্রত্যায়নের বিষয়টিও কমিটি করে দেখা হচ্ছে। তিনজন উপসচিব যাচাই-বাছাই করার পর সনদ দেওয়া হবে। এরমধ্যে যা সঠিক তো দেওয়া হবে, আর যেটা ত্রুটিপূর্ণ সেটায় কী ত্রুটি আছে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে।

আগে বলে দেওয়া হতো যে তার বয়সের সার্টিফিকেট নেই সে কারণে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না।

আমি বললাম না। এটা হবে না। কার ঠিক নেই বা বাবার নাম ঠিকমতো নেই তাই দেওয়া যাবে না, সেইটা বলতে পারবে না। বলতে হবে-এতো জনেরটা ঠিক আছে দেওয়া হলো। আর অন্যদের কী কারণে দেওয়া গেল না এবং তা পূরণ হলে পরে দেওয়া হবে, তা বলতে হবে। তাতে মানুষের মধ্যে যে না পাওয়ার অনিশ্চয়তা, তা থাকবে না। তারা নিশ্চিত হবে যে, যা প্রয়োজন তা দিলেই সনদ পাওয়া যাবে।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিতে আর কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?

এম এ হান্নান: প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ নির্দেশনা আছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে লাল মুক্তিবার্তায় নাম থাকতে হবে। আগে বা পরে যেগুলো গেজেট হয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সনদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করছি। এর বাইরে কেউ সনদ পাবে না। যে কারণে পুরো ব্যবস্থাটা একটা সিস্টেমে এসেছে।
সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষেত্রে যে টাইম ফ্রেম ছিল, তা থেকে আমরা সময় কমিয়ে এনেছি। আবেদন ফরমে সনদপত্রে ইস্যুর তারিখ থাকে। সেই তারিখেই দেওয়া হবে। তবে যাচাই না করে দেওয়া হবে না।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: আগের কোনো অনিয়মের চিত্র আপনার চোখে পড়ছে কী?

এম এ হান্নান: বিগত ২০০৯-২০১০ থেকে ২০১২-২০১৩ এই চার বছরে যেসব সনদ স্বাক্ষর হয়েছে এরমধ্যে অবিলিকৃত রয়েছে প্রায় ৩ হাজার  ২শ’ বা তারও বেশি। এটি আমাদের জন্য সুখকর সংবাদ নয়।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: সনদ ডেলিভারির ক্ষেত্রে ভোগান্তি দূর করতে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কী?

এম এ হান্নান: আমি এখন থেকে পাসপোর্ট ডেলিভারিরর মতো মুক্তিযোদ্ধা সনদ বিতরণ করতে চাই। ডেলিভারির জন্য যে দিন নির্ধারিত থাকে সে দিনই সনদ দিতে চাই। নির্দিষ্ট দিনের আগে সনদ প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। আপনার সনদ প্রস্তুত। এই মেজেসে দেওয়ার পর নির্ধারিত দিনেই পেয়ে যাবেন সনদপত্র।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: জমা থাকা সনদগুলোর ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?

এম এ হান্নান: এখন যাদের সনদ জমা আছে, তাদের মোবাইল নম্বর যদি থাকে তাহলে, এখন থেকে সে ব্যবস্থা নেবো। সবার যদি মোইল নম্বর না দেওয়া না থাকে, সে ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবহিত করা হবে। তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: এ ব্যবস্থায় জেলা প্রশাসক অফিসে আবেদনকারীরা হয়রানির শিকার হবে কিনা?

এম এ হান্নান: সেখানেও হয়রানির শিকার হতে পারে। ডিসি অফিসের কেউ বলতে পারে এতো টাকা দাও, তাহলে তোমার সনদ দেওয়া হবে। সে কারণে আমরা জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে আবেদনকারীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করার চিন্তা করছি।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনোভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মোবাইল নম্বর চাওয়া হবে কিনা?

