সকল মেনু

চাঁদপুর-শরীয়তপুর পরিনত হবে শিল্প জোনে

 শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর: নদী শাসন করা গেলে নদীবন্দর চাঁদপুর হয়ে উঠতে পারে শিল্প ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। সড়ক, রেল, নৌ-যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় মাঝারি শিল্প স্থাপনের জন্য এই এলাকাটি অত্যন্ত উপযোগি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এখানে রয়েছে বিপুল শ্রম শক্তিও।  চাঁদপুরকে এক সময় বরা হত ভারতের প্রবেশ দ্বার। নদী পথে চাঁদপুর হয়ে কলকাতা ও বার্মা যেতে হত। যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার কারণে ব্রিটিশ শাসনামলেই চাঁদপুরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। শহরের পুরানবাজার এলাকায় মারোয়াড়ি, নাখোদারা গড়ে তোলে একের পর এক পাট কল, চাল কল, লবণ ফ্যাক্টরি, ভূষা মালের আড়ত। কিন্তু দেশ ভাগের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক বিবাদ এবং সর্বোপরি নদী ভাঙ্গনের কারণে ব্যবসায় ছেদ পড়তে শুরু করে। ৮০’র দশকের শেষ দিকে নদী ভাঙ্গন এতটাই মারাত্নক আকার ধারন করে যে, ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হতে হতে একেবারে ছোট পরিসরে চলে আসে। এখন শুধু নামেই চাঁদপুর বাণিজ্য কেন্দ্র। বড় দু’টি পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে বহু আগে। লবণ মিলগুলোর প্রায় সবই বন্ধ। শুধু ভ’ষা মালের ব্যবসাটা টিকে আছে কোন রকমে। নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও ভোলার কিছু কিছু ব্যবসায়ী  এখানে আসেন এখনো মোকাম করতে। কিন্তু নদী শাসন করা গেলে এখানে আবারো ব্যবসা-বাণিজ্যের পুরোনো জৌলুস ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আলহাজ জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিমের মতে, গত চার দশকে চাঁদপুরের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদই নদীতেই চলে গেছে। আর এখন হুমকির মুখে ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তিনি জানান, চাঁদপুরকে রক্ষা করতে হলে নদী খনন এবং তীর সংরক্ষণ কাজ সমানভাবে চালিয়ে যেতে হবে। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ ইসমাইল হোসেন জানান, চাঁদপুর অপার সম্ভাবনাময় একটি জেলা। নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে চাঁদপুরকে রক্ষা করে  চাঁদপুর – শরীয়তপুর নৌ-রূটে একটি সেতু নির্মাণ করা গেলে চাঁদপুরে গড়ে তোলা যাবে শিল্প জোন। এখানে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট রয়েছে, সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। পর্যাপ্ত পানি রয়েছে। রয়েছে ১৫ হাজার একরের মত খাস জমি। শ্রমিক রয়েছে প্রচুর। শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সব সুবিধাই এখানে রয়েছে। এখানে শিল্প স্থাপন করা হলে ব্যবসায়ীরা বর্তমান খরচের চেয়ে ৩০ ভাগ কম খরচে উৎপাদন করতে পরবেন। এই এলাকায় বিদেশী বিনিয়োগেরও অপার সম্ভাবনা রয়েছে। চাঁদপুরের নদী ভাঙ্গনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ সার্ভেয়ার  কোলম্যান জে এম এর লেখা ‘ব্রক্ষপুত্র নদীর গতিপথ’ বই থেকে জানা যায়, আগে পদ্মা নদী মেঘনার সাথে সংযুক্ত ছিল না। তখন তা ফরিদপুরের পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরের সাথে মিলিত হতো। কিন্তু ১৭১৭ খ্রিঃ ভয়াবহ এক ভ’মিকম্পের ফলে পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে যমুনার সাথে মিশে যমুনার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করে গোয়ালন্দের কাছে গঙ্গার সাথে পুনরায় মিশে পদ্মা নদী নাম ধারন করে ভয়ংকর হয়ে আগের গতিপথ পরিবর্তন করে চাঁদপুরের উজানে এসে চাঁদপুর শহর থেকে ১৮ কিলোসিটার উত্তরে মোহনপুর এলাকা দিয়ে মেঘনার সাথে মিশে যায়। ফলে মেঘনার পানি প্রবাহ বহু গুণে বেড়ে যায় এবং শুরু হয় চাঁদপুরে নদী ভাঙ্গন। আজ থেকে ৮১ বছর আগে চাঁদপুরের অবস্থান ছিল প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তরে এবং ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে চাঁদপুর শহর এখন অনেক ভেতরে চলে এসেছে। ২০০০ সালে মাত্র কয়েক মিনিটের ভাঙ্গনে চাঁদপুর শহরের পুরোনো লঞ্চ ঘাট ও রেল ষ্টেশন নদীতে তলিয়ে যায়। চাঁদপুরের উপর থেকে পদ্মা ও মেঘনার পানির চাপ কমানোর জন্য ১৮৭১ সালে শহর থেকে চরবাগাদি পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল খনন করা হয়েছিল। এই খালটির সংযোগ দিয়ে দেয়া হয় মেঘনা নদীর সাথে। পরবর্তীতে এটিই ডাকাতিয়া নদীতে পরিনত হলেও শহর এলাকায় ভাঙ্গন ঠেকানো সম্ভব হয় নি। এই খালের উত্তর অংশই হচ্ছে চাঁদপুর শহরের নতুনবাজার এলাকা এবং দক্ষিণাংশ হচ্ছে পুরানবাজার এলাকা। চাঁদপুরের ভাটিতে বন্যার কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় তার হালনাগাদ কোন হিসেব পানি উন্নযন বোর্ডের কাছে নেই। প্রাপ্ত এক তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৬২  সালে চাঁদপুরের ভাটিতে পানি ধারণ ক্ষমতা ছিল প্রতি সেকেন্ডে ৩০ লাখ ঘনফুট। কিন্তু ওই বছরই বন্যায় পানি প্রবাহিত হয় ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ঘনফুট। গত ৫০ বছরে নদীতে পলি জমে, ডুবো চর এবং চর জেগে পানি ধারণ ক্ষমতা কমে অর্ধেকে নেমে এলেও পানি প্রবাহ কিন্তু কমেনি। বরং দিন দিনই তা বাড়ছে। ফলে এখানে নদী ভাঙ্গন অবধারিত একটি বিষয়ে পরিনত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক (বর্তমানে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান) ড. হুমায়ুন কবির ২০১৩ সালের ৩১ মে সন্ধ্যায় চাঁদপুর সার্কিট হাউজে এক কর্মশালায় বলেছিলেন, চাঁদপুরকে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে নদী শাসন অত্যন্ত জরুরি এবং অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্লাইট শো’র মাধ্যমে দেখিয়ে দেন চাঁদপুর শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে রাজরাজেশ্বর এলাকা দিয়ে পদ্মা নদীর একটি অংশ এসে মেঘনার মাথে মিশেছে। সেখানে একটি একটি ছোট চর রয়েছে। এই চরটির কারণে নদী বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। আনুমানিক ৩ থেকে ৫ বর্গ কিলোমিটারের এই চরটি কেটে দিলে মতলব বাজার, আমানুল্লাপুর, বিষ্ণুপুর, আশিকাঠি, তরপুরচন্ডি দিয়ে মেঘনা নদী ভেতরে ঢুকে পড়বে। পাশাপাশি কাটা চরের মাটি দিয়ে ওইসব এলাকার ২০ কিলোমিটার স্থান ভরাট করে দিতে হবে। তাহলেই  নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরে পাবে এবং চাঁদপুর শহরে ভাঙ্গন প্রবনতা কমবে।  অন্যদিকে ভরাটকৃতস্থানে নদীসিকস্তি লোকজনদের পুনর্বাসন এবং শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব হবে। কিন্তু চাঁদপুরে নদী শাসনের কোন উদ্যোগ  কখনোই নেযা হযনি। পাথর, জিইও ব্যাগ ও ব্লক ফেলে  নদীর স্রোতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অপপ্রয়াস চালানো হয়। আর এর মাধ্যমে কিছু লোকের ভাগ্য বদলে যায়। অথচ ১৯৭৪ সালে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা  যাচাই করতে আসা যুক্তরাষ্ট্রের ‘লিডশিল ডি লিউ ইঞ্জিনিয়ার্স’ এর দুইজন বিশেষজ্ঞ জন টি পেক ও ড. ভিক্টর জে গেলি চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ দেখে মন্তব্য করে গেছেন,‘ ছোট ছোট পাথর দিয়ে মেঘনাকে ঠেকানো যাবে না, চাঁদপুরও রক্ষা করা যাবে না’। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ৮০’র দশকে চাঁদপুরে আসা নেদারল্যান্ডের রয়েল হাসকানিং এর বিশেষজ্ঞরা মেঘনার মোহনা পরীক্ষা করে বলে গেছেন, চাঁদপুরের মোহনাতেই নদীর গভীরতা ৭১ মিটার। যা বিশ্বের আর কোন নদীতে দেখা যায় নি। এমন কী কোন কোন ক্ষেত্রে সমুদ্রেও এত গভীরতা পাওয়া যায় না।
গত ২শ’ ৯৫ বছরে চাঁদপুরের কত জনপদ নদী গর্ভে হারিয়ে গেছে তার কোন হিসেব নেই কারো কাছেই। তবে এই জেলার প্রবীণ লোকজনদের সাথে আলাপ করে যা জানা গেছে তা হল, এক সময় চাঁদপুর শহর ছিল নরসিংহপুরে। যা এখন শরীয়তপুর জেলায় পড়েছে। ১৯৬৫ থেকে এ পর্যন্ত চাঁদপুরের পুরানবাজারের বিশাল এলাকা, হরিনা, বাখরপুর, চালিতাতলি, গোবিন্দিয়া, হানারচর, বহরিয়া, সাকুয়া, ইব্রাহিমপুর, পুরন্ডপুর, কানুদী, মিয়ারবাজার, বিষ্ণপুর, বিষ্ণুদি, সফরমালীসহ বহু জনপদ হারিয়ে গেছে। তেমনিভাবে মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ ও হাইমচর উপজেলার কয়েক শত গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।  হাইমচর উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪ টি পুরোপুরিই নদীতে তলিয়ে গেছে। বাকি দু’টি কিছু অংশ নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এভাবে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে চাঁদপুর নামের জনপদটি হযত একদিন হারিয়েই যাবে মানচিত্র থেকে। তাই চাঁদপুরকে রক্ষার জন্য চাই মাষ্টারপ্ল্যান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top