সকল মেনু

চাঁদপুরে শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাল সনদ ব্যবসার অভিযোগ

 নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, চাঁদপুর: একুশ বছর ধরে হাজীগঞ্জ উপজেলার বড়কুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী পদে চাকুরি করেছি। এরপর পারিবারিক স্বচ্ছলতা আনার জন্যে তাহের চৌধুরী নামের এক শিক্ষকের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিপিএড (শরীর চর্চা) নিবন্ধন সনদপত্র সংগ্রহ করেছি। এ সনদপত্র দিয়ে ২০১০ সালের ১ জুলাই শরীর চর্চা শিক্ষক পদে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার শাহপুর হাই স্কুলে যোগ দেই। এক বছর পর এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) হয়। যার কাছ থেকে সনদপত্র নিয়েছি, এমপিওভুক্ত হওয়ার পর তাকে এক লাখ টাকা না দেয়ায় তিনি শিক্ষা অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে আমাকে চাকুরিচ্যুত করেছেন’। এ বক্তব্য হতভাগ্য শিক্ষক ইব্রাহিমের। শুধু শিক্ষক ইব্রাহিমই নন, এই জাল সনদ ব্যবসার হোতা শিক্ষক তাহের চৌধুরীর খপ্পরে পড়ে আরো তিন জন শিক্ষক চাকুরি হারিয়েছেন। এমন চাঞ্চল্যকর সংবাদে শিক্ষক সমাজে তোলপাড় চলছে। তারা শিক্ষক সমাজের কলঙ্ক তাহের চৌধুরীকে শুধু চাকুরিচ্যুতিই নয়, শাস্তিও দাবি করেছেন।  হাজীগঞ্জে উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ইব্রাহিমের মতো জাল সনদপত্র দিয়ে চাকুরি নেয়া আরো ৩ জন শিক্ষক চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। এরা হলেন : হাজীগঞ্জ উপজেলার সপ্তগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিষয়ের শিক্ষক মোঃ নজরুল ইসলাম, পালিশারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা শিক্ষক আফরোজা আক্তার ও ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা হাই স্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক মোঃ সফিকুল ইসলাম। অবশ্য সফিকুল এখন নতুন ইনডেক্স নিয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলার দেশগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকুরি করছেন।  এসব জাল জালিয়াতের মূল হোতা আবু তাহের চৌধুরীও পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি হাজীগঞ্জ উপজেলার দেশগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত আছেন। চাকুরিচ্যুত শিক্ষকদের অভিযোগ-তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তাহের চৌধুরী দুজনকে বিপিএড জাল সনদ, একজনকে কম্পিউটার বিষয়ে জাল সনদ ও একজন শিক্ষকের এমপিও ফাইলে জেলা শিক্ষা অফিসারের স্বাক্ষর জাল করেছেন। তারা এমপিওভুক্ত হওয়ার পরে চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাহের চৌধুরীর মূল কাজ জাল সনদ বিক্রয় করা। আর এ সনদ দিয়ে চাকুরি হলে এমপিও হওয়ার পর তিনি পুনরায় টাকা দাবি করেন। এমনকি তাদের কাছ থেকে প্রতি মাসে টাকাও নিচ্ছেন তিনি। এলাকায় তিনি ‘জাল তাহের’ হিসেবে পরিচিত। দেশগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনির হোসেন এ বিষয়ে জানান, গত ১২ জুন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক গৌর মন্ডল স্বাক্ষরিত একটি চিঠির মাধ্যমে শিক্ষক তাহের চৌধুরীর নাম এমপিও থেকে কেনো কাটা হবে না মর্মে ৭ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস দেন। ওই চিঠির ভাষ্য হচ্ছে, ‘আপনি তাহের চৌধুরী পালিশারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা শিক্ষক আফরোজা আক্তারের নিয়োগ ফাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সফিউদ্দিনের স্বাক্ষর জাল করেছেন বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে’। প্রধান শিক্ষক মনির হোসেন বলেন, তাহের চৌধুরী ওই চিঠির জবাব দেয়ার জন্য কয়েকদিন ঢাকায় ডিজি কার্যালয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন।  