সকল মেনু

হরতাল নির্বাসিত হচ্ছে !

আছাদুজ্জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম : দেশের সাধারণ মানুষের মন থেকে ক্রমশ নির্বাসিত হচ্ছে হরতাল। রাজনৈতিক কোনো দাবি আদায়ে এই কর্মসূচি আর চালিকা শক্তি হিসেবে কাজে আসছে না। মানুষের জীবিকার ওপর সরাসরি আঘাত হানায় প্রায় তিন দশক পর পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়েছে রাজনীতির সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক অস্ত্রটি।  রাজনৈতিক বিশ্লেষক, রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেছেন, আশির দশকের শেষ দিকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ে হরতাল খুবই জনপ্রিয়তা পায়। স্বৈরশাসকের পদত্যাগে এই হরতালই ছিল মোক্ষম অস্ত্র। রাজনৈতিক দাবি আদায়ে হরতালই হয়ে ওঠে চূড়ান্ত কর্মসূচি। তবে অপব্যবহার আর গুরুত্বহীন ইস্যুগুলোতে হরতাল দিয়ে এর মেরিট নষ্ট করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব ফায়দা ছাড়া একদমই জনগণের সম্পৃক্ততা থাকে না হরতালে। যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল ডাকলেও প্রায় সব অফিস-আদালত, দোকানপাট খোলা থাকে; রাস্তায় যানবাহন চলে। স্বাভাবিক কাজকর্মেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না হরতাল। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হরতাল প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। গাড়িতে পেট্রোল বোমা মেরে জ্বালিয়ে দেওয়া, মানুষ পুড়িয়ে মারা, রিকশা ভাঙচুর করা, ককটেল বিস্ফোরণে জনমনে ভীতি ছড়ানোই হরতালের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুলি-বোমায় মানুষ মারা যাচ্ছে, তার পরও হরতাল মানছে না কেন সাধারণ মানুষ- এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল রিকশাচালক আবদুুর রহিমকে। রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে কাজের সন্ধানে এই রাজধানীতে এসে রিকশাচালক হয়েছেন আবদুুর রহিম। প্রতিদিন রিকশা চালানোর রোজগারের টাকায় চলে মিঠাপুকুরের ছয় সদস্যের সংসার। রাজনীতির এই হরতাল রহিমের মতো শ্রমজীবীদের ভাগ্য বদল করে না বলেই হরতালের দিনেও রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছেন তিনি।

রহিম হটনিউজ২৪বিডি.কমকে অনেকটা ক্ষোভ নিয়েই বললেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাকে খেতে দেয় না। এক দিন রিকশা না চালালে উপোস করবে তার বউ-ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ বাবা-মা। এজন্যই ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় বেরিয়েছেন তিনি। তার মতো জামাল, আরিফরাও সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়েছেন রাস্তায়। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদেই তারা হরতালকে নির্বাসন দিয়েছেন।

হরতাল দাবি আদায়ের একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। সরকার কেন সেই অধিকারে গুরুত্ব দেয় না। এর উত্তর দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশনেই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নিজেদের স্বার্থে হরতাল দিচ্ছে অনেক রাজনৈতিক দল। সেই হরতালে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাস-ট্রাক-সিএনজির অটোরিকশা। মানুষের কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। মন্দির-মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কোরআন শরিফ পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ককটেল-বোমায় ভীতি ছড়ানো হচ্ছে। সেই হরতাল মেনে নেওয়া যায় না। এতে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা নেই।

তিনি আরো বলেন, হরতাল ডেকে রাজপথে থাকেন না হরতাল ডাকা রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা। টোকাই, সন্ত্রাসী, জঙ্গিদের দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ করান তারা।

প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, দেশের সাধারণ মানুষ চাইলে আইন করেই হরতাল বন্ধ করা হবে।

আইন বিশ্লেষক সৈয়দ মাহবুবুল আলমও বলেছেন, ফৌজদারি অপরাধ সৃষ্টি করতে পারে, এমন জনস্বার্থবিরোধী যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকা- আইন করে বন্ধ করা যেতে পারে। হরতাল যদি সেই অবস্থায় যায়, তাহলে হরতালও বন্ধ করা যাবে।

আজ সকালে অভিশংসন আইন বাতিলের জন্য বিএনপির ডাকা হরতালে বন্ধ দোকানের ঝাঁপি খুলতে খুলতে খিলগাঁওয়ের জননী স্টোরের মালিক মামুন হোসেন বললেন, দোকান বন্ধ রাখলে যে লোকসান হবে তা পোষানো যাবে না। প্রতিদিনই খরচ বাড়ছে, কিন্তু আয় বাড়ছে না। দোকান ভাড়া, সংসার- সব সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে টোকাই পিকেটাররা তার দোকানের ক্ষতি করতে পারে জেনেও তিনি দোকান খুলেছেন। অর্থনৈতিক চাহিদার কাছে হেরে যাচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচি।

বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে হরতাল শব্দটির যে অর্থ দেওয়া আছে তাতে বলা হয়েছে, ‘বিক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য যানবাহন, হাটবাজার, দোকানপাট, অফিস-আদালত ইত্যাদি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করা’। তবে এই আভিধানিক অর্থ আর বাস্তবে পাচ্ছে না হরতাল।

কালের কণ্ঠর এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে যতগুলো হরতাল হয়েছে, তার প্রায় ৯৫ শতাংশ ডাকা হয়েছে স্রেফ রাজনৈতিক কারণে বা রাজনৈতিক স্বার্থে। বাকি মাত্র প্রায় ৫ শতাংশ হরতালের পেছনে পাওয়া গেছে অর্থনৈতিক কারণ।

শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ফেডারেশন এফবিসিসিআইয়ের হিসাব অনুযায়ী প্রতিটি ২৪ ঘণ্টার হরতালে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ওই ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত হয়েছে।

২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থেকে যখন হরতাল দিয়েছিল, তখনই হরতাল সম্পর্কে জনসাধারণের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট হরতালের বিকল্প মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় এই কর্মসূচিতে। অহিংস মানববন্ধন কর্মসূচির কারণে ইমেজ ফিরে পায় আওয়ামী লীগ।

ওই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। তবে এই জোট ২০০৮ সালে বিরোধী দলে এসে এই বিকল্প কর্মসূচি গ্রহণ না করে ফের হরতালে ফিরে যায়। চরম ধ্বংসাত্মক হরতালে বিপর্যস্ত করে তোলে সারা দেশ।

৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের আগে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। একের পর এক হরতালে মানুষ মারায় মেতে ওঠে তারা। তবে ওই সব হিংসাত্মক হরতালেও রাজপথে রিকশা-বাস-ট্রাক-অটোরিকশা চলছে। শুধু আধুনিক ও কোটি কোটি টাকা মূল্যের বাস ও প্রাইভেট কারগুলো চলাচল করেনি।

৫ জানুয়ারির পর আজকের হরতাল পর্যন্ত যেসব হরতাল হয়েছে, তাতে জনসম্পৃক্ততা ছিল না মোটেও। এমনকি জামায়াতের মতো কট্টর মৌলবাদীদের গত দুটি হরতালও ছিল একদম ঢিলেঢালা। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টার হরতালেও বিএনপির পক্ষে সাধারণ জনগণ মাঠে নামেনি। মাঠে ছিল না বিএনপির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা-কর্মী।

বাসদ, ইসলামী ছাত্রসেনা, জামায়াত এবং বিএনপির হরতালের করুণ পরিণতিই বলে দিচ্ছে এই হরতাল দিয়ে আর কোনো দাবি আদায় সম্ভব নয়। জনগণ হরতালের মতো অর্থনীতি, জীবিকা ধ্বংসকারী কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করেই চলেছে।

বিএনপি-জামায়াত ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের ১২ জুন পর্যন্ত বিরোধীদলীয় জোটে থাকার সময় হরতাল দিয়েছিল ২৮৩ দিন। এর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে ৪৫ দিন, রাজধানী ঢাকা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ৪৭ দিন এবং স্থানীয় পর্যায়ে ১৯১ দিন।

অন্যদিকে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় হরতাল দিয়েছিল ১৭৩ দিন।

ক্ষমতায় থাকার সময় ১৯৯৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এবং ২০০৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, হরতাল জনগণ চায় না। এজন্য হরতাল পরিহার করা উচিত। একইভাবে ১৯৯৯ সালে ২ মার্চ কক্সবাজারের বিশাল জনসভায় হরতাল বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু কেউই কথা রাখেননি, কথা শোনেননি।

সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্তর গবেষণাগ্রন্থ `সংবাদপত্রে হরতালচিত্র ১৯৪৭-২০০০` থেকে জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত পূর্ণদিবস হরতাল ছিল পাঁচ দিন আর অর্ধদিবস হরতাল ছিল ১২ দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত পূর্ণদিবস ১০ দিন এবং অর্ধদিবস হরতাল ছিল ৪৩ দিন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ণদিবস ১০৪ দিন, অর্ধদিবস ১৯৪ দিন। ১৯৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত পূর্ণদিবস ১৫৫ দিন, অর্ধদিবস ২২৩ দিন এবং ১৯৯৬ সালের ৩১ মার্চ থেকে ২০০০ সালের ১২ জুন পর্যন্ত পূর্ণদিবস ১৫৯ দিন, অর্ধদিবস হরতাল ছিল ১০৭ দিন।

হরতালের দিন এখন ফুরিয়ে এসেছে। মানুষের জীবিকার ওপর সরাসরি আঘাত হানায় সাধারণ মানুষ আর হরতাল চায় না। সময়ের প্রয়োজনে বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ভাবতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top