এম এ হান্নান: বিজ্ঞপ্তি বা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নম্বর চাওয়া হবে কিনা তাও চিন্তাভাবনা করে দেখা হচ্ছে। আগে পরিকল্পনা করে কী পদ্ধতিতে করা যাবে, তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এবার আর কোনো ভুল নয়। আগে একটি পরিপত্র তাড়াহুড়ো করে জারি করা হয়েছিল। তাতে কিছু ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে। সনদধারী গণ কর্মচারীরা দুই বছর বা এক বছর চাকরি করতে পারবেন কিনা, তা অস্পষ্ট। এটা করার আগে ভাবা দরকার ছিল। এইটা করা হয়েছে বলেই সমস্যা হয়েছে। এটা সংশোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি সার সংক্ষেপ পাঠিয়েছি। তা অনুমোদনও হয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা, তারা এই সুবিধাটা পাবেন।

আমি এখন একটি সংশোধনী দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো লোক যেনো সনদ না পায়। আমি জনগণের টাকায়, গরীব মানুষের পয়সায় চলি এইটা আমাকে মনে রাখতে হবে।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: মুক্তিযোদ্ধা ভাতার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা?

এম এ হান্নান: আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত প্রতিমাসের ভাতা দিতে চাই। বর্তমানে তিনমাসের একসঙ্গে দেই। আমি রিপোর্ট পেলাম কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ছয় মাসের ভাতা একসঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আমরা দিলাম তিন মাসের তাহলে ছয় মাসের কোথেকে দেওয়া হলো?

আমি শোনার সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসককে ফোন করলাম। আমাকে বলা হয়েছে ব্যাংক ম্যানেজার ভুল করেছে। ব্যাংক ম্যানেজার আমার ছাড়পত্র ছাড়া দিল কীভাবে। আমি শো-কজ করেছি। ব্যাখ্যা চেয়েছি। ব্যাখ্যা যদি না দিতে পারে, তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সনদ এখন থেকে কোন  প্রক্রিয়ায় দেওয়া হবে?

এম এ হান্নান: জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মাধ্যমে গণশুনানির জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় এ কমিটি থাকবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য যদি মুক্তিযোদ্ধা হন তাহল তিনি ওই কমিটির প্রধান হবেন। যদি সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা না হন, সেক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হবেন এ কমিটির প্রধান। একাধিক কমান্ডার থাকলে যুদ্ধকালীন কমান্ডার প্রধান হবেন।

যুদ্ধাকালীন একাধিক কমান্ডারের মধ্যে কে প্রধান হবেন তা ঠিক করবে মন্ত্রণালয়। জেলা উপজেলা কমান্ডার, সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছাড়াও ইউএনও ওই কমিটির সদস্য থাকবেন।

যেদিন গণশুনানি হবে তার আগেই তা মিডিয়ায় প্রচার করা হবে। এভাবে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা হচ্ছে। যাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া কেউ সনদ না পান।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: জাল সনদ তৈরি ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?

এম এ হান্নান: টাকার চেয়েও সনদ তৈরির ব্যবস্থা নিরাপদ করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। টাকা তৈরির ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা করা হবে। ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করা হবে সনদ তৈরিতে।

হটনিউজ২৪বিডি.কম: এই মন্ত্রণালয় নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?

এম এ হান্নান:  আমি যদি জীবিত থাকি আর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে থাকি তাহলে একটি আদর্শ মন্ত্রণালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবো। দেশের এ ক্যাটাগরির মন্ত্রণালয় হিসেবে গড়ে তুলতে পারি সে প্রচেষ্টা আমার থাকবে।

আমি গত সপ্তাহে বিদেশ গিয়েছিলাম। সেখানে আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়েছি। সবাই আমাকে প্রশ্ন করেছে। এটা কী মন্ত্রণালয়? বিশ্বে এ রকম কোনো মন্ত্রণালয় তো নেই। আমি বললাম আমাদের দেশটা স্বাধীন হয়েছে সাড়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। এই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন।

যারা বেঁচে আছেন, যুদ্ধাহত আছেন এবং যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারের কল্যাণার্থে এই মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে।
এটা শোনার পর তারা আমাকে বললো তুমি এমন একটা মহান দেশের মানুষ। এত মহৎ তোমরা। আর এমন একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব তুমি, ‘আই স্যালুট ইউ। স্যালুট ইউর কান্ট্রি।’

এইটাতো আমার জন্য বিরাট পাওয়া। আমি এটাকে বুকে ধারণ করতে চাই। এক নম্বর করতে চাই এই মন্ত্রণালয়কে, যদি আল্লাহ আমাকে তৌফিক দেন। আপনারাও আমাকে দোয়া করেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top