এ বিষয়ে পালিশারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন জানান, ২০১২ সালে আফরোজা আক্তারকে শরীর চর্চা শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগের পর আফরোজা আক্তার তার এমপিওর ফাইলপত্র শিক্ষক তাহের চৌধুরীকে দিয়ে তৈরি করান। কিন্তু তাহের চৌধুরী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সফিউদ্দিনের স্বাক্ষর জাল করে এমপিও’র জন্য ডিজিতে ফাইল পাঠিয়ে দেন। তিনি আরো জানান, আফরোজার এমপিওভুক্তির খবর শুনে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সফিউদ্দিন আমাকে তার দপ্তরে তলব করে জানতে চান তার (আফরোজার) ফাইলে আমি স্বাক্ষর করি নাই, এমপিও আসলো কীভাবে? পরে আফরোজা তাহের চৌধুরীকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে তার ফাইলপত্র ঠিক করেছেন বলে শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে স্বীকার করেন। জাকির হোসেন আরো জানান, পরে মহাপরিচালকের কার্যালয় (ডিজি) থেকে আমাকে ও আফরোজাকে ডাকা হয়। সেখানেও আমি এবং আফরোজা তাহের চৌধুরী এ কাজ করেছে বলে লিখিত দিয়েছি। তাহের চৌধুরীর খপ্পরে পড়ে আফরোজা আক্তার চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। সপ্তগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফয়েজ আহম্মেদ জানান, নজরুল ইসলাম আমার এখানে যোগদানের পর কম্পিউটার নিবন্ধন সনদ জাল বলে জানতে পারি। পরে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে।  দেশগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা শিক্ষক সফিকুল ইসলাম তাহের চৌধুরীর কাছ থেকে জাল নিবন্ধন সনদের কারণে নতুন সনদপত্র নিয়ে নতুন ইনডেক্সে চাকুরি করছেন। এর আগে তিনি জাল নিবন্ধন সনদ দিয়ে পালিশারা উচ্চ বিদ্যালয়ে চার বছর এবং ফরিদগঞ্জের রূপসা হাই স্কুলে এক বছর চাকুরি করেছেন। এ প্রসঙ্গে সফিকুল ইসলাম বলেন, আমি এখন নতুন ইনডেক্সে চাকুরি করছি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে তাহের চৌধুরীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেসব বিষয়ে আপনি প্রশ্ন করছেন এসব বিষয়ে আমি অবগত নই। আপনাকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কারণ দর্শানো নোটিস দেয়া হয়েছে কেনো এ প্রশ্নের জবাবে তাহের চৌধুরী বলেন, সেখানে একটু সমস্যা হওয়ার কারণে এ নোটিস দেয়া হয়েছে।
হাজীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আলী রেজা আশরাফি বলেন, তাকে কারণ দর্শানো নোটিস দেয়া হয়েছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে আমার কাছে কোনো ফাইলপত্র আসেনি। তবে পালিশারা উচ্চ বিদ্যালয়ের ঘটনা তাহের চৌধুরীর সাথে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেনও জড়িত আছেন। আলী রেজা আশ্রাফী আক্ষেপ করে বলেন, সে পুরো হাজীগঞ্জ উপজেলার শিক্ষক সমাজকে কলঙ্কিত করেছে।  চাটখিল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, টাকার বিনিময়ে জাল সনদ দেয়ার একটি চক্র আছে। এ চক্রের মূল হোতা হিসেবে তাহের চৌধুরীর নামই বার বার আসছে। ইব্রাহিমের বেলায় এমপিওভুক্তি হওয়ার পর তাকে টাকা না দেয়ায় বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাহের চৌধুরীর বিরুদ্ধে এধরনের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top